ট্রাকচাপায় শিক্ষার্থীর মৃত্যু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ
২ ফেব্রুয়ারি ২০২২
ট্রাকচাপায় শিক্ষার্থীর মৃত্যুর ঘটনায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসিক হলের সামনে সারারাত বিক্ষোভ করে শিক্ষার্থীরা৷ সে সময় তারা পাঁচটি ট্রাকে আগুন লাগানোর পরে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থান নেয়৷
বিজ্ঞাপন
ডয়চে ভেলের কনটেন্ট পার্টনার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম জানায়, শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে রাতেই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল বডিকে প্রত্যাহার করার মৌখিক প্রতিশ্রুতি দেন উপাচার্য অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তার৷ বিডিনিউজকে বুধবার সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ প্রশাসক অধ্যাপক প্রদীপ কুমার পাণ্ডে বলেন, ‘‘উপাচার্য প্রক্টরিয়াল বডিকে প্রত্যাহারের মৌখিক ঘোষণা দিয়েছেন৷ শিক্ষার্থীদের আরও দাবি আছে, সেগুলো নিয়ে আজ আলোচনা হবে৷ দাপ্তরিক বিষয়গুলো আজ কোনো এক সময় চূড়ান্ত করা হবে৷’’
শিক্ষার্থীরা জানান, মঙ্গলবার রাত সাড়ে ৮টায় শহীদ হবিবুর রহমান হলের সামনে নির্মাণাধীন ভবনের পাথরবাহী একটি ট্রাক মোটরসাইকেল আরোহী তিন শিক্ষার্থীকে চাপা দেয়৷
এতে ঘটনাস্থলে মারা যান চারুকলা অনুষদের শেষবর্ষের শিক্ষার্থী এবং বিশ্ববিদ্যালয় ড্রামা অ্যাসোসিয়েশনের (রুডা) সাধারণ সম্পাদক মাহমুদ হাবিব হিমেল৷ একই বর্ষের শিক্ষার্থী রায়হান রিমেলকে গুরুতর অবস্থায় রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়৷ হিমেলের লাশটি প্রায় দেড় ঘণ্টা দুর্ঘটনাস্থলেই পড়ে ছিল৷ রাত পৌনে ১১টায় লাশটি ময়নাতদন্তের জন্য রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে নিয়ে যাওয়া হয়৷
সহস্রাধিক বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থী দুর্ঘটনাস্থলে এসে জড়ো হয়ে নির্মাণসামগ্রী বহনের পাঁচটি ট্রাকে তারা আগুন দেয়৷ এবং নির্মাণাধীন ভবনে ভাঙচুর করা ছাড়াও দুটি কক্ষে আগুন দেয়৷ শিক্ষার্থীদের বাধায় পুলিশ ও ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ি ক্যাম্পাসে প্রবেশ করতে না পেরে ফিরে যায়৷
শিক্ষার্থীদের একটি অংশ রাতে প্রধান ফটকের সামনে ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়ক তিন ঘণ্টা অবরোধ করে রাখে৷ পরে তারা উপাচার্যের বাসভবনের সামনে টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করে৷ রাতে বিক্ষোভরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলতে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে যান রাজশাহীর মেয়র ও আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য এএইচএম খায়েরুজ্জামান লিটন৷
উপাচার্য অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তার রাজশাহী মেডিকেল থেকে গভীর রাতে বাসায় ফেরেন৷ তার বাসভবনের সামনে তার কাছে শিক্ষার্থীরা প্রক্টরিয়াল বডির অপসারণসহ নিহতের পরিবারকে ১০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ, নিহতের বোনকে বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি দেওয়া, ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান পাল্টানো এবং ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের লিখিত দাবি জানান৷
উপাচার্য প্রক্টরিয়াল বডিকে অপসারণের মৌখিক আশ্বাস দিয়ে বলেন, বুধবার বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে হিমেলের জানাজা শেষে মরদেহ নাটোরে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার পর ক্যাম্পাসে ফিরে অন্যান্য দাবি নিয়ে শিক্ষার্থীদের সাথে আলোচনায় বসবেন৷ দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ট্রাকচালক গ্রেপ্তার না হওয়া পর্যন্ত হবিবুর রহমান হলের সামনে নির্মাণাধীন অ্যাকাডেমিক ভবনের কাজ বন্ধ রাখার ঘোষণা দেন উপাচার্য৷
শিক্ষার্থীর মৃত্যুর ঘটনায় মামলা করার প্রক্রিয়া চলছে বলে জানান মতিহার থানার ওসি আনোয়ার হোসেন তুহিন৷
এনএস/কেএম (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম)
শাবিপ্রবি: প্রাধ্যক্ষ অপসারণের দাবি থেকে উপাচার্যবিরোধী আন্দোলন
শুরুটা প্রাধ্যক্ষ অপসারণের দাবিতে, পুলিশি হামলায় যা পরিণত হয় উপাচার্যবিরোধী আন্দোলনে৷ এক দফা দাবিতে অনড় শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আন্দোলন চলছে সপ্তাহ পেরিয়ে৷ ঘটনাপ্রবাহ ছবিঘরে...
ছবি: bdnews24.com
যেখান থেকে শুরু
সূত্রপাত ১৩ জানুয়ারি, বেগম সিরাজুন্নেসা চৌধুরী হলের প্রাধ্যক্ষ জাফরিন আহমেদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের বিরোধের জেরে৷ অসদাচরণের অভিযোগে তার অপসারণের দাবিতে বিক্ষোভে নামেন ছাত্রীরা৷ রাত ১১টার দিকে তারা অবস্থান নেন উপাচার্যের বাসভবনের সামনে৷ উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদ দেন সমাধানের আশ্বাস৷ রাত আড়াইটায় ছাত্রীরা ফিরেন হলে৷
ছবি: bdnews24.com
তিন দফা দাবি
করোনা আক্রান্ত হওয়ার কারণ দেখিয়ে পরদিন জাফরিন আহমেদকে ছুটিতে পাঠান উপাচার্য৷ অন্য একজনকে করেন ভারপ্রাপ্ত প্রাধ্যক্ষ৷ কিন্তু পুরো কমিটির পদত্যাগ, হলের অব্যবস্থাপনা দূর, ছাত্রীবান্ধব ও দায়িত্বশীল প্রাধ্যক্ষ নিয়োগ; তিন দফা দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন ছাত্রীরা৷ তাদের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে উপচার্যের ঘণ্টাব্যাপী আলাপেও আসেনি সমাধান৷ শতাধিক আবাসিক ছাত্রী উপাচার্য কার্যালয় ঘেরাও করে শুরু করেন বিক্ষোভ৷
ছবি: bdnews24.com
‘ছাত্রলীগের’ হামলা
তৃতীয় দিনে আন্দোলনরত ছাত্রীদের ওপর হামলার অভিযোগ ওঠে শাবি ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে৷ ১৫ তারিখ সন্ধ্যায় প্রক্টরের উপস্থিতিতেই এই ঘটনা ঘটে বলে ছাত্রীরা জানান৷ তাদের একজন বলেন, ‘‘আন্দোলনে সংহতি জানাতে আসা ১০-১২ জন ছাত্রকে তারা বেধড়ক মারধর করে৷ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আলমগীর কবির এ সময় সেখানে ছিলেন৷’’ প্রক্টর ও ছাত্রলীগের এক সদস্য একে ‘হাতাহাতি’ হিসেবে অভিহিত করেন৷
ছবি: bdnews24.com
পুলিশের হামলা
ছাত্রীরা ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনের ঘোষণা দিয়ে বিক্ষোভ অব্যাহত রাখেন৷ তাদের সঙ্গে একাত্ব হন সাধারণ শিক্ষার্থীরাও৷ ১৬ তারিখ আইসিটি ভবনে উপাচার্যকে অবরুদ্ধ করেন তারা৷ তাকে মুক্ত করতে বিকালে উপস্থিত হয় পুলিশ৷ আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের তারা লাঠিপেটা, কাঁদুনে গ্যাস, রাবার বুলেট ও সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়ে ছত্রভঙ্গ করে৷ শিক্ষার্থী, কর্মকর্তাসহ আহত হন অর্ধশত৷
ছবি: bdnews24.com
পুলিশের মামলা
পরদিন পুলিশই অজ্ঞাত পরিচয় ২০০ থেকে ৩০০ শিক্ষার্থীকে আসামি করে মামলা করে৷ অভিযোগ শিক্ষার্থীরা গুলি বর্ষণ ও পুলিশকে হত্যার উদ্দেশ্যে মারপিট করেছে৷ তবে ঘটনা নিয়ন্ত্রণে পুলিশ ৩১টি শটগানের গুলি এবং ২১টি সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে বলেও মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে৷
ছবি: bdnews24.com
বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ
রোববার সন্ধ্যায় জরুরি সিন্ডিকেটে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের ঘোষণা দেয় কর্তৃপক্ষ৷ পরদিন বারোটার মধ্যে শিক্ষার্থীদের হল ত্যাগের নির্দেশনা দেয় তারা৷ এরমধ্যে প্রাধ্যক্ষ জাফরিন আহমেদ লিজা পদত্যাগ করেছেন বলে সংবাদ মাধ্যমকে জানান উপাচার্য৷ কিন্তু শিক্ষার্থীদের দাবি, পুলিশি হামলার ঘটনার এবার উপাচার্যকেই যেতে হবে৷ ভিসির পদত্যাগের এক দফা দাবিতে রাতে বিক্ষোভ মিছিল করেন দুই হাজারের বেশি শিক্ষার্থী৷
ছবি: bdnews24.com
প্রশাসনিক ভবনে তালা
শিক্ষার্থীদের দুপুর বারোটার আগে হল ত্যাগের নির্দেশ দিলেও প্রশাসনিক কার্যক্রম চালু রাখে কর্তৃপক্ষ৷ শিক্ষার্থীরা সেই নির্দেশ অমান্য করে উল্টো উপাচার্য কার্যালয়, দুটি প্রশাসনিক ভবন ও চারটি একাডেমিক ভবনে তালা ঝুলিয়ে দেন৷ এক সমাবেশ থেকে ভিসি ফরিদ উদ্দিন আহমেদকে শাবিপ্রবিতে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেন তারা৷
ছবি: bdnews24.com
সাবেকদের সহমর্মিতা
কর্তৃপক্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাইনিং ও ক্যান্টিন বন্ধ করায় নির্দেশ অমান্য করে ক্যাম্পাসে থেকে যাওয়া শিক্ষার্থীরা খাবার নিয়ে পড়েন বিপাকে৷ সমাধান হিসেবে হাজারো শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের গোলচত্বরের পাশে নিজেরাই রান্না ও খাবার আয়োজন শুরু করেন৷ আন্দোলনে একাত্মতার পাশাপাশি এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থীরা তাদের সহায়তায় এগিয়ে আসেন৷
ছবি: bdnews24.com
রাষ্ট্রপতির কাছে পত্র
উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে ১৮ তারিখ রাষ্ট্রপতি ও আচার্য আব্দুল হামিদের কাছে চিঠি পাঠান শিক্ষার্থীরা৷ সেখানে তারা লিখেন, ‘‘বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশ ডেকে এনে শিক্ষার্থীদের উপর এমন নৃশংস হামলা চালিয়ে শিক্ষার্থীদের মৃত্যুঝুঁকিতে ফেলায় শাবিপ্রবি উপাচার্য যেভাবে মূল কুশীলবের ভূমিকা পালন করেছেন তা সরাসরি সংবিধান বিরোধী এবং আপনার কর্তৃক ফরিদ উদ্দিন আহমেদের উপর অর্পিত দায়িত্বের বরখেলাপ৷’’
ছবি: bdnews24.com
আমরণ অনশন
উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদের পদত্যাগ ও পুলিশের দায়ের করা মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে ১৯ তারিখ থেকে আমরণ অনশন কর্মসূচি শুরু করেন শিক্ষার্থীরা৷ উপাচার্যের বাসভবনের সামনে বিকাল ৩টায় শুরু করা এই কর্মসূচিতে অংশ নেন নয়জন ছাত্রী ও ১৫ ছাত্র৷ অনশনকারীদের ঘিরে রাখেন অন্য ছাত্র-ছাত্রীরাও৷ এর আগে উপাচার্যের পদত্যাগের জন্য বেলা ১২টা পর্যন্ত সময় বেঁধে দেন তারা৷
ছবি: bdnews24.com
অসুস্থ হচ্ছেন শিক্ষার্থীরা
সময় যত গড়াচ্ছে তত স্তিমিত হচ্ছেন অনশনরত শিক্ষার্থীরা৷ আমরণ অনশন করা ১১ জন শিক্ষার্থী শুক্রবার পর্যন্ত অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন৷ এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘‘অনেকেই অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে; আমরা পর্যাপ্ত মেডিকেল সাপোর্ট পাচ্ছি না৷ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকেও আমাদের কোনো মেডিকেল সাপোর্ট দিচ্ছে না৷’’ আলোচনার জন্য কোষাধ্যক্ষের নেতৃত্বে একটি দল শিক্ষার্থীদের সঙ্গে দেখা করলেও উপাচার্যের কোনো সাড়া মিলছে না৷
ছবি: bdnews24.com
ফরিদ উদ্দিন আহমেদ কে
বিশ্ববিদ্যালয় ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ থেকে অনার্স, মাস্টার্স ও অস্ট্রেলিয়ার মোনাশ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমইসি ডিগ্রিধারী৷ তার কোনো ডক্টরেট ডিগ্রি নেই৷ অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ ২০০৯ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত টানা পাঁচ মেয়াদ ঢাবির সমাজ বিজ্ঞানের ডিন ছিলেন৷ সরকারপন্থি নীল দলের রাজনীতিতে যুক্ত এই শিক্ষক নেতা ২০১৭ সাল থেকে শাবিপ্রবির ভিসি৷