‘ট্রাম্প প্রশাসন ভারতকেই প্রাধান্য দেবে’
৬ ডিসেম্বর ২০২৪বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও কি তা হবে? হলে সেই পরিবর্তনের ধরন এবং প্রভাব কেমন হতে পারে? ডয়চে ভেলেকে এসব প্রশ্নেরও উত্তর দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সাব্বির আহমেদ৷
ডয়চে ভেলে: ডনাল্ড ট্রাম্প দায়িত্ব নেয়ার পর তাদের আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে কি কোনো পরিবর্তন আসবে?
ড. সাব্বির আহমেদ: সরকার পরিবর্তন হলে মার্কিন কূটনীতিতে সাধারণত বড় ধরনের কোনো পবির্তন আসে না৷ মৌলিক স্বার্থে কোনো পবির্তন হয় না৷ তবে দুইটি রাজনৈতিক দলের বিদেশ নীতি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে পরিবর্তন হয়৷ ডনাল্ড ট্রাম্প অ্যামেরিকার স্বার্থকেই প্রাধান্য দেবেন৷ তিনি অ্যামেরিকাকে ‘গ্রেট অ্যামেরিকা এগেইন' করতে চাচ্ছেন৷ ফলে তার অ্যাপ্রোচ তো আলাদা হবেই৷ এটা আগেও দেখেছি, এবারও হবে৷ অ্যামেরিকা যেসব জায়গায় খরচ করতো, সেখানে ব্যয় সংকোচন নীতি চলে আসবে৷ এটার প্রভাব বাংলাদেশেও পড়বে৷ বাংলাদেশে এতদিন যেসব ডেভেলমপমেন্ট অ্যাসিসট্যন্সগুলো তারা দিয়ে গেছে, সেটা হয়তো বন্ধ হবে না, তবে পরিমাণ কমে যাবে৷ আর রিপাবলিকানরা কিছুটা যুদ্ধবিরোধী৷ বিভিন্ন যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে তারা ডেমোক্র্যাটদের মতো নয়৷ ট্রাম্প তো ইউক্রেন যুদ্ধ চালাবেন না বলেই দিয়েছেন৷ আরেকটা হলো, ক্লাইমেট ফান্ডে বড় অঙ্কের অর্থ দেয়ার নীতিও ট্রাম্প বহাল রাখবেন বলে আমার মনে হয় না৷ অ্যামেরিকা পুরোপুরি যুদ্ধ বন্ধ না করলেও বড় অংশ থেকে সরে আসবে৷ তার প্রধান লক্ষ্যই হবে অ্যামেরিকার অর্থনীতি আরো সমৃদ্ধ করা৷ অভিবাসন নীতিতেও পরিবর্তন আসবে৷ ট্রাম্পের আগের বারে দেখেছি কিছু কিছু মুসলিম দেশ থেকে অভিবাসনে তার রিজার্ভেশন ছিল৷
সেক্ষেত্রে বাংলাদেশে তার প্রভাব পড়বে?
প্রভাব পড়তে পারে৷ বাংলাদেশ থেকে অ্যামেরিকায় স্থায়ীভাবে বসবাসের ব্যাপারে রিপাবলিকানরা কট্টর অবস্থানে যেতে পারে৷ আমি বলছি না সেরকম হবে, তবে হতে পারে৷ তবে ছাত্রদের আসা-যাওয়ার ক্ষেত্রে একটা বড় ধরনের ইমপ্যাক্ট ফেলবে বলে আমার মনে হয়৷
ইউক্রেন যুদ্ধ থেমে গেলে রাশিয়া-অ্যামেরিকার সম্পর্ক বা ওই এলাকার চেহারা কেমন হবে?
ইউক্রেন যুদ্ধে অ্যামেরিকা আমার মনে হয় সিগনিফিক্যান্টলি তার বিনিয়োগ কমিয়ে ফেলবে৷ সেক্ষেত্রে ইউরোপ-নির্ভরশীলতা ছাড়া ইউক্রেনের হাতে কোনো বিকল্প থাকবে না৷ আর আমার মনে হয়, রিপাবলিকান জমানায় ইউক্রেন ন্যাটোর সদস্যপদও পাবে না৷ আর ট্রাম্প যেসব দেশকে ন্যাচারাল অ্যালাই মনে করে, তাদের সঙ্গে বৈরিতায় জড়াবে না৷
তাহলে ট্রাম্প কি গণতন্ত্র, মানবাধিকার এসব ছেড়ে তার সব গুরুত্ব অর্থনীতির ওপর দেবে?
আমার মনে হয় ঝোঁকটা অর্থনীতিতেই থাকবে৷ ডেমোক্র্যাসি নিয়ে রিপাবলিকানদের মাথাব্যথা আগেও আমি দেখিনি, এবারও হবে বলে মনে হয় না৷ তবে হিউম্যান রাইটস ইস্যুতে অ্যামেরিকার অবস্থান একই থাকবে৷ তারা তাদের কথা বলবেই৷
আঞ্চলিক, ইন্দো-প্যাসিফিক রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান কেমন হবে?
এই অঞ্চলে আধিপত্য ধরে রাখার ক্ষেত্রে অ্যামেরিকা চীনকে তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করে৷ এক্ষেত্রে রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য নেই৷ চীনের ট্রেড নিয়ে তারা একটা সংকট তৈরি করবে৷ চীনের পণ্য অ্যামেরিকার মার্কেটে ঢোকার ক্ষেত্রে আরো বেশি শুল্ক আরোপ হতে পারে৷ আরেকটা বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু হতে পারে৷
ট্রাম্পের সাথে মোদীর ভালো সম্পর্ক৷ সেই কারণে এই অঞ্চলের অন্য দেশগুলো কি চাপে পড়তে পারে?
ভারত একটি বড় শক্তি৷ আঞ্চলিক সুপার পাওয়ার৷ কিন্তু সেই কারণে যে অ্যামেরিকা ভারতের সব কথা শুনবে, তা নয়৷ আবার রিপাবলিকান প্রশাসনের সাথে ভারত যে একটা সমঝোতার মধ্য দিয়ে চলবে, এটাও সত্য৷ রিপাবলিকানদের কনসার্ন হবে ইকোনমিক ইন্টারেস্ট৷ ভারত একটা বিশাল দেশ, বিশাল বাজার৷ এই বাজার অ্যামেরিকা কখনোই হাতছাড়া করবে না৷ ভারতের সাথে তাই সম্পর্ক ভালো থাকবে, ভালো করবে- যেটা আগেও করেছে৷
রসায়নটা কী হবে? ভারতের সঙ্গে অ্যামেরিকার ভালো সম্পর্ক৷ পাকিস্তানের সঙ্গেও ভালো৷ আবার ভারত-পাকিস্তান বৈরি৷ চীনের সাথে আবার পাকিস্তান...
এগুলো যেমন আছে তেমনই থাকবে৷ অ্যামেরকিার পাকিস্তানের সাথে যতটুকু সম্পর্ক রাখার রাখবে৷ তার কৌশলগত সম্পর্ক সে রাখবে, ছেড়ে যাবে না৷ তবে এই অঞ্চলে সে ভারতকেই প্রাধান্য দেবে৷ ভারতকে যদি প্রাধান্য দেয় তার প্রভাব তো বাংলাদেশের ওপর পড়ার সম্ভাবনা আছে৷
মিয়ানমারের ব্যাপারে কী হবে? আমরা তো রোহিঙ্গাদের জন্য বড় ফান্ডটা অ্যামেরিকার কাছ থেকেই পাই৷
মিয়ানমারও অ্যামেরিকার ইন্টারেস্টের একটা গুরুত্বপূর্ণ জায়গা৷ সে যদি মনে করে মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সহায়তা করলে অ্যামেরিকার স্বার্থ রক্ষা পাবে, তাহলে সে তাদের সহায়তা করবে৷
ট্রাম্প-মোদীর সম্পর্ক ছাড়াও ট্রাম্প প্রশাসনে তো ভারতীয় বংশোদ্ভূতদের প্রভাব আছে৷ সেটা ধরে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের জায়গায় কোনো পরিবর্তন আসবে?
একটা জায়গা হলো বাংলাদেশ ও অ্যামেরিকার সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্ক৷ এখানে একটা চাপ হতে পারে৷ অ্যামেরিকা দীর্ঘদিন ধরে রোহিঙ্গা শণার্থীদের বড় ধরনের সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে৷ আমার মনে হয় এখানে টান পড়বে৷ ট্রাম্প প্রশাসনে ভারতীয়দের যে প্রভাব, এটা বাংলাদেশের জন্য একটা বাড়তি চাপ তৈরি করতে পারে৷ আর ভারত যদি বাংলাদেশের বিগত পতিত সরকারকে সেখানে পুনর্বাসনের চেষ্টা করে, তাহলে ভারতের সঙ্গে তো বাংলাদেশের একটা রাজনৈতিক টানপোড়েন তৈরি হবে৷ তবে এটার আবার অন্য দিকও আছে৷ বাংলাদেশে কিন্তু ১৮ কোটি জনগণ৷ এটা কিন্তু ভারতের জন্য বড় একটি বাজার৷ সুতরাং ভারত তার অর্থনৈতিক প্রয়োজনেই বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ক শেষ পর্যন্ত খারাপ করবেন৷ আরেকটা আছে ভূরাজনৈতিক৷ বাংলাদেশ যদি ভারতের আচরণের কারণে চীনের দিকে ঝুঁকে যায় সেটা তার জন্য সমস্যা৷ এই কারণে ভারতের চেষ্টা থাকবে বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করা৷ আর এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ব্যক্তি নয়, তারা চেষ্টা করতে পারে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগকে স্বাভাবিক রাজনৈতিক ধারায় ফিরিয়ে আনতে৷
এই ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোনো প্রভাব থাকবে?
থাকতে পারে৷ প্রভাব থাকতে পারে এই কারণে যে, ইউরোপ, অ্যামেরকিা চায় না বাংলাদেশে কোনো রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ হোক৷ এখন পর্যন্ত মানবাধিকারের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক যে ডেভেলপমেন্ট, তাতে তারা রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধের বিপক্ষে৷ জামায়াতে ইসালামীর সঙ্গে যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূতরা বৈঠক করলো, সেখানে কিন্তু তাদের একই কনসার্ন প্রকাশ পেয়েছে৷ আওয়ামী লীগকে স্বাভাবিক রাজনীতিতে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে ট্রাম্প প্রশাসনের একটা ভূমিকা থাকতে পারে ভায়া ইন্ডিয়া৷