ট্রাইব্যুনালে স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা : কতটুকু জানলো জাতিসংঘ?
২০ জানুয়ারি ২০২৫কী কী জানতে পেরেছেন তারা? সেখানে পরিস্থিতি আসলে কেমন?
জাতিসংঘের প্রতিনিধি দলটি সেখানে যায় রবিবার। প্রতিনিধি দলে ছিলেন ঢাকায় নিযুক্ত জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী গোয়েন লুইস ও ঢাকায় জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারীর কার্যালয়ের সিনিয়র মানবাধিকার বিষয়ক উপদেষ্টা হুমা খান।
মানবতাবিরোধী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক মন্ত্রী, এমপি, সরকারি কর্মকর্তাদের বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা এবং প্রসিকিউশন টিম কাজ করছে। ট্রাইব্যুনালে মামলাগুলো এখনো প্রসিকিউশনের তদন্ত পর্যায়ে আছে।
জাতিসংঘ টিমের পরিদর্শনের পর ট্রাইব্যুনালৈ চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, ‘‘প্রতিনিধিরা জানতে চেয়েছেন ট্রাইব্যুনালের বিচার ও তদন্ত প্রক্রিয়া কেমন এগোচ্ছে, কী পর্যায়ে আছে, কোনো সমস্যা আছে কিনা, তাদের পক্ষ থেকে সাহায্য-সহযোগিতা দরকার আছে কিনা, এই বিচারপ্রক্রিয়া স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ করার ব্যাপারে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে, কী কী কাজ করা হচ্ছে, সে ব্যাপারে জাতিসংঘের সহযোগিতা দরকার আছে কিনা৷ এসব বিষয় নিয়ে তারা খোলামেলা আলোচনা করেছেন।”
প্রসিকিউশন এবং তদন্ত সংস্থাকে প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তিগত সহায়তা দিতে প্রতিনিধিদের কাছে চিফ প্রসিকিউটর কার্যালয় অনুরোধ জানিয়েছে বলেও জানান তাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘‘এই বিচারপ্রক্রিয়ার প্রতি জাতিসংঘের সমর্থন যাতে অব্যাহত থাকে, সে ব্যাপারে আমরা তাদের কাছে অনুরোধ জানিয়েছি।''
জাতিসংঘের প্রতিনিধিদল মানবতাবিরোধী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয় পরিদর্শনের পরের দিন আসামিদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছে ডয়েচে ভেলে৷ কিন্তু স্বজনদের অনেকেই প্রকাশ্যে সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে চাননি। সাবেক এক মন্ত্রীর স্ত্রী নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আসলে আমরা এখনো বুঝে উঠতে পারছিনা যে কী হচ্ছে। আমরা ভালো কোনো আইনজীবীও নিয়োগ করতে পারছি না। কারাগারে দেখা করার সুযোগ পাচ্ছি না। কারাগারে ডিভিশনের আদেশ দেয়া হলেও বাস্তবে ডিভিশন দেয়া হয়েছে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ আছে। ন্যায়বিচার পাবো কিনা জানি না”
তবে পরিচয় প্রকাশ করেই কথা বলেছেন অব্যাহতিপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসানের বোন অ্যাডভোকেট নাজনিন নাহার। তিনি জিয়াউল আহসানের আইনজীবী হিসাবেও কাজ করছেন। ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘ট্রাইব্যুনালে অনেক সমস্যা আছে। ট্রাইব্যুনালে গেলে মনে হয় আমি কর্মচারী তারা মালিক। আমাদের সাথে সেই আচরণ করা হয়।”
তিনি আরো বলেন, সঙ্গে একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট নিতেও খুব সমস্যায় পড়তে হয়৷ সোমবার ফটোকপি করতে বাইরে পাঠানোর পর অ্যাসিস্ট্যান্টকে আর ঢুকতে দেয়া হয়নি বলেও দাবি করেন তিনি৷
তিনি আরো বলেন, ‘‘এম আই ফারুকী সাহেব আমার সিনিয়র। উনি বয়ষ্ক মানুষ। ওনাকে সেখানে নিয়ে যেতে দুইজন লোক লাগে। আমি যখন ট্রাইব্যুনালে যাই, তখন এটার জন্য অনেক ফাইট করতে হয়। খুব কড়াকড়ি করা হয়, কোনো গ্যাজেট নিতে দেয়া হয় না। ল্যাপটপ, মোবাইল, এমনকি ঘড়িও নিতে দেয়া হয় না৷ আর আমি যখন আইনজীবী হিসবে আমার ভাইয়ের সাথে কথা বলি, সেখানে গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন থাকে। ওয়ান টু ওয়ান কথা বলতে দেয়া হয় না। এটা তো নিয়ম না৷তাই অনেক সময় আমাদের কানেকানে কথা বলতে হয়,'' বলেন তিনি।
ট্রাইব্যুনাল সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘‘এখন যিনি ট্রাইব্যুনালের প্রধান, তাকে আমি কখনো হাইকোর্টে বিচারক হিসাবে দেখিনি। আমার ভুলও হতে পারে। আর চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম সাহেব তো আগে ডিফেন্স (আসামি পক্ষ) ল-ইয়ার ছিলেন। সেই মামলাগুলো কিন্তু এখনো শেষ হয়নি।”
‘‘আর এখনো মূল বিচার কাজ শুরু হয়নি। তদন্ত চলছে,'' বলেন তিনি।
গত পাঁচমাসে অনেক সাংবাদিককেও গণহত্যা মামলার আসামি করা হয়েছে। তাদের মধ্যে যারা গ্রেপ্তার হননি তাদের কয়েকজনকে চেষ্টা করলেও প্রকাশ্যে মন্তব্য করতে রাজি হননি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সিনিয়র সাংবাদিক ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘কোনো মন্তব্য করে নতুন করে বিপদে পড়তে চাই না। সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা হতে পারে, অনৈতিক কাজের মামলা হতে পারে, কিন্তু হত্যা - গণহত্যার মামলা ন্যক্কারজনক। এই সরকারের আমলে আমি ন্যায়বিচার আশা করি না। তাই এটা নিয়ে কিছু বলতেও চাই না।”
ট্রাইব্যুনালের স্বচ্ছতা ও বিচার সম্পর্কে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জেড আই খান পান্না বলেন, ‘‘এখনো তো বিচারকাজ শুরু হয়নি। তদন্ত চলছে। বিচার শুরু হলে বিচারের স্বচ্ছতা নিয়ে কথা বলা যেতো। তবে আমি খুব তারাহুড়ো দেখতে পাচ্ছি। জাস্টিস হারিড, জাস্টিস বারিড।”
"তবে ট্রাইব্যুনালের যিনি চেয়ারম্যান, তিনি কখনো হাইকোর্টের জাজ ছিলেন না। তিনি কখনো হাইকোর্টের বিচারকের চেয়ারে বসেননি। আমি যতদূর জানি, ভুলও হতে পারে, পাঁচ-ছয় বছর আগে তিনি জেলা জজ হিসাবে অবসর নিয়েছেন। কিন্তু ট্রাইব্যুনাল হাইকোর্টের সমান। আর চিফ প্রসিকিউর একই ট্রাইব্যুনালে আগে ছিলেন আসামিপক্ষের আইনজীবী, এখন তিনি রাষ্ট্রপক্ষের। তবে এখন যেটা করছেন, সেটা চাকরি। আর আগেরটা ব্যক্তির।”
এইসব বিষয় নিয়ে ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলামের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলার চেষ্টা করা হয়৷ তবে তিনি অনেক প্রশ্নেরই জবাব দিতে চাননি। সশরীরে গিয়ে কথা বলতে বলেন তিনি। টেলিফোনে তিনি বলেন, ‘‘জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক কোনো টিম আসেনি, জাতিসংঘ সরাসরি এসেছিল। এসেছিলেন জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি ও মানবাধিকার বিষয়ক সমন্বয়ক। তারা রেগুলার বেসিসেই আমাদের সঙ্গে কথা বলেন। তারা এই প্রক্রিয়াকে সমর্থন করেন এবং তারা টুইট করেছেন যে, বাংলাদেশে প্রতিশ্রুত ন্যায়বিচারের পক্ষে তারা আছেন।”
বিচার প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতার প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘‘তারা এ ধরনের কোনো কথা বলেননি। তারা স্বচ্ছতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন করেননি। তারা জানতে চেয়েছেন যে, আমরা বিভাবে বিচার প্রক্রিয়া স্বচ্ছ করছি।”
ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যন আগে হাইকোর্টের বিচারপতি ছিলেন না আর তিনি নিজে ডিফেন্স ল-ইয়ার ছিলেন- এ নিয়ে টেলিফোনে কিছু বলতে অপারগতা প্রকাশ করলেও জানতে চান, ‘‘তাতে সমস্যা কী?''
রোববার জাতিসংঘের প্রতিনিধি দল সাংবাদিকদের সঙ্গে কোনো কথা বলেননি।
বাংলাদেশের সংবিধানে মানবতাবিরোধী আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচারে বিষয়টি সংযুক্ত হয় ১৯৭৩ সালে৷ স্বাধীনতার ৩৯ বছর পর মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়৷ আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয় ২০১০ সালের ২৫ মার্চ৷ পরে ২০১২ সালের ২২ মার্চ ট্রাইব্যুনাল-২ নামে আরেকটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়৷ ২০১৫ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর দুটিকে একীভূত করে আবার একটি ট্রাইব্যুনাল করা হয়৷
এই ট্রাইব্যুনালে ইতিমধ্যে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অনেকের বিচার ও সর্বোচ্চ শাস্তি কার্যকর করা হয়েছে৷ মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত আরো কয়েকজনের বিচার সেই ট্রাইব্যুনালে চলছিল৷
গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ট্রাইব্যুনালের তৎকালীন চেয়ারম্যান অবসরে যান৷ আরেক সদস্যকে হাইকোর্টে ফিরিয়ে নেওয়া হয়৷ অপর সদস্য অব্যাহতি নিয়েছেন৷ এছাড়া আওয়ামী লীগ আমলে নিয়োগ পাওয়া প্রসিকিউটরেরা এক পর্যায়ে পদত্যাগ করেন৷
১৫ অক্টোবর ট্রাইব্যুনালে যোগ দেন তিন সদস্যের বিচারক প্যানেল৷ এর আগেই চিফ প্রসিকিউটর এবং তদন্ত সংস্থার জনবল নিয়োগ দেয়া হয়৷
শেখ হাসিনা এবং অন্য ৪৫ জনের বিরুদ্ধে গণহত্যার মামলা দিয়ে ১৭ আগস্ট ট্রাইবুন্যালের বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মধ্যে সংঘটিত গণহত্যা এবং বিগত আওয়ামী লীগ শাসনামলে সংঘটিত গুম, খুনসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার করা হচ্ছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে।