জি-৭ নেতারা বাণিজ্য নিয়ে, এমনকি একটি যৌথ বিবৃতি তৈরি করতেও হিমসিম খাচ্ছেন৷ যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের চিন্তাভাবনায় এত পার্থক্য যে, এর সমাধানের পথ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না৷
বিজ্ঞাপন
জি-৭ শীর্ষ সম্মেলনের শুক্রবার ছিল প্রথম দিন৷ দিনের আলোচনা শেষে মার্কিন প্রেসিডেন্ট যদিও দাবি করেছেন যে, ‘অনেক অগ্রগতি' হয়েছে, কিন্তু আদতে পশ্চিমা এই দেশগুলো বাণিজ্য, জলবায়ু ও ইরানের পরমাণু চুক্তি বিষয়ে দ্বিধাবিভক্তই রয়ে গেছে৷
এবারের সম্মেলনের আয়োজক ক্যানাডা কয়েকদিন আগেই মন্তব্য করে যে, প্রতিবেশী দেশটি ও ইউরোপের ওপর ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়ামের ওপর যে আমদানি শুল্ক বসিয়েছে, তা ‘অবৈধ'। এই শুল্ক তুলে নেয়ার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ নেই বলেই মনে হচ্ছে৷
‘অর্থনৈতিক নিরাপত্তা'র কথা ভেবে এই শুল্ক বসানো হয়েছে বলে ট্রাম্প প্রশাসনের যুক্তি বরং যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের মধ্যে এক ধরনের বাণিজ্য যুদ্ধের অবকাশ তৈরি করেছে বলে মত বিশ্লেষকদের৷ এবারের জি-৭ সম্মেলনে এর কতটুকু সমাধান হবে, তা এখনো নিশ্চিত নয়৷
ট্রাম্পের সঙ্গে দু'বার বৈঠকের পর ফ্রেঞ্চ প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাক্রোঁ বলেন যে, ‘খোলাখুলি' আলোচনা হয়েছে৷ তবে সমাধান হয়েছে বা হতে যাচ্ছে এমন কোনো ইঙ্গিত দিতে পারেননি তিনি৷
জাস্টিন ট্রুডোর অফিস জানায়, ক্যানাডার প্রধানমন্ত্রী ট্রাম্পকে বলেন, জাতীয় অর্থনৈতিক নিরাপত্তার নামে শুল্ক আরোপ কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়৷ দুই নেতার দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে এ কথা বলেন তিনি৷ ট্রাম্প সেখানে মুখ বাঁচানো কথাবার্তা বলেন বলে জানা যায়৷
সব মিলিয়ে এবারের জি-৭ বৈঠকের পর যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা বিশ্বের পথচলা সামনে আরো কঠিন হয়ে পড়বে বলেই মনে করা হচ্ছে৷ ইউরোপীয় কাউন্সিল প্রধান ডোনাল্ড টাস্কের ভাষায়, ‘‘আমি শঙ্কিত, এভাবে চললে পৃথিবীতে শৃঙ্খলা বলে আর কিছু থাকবে না৷ বিস্ময়ের ব্যাপার এর কারণ হিসেবে যাদের আমরা সবসময় দায়ি করি তারা নয়, এর কারণ হবে যারা সবসময় শৃঙ্খলা রক্ষার কথা বলে, সেই যুক্তরাষ্ট্র৷''
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে জি-৭-এর অন্য দেশগুলো যেমন, ক্যানাডা, ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি, জাপান ও ইটালির সঙ্গে মতবিরোধ এই প্রথম এমন অবস্থায় গিয়েছে যে, একটি সম্মেলনের একটি যৌথ বিবৃতি তৈরি করতে হিমসিম খাচ্ছেন কর্মকর্তারা৷
টুইট বার্তায় মাক্রোঁ বলেই দিয়েছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়াই যৌথ বিবৃতিতে স্বাক্ষর করবেন অন্য নেতারা৷
‘‘একা হতে সমস্যা নেই মার্কিন প্রেসিডেন্টের৷ আমাদেরও সমস্যা নেই, তাঁকে ছাড়া কোনো চুক্তিতে সই করতে৷'' টুইট করেন তিনি৷
Trump goes it alone: Europe at a loss?
26:00
ক্যানাডা থেকে শনিবার সকালেই ফিরে যাবার কথা ট্রাম্পের৷ কারণ মঙ্গলবার তাঁর সঙ্গে উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট কিম জং উনের ঐতিহাসিক সাক্ষাৎ হবার কথা সিঙ্গাপুরে৷ সেজন্য প্রস্তুতি দরকার৷
বাণিজ্য যুদ্ধ হলে কী ক্ষতি হবে?
ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর ‘অ্যামেরিকা ফার্স্ট’ নীতি রূপায়ন করতে আমদানির পথে বাধা সৃষ্টি করছেন৷ সেই ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ফলে আন্তর্জাতিক মুক্ত বাণিজ্য কাঠামোর মারাত্মক ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে৷ তারই কিছু দৃষ্টান্ত তুলে ধরা হলো৷
ছবি: Imago/Ralph Peters
বাণিজ্য যুদ্ধের অর্থ কী?
কোনো দেশ কোনো এক বা একাধিক পণ্য আমদানির উপর কর, শুল্ক বা অন্য কোনো আর্থিক বোঝা চাপালে বাকি দেশগুলিও পালটা পদক্ষেপ নিতে পারে৷ বিশেষ করে অ্যামেরিকা ও চীনের মতো বিশাল দেশের সংঘাতের জের ধরে গোটা বিষয়টি আন্তর্জাতিক স্তরে বাণিজ্য যুদ্ধের আকার নিতে পারে, যা নিয়ন্ত্রণে আনা মোটেই সহজ হবে না৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/T. Peter
অতীত দৃষ্টান্ত
১৯৩০-এর দশকে শেষ বাণিজ্য যুদ্ধের জের ধরে ‘গ্রেট ডিপ্রেশন’ বা বিশাল মন্দা আরও মারাত্মক আকার ধারণ করেছিল৷ মার্কিন প্রেসিডেন্ট হার্বার্ট হুবার সে বছর শুল্ক সংক্রান্ত নতুন আইন কার্যকর করার ফলে ২০ হাজারেরও বেশি পণ্যের উপর শুল্ক চাপানো হয়েছিল৷ ট্রাম্প প্রশাসন অবশ্য দাবি করছে যে, এ ক্ষেত্রে শুধু নির্দিষ্ট কিছু পণ্য ও দেশের জন্য শুল্ক চাপানো হচ্ছে৷
ছবি: Reuters/Library of Congress
ট্রাম্প কেন বাণিজ্য যুদ্ধের পথে এগোচ্ছেন?
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য প্রতিকূল বাণিজ্য ঘাটতির বিরুদ্ধে শুরু থেকেই তোপ দেগে এসেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প৷ তবে সমালোচকদের মতে, এমন সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির ফলে তিনি অ্যামেরিকার সার্বিক বাণিজ্যিক সম্পর্কের স্বার্থ দেখতে পাচ্ছেন না৷ কারণ, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক কাঠামো তোলপাড় হয়ে গেলে আখেরে অ্যামেরিকারই ক্ষতি হবে৷ ডলারের বিনিময় মূল্য বেড়ে যাবে, রপ্তানি কমে যাবে এবং প্রবৃদ্ধি ক্ষতিগ্রস্ত হবে৷
ছবি: picture-alliance/K. Ohlenschläger
পালটা পদক্ষেপ
ট্রাম্প প্রশাসন একের পর এক শাস্তিমূলক পদক্ষেপ ঘোষণা করলে বাকি দেশগুলিও হাত গুটিয়ে বসে থাকবে না৷ ক্যানাডা, মেক্সিকো, চীন, জাপান, ব্রাজিল ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন অ্যামেরিকার বিরুদ্ধেও পালটা পদক্ষেপের প্রস্তুতি নিচ্ছে৷ এমন বাণিজ্য যুদ্ধ এড়াতে দ্বিপাক্ষিক বোঝাপড়ার চেয়ে বহুপাক্ষিক সমাধানসূত্রের পরামর্শ দিচ্ছেন অর্থনীতি বিশেষজ্ঞরা৷
ছবি: Reuters/W. Rattay
অ্যামেরিকার ক্ষতি
সব সাবধানবাণী উপেক্ষা করে ট্রাম্প যদি সত্যি আমদানির উপর বাড়তি শুল্ক চাপান, তার পরিণতি অ্যামেরিকার জন্যও ইতিবাচক হবে না৷ যেমন, ইস্পাত আমদানির উপর শুল্ক চাপালে অ্যামেরিকার বাজারেও তার মূল্য বেড়ে যাবে৷ তার ফলে মার্কিন ইস্পাত কোম্পানিগুলির লাভ হলেও ক্রেতাদের বাড়তি মূল্য গুনতে হবে৷ যে কোম্পানিগুলি ইস্পাত ব্যবহার করে পণ্য উৎপাদন করে, তাদের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাবে৷
ছবি: picture alliance/dpa/R. Weihrauch
পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া
অ্যামেরিকায় ইস্পাত রপ্তানি করতে না পারলে চীন ইউরোপের বাজারে তা আরও সস্তায় বিক্রি করার চেষ্টা করতে পারে৷ স্বাভাবিক বাণিজ্য ব্যাহত হলে এমন আরও দৃষ্টান্ত দেখা যেতে পারে৷ সামগ্রিকভাবে এমন অস্বাভাবিক প্রবণতা নানাভাবে সাধারণ মানুষের জন্য ক্ষতিকর হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে৷ সাম্প্রতিক নানা সংকট কাটিয়ে বিশ্ব অর্থনীতি যখন সবে মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে, তখন নতুন করে এমন বিপদ দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে উঠছে৷
ছবি: picture alliance/dpa/XinHua
আইনি লড়াই
আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সংগঠন ডাব্লিইউটিও সাম্প্রতিক কালে বিশ্ব বাণিজ্যের বিধিনিয়ম স্থির করে এসেছে এবং বিবাদ মেটানোর চেষ্টা করেছে৷ বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু হলে মামলার সংখ্যা আরও বেড়ে যাবে৷ সব পক্ষ ডাব্লিইউটিও-র রায় না মানলে এই সংগঠন অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়তে পারে৷ এমন কাঠামো তার কার্যকারিতা হারালে ভবিষ্যতে সেই ক্ষতি পূরণ করা সহজ হবে না৷