যুদ্ধাপরাধী পাকিস্তানি সেনাদের অপরাধ তদন্তে প্রস্তুত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল৷ সরকার ইঙ্গিত দিলেই শুরু হবে তদন্ত৷ তবে এখনও সরকারের কাছ থেকে সে ধরনের কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি বলে জানান অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত৷
ছবি: DW/M. Mamun
বিজ্ঞাপন
তদন্ত সংস্থার প্রধান সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, দেশি যুদ্ধাপরাধীদের তদন্ত করতে গিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের অপরাধের কিছু তথ্য-উপাত্ত তাদের হাতে চলে এসেছে, যা তারা সংরক্ষণ করছেন৷ তবে এ মুহূর্তে তদন্ত শুরু হয়েছে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বাঙালি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে৷
আব্দুল হান্নান খান জানান, অন্তত দু'জন বাঙালি সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়ে গেছে৷ এদের মধ্যে শহীদুল্লাহ নামে একজনের বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছে৷ এছাড়া আরো একজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হচ্ছে৷ তার বিরুদ্ধেও মামলা হয়েছে৷ তাদের বাড়ি রংপুরে৷
আব্দুল হান্নান খান
This browser does not support the audio element.
বলা বাহুল্য একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের বিচারে সাতবছর আগে ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর, এই প্রথম কোনো সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হলো৷ একাত্তরের ২৫শে মার্চ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাঙালি নিধন শুরুর পর প্রতিরোধ যুদ্ধে বাঙালি অনেক সেনা সদস্য যুক্ত হয়েছিলেন৷ তবে পাকিস্তানেও আটকা পড়েন অনেক সেনা কর্মকর্তা৷ একাত্তরে বেসামরিক রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস বাহিনীর পাশাপাশি বাঙালি সেনা সদস্যদের কেউ কেউ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হয়ে স্বজাতির বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছিলেন৷
আব্দুল হান্নান খানের কথায়, ‘‘একাত্তরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কর্মরত বাঙালি কর্মকর্তাদের সবাই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেননি৷ এদের অনেকেই পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মিলে মানবতাবিরোধী অপরাধে যুক্ত হন৷'' তিনি বলেন, একটি ঘটনা আমরা জেনেছি....ঐ সময় রংপুরে একটি গণহত্যার ঘটনা ঘটেছিল৷ সেখানে কয়েকজন বাঙালি অফিসারের সম্পৃক্ততা ছিল৷ এ বিষয়ে প্রাথমিক অনুসন্ধান শেষ হয়েছে জানিয়ে হান্নান খান জানান, দু'জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে৷ এদের মধ্যে একজন গ্রেপ্তার হয়েছেন, অপরজন পলাতক৷
বিষয়টি তদন্তাধীন বলে এ নিয়ে বিস্তারিত জানাতে রাজি হননি তদন্ত সংস্থার প্রধান৷ একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের বিচার নিষ্পত্তির পর এ পর্যন্ত ছ'জনের ফাঁসির দণ্ড কার্যকর করা হয়েছে৷ এরা সবাই রাজনীতিক – পাঁচজন জামায়াতে ইসলামীর নেতা, একজন বিএনপির৷ এছাড়া আর যারা দণ্ডিত, তারাও জামায়াতে ইসলামী ও মুসলিম লীগের নেতা৷
রানা দাশগুপ্ত
This browser does not support the audio element.
অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত এ বিষয়ে বলেন, ‘‘আমাদের ট্রাইব্যুনাল আইন অনুযায়ী শুধু ১৯৫ জন নয়, আরো যদি কোনো সেনা কর্মকর্তার সংশ্লিষ্টতা উঠে আসে, তাদের বিচারও এখানে করা সম্ভব৷ কিন্তু এই বিচার করার জন্য সরকারের ইঙ্গিত প্রয়োজন৷ সেই ধরনের কোনো ইঙ্গিত আমরা এখনও পায়নি৷ কারণ দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের ব্যাপার আছে৷ তবে সরকার চাইলে আমাদের সেই ধরনের প্রস্তুতি আছে৷ আমরা যে কোনো সময় শুরু হতে পারব৷''
জামায়াতের নতুন আমির মকবুল আহমাদের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে জানিয়ে আব্দুল হান্নান খান বলেন, ‘‘আমরা আশা করছি, এ বিষয়ে উপযুক্ত তথ্য-উপাত্ত আমরা পাবো৷''
অন্যান্য যুদ্ধাপরাধীদের নিয়েও তদন্ত চলছে৷ বাগেরহাটের এমন ১৪ জনের বিরুদ্ধে গত রবিবার প্রতিবেদন দাখিল করে তদন্ত সংস্থা৷ বাগেরহাটের কচুয়া ও মোরেলগঞ্জ থানায় মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের অভিযোগে এই ১৪ জনের বিরুদ্ধে প্রস্তুত প্রতিবেদনটি ট্রাইব্যুনালের ৪৫তম প্রতিবেদন৷ এই ১৪ জনের মধ্যে চারজন গ্রেপ্তার হয়েছেন৷ বাকি ১০ জন পলাতক৷ এরা হলেন – খান আশরাফ আলী, সুলতান আলী খান, রুস্তম আলী মোল্লা, মকছেদ আলী দিদার, শেখ ইদ্রিস আলী, শেখ রফিকুল ইসলাম বাবুল, মনিরুজ্জামান হাওলাদার, হাশেম আলী শেখ ও আজহার আলী শিকদার৷ এছাড়া যে চারজন গ্রেপ্তার হয়েছেন, তারা হলেন – খান আকরাম হোসেন, শেখ উকিল উদ্দিন, আব্দুল মকবুল মোল্লা ও ইদ্রিস আলী মোল্লা৷
এ বিষয়ে আপনার মতামত জানান, লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷
১৯৪১ সালের ২৬ আগস্ট জামায়াতে ইসলামী হিন্দ নামে উপমহাদেশে জামায়াতে ইসলামীর যাত্রা শুরু হয়৷ দলটির প্রতিষ্ঠাতা সায়েদ আবুল আলা মওদুদী৷ এরপর ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর গঠিত হয় জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান৷ বাংলাদেশ অংশের নাম হয় পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামী, যার প্রধান ছিলেন গোলাম আযম৷ ১৯৬৪ সালে পাকিস্তানে জামায়াতে ইসলামী নিষিদ্ধ হয়৷ তবে কয়েকমাস পরই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়েছিল৷
ছবি: Jamaat-e-islami.org
সুবিধাবাদী দল
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক মামুন আল মোস্তফা সম্প্রতি এক প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘‘১৯৪১ সালে কার্যক্রম শুরুর পর থেকে বিভিন্ন বিষয়ে নিজেদের অবস্থান সুবিধা পেলেই বদলে ফেলেছে জামায়াত৷’’ তিনি বলেন, অন্য অনেক দলের মতোই যেখানে লাভ দেখেছে, বিনা দ্বিধায় সে পথে গেছে দলটি৷ ‘‘জামায়াত পাকিস্তানের বিরোধিতা করলেও ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় দলটির শীর্ষ নেতৃত্ব পাকিস্তানে চলে যায়৷’’ আরও জানতে ক্লিক ‘+’৷
ছবি: picture-alliance/ZUMA Press/Z.H. Chowdhury
মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতা
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে জাময়াতে ইসলামী৷ শুধু বিরোধিতা নয়, গণহত্যা, ধর্ষণ, লুটতরাজসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আছে দলটির বিরুদ্ধে৷
ছবি: National Monument of Savar
বাংলাদেশে নিষিদ্ধ, তারপর আবার...
স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামী নিষিদ্ধ হয়৷ তবে ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর জামায়াতে ইসলামী রাজনীতিতে সক্রিয় হয়৷ ১৯৭৬ সালে জিয়াউর রহমান সুযোগ করে দিলে ইসলামিক ডেমোক্র্যাটিক পার্টি নামে জামায়াত কাজ শুরু করে৷ বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগেই পালিয়ে যাওয়া গোলাম আযম ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশে ফিরে এলে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ নামে কাজ শুরু করে৷
ছবি: picture-alliance/epa/Ahmad Fayyaz
নির্বাচনি রাজনীতিতে জামায়াত
জামায়াত বাংলাদেশে প্রথম নির্বাচনে অংশ নেয় ১৯৮৬ সালের তৃতীয় সংসদ নির্বাচনে৷ সেই বার তারা ১০টি আসন পায়৷ এরপর ১৯৯৬ সালে ৩টি, ২০০১ সালে বিএনপির সঙ্গে ঐক্য করে ১৭টি আর ২০০৮ সালে দু’টি আসন লাভ করে৷ এর মধ্যে ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত জামায়াতের দু’জন নেতা মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন৷
ছবি: AFP/Getty Images
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুন্যাল গঠন
নির্বাচনি প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী, ২০১০ সালে ২৫শে মার্চ যুদ্ধাপরাধের বিচারে মানবতাবিরোধী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে আওয়ামী লীগ সরকার৷ ট্রাইব্যুনালের রায়ে জামায়াত নেতাদের দণ্ড ছাড়াও দলটিকেও যুদ্ধাপরাধী রাজনৈতিক দল হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে৷
ছবি: AP
মীর কাসেমের ফাঁসি বড় ধাক্কা
যুদ্ধাপরাধের বিচার বানচালের জন্য জামায়াত সবসময়ই সক্রিয় ছিল৷ এ লক্ষ্যে প্রচুর অর্থ খরচ করে বিচার বন্ধ ও জামায়াত নেতাদের রক্ষায় আন্তর্জাতিক লবিস্ট নিয়োগ করা হয়৷ এই কাজের নেতৃত্বে ছিলেন মীর কাসেম আলী৷ তিনি মূলত জামায়াতের ব্যবসা-বাণিজ্য এবং শিল্প প্রতিষ্ঠান দেখভাল করতেন৷ মীর কাসেম আলির ফাঁসি কার্যকর হওয়ায় জামায়াতের অর্থনৈতিক ভিত্তিতে আঘাত লেগেছে বলে মনে করা হচ্ছে৷
ছবি: STRINGER/AFP/Getty Images
নিবন্ধন বাতিল হয়েছে, দল নয়
সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশে নির্বাচন কমিশন জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করেছে৷ ফলে দলটি এখন আর দলীয়ভাবে এবং দাঁড়িপাল্লা ব্যবহার করে নির্বাচনে অংশ নেয়ার সুযোগ পাচ্ছে না৷ তবে দল হিসেবে জামায়াত এখনও বৈধ একটি রাজনৈতিক সংগঠন৷
ছবি: DW
নতুন আমির কে হচ্ছেন?
যুদ্ধাপরাধের দায়ে দলের শীর্ষ কয়েকজন নেতার ফাঁসি কার্যকর হওয়ায় নতুন নেতৃত্ব গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়৷ বর্তমানে মকবুল আহমেদই দলটির আমিরের দায়িত্ব পালন করছেন৷