1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ট্রানজিট : বেশি লাভ আনতে পারে বন্দরের আধুনিকায়ন

হারুন উর রশীদ স্বপন ঢাকা
৫ মে ২০২৩

বাংলাদেশ থেকে পণ্য পরিবহণের স্থায়ী ট্রানজিট পেয়েছে ভারত৷ দেশটি বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহার করে উত্তর-পূর্ব ভারতীয় রাজ্যগুলোতে পণ্য পরিবহণ করতে পারবে৷

চট্টগ্রাম বন্দর৷
বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারত যত বেশি বাংলাদেশের বন্দর ব্যবহার করবে বাংলাদেশের লাভের পরিমাণ তত বেশি হবে৷ছবি: Md Manik/ZUMA Wire/imago images

২০২০ সালের জুলাই থেকে এ পর্যন্ত বিশেষ অনুমোদনে বাংলাদেশের বন্দর ব্যবহার করে ভারত কয়েকটি চালান উত্তর-পূর্ব ভারতীয় রাজ্যগুলোতে পাঠিয়েছে৷ তাতে দেখা যায় গত বছর মাশুল পেয়েছে সব মিলিয়ে আনুমানিক দুই লাখ টাকা৷ কিন্তু বিশ্লেষকরা বলছেন, এটার সঠিক কোনো হিসাব নিরূপণ করা হয়নি৷ তা হলে বোঝা যেতো ট্রানজিট দিয়ে বছরে বাংলাদেশ কত টাকা আয় করতে পারবে৷ তাছাড়া বিষয়টি নির্ভর করছে চাহিদা ও জোগানের ওপর৷

মাশুল নির্ধারণ করতে হবে দুই দেশের লাভের কথা চিন্তা করে৷ কেউ যেন এককভাবে লাভবান না হয়৷ কিন্তু বন্দর অব্যবহৃত রেখে লাভ নেই৷ 

বাংলাদেশ কী পাবে

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড স্থায়ী ট্রানজিটের আদেশে পণ্য পরিবহণে মাশুল নির্ধারণ করে দিয়েছে৷ প্রতি চালানের প্রসেসিং ফি ৩০ টাকা, প্রতি টনের জন্য ট্রান্সশিপমেন্ট ফি ২০ টাকা, নিরাপত্তা ফি ১০০ টাকা, কনটেইনার স্ক্যানিং ফি ২৫৪ টাকা এবং অন্যান্য প্রশাসনিক ফি ১০০ টাকা৷

এর বাইরে কনটেইনার বা গাড়ির জন্য কিলোমিটারপ্রতি এসকর্ট (পাহারা) ফি ৮৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে৷ আগে প্রতি চালানে এসকর্ট ফি ছিল ৫০ টাকা৷

এছাড়া ইলেকট্রিক লক ও সিল ফি নামের আরেকটি খাত রয়েছে৷ কনটেইনারে ইলেকট্রিক লক ও সিল ব্যবস্থা কার্যকর হওয়ার আগে এসকর্ট ফি আদায় করা হবে৷ ইলেকট্রিক সিল বাস্তবায়ন হলে তখন এসকর্ট ফি দিতে হবে না৷

সড়কের মাশুল

এর বাইরেও সড়কপথে পণ্য পরিবহণের জন্য সড়ক পরিবহণ ও সেতু মন্ত্রণালয়ের নির্ধারিত মাশুল দিতে হবে৷ প্রতি টন পণ্যে প্রতি কিলোমিটারে মাশুল এক টাকা ৮৫ পয়সা৷ মোট আটটি রুটের মাশুল নির্ধারণ করা হয় ২০২১ সালে৷ এই রুটগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দূরত্ব মোংলা বন্দর-গোপালগঞ্জ-মাওয়া-ঢাকা-নরসিংদী-আশুগঞ্জ-সিলেট-তামাবিল রুটের৷ এই রুটে ৪৩৫ কিলোমিটার দূরত্বের জন্য টোলসহ মাঝারি পণ্য পরিবহণক্ষমতার ট্রাকের আদায়যোগ্য মাশুল নির্ধারণ করা হয়েছে ১২ হাজার ১৯৫ টাকা৷ আর সবচেয়ে কম দূরত্ব চট্টগ্রাম বন্দর-ফেনী-কুমিল্লা-বিবিরবাজার রুটের, ১৪৩ কিলোমিটার৷ এই রুটে সড়কপথের মাশুল তিন হাজার ৯৮৮ টাকা৷ আর সব ধরনের মাশুলের ওপর নির্ধারিত হারে ভ্যাট দিতে হবে৷

বিভিন্ন পর্যায়ে কথা বলে জানা গেছে, বন্দর, কাস্টম, সিঅ্যান্ডএফ, পরিবহণসহ সবমিলিয়ে ২০ ফুট দীর্ঘ একটি কনটেইনারে বাংলাদেশের আয় হতে পারে ৭০০ থেকে ৮০০ ডলার৷ ২০২০ সালে প্রথম জাহাজে চারটি কনটেইনারে ১০৩ টন পণ্য আসে৷ সব মিলিয়ে বাংলাদেশ পেয়েছে প্রায় ৫৯ হাজার টাকা৷

ভারতের কী সুবিধা

উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাতটি রাজ্যে পণ্য নিতে চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহার করে ভারতের অর্থ ও সময় সাশ্রয় হবে ৷ সময় এবং দূরত্বেও লাভবান হবে তারা৷ ট্যারিফ কমিশনের কোর কমিটি ট্রানজিট হলে কোনো রুট দিয়ে পণ্য নিলে কার কত অর্থ সাশ্রয় হবে সে ব্যাপারে তাদের রিপোর্টে এ নিয়ে ধারণা পাওয়া যায়৷ বাংলাদেশকে মাশুল দেয়ার পরও তামাবিল-চট্টগ্রামে ১২ শতাংশ, আখাউড়া-চট্টগ্রামে ৭০ শতাংশ, আখাউড়া-বেনাপোলে ৪৮ শতাংশ, সুতারকান্দি-বেনাপোলে ৩৩ শতাংশ, সুতারকান্দি-চট্টগ্রামে ৫৩ শতাংশ, বাংলাবান্ধা-মোংলা ২৯ শতাংশ, বুড়িমারী-মোংলা ১২ শতাংশ, শাহবাজপুর-চট্টগ্রাম ৬৭ শতাংশ, আখাউড়া-দর্শনা ৭০ শতাংশ, রায়মঙ্গল-আশুগঞ্জে প্রায় ৫০ শতাংশ এবং শাহবাজপুর-দর্শনা রুটে ট্রানজিট সুবিধা পেলে ভারতের সাশ্রয় হবে ৫৭ শতাংশ খরচ৷

ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলার সঙ্গে কলকাতার দূরত্ব এক হাজার ৬৮০ কিলোমিটার৷ আর চট্টগ্রাম বন্দর থেকে আগরতলার দূরত্ব মাত্র ২৪৮ কিলোমিটার৷ মেঘালয়ের রাজধানী শিলংয়ের সঙ্গে কোলকাতার দূরত্ব এক হাজার ১৫০ কিলোমিটার হলেও চট্টগ্রাম বন্দর থেকে এ দূরত্ব ৫৭০ কিলোমিটার৷ মিজোরামের রাজধানী আইজলের সঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দরের দূরত্ব ৬৫৫ কিলোমিটার আর কলকাতার দূরত্ব এক হাজার ৫৫০ কিলোমিটার৷ নাগাল্যান্ডের রাজধানী কোহিমার সঙ্গে বন্দরের দূরত্ব ৮৮০ কিলোমিটার হলেও কলকাতার দূরত্ব এক হাজার ৪৫০ কিলোমিটার৷ কলকাতা থেকে অন্যান্য রাজ্যের দূরত্বও চট্টগ্রামের তুলনায় গড়ে তিন গুণের বেশি৷ উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাত রাজ্যে পণ্য পরিবহণে ভারত সরকারের সময় ও অর্থ দুটিই বেশি যাচ্ছে৷ বাংলাদেশের ওপর দিয়ে সাত রাজ্যে পণ্য পরিবহণ শুরু হওয়ায় এখন আগের চেয়ে ভারতের  খরচ কমে যাবে৷

নেপাল-ভুটানে ফ্রি ট্রানজিটের কত দূর?

২০২২ সালে সেপ্টেম্বরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময় বাংলাদেশকে তৃতীয় দেশে পণ্য রপ্তানির জন্য বিনা মাশুলে ভারত ট্রানজিট সুবিধার প্রস্তাব দেয়৷ এটা কার্যকর হলে নেপাল ও ভুটানে পণ্য রপ্তানিতে সুবিধা পাবে বাংলাদেশ৷ তবে এর আগেই মাশুল দিয়ে ২০২১ সালে বাংলাদেশ থেকে নেপালে সার রপ্তানিতে ট্রানজিট সুবিধা দিয়েছে ভারত৷ চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার রহনপুর ও ভারতের সিঙ্গাবাদ রেলপথ দিয়ে এই ট্রানজিট সুবিধা দেওয়া হয়েছে৷ তবে এখনো সার্বিক ট্রানজিট ও ফ্রি ট্রানজিট সুবিধা পাওয়া যায়নি৷
নেপাল ও ভুটানে বাংলাদেশের পণ্যের বাজার সম্প্রসারিত হচ্ছে৷ নেপালে বাংলাদেশের প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ, ওয়ালটন, আসবাবপত্রের প্রতিষ্ঠান হাতিলসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান পণ্য রপ্তানি করে৷ পণ্যের তালিকায় আছে মোটরসাইকেল, ফ্রিজ, টেলিভিশন, আসবাব, খাদ্যজাত পণ্য ইত্যাদি৷ ভুটানে যায় জুস, ড্রিংক, পোশাকসহ বিভিন্ন পণ্য৷

প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের বিপণন পরিচালক কামরুজ্জামান কামাল বলেন, ‘‘এখনো ট্রানজিট সুবিধা নেপাল-ভুটানে পাওয়া যাচ্ছে না৷ পাওয়া গেলে আমাদের সময় এবং খরচ অনেক বেঁচে যেত৷ আর নেপালে আমরা উচ্চ শুল্কের শিকার হচ্ছি৷ ভারতীয় পণ্যের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ শুল্ক দিতে হয় বাংলাদেশি পণ্যের৷’’

ওয়ালটনের বিপণন পরিচালক হুমায়ুন কবিরও বলেন, ‘‘ট্রানজিট সুবিধা পেলে আমাদের পণ্য রপ্তানি খরচ অনেক কমে যেতো৷’’

২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে এক হাজার ৬৭ কোটি নেপালি রুপির সমপরিমাণ পণ্য রপ্তানি হয়েছে দেশটিতে৷ অন্যদিকে নেপাল থেকে বাংলাদেশে এসেছে ৬৭ কোটি রুপির পণ্য৷

বিশ্লেষকরা যা বলছেন

সিরডাপের পরিচালক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক মো. হেলাল উদ্দিন মনে করেন, ‘‘ট্রানজিট বিশ্বের অনেক দেশেই আছে৷ আমাদের রাজনৈতিক বিতর্ক এড়িয়ে এর সুবিধা আমরা কীভাবে নেবো সেই দিকে মনোযোগ দিতে হবে৷’’

তিনি বলেন, ‘‘ভারত তো লাভবান হবে৷ সেভেন সিস্টারে তার পণ্য পরিবহণ খরচ অনেক কমে যাবে৷ এখন আমাদের দেখতে হবে৷ সে যতটা লাভবান হবে তার কত অংশ বাংলাদেশ নিতে পারে৷ বাংলাদেশের কাঠামোগত উন্নয়ন, সড়কসহ আরো অনেক খরচ আছে, সেগুলো হিসাব করে মাশুলের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হবে৷ বিষয়টি হতে হবে উভয় পক্ষের লাভবান হওয়ার৷’’

তার মতে, ‘‘আমরা তো এখনো কোনো জরিপ করিনি যে, ভারত বছরে কত পণ্য পরিবহণ করবে তা বুঝবো৷ সেটা করা উচিত৷ মোট কথা, আমাদের খরচের সঙ্গে লাভের সমন্বয় করতে হবে৷ এটা যেন এক পক্ষের লাভের বিষয় না হয়৷ আর আমাদের বার্গেইনিং ক্যাপাসিটির ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে৷’’

আমরা আমাদের বন্দরের চাহিদা বাড়াতে পারলে মাশুল বাড়াতে পারবো: ড. আহসান এইচ মনসুর

This browser does not support the audio element.

আর পলিসি রিচার্স ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এবং অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘‘কে বেশি লাভ পেলো সেই বিতর্ক না করে আমাদের ব্যবসাটা মাথায় রাখতে হবে৷ এরপর মাতারবাড়ি আসছে৷ বন্দর বসিয়ে রেখে লাভ নাই৷ আমাকে ব্যবসা করতে হবে৷ আর সেটা করতে হলে বন্দরের ওপর ভারতের নির্ভরশীলতা বাড়াতে হবে৷ তখন আমরা বেশি আয় করতে পারবো৷’’

তিনি বলেন, ‘‘এই বন্দর শুধু ভারত কেন, অন্যদেশও ব্যবহার করবে৷ তাই বন্দরকে আধুনিক এবং সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন করতে হবে৷ আর সব সময় আমাদের আয়ের খাতগুলো আমাদের বুঝে নিতে হবে৷ বন্দরের ব্যবহার যত বাড়বে, আমাদের আয় বাড়বে ৷ আমরা তখন বেশি মাশুল নিতে পারবো৷’’

বাংলাদেশ মাশুল কম নিচ্ছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘এটা তো ডিমান্ড সাপ্লাইয়ের মতো৷ আমরা আমাদের বন্দরের চাহিদা বাড়াতে পারলে মাশুল বাড়াতে পারবো৷ দুই দেশই যেন লাভবান হয়, সেটা বিবেচনা করে সব ধরনের মাশুল নির্ধারণ করতে হবে৷’’

তারা মনে করেন, এই ট্রানজিটে পরিবহণ থেকে আয়ের একটা বড় সুযোগ আছে৷ ভারত থেকে যাতে বাংলাদেশি জাহাজে পণ্য আনা যায়, সেদিকে নজর দিতে হবে৷ আর বন্দরের সুযোগ-সুবিধা বাড়িয়ে শুল্ক বাড়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য
স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ