জার্মানিতে তিন দলের তথাকথিত ‘ট্রাফিক লাইট কোয়ালিশন' সরকার গঠনের সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়ে উঠছে৷ অন্যদিকে ম্যার্কেলের শিবিরের কোণঠাসা নেতা আরমিন লাশেট নেতৃত্ব থেকে সরে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত দিয়েছেন৷
বিজ্ঞাপন
২৬শে সেপ্টেম্বর জার্মানির সংসদ নির্বাচনের পর চারটি দল জোট সরকার গঠনের নানা সম্ভাবনা খতিয়ে দেখছে৷ বৃহস্পতিবার নির্বাচনে জয়ী সামাজিক গণতন্ত্রী এসপিডি দল, পরিবেশবাদী সবুজ দল ও উদারপন্থি এফডিপি দল ত্রিপাক্ষিক আলোচনা চালিয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে৷ আগামী সপ্তাহে তিন পক্ষ আরো বিস্তারিত আলোচনায় বসবে৷ প্রাথমিক এই সংলাপে প্রক্রিয়ায় ইতিবাচক সাড়া পেলে আনুষ্ঠানিকভাবে জোট সরকার গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হবার কথা৷ তিন দলের লাল, হলুদ ও সবুজ রংয়ের প্রতীকের পরিপ্রেক্ষিতে এমন জোটকে ‘ট্রাফিক লাইট কোয়ালিশন' হিসেবে বর্ণনা করা হয়৷
এদিকে নির্বাচনের ফল প্রকাশের পর সরকার গড়ার দাবি জানিয়েও ধীরে ধীরে পিছু হটছিলেন ম্যার্কেলের শিবিরের চ্যান্সেলর পদপ্রার্থী আরমিন লাশেট৷ নিজের সিডিইউ দল ও ইউনিয়ন শিবিরের মধ্যে প্রবল সমালোচনা ও বিরোধিতার মুখে শুক্রবার তিনি নেতৃত্ব থেকে সরে দাঁড়ানোর ইচ্ছা প্রকাশ করলেন৷ তবে আচমকা পদত্যাগ না করে তিনি ধাপে ধাপে নেতৃত্ব বদলের প্রক্রিয়ায় ‘সমন্বয়' করতে চান৷ সেইসঙ্গে ইউনিয়ন শিবিরের নেতৃত্বে আগামী সরকার গঠনের ইচ্ছাও ত্যাগ করতে প্রস্তুত নন তিনি৷ অর্থাৎ লাশেটের মতে, তিনি নিজে সরে দাঁড়ালেও ইউনিয়ন শিবির ‘জামাইকা কোয়ালিশন' সরকারের নেতৃত্ব দিতে এখনো প্রস্তুত৷
আরমিন লাশেট নিজের প্রস্থানের গতিপথ স্থির করতে চাইলেও দল ও শিবিরের মধ্যে বিভ্রান্তি ও অরাজকতার পরিপ্রেক্ষিতে সেই প্রক্রিয়ার উপর তাঁর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সংশয় রয়েছে৷ শূন্যস্থান পূরণ করতে অনেক নেতাই তৎপরতার ইঙ্গিত দিয়েছেন৷ ঐকমত্যের ভিত্তিতে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতার হস্তান্তর সম্ভব না হলে রক্ষণশীল শিবির আরও সংকটের মধ্যে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে৷
জার্মানিতে ব্যালট বাক্স থেকে সরকার গঠনের দীর্ঘ প্রক্রিয়া
জনগণের ইচ্ছার ন্যায্য প্রতিফলন ঘটাতে গিয়ে জার্মানির নির্বাচন প্রক্রিয়া বেশ জটিল হয়ে উঠেছে৷ অনেক নাগরিকেরও সব খুঁটিনাটি বিষয় সম্পর্কে ধারণা নেই৷ এমনই কিছু বৈশিষ্ট্যের দিকে নজর দেওয়া যাক৷
ছবি: picture-alliance/dpa/D. Kalker
নেই আলাদা ভোটার তালিকা
জার্মানিতে স্থায়ীভাবে বসবাসকারী সব মানুষকেই পৌর কর্তৃপক্ষের কাছে নাম নিবন্ধন করতে হয়৷ তাই সেই তালিকা থেকে শুধু জার্মান নাগরিকদের বেছে নিয়ে ডাকযোগে ভোট দেবার আমন্ত্রণ পাঠানো হয়৷ জাতীয় পরিচয়পত্র ও সেই আমন্ত্রণপত্র নিয়ে নির্ধারিত ভোটগ্রহণ কেন্দ্রে গেলেই ভোট দেওয়া যায়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/J. Güttler
ডাকযোগে ভোট দেবার সুযোগ
ভোটার হিসেবে আমন্ত্রণপত্র পেলে সশরীরে ভোট না দিলেও চলবে৷ কোনো কারণ না দেখিয়ে পোস্টাল ব্যালটের মাধ্যমে আগেভাগেই ভোট দেওয়া সম্ভব৷ যে সব জার্মান নাগরিক বিদেশে থাকেন, তারাও জার্মানিতে তাদের সর্বশেষ বাসস্থানের পৌরসভার মাধ্যমে পোস্টাল ব্যালট সংগ্রহ করতে পারেন৷
ছবি: Jens Krick/Flashpic/picture alliance
নাগরিকদের দুটি করে ভোট
জার্মানির সংসদ নির্বাচনে ভোটাররা দুটি করে ভোট দেবার সুযোগ পান৷ প্রথমটি নির্বাচনি কেন্দ্রে সরাসরি প্রার্থী বাছাইয়ের জন্য, দ্বিতীয়টি পছন্দের কোনো দলের জন্য৷ প্রার্থী ও দল ভিন্ন হলেও চলবে৷ দ্বিতীয় তালিকায় দলীয় সমর্থনের অনুপাতের ভিত্তিতে সংসদে অর্ধেক আসনে প্রার্থী স্থির করা হয়৷
ছবি: C. Ohde/blickwinkel/McPHOTO/picture alliance
‘বোনাস’ ভোটের জটিল হিসেব
ভোটারদের দেওয়া প্রথম ভোটের ভিত্তিতে ২৯৯ জন স্থানীয় প্রার্থীর সরাসরি এবং দ্বিতীয় ভোটের ভিত্তিতে বাকি ২৯৯ জনের দলীয় মনোনয়ন অনুযায়ী সংসদে আসন পাওয়ার কথা৷ কিন্তু বাস্তবে সংসদে সদস্যসংখ্যা ৫৯৮ ছাপিয়ে যায়৷ কোনো দল যদি শতকরা হিসেবে দ্বিতীয় ভোটের তুলনায় বেশি মাত্রায় প্রথম ভোট পায়, তখন জটিল এক নিয়মের ভিত্তিতে সেই দল সংসদে কিছু বাড়তি আসন লাভ করে৷ তখন ‘ক্ষতিপূরণ’ হিসেবে বাকি দলগুলিকেও বেশি আসন দিতে হয়৷
সব দল সংসদে স্থান পায় না
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে জার্মানির গণতন্ত্রের দুর্বলতা কাটাতে সংবিধান প্রণেতারা অপেক্ষাকৃত ছোট দলগুলির ক্ষমতা সঙ্কুচিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন৷ দ্বিতীয় ভোটের কমপক্ষে পাঁচ শতাংশ না পেলে কোনো দল সংসদের নিম্ন কক্ষ বুন্ডেসটাগে স্থান পায় না৷ তবে নির্বাচনি কেন্দ্রে কমপক্ষে তিনটি আসন পেলেও সংসদীয় দলের মর্যাদা পাওয়া সম্ভব৷
ছবি: Tim Brakemeier/dpa/picture alliance
ভোটগ্রহণের দিন রোববার
জার্মানিতে ভোটগ্রহণের জন্য সাধারণত রোববারের দিনটিকেই বেছে নেওয়া হয়৷ নাগরিকেরা ছুটির দিনে নির্বিঘ্নে ভোট দেবার সুযোগ পান৷ সন্ধ্যা ছয়টার মধ্যে ভোটগ্রহণ শেষ হলে গণনা শুরু হয়৷ শিল্পোন্নত দেশ হয়েও জার্মানি নিরাপত্তার খাতিরে এখনো ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন ব্যবহার করে না৷ কাগজের ব্যালট গণনার পর দ্রুত ফলাফল জানতে অবশ্য প্রযুক্তির প্রয়োগ বাড়ছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/J.Stratenschulte
ভোটের ফল প্রকাশের পর জনগণ ‘ক্ষমতাহীন’
নির্বাচনি প্রচারের শেষে ভোট দেবার সময় পর্যন্ত ভোটাররা পছন্দের প্রার্থী ও দলকে বেছে নিতে পারেন৷ তবে জার্মানিতে সাধারণত জোট সরকার ক্ষমতা গড়ে৷ নির্বাচনের পর আসনসংখ্যার বিচারে সবচেয়ে শক্তিশালী দল জোট গড়ার উদ্যোগ শুরু করে৷ সাধারণত প্রাথমিক আলাপ-আলোচনার পর নির্দিষ্ট শরিক দলের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠকের প্রক্রিয়া শুরু হয়৷ দলীয় কর্মসূচি নিয়ে দরকষাকষির পর জোট সরকারের ন্যূনতম সাধারণ কর্মসূচি স্থির হয়৷
এমন ভঙ্গুর অবস্থায় কোনো জোট সরকারের নেতৃত্ব দেবার ক্ষমতা তাই বড় প্রশ্নের মুখে পড়ছে৷ অর্থাৎ কোনো কারণে ‘ট্রাফিক লাইট কোয়ালিশন' গড়ার উদ্যোগ বিফল হলে ‘জামাইকা কোয়ালিশন' সরকার গঠন করা আদৌ সম্ভব হবে কিনা, তা স্পষ্ট নয়৷
এদিকে বিদায়ী চ্যান্সেলর হিসেবে আঙ্গেলা ম্যার্কেল রোম সফরে গিয়ে বলেছেন, তার মতে জার্মানিতে যথেষ্ট দ্রুত আগামী সরকার গঠিত হবে৷ চার বছর আগের মতো দীর্ঘ অপেক্ষার প্রয়োজন হবে না৷ এসপিডি, এফডিপি ও সবুজ দলও দেশের স্বার্থে জোট সরকার গড়ার লক্ষ্যে দ্রুত পদক্ষেপের আশা প্রকাশ করছে৷ তবে এফডিপি দলের নেতা ক্রিস্টিয়ান লিন্ডনার স্পষ্ট জানিয়েছেন যে, তার দল সমান্তরালভাবে দুটি জোট নিয়ে আলোচনা করবে না৷ ইউনিয়ন শিবিরে নেতৃত্ব বদল সত্ত্বেও তিনি বিচলিত নন৷ লিন্ডনার বলেন, জোট সরকার গঠনের ক্ষেত্রে ব্যক্তি নয়, কর্মসূচির ক্ষেত্রে যথেষ্ট মিল থাকা জরুরি৷ উল্লেখ্য, এফডিপি এবং সবুজ দল এখনো ইউনিয়ন শিবিরের সঙ্গে জোটের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয় নি৷