ট্রাম্পের নতুন যুগের পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রেও প্রবাদটিকে ব্যবহার করা যেতে পারে। নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের হাঁচি কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিশ্বের অনেক দেশের জন্য শুধু সর্দি নয়, দীর্ঘমেয়াদি কাশি বা নিউমোনিয়ার কারণ হয়ে যেতে পারে। কারণ, ‘হস্তক্ষেপহীন' ও ‘বাণিজ্য সুরক্ষাবাদ'-এর ওপর ভিত্তিতে করে ‘অ্যামেরিকা ফার্স্ট' নীতি বিশ্বের বিবদমান ও সংঘাতে লিপ্ত অনেক অঞ্চলের হিসেব-নিকেশ পাল্টে দিতে পারে। সে কারণে বিশ্বের অনেক দেশের সরকারী দরবারে ট্রাম্পের অভিষেকের পর পররাষ্ট্র নীতিতে কী পরিবর্তন হবে বা হতে পারে, তা বের করার চেষ্টা করছেন। বিশেষ করে আইনপ্রণয়ন সংশ্লিষ্ট সব ক্ষেত্রে রিপাবলিকানদের জয়জয়কার এ ভাবনাকে বাড়িয়ে দিয়েছে। কারণ, বিপুল ও সর্বব্যাপী ম্যান্ডেটের পর ট্রাম্পকে অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্রনীতি বাস্তবায়নে বিরোধীদের মুখাপেক্ষী হতে হবে না। চাইলেই তিনি আইন পাশ করতে পারবেন। মাত্রাতিরিক্ত এই ক্ষমতা ট্রাম্পের ‘অ্যামেরিকা ফার্স্ট' নীতিকে অনেক বেশি আগ্রাসী করে তুলতে পারে। বিশ্বব্যাপী রাশিয়া-ইউক্রেন, ইসরায়েল-ফিলিস্তিন ও মধ্যপ্রাচ্য সংঘাত এবং চীনের সাথে বৈরিতা সম্পর্কেই মূলত ট্রাম্পের প্রশাসনের বিদেশ নীতি নিয়ে আলোচনাটা সীমিত। তবে নির্বাচনি বৈতরণি পার হওয়ার সময় পাওয়া দক্ষিণ এশিয়ার ভোটারদের সমর্থনের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সাথে ব্যক্তিগত সু-সম্পর্ক, দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে চীনের প্রভাব বৃদ্ধির লাগাম টেনে ধরতে গেলে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের বিষয়ে ট্রাম্পের নতুন প্রশাসনের পররাষ্ট্র নীতিতে নতুন অনুঘটক যোগ হতে পারে। ট্রাম্পের ভবিষ্যত পররাষ্ট্র নীতি সম্পর্কে ধারণা পেতে তার বিগত সময়ের নীতি, ট্র্যাক রেকর্ড, নির্বাচনি প্রচারের সময় করা তার মন্তব্যগুলো বিশ্লেষণ করে কিছু অনুসিদ্ধান্ত টানা যেতে পারে। তবে ট্রাম্প তার কর্মকাণ্ড দিয়ে ইতিমধ্যে প্রমাণ করেছেন, তিনি অনুমানযোগ্যভাবে অপ্রত্যাশিত একটি চরিত্র, যাকে নিয়ে যে কোনো সময় যে কোনো ধারণা সাধারণ হাঁচি-কাশির মতই মিলিয়ে যেতে পারে। যেমন, প্রথম মেয়াদের প্রথম দিকে তৎকালীন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা এইচ আর ম্যাকমাস্টার ট্রাম্পকে আফগানিস্তান থেকে সমস্ত মার্কিন সেনা প্রত্যাহার না করতে রাজি করেছিলেন। কিন্তু হঠাৎ করেই ট্রাম্প তার মত পরিবর্তন করেন এবং তার দলকে তালেবানদের সাথে একটি প্রত্যাহার চুক্তি করার অনুমতি দেন।
নির্বাচনি প্রচারাভিযানের সময় ট্রাম্পের অন্যতম আলোচিত মন্তব্য ছিল, ‘আমি যদি প্রেসিডেন্ট পদে ফিরি, এই যুদ্ধ বন্ধে আমার একদিন সময় লাগবে।' যদিও ট্রাম্প বা তার হবু প্রশাসন বিষয়টি নিয়ে এখনো পরিষ্কার কোনো পরিকল্পনা তুলে ধরেননি। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়, ইউক্রেন-রাশিয়া সংঘাত বন্ধের জন্য ট্রাম্প দুটি নীতি গ্রহণ করবেন। প্রথমত, ট্রাম্প তার ফেস ভ্যালু দিয়ে ইউক্রেন ও রাশিয়াকে আলোচনার টেবিলে বসাবেন। যেটি দুপক্ষকে দ্রুত একটি চুক্তি করার মতো সমাধানে নিয়ে যেতে পারে। দ্বিতীয়ত, জেলেনস্কিকে অস্ত্র সরবরাহ কমিয়ে দিয়ে পুতিনের কাছে ট্রাম্প প্রশাসনের এমন একটি দিক তুলে ধরবেন যাতে পুতিনও এ ধরনের সমাধানে রাজি হয়। এমনিতেই ধরে নেয়া হয় যে, ট্রাম্পের সাথে পুতিনের সম্পর্ক ভালো। ইউক্রেন-রাশিয়া ইস্যুতে ট্রাম্প ১৯৫৩ সালে কোরীয় উপদ্বীপে সংঘাত এড়ানোর মতো প্রক্রিয়া অনুসরণ করার চেষ্টা করতে পারেন।
ট্রাম্প তার ‘আমেরিকা ফার্স্ট' নীতি বাস্তবায়নে বিশ্বের পরাশক্তিগুলোর সাথে সমর যুদ্ধের চেয়ে অর্থনৈতিক যুদ্ধে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। উপরন্তু এর মাধ্যমে ট্রাম্প অতীতের মতই ন্যাটোকে একটি কড়া বার্তা পৌঁছে দিতে চাইবেন। অতীতে তিনি জোট থেকে বের হয়ে যাওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন। ন্যাটো রক্ষায় যুক্তরাষ্ট্রের কোষাগার থেকে অস্ত্রের টাকা পরিশোধ করতে কখনই চান না ট্রাম্প। ফলশ্রুতিতে এমনটা হলে ন্যাটো ও ইউরোপিয়ান দেশগুলোর মধ্যে এক ধরনের ট্রাম্প আতঙ্ক তৈরি হতে পারে। ট্রাম্প তার প্রথম মেয়াদের কয়েক মাসের মধ্যে প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে সরে এসেছিলেন। তিনি দ্বিতীয় মেয়াদেও একই নীতি অনুসরণ করবেন। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির জোয়ার প্রতিষ্ঠা করতে চাওয়া ট্রাম্পের পক্ষে এর বাইরে যাওয়া প্রায় অসম্ভব। আমাদের মনে রাখতে হবে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের বৃহত্তম তেল ও গ্যাস উৎপাদক এবং দ্বিতীয় বৃহত্তম কার্বণ নিঃসরণকারী।
মধ্যপ্রাচ্যে বাইডেনের ‘শান্তির জন্য অস্ত্র' নীতি ব্যর্থ হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। গাজা ও লেবাননে ইসরাইলের এই নীতি অনেক ধ্বংসাত্মক পরিস্থিতি ডেকে এনেছে। তবে ট্রাম্পের আগের নীতিও যে খুব কার্যকরী তেমনটা বলা যাবে না। মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি আনার ক্ষেত্রে তার ‘অনুদান ছুঁড়ে দেয়া'র নীতি এবার কাজে নাও লাগতে পারে। এবার ট্রাম্প প্রশাসনের মধ্যপ্রাচ্য নীতি হবে অনেকটা ‘কান টানলে মাথা আসে' আর ‘বিচার মানি কিন্তু তাল গাছ আমার' নীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। যদিও ইউক্রেনের মতই মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প, কিন্তু সেটি খুব সহজ হবে না। তিনি হয়তো নির্বাচনী বক্তব্যের সূত্র ধরে ইসরাইলকে অস্ত্র সরবারহ কমিয়ে দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের আগুন নেভানোর চেষ্টা করবেন। তাতে গাজায় ইসরায়েল-হামাস আর লেবাননে ইসরাইল-হেজবুল্লাহ যুদ্ধের ভয়াবহতা কমতে পারে কিন্তু সংঘাত পুরোপুরি থামবে না। কারণ তার ‘কান টানলে মাথা আসে' নীতিতে হামাসকে অর্থায়ন করার অভিযোগে ইরানের ওপর আরো কঠোর হবেন। ট্রাম্পের ধারণা, ইরানের ওপর ‘সর্বোচ্চ চাপ' প্রয়োগ নীতি আরোপ করলে মধ্যপ্রাচ্যে হামাসের বাড়াবাড়ি থামিয়ে দেয়া যাবে। ইরানের পরমাণু কর্মসূচি বন্ধ রাখার শর্তে তেহরানের ওপর থেকে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার তুলে নেওয়ার চুক্তি হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানিসহ কয়েকটি পক্ষের। আগেরবার ট্রাম্প প্রশাসন সেই চুক্তি থেকে একতরফাভাবে বেরিয়ে গিয়েছিল। ইরানের উপর সবচেয়ে বড় ধরনের নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। এমনকি ট্রাম্প প্রশাসনের বিরুদ্ধে ইরানের সবচেয়ে শক্তিশালী সামরিক কমান্ডার জেনারেল কাসেম সোলেইমানিকে হত্যারও অভিযোগ ছিল।
আবার বিগত চার বছরে পরিস্থিতি অনেকখানি বদলে গেছে। চার বছর পর ট্রাম্পের একইরকম ইসরায়েল-পন্থী নীতি মধ্যপ্রাচ্য রাজনীতিতে বিরোধের মুখে পড়ার আশঙ্কাকে উড়িয়ে দেয়া যায় না। মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি প্রক্রিয়া শুধু ইসরায়েল-ফিলিস্তিন-ইরানের উপর নির্ভর করে না। হামাসের হাতে বন্দী জিম্মিদের মুক্তির ক্ষেত্রে মধ্যপ্রাচ্যের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদেরকে এক টেবিলে বসাতে না পারলে ট্রাম্পের পররাষ্ট্র নীতি শুরুতেই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে যাবে। মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রক্রিয়ার জন্য সমন্বিত উদ্যোগ নিতে না পারায় গাজার যুদ্ধবিরতি বিষয়ে বাইডেন প্রশাসনের কূটনৈতিক উদ্যোগ স্থবির হয়ে হোয়াইট হাউসেই পড়ে ছিল। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর প্রতি ট্রাম্পের পক্ষপাতিত্ব সমস্যাটিকে আরো জটিল করে তুলতে পারে। এমনিতেই আগেরবার মার্কিন দূতাবাস তেল আবিব থেকে জেরুজালেমে স্থানান্তর, সিরিয়ায় ইসরাইলের দখল করা গোলান মালভূমির স্বীকৃতি দান, আরব দেশগুলোর সঙ্গে ইসরাইলের অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক ভিত্তিভূমি আব্রাহাম অ্যাকর্ড ভেঙে দেয়ার কারণে মধ্যপ্রাচ্য ইস্যুতে এই অঞ্চলের মুসলিম দেশগুলো ট্রাম্পকে যথেষ্ট সন্দেহের চোখে দেখে। ফলে একদিকে হামাসকে থামানোর জন্য ইরানের প্রতি কঠোর হওয়া, অন্যদিকে ফিলিস্তিনিদের দাবি না মেনে ইসরায়েলিদের প্রতি পক্ষপাতিত্ব নীতি সমস্যাকে নতুন রূপ দিতে পারে, কিন্তু স্থায়ী সমাধান এনে দিবে না। তবে ট্রাম্প মধ্যপ্রাচ্যে এমন একটি চুক্তিতে পৌঁছানোর চেষ্টা করবেন যা সত্যিকারের দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধানের বিনিময়ে সৌদি ও ইসরায়েলের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে পারে।
ট্রাম্পের বৈদেশিক নীতি বেশ কৌশলগত ও বৈচিত্র্যময়। দেশ, প্রেক্ষাপট এবং মার্কিন স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ভেদে ট্রাম্পের নীতিতে ভিন্নতা আমরা অতীতেও লক্ষ্য করেছি। ভবিষ্যতেও যে ভিন্ন হবে একথা বললে অত্যুক্তি খুব বেশি করা হবে না। বিশ্বের অন্যান্য দেশ ও অঞ্চলের সাথে ট্রাম্পের পররাষ্ট্র নীতি যেভাবে মানবাধিকার ও গণতন্ত্র ইস্যুর আলোকে আবর্তিত হয় চীনের সাথে তেমনটি অতীতে দেখা যায়নি। ভবিষ্যতেও
তেমনটি ঘটার সম্ভাবনা সুদূর পরাহত। স্বাভাবিকভাবে বহু বছর ধরে তাইওয়ান ও এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দুই সুপারপাওয়ার চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে দৃশ্যমান দ্বন্দ্ব আছে। কিন্তু আমরা ট্রাম্পের প্রথম দফায় দেখলাম চীনের সাথে টক্করটা তিনি পূর্বসূরীদের মতো করে দেননি। প্রথম দিকে তাইওয়ান ও যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতিকদের মধ্যে যোগাযোগ চালু করেছিলেন, কিন্তু তাতে চীন ক্ষুব্ধ হলে তিনি বাণিজ্যিক লড়াইয়ের পথ ধরেছিলেন। চীনকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য বাইডেনসহ অতীতের মার্কিন শাসকরা অন্য দেশগুলোর সঙ্গে সুরক্ষার বিষয়ে শক্তিশালী অংশীদারিত্ব গড়ে তোলার নীতিতে বিশ্বাসী ছিল। ট্রাম্প প্রশাসন এক্ষেত্রে ভিন্নভাবে চিন্তা করে। ট্রাম্প মনে করেন, চীনের উপর এমনভাবে শুল্ক আরোপ করবেন যা দেশটিকে ‘পঙ্গু' করে দিতে পারে। চীনা অবরোধ ঠেকাতে তাইওয়ানকে সামরিক সহায়তা দেয়ার চেয়ে কড়া শুল্ক আরোপের মধ্যে চীনকে বাণিজ্যিক দিক থেকে কাবু করতে চান তিনি। ২০১৮ সালে চীন থেকে আমদানি পণ্যে ট্রাম্প প্রশাসন ২৫০ বিলিয়ন ডলার শুল্ক আরোপ করেছিল। এর অর্থ হলো চীনের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক ট্রাম্পের নীতিতে এক ধরনের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক। যদিও ট্রাম্প দাবি করেছেন, তার সাখে শি জিনপিংয়ের সাথে ভাল সম্পর্ক এবং তিনি চীনের সাথে কাজ করতে চান। কিন্তু ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের মতে অনেক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক মনে করে, ব্যবসা-বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে চীনকে ঘিরে ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট' নীতি পরিচালিত হবে। ট্রাম্পের এই নীতির কার্যকারিতা অনেক সুদূরপ্রসারী সেটি বুঝা যায় যখন দেখি বাইডেন প্রশাসন চীনা আমদানির ক্ষেত্রে ট্রাম্পের আগের প্রশাসনের শুল্ক বজায় রেখেছিলন। যদিও বাইডেন বরাবর দাবি করেন, তার প্রশাসন চীন নীতির প্রতি অনেক বেশি দায়িত্বশীল দৃষ্টিভঙ্গি দেয়ায়। চীনকে ট্রাম্পের এই যে ‘কৌশলগত প্রতিযোগী' হিসেবে বিবেচনা করা এবং আশাতীত মাত্রাতিরিক্ত শুল্ক আরোপের মাধ্যমে চীনকে কাবু করার চেষ্টা করার নীতি বৈশ্বিক নিরাপত্তা ও বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ব্যাপক প্রভাব ফেলতে পারে। অতীতে আমরা দেখেছিলাম ট্রাম্প যখন চীনা পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপ করেছিল তখন চীনও আমেরিকান আমদানির ক্ষেত্রে শুল্ক আরোপ করেছিল। ফলে বেইজিংয়ের সঙ্গে ওয়াশিংটনের বাণিজ্য যুদ্ধ লেগে যাওয়ার আশঙ্ক দেখা দিয়েছিল। ইতিমধ্যে গণমাধ্যমের খবর হলো, ট্রাম্প চীনের আমদানি পণ্যের ওপর শুল্ক বাড়ানোর জন্য মনস্থির করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের আবাসন ও জ্বালানি অবকাঠামো এবং প্রযুক্তি খাতে চীনা কোম্পানির মালিকানা নিষিদ্ধ করতে চান তিনি। বাণিজ্য নীতির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের শিল্প, উৎপাদন এবং সেই সংক্রান্ত কাজে মার্কিনদের অগ্রাধিকারের বিষয়ে জুড়ে দিয়ে ভোটারদের মধ্যে একটা নির্দিষ্ট ধারণা তৈরি করার চেষ্টাও করেছিলিন। এ নীতিতে অনড় থাকলে তার একটাই পরিণতি হতে পারে। সেটি হলো নতুন বাণিজ্যযুদ্ধ। তবে ট্রাম্প একদিকে যেমন প্রত্যয়ী তেমনি অন্যদিকে অনেক বেশি আগ্রাসী। তাই সামনের দিনগুলোতে জিনপিংয়ের সঙ্গে তার সম্পর্ক কী হবে সেটি নিয়ে এখনকার ভাবনা ভবিষ্যতে নাও মিলতে পারে।
মার্কিন রাজনীতিতে শাসনের পরিবর্তন দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলেও এবার নতুন বাতাবরণ নিয়ে এসেছে।অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে বাংলাদেশে নতুন একটি অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়েছে। মার্কিন রাজনীতির গতিপ্রকৃতি ও বৈশ্বিক রাজনীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান অনুযায়ী বাংলাদেশ এমনিতে আমেরিকার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি রাজনৈতিক ফ্যাক্টর হিসেবে বিবেচিত হওয়ার কথা নয়। বাংলাদেশের মত দেশগুলোর ক্ষেত্রে মার্কিন পররাষ্ট্র নীতি গণতন্ত্র, সুশাসন ও মানবাধিকারকে ঘিরে আবর্তিত হয়। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় এবার দৃশ্যপট ভিন্ন চিত্র তুলে ধরে। এ অঞ্চলটিতে ট্রাম্পের পররাষ্ট্র নীতি নতুন রূপে আবির্ভুত হতে পারে। সেটি হতে পারে চীন ও ভারতের দ্বৈরথকে কেন্দ্র করে। শেখ হাসিনার আমলে বাংলাদেশের সাথে ভারতের সাথে সম্পর্ক ছিল খোলামেলা আর চীনের সাথে ছিল কৌশলগত সম্পর্ক। কিন্তু ড. ইউনূস সরকারের নীতি পুরোপুরি উল্টো। সংখ্যালঘু ইস্যু ও শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দেয়াসহ নানা কারণে ভারতের সাথে ইতিমধ্যে বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের রাজনৈতিক সম্পর্ক নাজুক হলেও বাণিজ্যিক সম্পর্কটি বেশ কৌশলগত। অন্যদিকে চীনের সাথে ড. ইউনূস সরকারের সম্পর্ক আগের সরকারের কৌশলগত সম্পর্ক থেকে হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্কে রূপ নিয়েছে। ট্রাম্প প্রশাসন কখনোই চাইবে না এ অঞ্চলে চীনের অর্থনৈতিক করিডোরের প্রসার ঘটুক। ট্রাম্প ইতিমধ্যে তার নির্বাচনী প্রচারের সময় বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভিযোগটি সামনে নিয়ে এসেছেন। এর আগে অতীতে এমনটা কখনই ঘটেনি। ভারতীয় বংশোদ্ভুত ভোটারদের চাপে কিংবা অন্য যে কোনো কারণেই হোক না কেন বিষয়টি ট্রাম্পের মার্কিন পররাষ্ট্র নীতিতে একটি নতুন মাত্রা যোগ করবে। ট্রাম্পের যে সম্ভাব্য প্রশাসন সেখানে ভারতীয় বংশোদ্ভুত ও হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের তালিকাটা কম নয়। তাছাড়া ট্রাম্পের আগের প্রশাসনও দক্ষিণ এশিয়াকে ভারতীয় লেন্সে দেখতো। তার উপর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাথে ট্রাম্পের ব্যক্তিগত সুসম্পর্ক বিষয়টিতে অতিরিক্ত অনুঘটক যোগ করতে পারে। সেক্ষেত্রে ট্রাম্প প্রশাসন বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ইস্যু সামনে এনে পোশাক রফতানিরর ওপর খগড় আরোপ করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের পোশাক রফতানির বৃহত্তম একক রফতানি গন্তব্য। এমনিতেই সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি পোশাক রপ্তানি ১৪% হ্রাসের সম্মুখীন হয়েছে। সেক্ষেত্রে ট্রাম্প প্রশাসন থেকে চাপ আসলে সেটি বাংলাদেশের নতুন সরকারকে ভাবিয়ে তুলবে। তবে চীন থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর কড়া শুল্ক আরোপ করলে একই সাথে বাংলাদেশের পোশাকের ওপর কড়া শুল্ক আরোপের নীতি কতটুকু কার্যকর করা যাবে সে প্রশ্ন থেকেই যায়। আবার ড. ইউনূসের সাথে ক্লিনটন পরিবার এবং ডেমোক্রেটদের হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ককে যদি ট্রাম্প সহনশীল দৃষ্টিভঙ্গিতে না দেখে তাহলে বিষয়টি বাংলাদেশের শাসকদের মাথাব্যাথার কারণ হতে পারে। কারণ ট্রাম্প ইতিমধ্যে ক্ষ্যাপাটে শাসক হিসেবে পরিচিত।
আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে, ট্রাম্প ও প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের মধ্যে পররাষ্ট্রনীতিতে বিস্তর ফারাক রয়েছে। ট্রাম্পের বিচ্ছিন্নতাবাদী নীতির অর্থ হলো, তিনি যুক্তরাষ্ট্রের চারপাশে দেয়াল তৈরি করবেন, সে দেয়াল মূলত অর্থনৈতিক দেয়াল। এখানে ট্রাম্পের নীতির সাথে চাণক্যের আর্থিক নীতির মিল খুঁজে পাওয়া যায়। ট্রাম্প সম্ভবত ন্যাটোর মতো জোটের বিষয়ে সংশয়ী লাইন নেবেন, প্যারিস জলবায়ু চুক্তির
মতো কয়েক ডজন অন্যান্য দেশের সাথে আলোচিত আন্তর্জাতিক চুক্তি থেকে সরে আসবেন এবং রাশিয়ার সাথে যুদ্ধে ইউক্রেনকে মার্কিন সমর্থন বন্ধ করে দেবেন। তবুও আশ্চর্যজনকভাবে, কিছু সমালোচনামূলক বৈদেশিক নীতি ইস্যুতে হয়তো ট্রাম্প বাইডেন প্রশাসনের ধারাবাহিকতা রক্ষা করবেন। কারণ তিনি অনুনমেয় চরিত্র। একজন অপ্রত্যাশিত কমান্ডার ইন চিফ। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে তিনি কখন কী সিদ্ধান্ত নেন, কাকে কী বলে উঠেন তা অনুমান করার সাধ্য কারো নেই।