সংসদে বাৎসরিক ভাষণে মার্কিন প্রেসিডেন্ট প্রথম কার্যকালে নিজের সাফল্য তুলে ধরে বিরোধী পক্ষ ও তাদের সম্ভাব্য প্রার্থী ট্রাম্পের জোরালো সমালোচনা করলেন৷ ভোটারদের মন জয় করতে কিছু ঘোষণাও করলেন তিনি৷
বিজ্ঞাপন
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের এই বছরে দুই রাজনৈতিক শিবিরের মধ্যে সংঘাত তুঙ্গে উঠেছে৷ অর্থনীতি ও কর্মসংস্থানের মতো ক্ষেত্রে বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন যথেষ্ট সাফল্যের দাবিদার হওয়া সত্ত্বেও জনমত সমীক্ষায় তিনি ভালো ফল করতে পারছেন না৷ বয়সের কারণে তিনি আরো চার বছর ক্ষমতায় থাকার উপযুক্ত কিনা, সেই বিতর্ক তাঁর পুনর্নির্বাচনের উপর কালো ছায়া ফেলছে৷ অন্যদিকে মামলা-মোকদ্দমা ও বিতর্কের ধাক্কা সামলে সাবেক প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প রিপাব্লিকান দলের মনোনয়নের পথে এগিয়ে চলেছেন৷
এমনই প্রেক্ষাপটে প্রেসিডেন্টের ‘স্টেট অফ দ্য ইউনিয়ন' ভাষণে নিজেকে শক্তিশালী হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করলেন বাইডেন৷ ভোটারদের মন জয় করতে একাধিক পদক্ষেপের ঘোষণা করলেন তিনি৷ প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি যে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের জন্য লড়াই করছেন, তার আরো প্রমাণ হিসেবে বাইডেন ধনী ও বড় কোম্পানির উপর করের হার বাড়ানোর ঘোষণা করলেন৷ সেই সঙ্গে অ্যামেরিকার স্বল্প আয়ের মানুষের করের বোঝা কমাতে চলেছেন তিনি৷ তবে সংসদে বর্তমানে অচলাবস্থার কারণে সেই সব প্রস্তাব আদৌ অনুমোদন পাবে কিনা, সে বিষয়ে সংশয় রয়েছে৷
ইতিবাচক পদক্ষেপের পাশাপাশি বাইডেন তাঁর ভাষণে আগামী নির্বাচনে সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী ট্রাম্পের জোরালো সমালোচনা করেন৷ তিনি বলেন, প্রেসিডেন্ট লিংকন ও গৃহযুদ্ধের সময়ের পর অ্যামেরিকায় স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র এমন হুমকির মুখে পড়েনি৷ সরাসরি ট্রাম্পের নাম মুখে না এনেও মোট ১৩ বার তিনি ‘আমার পূর্বসূরি' হিসেবে তাঁর উল্লেখ করে রাশিয়ার কাছে নতি স্বীকার করার অভিষোগও করেন৷ সামরিক জোট ন্যাটো সম্পর্কে ট্রাম্পের মন্তব্যের তীব্র বিরোধিতা করেন বাইডেন৷
ট্রাম্পের জোরালো প্রভাবের কারণে রিপাব্লিকান দলের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কেও কটু মন্তব্য করেন বাইডেন৷ বিশেষ করে মেক্সিকো সীমান্তে অনুপ্রবেশ কমাতে তাঁর প্রশাসনের প্রস্তাবে বাধা দিয়ে তারা দেশের ক্ষতি করে শুধু রাজনৈতিক ফায়দা তোলার চেষ্টা করছে বলে তিনি অভিযোগ করেন৷ সেই বিল পাশ হলে সীমান্তে নিয়ন্ত্রণ আরো জোরালো করা সম্ভব বলে বাইডেন দাবি করেন৷ সংঘাতের বদলে সহযোগিতার মাধ্যমে সীমান্তের সমস্যা সমাধানের পক্ষে সওয়াল করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট৷
ডেমোক্র্যাট দলের সব সমর্থকদের মন জয় করতেও বাইডেন তাঁর ভাষণে কিছু পদক্ষেপের ঘোষণা করেন৷ বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য সংকটের ক্ষেত্রে ইসরায়েলের প্রতি বাইডেন প্রশাসনের অবিচল সমর্থনের কারণে তাদের মধ্যে যে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে, তা কিছুটা দূর করতে বাইডেন গাজা উপকূলে অস্থায়ী বন্দর তৈরি করে সেখানে আরো ত্রাণ সাহায্য বণ্টনের অঙ্গীকার করেন৷ তবে মার্কিন সামরিক বাহিনীকে সেই নির্দেশ দিলেও গাজায় মার্কিন সৈন্য প্রবেশ করবে না বলে বাইডেন আশ্বাস দিয়েছেন৷ তিনি গাজায় অবিলম্বে অস্ত্রবিরতির ডাক দেন৷
২০২৪: নির্বাচনের রেকর্ডের বছর
বিশ্বের মোট জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি বাস করেন এমন ৭৬টি দেশে এ বছর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে৷ এসব নির্বাচনের ফল গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে বলে অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন৷
ছবি: Rui Vieira/empics/picture alliance
৭৬ দেশে নির্বাচন
লন্ডনভিত্তিক দ্য ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ) বলছে, এ বছর ৭৬টি দেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে৷ এসব দেশে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি মানুষ বাস করেন৷ এর আগে কোনো বছর এতগুলো দেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি৷
ছবি: THIBAUD MORITZ/AFP
কঠিন পরীক্ষার মুখে গণতন্ত্র
গণতন্ত্রের আদর্শিক ধারনা এবং শাসনব্যবস্থা হিসেবে তার যে শক্তি, তার একটা বড় পরীক্ষা এবছরের নির্বাচনগুলোর মাধ্যমে হবে বলে মনে করছেন আলী রীয়াজ৷ তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর, আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো এবং আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট৷
ছবি: DW
বাংলাদেশ
৭ জানুয়ারি বাংলাদেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়৷ শেখ হাসিনা চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন৷ চীন, ভারত, রাশিয়া ও জাপানসহ অনেক দেশ তাকে অভিনন্দন জানিয়েছে৷ যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য বলেছে, নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী হয়নি৷ আর বড় সব দল নির্বাচনে না আসায় দুঃখ বা হতাশা প্রকাশ করে নির্বাচনে হওয়া অনিয়মগুলোর পূর্ণাঙ্গ তদন্তের আহবান জানিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন৷
ছবি: Mohammad Ponir Hossain/REUTERS
তাইওয়ান
তাইওয়ানকে ঘিরে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ে উত্তেজনা তৈরি হয়েছে৷ তাই সেদেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দিকে বিশ্ববাসীর আগ্রহ ছিল৷ ১৩ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনে স্বাধীনতাপন্থি এবং চীনবিরোধী হিসেবে পরিচিত নেতা লাই চিং-তে জয়ী হয়েছেন৷
ছবি: Carlos Garcia Rawlins/REUTERS
পাকিস্তান
৮ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে ইমরান খান সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থীরা সবচেয়ে বেশি আসনে জয়ী হন৷ তবে ইমরান খানের দল পিটিআই ভোটে কারচুপির অভিযোগ এনেছে৷ এরই মধ্যে জোট সরকার গঠনে সম্মত হয়েছে নওয়াজ শরীফ ও বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারির দল৷
ছবি: NAVESH CHITRAKAR/REUTERS
ইন্দোনেশিয়া
১৪ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বর্তমান প্রতিরক্ষামন্ত্রী প্রাবোয়ো সুবিয়ান্তো প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন৷ সুহার্তোর স্বৈরাচারী শাসনের সময় সুবিয়ান্তো সেনাপ্রধান ছিলেন৷
ছবি: Agung Kuncahya B./Xinhua/IMAGO Images
রাশিয়া
১৫-১৭ মার্চ রাশিয়ায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে৷ এর মাধ্যমে পঞ্চমবারের মতো প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন ভ্লাদিমির পুটিন৷
ছবি: Sergei Bobylev/Tass/dpa/picture alliance
ভারত
এপ্রিল-মে মাসে বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক এই দেশটিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে৷ নরেন্দ্রো মোদীর নেতৃত্বাধীন ডানপন্থি হিন্দু জাতীয়তাবাদী বিজেপি তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/P. Paranjpe
সাউথ আফ্রিকা
২৯ মে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে৷ ১৯৯৪ সালে বর্ণবাদের পতনের পর এটি দেশটির সপ্তম নির্বাচন হবে৷ সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা ধরে রাখতে এবার আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস এএনসিকে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হতে পারে৷ কারণ অর্থনীতি ধুঁকছে, বিদ্যুৎ পরিস্থিতিও ভালো নেই, তাছাড়া বেকারত্বের হার প্রায় ৩২ শতাংশ৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/B. Curtis
মেক্সিকো
২ জুনের নির্বাচনের মাধ্যমে দেশটিতে প্রথমবারের মতো একজন নারী প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন৷ মেক্সিকো সিটির সাবেক মেয়র ক্লওদিয়া শেইনবাউম (বামে) ও সাবেক বিরোধী সেনেটর খোচিতিল গালভেসের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে৷
ছবি: Fernando Llano/Marco Ugarte/AP Photo/picture alliance
ইউরোপীয় ইউনিয়ন
৬-৯ জুনের নির্বাচনের আগে ইইউর অনেক দেশে উগ্র ডানপন্থি দলগুলোর জনপ্রিয়তা বাড়ছে৷ ইইউ নির্বাচন শেষে তারা ক্ষমতায় যেতে না পারলেও এমন ফল করতে পারে, যা ইইউর নীতির উপর আরও বেশি প্রভাব ফেলার ক্ষেত্রে, তাদের হাত আরও শক্তিশালী করতে পারে৷ সেটি হলে ব্রাসেলস হয়ত ইইউর বিভিন্ন দেশে আইনের শাসনজনিত সমস্যা নিয়ে বেশি কথা বলতে পারবে না৷ গণতান্ত্রিক সমাজ গড়ার জন্য যে মূলবোধগুলো প্রয়োজন তাও রক্ষায় কাজ করতে পারবে না৷
ছবি: InaPlavans/Zoonar/picture alliance
যুক্তরাষ্ট্র
বিশ্বের সবচেয়ে পুরনো গণতান্ত্রিক দেশটিতে নভেম্বরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে৷ এবার ডনাল্ড ট্রাম্পের জয়ের সম্ভাবনা দেখছেন অনেকে৷ সেটি হলে দেশটির গণতান্ত্রিক পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে৷ কারণ ট্রাম্প প্রায়ই বলছেন, তিনি পুনরায় নির্বাচিত হলে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের শায়েস্তা করতে বিচার বিভাগকে ব্যবহার করবেন৷ অথচ কার্যকরী গণতন্ত্রের অন্যতম প্রধান শর্ত বিচার বিভাগের স্বাধীনতা৷
ইইউ, যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ
আলী রীয়াজ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ভবিষ্যতে যেসব দেশ ও অঞ্চল গণতন্ত্রের পতাকাবাহী হতে পারে তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউ৷ সেখানকার নির্বাচনে বড়রকমের ব্যত্যয় ঘটলে বর্তমানে গণতন্ত্র যে পশ্চাদপসরণ অবস্থায় আছে সেখান থেকে ফিরে আসা কঠিন হবে৷