সম্প্রতি রাজধানী ঢাকা কাঁপিয়ে দিলো অটোরিকশা চালকদের আন্দোলন। অটোরিকশা চালকদের আন্দোলন বা সমস্যা তিন মাসের নয়, বরং, আরো আগে থেকেই।
বিজ্ঞাপন
কখনো তলিয়ে দেখা হয়নি, কিন্তু এই ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা নিয়ে প্রশাসন আর চালকদের টানাহ্যাঁচড়া, লুকোচুরি চলছিল শুরু থেকেই। মোহম্মদপুর আল্লাহ করিম মসজিদ বাসস্ট্যান্ড থেকে নিত্য বাসযাত্রী আমি। চার রাস্তার মোড় একটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট।
ঢাকা শহরের মে-জুন মাসে ট্রাফিক পুলিশ প্রায় দিনই মাইকিং করতো,অটোরিকশা চালকরা কেউ যেন গলি ছেড়ে রাজপথে না আসে। মে-জুন মাসে একদিন শুনতে পেলাম, জনৈক ট্রাফিক পুলিশ মাইকে বলছে, ‘‘সব অটোরিকশা চালকরা জামাত- শিবির। এলাকায় মামলা খেয়ে ঢাকা শহরে অটোরিকশা চালাচ্ছে। একবার ধরলে ছেড়ে দেয়া হবে না।''
দৃশ্যপট পালটে গেল মাস দুয়েক পরেই। সেপ্টেম্বরের এক সকালে ট্রাফিক পুলিশের মাইকিং শুনলাম, ‘‘এই অটোরিকশা চালকদের সবাই ফ্যাসিস্টের দোসর। গা ঢাকা দেয়ার জন্য অটোরিকশা নিয়ে রাস্তায় নেমেছে।''
আমি বারকয়েক তাকিয়ে চেনার চেষ্টা করলাম পুলিশটি একই ব্যক্তি কিনা। ঠিক শনাক্ত করতে পারলাম না।
এটি গল্প নয়। আমার বাস্তব অভিজ্ঞতা।
বলছিলাম এই ট্যাগের বাস্তবতার কথা। এক রাতে যেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে হলে শ্লোগান উঠলো, তুমি কে আমি কে…রাজাকার, রাজাকার। জাতি স্পষ্টত কমে বেশিতে দুইভাগে বিভক্ত হয়ে গেল, তখন জামাত-শিবির ট্যাগিংয়ের দেড় দশক অতিক্রান্ত। ছাত্রদের স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এই ট্যাগিং গায়ে মেখে নেয়ার মাঝে তাৎক্ষণিক এক তীব্র ক্ষোভ আর প্রতিবাদ আবিষ্কার করা গিয়েছিল।
কিন্তু যে পরিচয় বাংলাদেশ নামের স্বাধীন সার্বভৌম একটি রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের চরম ও পরম গৌরবের বিরুদ্ধাচারণ করে সেই ট্যাগিং রাগে, ক্ষোভে,প্রতিবাদে ধারণ করাটা কতটা ঠিক বা বেঠিক সেই বিবেচনা ভবিষ্যতের ইতিহাসের বয়ানের জন্য তোলা থাক।
কিন্তু এই যে ট্যাগিংয়ের বাস্তবতা, রাজনৈতিক দমন-পীড়নে এ এক নির্মম ও প্রতারক অস্ত্র। আওয়ামী শাসনামলে ছিল বিএনপি-জামাত ট্যাগিং। কাদের ট্যাগিং দেয়া হতো? যাদের কর্মকাণ্ড শাসকদের পছন্দ হতো না,যাদের আবার আইনগতভাবে কোনো দোষেও দোষী সাব্যস্ত করা যেতো না তাদের জন্য সবচেয়ে সহজলভ্য ছিল এই ট্যাগিং।
বাংলাদেশে সরকার বদলালেও ঘৃণাত্মক, তুচ্ছার্থক ট্যাগ দিয়ে ভিন্নমতকে দমানোর রাজনৈতিক ধারায় গুণগত কোনো পরিবর্তন আসেনি৷ এই ‘ট্যাগের রাজনীতি’ নিয়ে সমাজের বিশিষ্টজনরা জানিয়েছেন তাদের উদ্বেগ ও আকাঙ্ক্ষার কথা।
ছবি: AFP
আমরা কাউকে ট্যাগ দিবো না, গঠনমূলক সমালোচনা করবো : মাহমুদুর রহমান মান্না,
নাগরিক ঐক্যের সভাপতি
আমি এই সময়ের কথা বলছি, কারণ, এখন সবাই খুবই ইমোশনাল মানুষ। তাই বিভিন্নভাবে ট্যাগ দিচ্ছে। এ মুহূর্তে একটা ইনক্লুসিভ সোসাইটি গড়তে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর অন্যকে দোষারোপ না করার চর্চা করতে হবে নিজেদের মধ্যে। আমরা বিভিন্ন ট্যাগ দিবো না কাউকে, আমরা গঠনমূলক সমালোচনা করবো। অন্যের চরিত্রহনন হয়, এ ধরনের কোনো কার্যক্রমে আমরা যাবো না। তবে এজন্য সময় লাগবে৷ কিন্তু চর্চা থামিয়ে রাখা যাবে না।
ছবি: DW
রাজনৈতিক দলের মধ্যে একটি শুদ্ধ আচরণের চর্চার প্রয়োজন : এলিনা খান, মানবাধিকার কর্মী ও আইনজীবী
মুক্তিযুদ্ধের সময় এক ধরনের নাম দেয়া হয়েছে, আবার বর্তমান সময়ে এক ধরনের নাম দেয়া হচ্ছে। এগুলো ঠিক না। সব দলে ভালো মানুষ, খারাপ মানুষ রয়েছে। এখান থেকে বেরিয়ে আসার জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক দলের মধ্যে একটি শুদ্ধ আচরণের চর্চা। প্রত্যেকটা রাজনৈতিক দল অন্য রাজনৈতিক দলকে শ্রদ্ধা করবে, সম্মান করবে। কেউ যদি অন্যায় করে থাকে, তার রাষ্ট্রীয়ভাবে শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
ছবি: DW
বিভিন্ন ট্যাগ দেয়ার মানে হচ্ছে জাতিকে বিভক্ত করে দেয়া : এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন, সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী
২০০৮ সালের পর আওয়ামী লীগ সরকার রাষ্ট্রের মধ্যে বিভিন্ন বিভক্তির জন্ম দেয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বিভিন্ন সংগঠনও নেগেটিভ এক ধরনের কথা বলতে শুরু করলেন। জাতীয় যে বিভক্তি সৃষ্টি হয়েছে, সেখান থেকে বেরিয়ে এসে জাতীয় ঐক্য গঠন করে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। ট্যাগের রাজনীতি পরিহার করে জাতীয় ঐক্যের মাধ্যমে আমাদেরকে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে।
ছবি: DW
ট্যাগের রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে : সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স, যুগ্ম মহাসচিব, বিএনপি
৫ ই আগস্ট তথা ছাত্র-গণবিপ্লবের যে আকাঙ্ক্ষা বা যে প্রত্যয়, তা হচ্ছে পরিবর্তনের রাজনীতি। রাজনীতির একটা পরিবর্তন প্রয়োজন, রাষ্ট্রেও একটা পরিবর্তন প্রয়োজন। সে কারণে রাজনীতির যে পুরনো ধ্যান-ধারণা, সেখান থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। কেউ যদি প্রকৃত অর্থে অন্যায় কাজ করে থাকে, সেটা অন্য ভাষায় সমালোচনা করা যেতে পারে, কিন্তু কথায় কথায় বিভিন্ন ট্যাগ দিয়ে দেয়া- এ ধরনের রাজনীতি জনগণ পছন্দ করে না।
ছবি: DW
ট্যাগিং রাজনীতি ৫ আগস্টে সরকার পতনের পর বেড়ে গেছে : অধ্যাপক তাসনীম সিরাজ মাহবুব, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
আমার মনে হয়, ট্যাগিং রাজনীতিটা ৫ ই আগস্টে সরকার পতনের পরে বেশি বেড়ে গিয়েছে। ৫ ই আগস্টের আগে কয়েকটি সীমিত শব্দে ট্যাগিং সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু এখন অনেক নতুন নতুন শব্দ ট্যাগিংয়ে যোগ হয়েছে৷ এখন বিভিন্ন ট্যাগিং ব্যবহৃত হচ্ছে৷ সবাই তাদের ব্যক্তিগত স্বার্থ উদ্ধার করতে তা করছে। এই ট্যাগিং রাজনীতি থেকে বের হতে হলে দেশের সকল নাগরিককে সচেতন হতে হবে।
ছবি: DW
ট্যাগ দেয়ার কারণে অনেক সময় মবের সৃষ্টি হয় : মাসুদ কামাল, সিনিয়র সাংবাদিক
বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সমন্বয়ক- তারা যে একে অপরকে বিভিন্ন ট্যাগ দিচ্ছেন, এতে করে তাদের ইমেজ নষ্ট হচ্ছে। বিভিন্ন ট্যাগ দেয়ার কারণে অনেক সময় মবের সৃষ্টি হয়। সরকারকে এ ব্যাপারে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
ছবি: DW
নেতাদের আগে ট্যাগিংয়ের রাজনীতি থেকে সরতে হবে : মোহাম্মদ সাইফুল আলম চৌধুরী, শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ট্যাগিংয়ের রাজনৈতিক সংস্কৃতি থেকে উত্তরণের জন্য বাংলাদেশের রাজনৈতিক শিক্ষাটা রাজনৈতিক দল থেকে আসতে হবে। রাজনৈতিক উচ্চস্তরের নেতারা তাদের অনুসারীদেরকে ট্যাগিং রাজনীতি থেকে দূরে সরাতে হলে আগে তাদেরকে ট্যাগিং রাজনীতি থেকে দূরে সরতে হবে। তখন বাকি অনুসারীরা এটা অভ্যাসে পরিণত করবে।
ছবি: DW
রাজনৈতিক নেতাদের আগে ট্যাগিংয়ের রাজনীতি থেকে দূরে সরতে হবে : মনজিল মোরসেদ, সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী
রাজনৈতিকভাবে বিভিন্ন ট্যাগ দেয়ার প্রচলন অনেক আগে থেকেই ছিল। আগে ছিল ‘রাজাকারের দোসর’ আর বর্তমানে হচ্ছে ‘ফ্যাসিবাদের দোসর’৷ এটির মাধ্যমে একটা বিশেষ সুবিধা নেয়ার চেষ্টা করা হয়। এগুলো আপাতত সমাধান করা খুবই কঠিন। সমাধান করার জন্য প্রথমে একটা সুস্থ রাজনীতি প্রয়োজন৷ সঠিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হলে তাহলে এগুলো থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে পারবো। সুস্থ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা না হলে এগুলো বন্ধ হবে না বলে মনে হয়।
ছবি: DW
ট্যাগিংয়ের সংস্কৃতি কখনো সুস্থ চর্চা না : মানজুর আল মতিন, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও উপস্থাপক
বিরুদ্ধমত যুক্তি দিয়ে মোকাবেলা করতে হবে। বাংলাদেশ সবার। এদেশ কারো নির্দিষ্ট একটা মতের মানুষের হতে পারে না। একটা আধুনিক রাষ্ট্রে বিভিন্ন মতের মানুষেদের একসাথে এক জায়গায় সহাবস্থান করার সুযোগ করে দেয়ার মতো একটা রাষ্ট্র আমাদের দিক থেকে গড়ে তুলতে হবে। সকলে সকলের মত প্রকাশ করতে পারবে, সেজন্য তাকে টার্গেট করা যাবে না। বিনা কারণে একটা মানুষকে ভিক্টিমাইজ করার জন্য তা ব্যবহার করা হয়, সেটা কাম্য না।
‘শিবির’..‘স্বাধীনতাবিরোধী’..‘রাষ্ট্রদ্রোহী’- এ ট্যাগগুলো তো পূর্বে পতিত ফ্যাসিবাদের প্রধান হাতিয়ার ছিলে। বর্তমানেও ট্যাগের রাজনীতি চলছে। এখান থেকে বের হতে হলে সকল রাজনৈতিক ব্যক্তিকে সচেতন হতে হবে। ছাত্র-জনতার প্রাণ উৎসর্গের মধ্য দিয়ে যে নতুন বাংলাদেশ হয়েছে- মানুষ গণতন্ত্রের, ভোটাধিকার ফিরে পাবার স্বপ্ন দেখছে, সেখানে সেই অতীতের অভিশপ্ত চর্চার পুনরাবৃত্তি কোনোভাবেই কাম্য নয়।
ছবি: DW
প্রতিহিংসার রাজনীতি আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় দুর্বলতাগুলোর একটি : দীপ্তি চৌধুরী, গণমাধ্যম ও উন্নয়ন কর্মী
প্রতিহিংসার রাজনীতি আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় দুর্বলতাগুলোর একটি, যার থেকে এই ট্যাগ দেয়ার সংস্কৃতি। এটি আমাদের জাতিগত বিভাজন তৈরি করে। এই ট্যাগের রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসার উপায় মনে হয় জাতীয় ঐক্যের একটা কমন গ্রাউন্ড তৈরি করা। আমরা একেকজন একেক মতাদর্শের হতেই পারি বা একেক উপায়ে দেশের কল্যাণ চাইতে পারি। তবে দেশের কল্যাণ যে সবাই চাইছি- এটি নিশ্চিত করা এবং বিশ্বাস করা আমাদের জন্য অপরিহার্য।
ছবি: DW
11 ছবি1 | 11
ক্ষমতাবান ব্যক্তিও শত্রুস্থানীয় কাউকে ঘায়েল করার জন্য এই অস্ত্রই শান দিতো। এই অস্ত্রে জেল-জুলুম-গুম কিংবা ঘায়েল সবই সহজ হতো রাজনৈতিক অনুকূল পরিবেশের কারণে।
আগস্টে পরিস্থিতি পাল্টেছে। রাজনীতির উত্তর মেরু থেকে দক্ষিণ মেরুর যাত্রায় ‘'দায় ও দরদের রাষ্ট্র' কিংবা ইনক্লুসিভ সোসাইটির স্বপ্ন দেখানো হলেও বাস্তবে ট্যাগিংয়ের বাস্তবতার পরিবর্তন ঘটেনি, বরং আরো তীব্রতর হয়েছে। ফ্যাসিস্ট কিংবা ফ্যাসিস্টের দোসর বলে ট্যাগ দিতে এখন কেউ মুহূর্তমাত্র ভাবে না।
রাজনৈতিকভাবে তো বটেই,সামাজিক,সাংস্কৃতিক, এমনকি ব্যক্তিগত পর্যায়েও এই ট্যাগিং সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হয়ে উঠেছে প্রতিশোধপরায়ণতার, সুযোগ সন্ধানের, চাঁদাবাজির,দখলদারিত্বের।
এই ট্যাগিং এখন এক আতঙ্কের নাম।কোনো সত্য প্রচলিত বয়ানের বাইরে গেলেই এই ট্যাগিং আর ট্যাগিং সংক্রান্ত মবের ভয় গ্রাস করে আছে মানুষের স্বাভাবিক বাক প্রবণতা।
অভ্যুত্থান, সরকার পরিবর্তন আর সুন্দর কোন সমাজ বিনির্মাণ কখনোই সম্ভব নয় এই উদ্দেশ্য প্রণোদিত ট্যাগিংয়ের সংস্কৃতি বিদ্যমান থাকলে। আর এই ট্যাগিং ততোদিনই বিদ্যমান থাকবে যতোদিন উদ্দেশ্য সৎ না হয়।