হাতে সময় আর এক সপ্তাহ। তার মধ্যেই অ্যামেরিকার সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি করতে হবে ভারতকে। না হলে বর্ধিত শুল্ক দিতে হবে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প চান, ভারত কৃষি, ডেয়ারিসহ বিভিন্ন পণ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক কম করুক। ছবি: Andrew Caballero-Reynolds/AFP/Getty Images
বিজ্ঞাপন
গত কয়েক মাস ধরে সমানে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে আলোচনা চলছে। সেই আলোচনা এখনো চলছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প আবার বলেছেন, ''আমার মনে হয়, আমরা ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি করতে চলেছি। এটা অন্য ধরনের চুক্তি হবে। এটা এমন একটা চুক্তি হবে, যেখানে আমরা ভিতরে ঢুকতে পারব। এখন ভারত কাউকে(পণ্যকে) ভিতরে ঢুকতে দেয় না। আমি মনে করি, এবার তারা দেবে। ভারত যদি এবার ঢুকতে দেয়, তাহলে আমরা অনেক কম শুল্ক চালু করে চুক্তি করতে পারব।''
ট্রাম্প আগেও বলেছেন এবং আবার খুব স্পষ্ট করে বলেছেন, চুক্তি করতে গেলে অ্যামেরিকাকে ভারতের বাজারে ঢুকতে দিতে হবে। ভারত নিজের দেশের সংস্থা, কৃষক ও ব্যবসায়ীদের স্বার্থ সুরক্ষিত রাখতে প্রচুর শুল্ক বসিয়ে রেখেছে। অ্যামেরিকা চাইছে, ভারত এই শুল্ক অনেকটা কম করে কৃষি, ডেয়ারি ও নির্দিষ্ট শিল্পক্ষেত্রে মার্কিন পণ্য ও সংস্থার প্রবেশের পথ প্রশস্থ করুক। না হলে চড়া হারে শুল্ক বসিয়ে ভারতীয় পণ্যের অ্যামেরিকায় ঢোকার পথ বন্ধ করে দেয়া হবে।
ভারতের সমস্যা
অ্যামেরিকায় এখন ভারতীয় প্রতিনিধিদল মার্কিন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে আলোচনা করছেন। এই প্রতিনিধিদলের নেতা হলেন রাজেশ আগরওয়াল। তার ভারতে ফিরে আসার কথা ছিল। কিন্তু আলোচনা শেষ হয়নি বলে তিনি এখনো থেকে গেছেন।
নিউজউইক পত্রিকাকে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শংকর বলেছেন, ''খুবই জটিল বাণিজ্য আলোচনা চলছে। আশা করি, আলোচনা সফল হবে। কিছু গিভ অ্যান্ড টেক বা দেয়া-নেয়ার বিষয় থাকবে।''
ওয়াশিংটন সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের রিচার্ড রসো বিবিসিকে বলেছেন, ''যুক্তরাষ্ট্র ভারতের কৃষিক্ষেত্রে ঢুকতে চায়। আর আর্থিক ও রাজনৈতিক কারণে ভারত তাদের কৃষকদের রক্ষা করতে চায়।''
ওয়াশিংটন চায় ভারত আপেল, বাদাম, জেনেটিক্যৈালি মডিফায়েড(জিএম) শস্যের উপর শুল্ক কমাক। এর ফলে অ্যামেরিকা এই সব পণ্য ভারতে রপ্তানি করতে পারবে। ভারত দুধ ও দুধজাত পণ্যের উপর শুল্ক কম করুক।
ট্রাম্পের শুল্কের চাপ বিশ্বব্যাপী যেমন প্রভাব ফেলতে পারে
ঘোষণার এক সপ্তাহ পর ৯০ দিনের জন্য পারস্পরিক শুল্ক স্থগিত করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প৷ ছবিঘরে ট্রাম্পের পাল্টা শুল্ক কোথায় কী প্রভাব ফেলতে পারে তার বিস্তারিত...
ছবি: Mark Schiefelbein/AP Photo/picture alliance
শুল্কের ঘোষণা
২ এপ্রিল বিশ্বের সব দেশের পণ্য আমদানির উপর নানা হারে বাড়তি শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেন ডনাল্ড ট্রাম্প৷ ঘোষণার এক সপ্তাহ পর অবশ্য চীন, ক্যানাডা ও মেক্সিকো ছাড়া বাকি রাষ্ট্রগুলোর উপর আরোপিত শুল্ক ৯০ দিনের জন্য স্থগিত করেছেন ট্রাম্প৷ ৯০ দিন পর যদি এই শুল্ক তিনি আবার আরোপ করেন, তাহলে ভোক্তা পর্যায় থেকে শুরু করে বিশ্ব অর্থনীতি ও রাজনীতি- সব জায়গাতেই এর মারাত্মক প্রভাব পড়বে বলে আশঙ্কা বিশ্লেষকদের৷
ছবি: Jim Lo Scalzo/UPI Photo/Newscom/picture alliance
মার্কিন শুল্কের ইতিহিস
অ্যামেরিকার বাণিজ্যের শুরুর দিক থেকেই শুল্ক আরোপের ইতিহাস রয়েছে৷ দেশটি ১৮২০ সালে বিদেশি পণ্যের উপর ৩০ ভাগের মতো শুল্ক আরোপ করেছিল৷ ১৯৩০ সালে ফেডারেল ইনকাম ট্যাক্স দপ্তর গঠনের পর থেকে শুল্ক কমাতে থাকে যুক্তরাষ্ট্র৷ ডনাল্ড ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে শুল্ক নিয়ে চীনের সাথে বাদানুবাদ শুরু হয়৷ ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে, অর্থাৎ, ১৮২০ সালের দুইশ বছর পর মার্কিন শুল্কের হার আকাশচুম্বী হয়ে ওঠে৷
ছবি: Liu Jie/Xinhua/IMAGO
শুরু হয় ‘শুল্ক-যুদ্ধ’
ডনাল্ড ট্রাম্পের শুল্ক আরোপের ঘোষণার পর এশিয়ার বৃহৎ অর্থনীতির দেশ চীন যুক্তরাষ্ট্রের সব পণ্যের ওপর শুল্ক বাড়িয়ে ৮৪ শতাংশ করে, যা আগে ছিল ৩৪ শতাংশ৷ পাল্টা জবাব দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট৷ চীনা পণ্যের উপর ১৪৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেন ডনাল্ড ট্রাম্প৷ ট্রাম্পের প্রাথমিক ঘোষণার পর যুক্তরাষ্ট্রের উপর শুল্ক আরোপের প্রস্তুতি নিচ্ছিল ইউরোপীয় ইউনিয়নও৷ যদিও ট্রাম্পের স্থগিতাদেশের ঘোষণায় পিছু হটে ইইউ৷
ছবি: Mark Schiefelbein/AP Photo/picture alliance
তেলের দাম, শেযার বাজার
ট্রাম্পের ঘোষণার সাথে সাথেই অস্থিরতা দেখা যায় তেল ও শেয়ারের বাজারে৷ তেলের দাম কমেছে প্রতি ব্যারেলে ৫০ ডলার পর্যন্ত৷ ভয়াবহ পরিস্থিত তৈরি হয়েছে আন্তর্জাতিক শেয়ার বাজারে৷ মন্দার আশঙ্কায় ট্রাম্পের ঘোষাণার প্রথম দুই দিনে শুধুমাত্র মার্কিন শেয়ারবাজার ৫ লাখ ৪০ হাজার কোটি ডলার হারিয়েছে৷
ছবি: Mark Ralston/AFP
অর্থনৈতিক মন্দার আশঙ্কা
পারস্পরিক শুল্ক আরোপ করা হলে চলতি বছরের শেষের দিকে বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দা শুরু হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে৷ যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি বিষয়ক প্রতিষ্ঠান জে পি মর্গ্যান জানায়, ট্রাম্পের শুল্ক আরোপের পর চলতি বছরের শেষ নাগাদ মন্দার শঙ্কা ৬০ ভাগে দাঁড়িয়েছে৷ অর্থনৈতিক মন্দা চরম পর্যায়ে গেলে ভূগতে হবে বিশ্বের প্রায় সব মানুষকেই৷
ছবি: Gregor Fischer/Getty Images
প্রবৃদ্ধি কমার আশঙ্কা
শুল্ক আরোপের প্রভাব পড়বে আমদানি-রপ্তানিতে৷ এর ফলে বিভিন্ন দেশের আশানুরূপ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব না-ও হতে পারে৷ ২ এপ্রিল ট্রাম্পের শুল্ক ঘোষণার পর ইউরোপের দেশ ইটালি চলতি বছরের প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস এক দশমিক দুই থেকে কমিয়ে শূন্য দশমিক ছয়-এ নামিয়ে এনেছিল৷ অর্থনীতিবিদদের আশঙ্কা, ট্রাম্পের পারস্পরিক শুল্ক আরোপের ফলে চলতি বছর জার্মানির জিডিপি প্রবৃদ্ধি শূন্য দশমিক এক ভাগে নেমে আসতে পারে৷
ছবি: natatravel/Depositphotos/IMAGO
ক্রেতাদের ভোগান্তি
শুল্ক আরোপের প্রভাব পণ্যের দামের উপর পড়বেই৷ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য প্রবেশে অধিক শুল্কের মাশুল সংশ্লিষ্ট দেশের ক্রেতাদের ক্রয়ক্ষমতার উপর প্রভাব ফেলবে৷ শুধু তাই নয়, পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে চীন শুল্ক বাড়ানোয় তার প্রভাবও ক্রেতাদের উপর পড়বে৷
ছবি: Frank Hoermann/SVEN SIMON/IMAGO
ক্ষতিগ্রস্ত হবে উৎপাদন
ট্রাম্পের পাল্টা শুল্ক যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্ববাণিজ্যে উৎপাদন প্রক্রিয়াকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে, এমনটাই মনে করেন সিঙ্গাপুর ন্যাশনাল ইউনাভির্সিটির সহযোগী অধ্যাপক জান-ইন চোং৷ এর কারণ হিসেবে তিনি বলছেন, এই শুল্ক বিশ্বব্যাপী পণ্যের চাহিদার উপর প্রভাব ফলেবে, যার প্রভার পড়বে উৎপাদনে৷
ছবি: CFOTO/NurPhoto/IMAGO Images
বাজারে অবস্থান হারাতে পারে অনেক দেশ
ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া ও বাংলাদেশের মতো দেশগুলো, যাদের রপ্তানি আয়ের একটি বড় অংশ আসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে, সেই দেশগুলো প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে বাজারে তাদের অবস্থান হারাতে পারে বলে আশঙ্কা অর্থনীতিবিদদের৷ এর প্রভাব এমন দেশগুলোর অর্থনীতিতে মারাত্মকভাবে পড়তে পারে৷
ছবি: Joy Saha/ZUMA Press Wire/picture alliance
আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা ও বাণিজ্য জোটে প্রভাব
বাণিজ্য ক্ষত্রে অনিশ্চিয়তা ফলে অনেক দেশ নতুন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সহযোগী খুঁজে পাওয়ার দিকে ধাবিত করতে পারে বলে আশঙ্কা অনেক বিশেষজ্ঞের৷ এরই মধ্যে বাণিজ্য সম্প্রসারণে চীনের সাথে সম্পর্ক তৈরির চেষ্টা করছে অনেক দেশ- এমনটাই দাবি সিঙ্গাপুরের গবেষণা সংস্থা আইএসইএএস-ইউসোফ ইশাক ইনস্টিটিউটের এশিয়ান স্টাডিজ সেন্টারের অর্থনীতিবিদ ক্রিস্টিনা ফং৷
ছবি: Ute Grabowsky/photothek/picture alliance
অসমান্তরাল বাণিজ্য যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র
ট্রাম্পের এই পরিকল্পনা বিশ্বের বিভিন্ন দেশকে যেমন ক্ষতির মুখে ফেলবে, যুক্তরাষ্ট্র নিজেও ঠিক ততটাই ক্ষতির সম্মুখীন হবে বলে অনুমান করা হচ্ছে৷ এক নিবন্ধে বিজনেস হার্ভার্ড রিভিউ ট্রাম্পের এই পরিকল্পনাকে ৩৬০ ডিগ্রির বাণিজ্য যুদ্ধ বলে মন্তব্য করে৷
ছবি: Anna Moneymaker/Getty Images
11 ছবি1 | 11
সূত্র জানাচ্ছে, ভারত চাইছে, দুধ ও দুধজাত পণ্য ও জিএম শস্যকে বাদ রেখে এখন চুক্তি হোক। কিন্তু অ্যামেরিকা চাইছে, ভারত তাদের পণ্য ঢোকার সুযোগ করে দিয়ে শুল্ক কম করুক। বিনিময়ে অ্যামেরিকাও ভারতীয় পণ্য যাতে আরো বেশি করে সেদেশে ঢুকতে পারে, সেজন্য শুল্ক কম করবে। ট্রাম্প যে কম শুল্ক চালু করার জন্য চুক্তির কথা বলেছেন, তার মূল সূত্র এটাই।
ইন্ডিয়ান রেভিনিউ সার্ভিসের সাবেক কর্মকর্তা এবং কাস্টমস অ্যান্ড এক্সাইজ বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান সুমিত দত্ত মজুমদার ডিডাব্লিউকে বলেছেন, ''কৃষি ক্ষেত্রে শুল্ক কম করা হলে ভারতের কৃষকরা তো অসুবিধায় পড়বেনই।''
কৃষি বিশেষজ্ঞ সাংবাদিক হরবীর সিং ডিডাব্লিউকে বলেছেন, ''অ্যামেরিকার কৃষকদের সঙ্গে ভারতের কৃষকদের কোনো তুলনা হয় না। অ্যামেরিকায় ১ কোটি ৮০ লাখ কৃষক এবং ভারতের কৃষকের সংখ্যা প্রায় ১৫ কোটি, যাদের মধ্যে ৮৯ শতাংশ ছোট ও মাঝারি কৃষক। ফলে তাদের সুরক্ষা প্রয়োজন। অ্যামেরিকায় সরকার বিভিন্ন ভাবে কৃষকদের ভর্তুকি দেয়। তাদের ভর্তুকির পরিমাণ ভারতের কৃষকদের তুলনায় অনেক বেশি। তাই অ্যামেরিকার ও ভারতীয় কৃষকদের কোনো তুলনা হয় না। ভারতীয় কৃষকদের আমরা বাজারের হাতে ছেড়ে দিতে পারি না।''
দ্য সেক্রেটারিয়েটের সম্পাদক এবং দীর্ঘদিন ধরে অর্থনৈতিক সাংবাদিকতা করা জয়ন্ত রায়চৌধুরী ডিডাব্লিউকে বলেছেন, ''কিছু পণ্যের ক্ষেত্রে ভারত শুল্ক কমাবে। কিন্তু চাল-গমের মতো খাদ্যশস্যের উপর নয়। তেমনই ডেয়ারির ক্ষেত্রে স্পেশালাইজড চিজের মতো কিছু পণ্যে শুল্ক কমবে। কিন্তু বাকি পণ্যে কমার সম্ভাবনা কম।''
রাজনৈতিক প্রভাব
হরবীর মনে করেন, ''কৃষি ও ডেয়ারিতে শুল্ক প্রচুর কম করলে একটা ধারণা তৈরি হবে, সরকার কৃষক-বিরোধী কাজ করেছে। ডেয়ারির সঙ্গেও আট কোটি মানুষ জড়িত। পেস্তা, হ্যাজেলনাট, অ্যামন্ড আমরা প্রচুর পরিমাণে আমদানি করছি। অ্যামেরিকা আপেলের উপর ৫০ শতাংশ শুল্ক কমাতে বলেছে। তারা সোয়াবিন ও কর্ন ঢালাও রপ্তানি করতে চায়। তাদের কৃষকদের ভারতের বাজার দরকার। তাদের সব দাবি মেনে নিলে ভারতে রাজনৈতিকভাবে বিপাকে পড়বে শাসক দল।''
জয়ন্তও বলছেন, ''কৃষি ও ডেয়ারিতে অ্যামেরিকার সব দাবি মানতে হলে রাজনৈতিক সমস্য়া হবে। সেটা সরকার চাইবে না। আবার অ্যামেরিকার সঙ্গে বাণিজ্য চালু রাখাটা জরুরি। তাই কিছু ক্ষেত্রে শুল্ক কমিয়ে, কিছু ক্ষেত্রে অনড় থেকে পরিস্থিতি সামলাতে চাইছে ভারত।''
সেজন্যই এই বাণিজ্য চুক্তি, শুল্ক নিয়ে আলোচনা একটা কঠিন ও চ্যালেঞ্জিং হয়ে দাঁড়িয়েছে।