সত্যিই যেন একটা বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি – বিজ্ঞানীদের কাছে এখনও কিন্তু এমনটাই মনে হচ্ছে৷ ১০ বছর ধরে ধাওয়া করার পর, শেষে বুধবার ধূমকেতু ৬৭পি বা চুরিয়মোভ-গেরাসিমেনকোর কাছে পৌঁছেছে ইউরোপীয় মহাকাশ যান রোসেটা৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বিজ্ঞাপন
পৃথিবী থেকে প্রায় ৫০ কোটি কিলোমিটার দূরে থাকা ধূমকেতুটিকে খুব কাছে থেকে পর্যবেক্ষণের চেষ্টায় বড় সাফল্য পেয়েছে রোসেটা৷ বিজ্ঞানীদের আশা পৃথিবীতে প্রাণের উৎস যে কার্বন এবং পানি, তা এই ধূমকেতু থেকেই এসেছিল কিনা – সেটা পরীক্ষা করে থেকে জানা যেতে পারে৷ রোসেটা নামের এই যানটির লক্ষ্য হচ্ছে আগামী এক বছর ধরে ধূমকেতুটিকে প্রদক্ষিণ করা এবং সেখানে একটি ল্যান্ডার অবতরণযান পাঠিয়ে তার উপাদানগুলো পরীক্ষা করা৷ এই প্রকল্পটিতে খরচ হয়েছে প্রায় দুইশ কোটি ডলার৷
ঐতিহাসিক গবেষণা
২০০৪ সালের ২রা মার্চ রোসেটা মহাকাশের উদ্দেশ্যে রওনা হয়৷ দীর্ঘ ১০ বছর ধরে সৌরমণ্ডলের ভিতর দিয়ে যাত্রা শেষে ৬৭পি ধূমকেতুর পাশে পৌঁছায় যানটি৷ ধূমকেতুর কাছে পৌঁছাতে গিয়ে রোসেটাকে নানা বাধা পেরিয়ে অতিক্রম করতে হয়েছে প্রায় ৬০০ কোটি কিলোমিটার পথ৷ এই যাত্রাপথে জার্মানির ডার্মস্টাট শহর থেকে বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদরা তাকে নিয়ন্ত্রণ করেছে৷
দীর্ঘ অপেক্ষার পর রসেটার সাফল্য, বিজ্ঞানীরা খুশিছবি: Reuters
রোসেটা মহাকাশযান এখন ধূমকেতুর পাশে নিজেকে এমনভাবে স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে যাতে ধূমকেতুর কক্ষপথে এটি পাশাপাশি প্রদক্ষিণ করতে পারবে৷ জার্মানির ডার্মস্টাটে সংস্থাটির নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র থেকে অভিযানের সাফল্য ঘোষণা করেন ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি ইএসএ মহাপরিচালক জ্যঁ জ্যাকস ডর্ডাইন৷ বলেন, ‘‘দশ বছর, পাঁচ মাস এবং চারদিন ঘোরার পর এবং সূর্যকে পাঁচবার প্রদক্ষিণ করার পর চারশ কোটি মাইল ঘোরার পর অবশেষে লক্ষ্যে পৌঁছেছে রোসেটা৷ এখন আমরা বিজ্ঞানের একটা স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে পা রেখেছি৷ এটাই সুযোগ৷''
এর আগের মিশনগুলোতে যে মহাকাশযান পাঠানো হয়েছে সেগুলো ধূমকেতুর গতিপথের কাছ দিয়ে দ্রুত পার হয়ে গেছে৷ কেবল ধূলিকণার নমুনা এবং কিছু তথ্য সংগ্রহ ছাড়া ওই মিশনে আর কিছু অর্জন সক্ষম হয়নি৷
এই দীর্ঘ পথে শক্তি বাঁচানোর জন্য রোসেটাকে ৩১ মাসের জন্য অকেজো করে রাখা হয়েছিল বলে জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা৷ চলতি বছরের জানুয়ারিতে তার কাজ আবার চালু করা হয়৷
শতাব্দীর সেরা ধূমকেতু আইসন আর নেই!
ছবি: Reuters
মর্মান্তিক বিদায়
যুক্তরাষ্ট্রের সৌর পদার্থবিদরা ধূমকেতু আইসনের গতিবিধির দিকে নজর রাখছিলেন৷ বৃহস্পতিবার স্থানীয় সময় সন্ধ্যায় যখন সূর্যের খুব কাছাকাছি পৌঁছায় এটা, তখন তারা এটিকে অত্যন্ত উজ্জ্বল ধূমকেতু হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন৷ কিন্তু বৃহস্পতিবার রাতে নাসা টুইটারে জানায়, পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে আইসন আর নেই৷ টেলিস্কোপে সূর্যের পাশে বিশালাকার বরফ ও ধুলোর জায়গায় কেবল একটি ক্ষীণ স্রোতরেখা দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
তীব্র তাপই মৃত্যুর কারণ
বৃহৎ আকার সত্ত্বেও, আইসন সম্ভবত সূর্যের কাছাকাছি এসে তীব্র তাপ ও তাপস্রোত সইতে না পেরে খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে গেছে৷ ইউরোপীয় স্পেস এজেন্সির (ইএসএ) পর্যবেক্ষকরা বলেছেন, গ্রিনিচ মান সময় ২১:৩০ মিনিটে আইসন নিশ্চিহ্ন হয়েছে৷ ইএসএ টুইটারে জানিয়েছে, সোহোতে অবস্থানরত আমাদের বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত করেছেন আইসন আর নেই৷
ছবি: picture-alliance/Photoshot
শতাব্দীর সেরা ধূমকেতু
সাম্প্রতিক কালে দৃশ্যমান বিভিন্ন উজ্জ্বল ধূমকেতুর মধ্যে আইসন অন্যতম৷ অনেকে এটিকে শতাব্দীর সেরা ধূমকেতু আখ্যা দিয়েছেন৷ ইন্টারন্যাশনাল সায়েন্টিফিক অপটিক্যাল নেটওয়ার্কের (আইএসওএন) মাধ্যমে ধূমকেতুটি আবিষ্কার করা হয়েছে বলে এটির নাম দেওয়া হয়েছে সি/২০১২ এস১ (আইএসওএন বা আইসন)৷
ছবি: Reuters
বৃহদাকার ধুমকেতু
১৪ মাস আগে এই ধূমকেতুটিকে আবিষ্কৃত হয়৷ এরপর এটিকে নিয়ে অনেক আশা ছিল জ্যোর্তিবিদদের৷ আইসনের বয়স ৪৬০ কোটি বছর বলে ধারণা করা হয়৷ আইসন অন্যান্য ধূমকেতুর তুলনায় বেশ বড়৷ এর পরিধি এক কিলোমিটারেরও বেশি৷
ছবি: cc-by/LarryBloom
টিকে থাকা নিয়ে সংশয় ছিল
আগেই প্রশ্ন উঠেছিল, সূর্যের কাছাকাছি গেলে ধূমকেতু আইসন বাঁচবে কিনা৷ তবে, সূর্য থেকে মাত্র ১০ লাখ কিলোমিটার দূরত্ব দিয়ে যাওয়ার সময়ই এটি ধ্বংস হয় বলে ধারণা করা হচ্ছে৷ সূর্যকে অতিক্রম করার সময় ২৭৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় এটি ভেঙে গুড়োগুড়ো হয়ে মহাকাশে ভস্মীভূত হয়৷ এর আগে অন্য কোন ধূমকেতু সূর্যের এত কাছ দিয়ে যায়নি৷
ছবি: picture alliance / dpa
বাংলাদেশ থেকে দেখা
বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো আইসন ধূমকেতু শনাক্ত করা হয়েছে এ বছরের নভেম্বরে৷ মুন্সিগঞ্জের লৌহজং উপজেলার শিমুলিয়া গ্রাম থেকে ৩ নভেম্বর ভোর পাঁচটায় আইসন শনাক্তকরণের পাশাপাশি ধূমকেতুটির একটি ছবি তোলা হয়৷ বাংলাদেশের বিজ্ঞান সংগঠন অনুসন্ধিৎসু চক্রের জ্যোতির্বিজ্ঞান বিভাগের উদ্যোগে সেই ছবিটি তোলা হয়েছিল৷
ছবি: Anushandhitshu Chokro Science Organization
লভজয়ের পরিণতি
সৌরমণ্ডলের একেবারে দূর প্রান্তের বরফ-ঠাণ্ডা এলাকা ‘উর্ট ক্লাউড’ থেকে এসেছিল ধূমকেতু আইসন৷ ধূমকেতুটি ঘণ্টায় ১০ লক্ষ কিলোমিটারেরও বেশি গতিতে সূর্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল৷ কিন্তু শক্তিধর নক্ষত্র সূর্যের তেজের কাছে শেষ পর্যন্ত টিকল না এটি৷ পরিণতি হলো ধূমকেতু লভজয়ের মতোই৷ ২০১১ সালে সূর্যের কক্ষপথের কাছে এসে ধ্বংস হয়ে যায় লভজয়৷
ছবি: NASA/Don Davis
ধূমকেতু কি?
ধূমকেতু হলো ধুলো, বরফ ও গ্যাসের তৈরি এক ধরনের মহাজাগতিক পদার্থ৷ এটি সৌরজাগতিক বস্তু বা সূর্যের খুব কাছ দিয়ে পরিভ্রমণ করার সময়, কখনো কখনো তার লেজ প্রদর্শণ করে৷ এটি প্রস্থে কয়েকশ’ মিটার থেকে দশ কিলোমিটার এবং দৈর্ঘ্যে কয়েকশ’ কোটি কিলোমিটার পর্যন্ত হলে পারে৷
ছবি: NASA/Science dpa
হ্যালির ধূমকেতু
প্রতি ৭৫-৭৬ বছর পর পর পৃথিবীর আকাশে দৃশ্যমান হয়ে উঠা একটি ধূমকেতু হ্যালি৷ বিখ্যাত ইংরেজি জ্যোতির্বিজ্ঞানী এডমন্ড হ্যালির নামানুসারে এর নামকরণ করা হয়েছে৷ এর অফিসিয়াল ডেসিগনেশন হচ্ছে ১পি/হ্যালি৷
ছবি: AP
9 ছবি1 | 9
গত দু'মাস ধরে ধীরে ধীরে কমানো হয়েছে রোসেটার গতি৷ ধূমকেতুটির গতি ঘণ্টায় প্রায় ৫৫ হাজার কিলোমিটার৷ আগামী ১৫ মাস ধরে রোসেটা এভাবেই ঘুরবে৷
সব কিছু ঠিকঠাক চললে এ বছরের নভেম্বরে রোসেটার সঙ্গে থাকা যান ফিলায়ে ল্যান্ডারকে ধূমকেতুর উপরে নামাতে চায় ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি৷ বিজ্ঞানীরা বলছেন, সব কিছু যদি পরিকল্পনা মাফিক চলে, তাহলে নভেম্বর নাগাদ তারা রোসেটাকে ফিরিয়ে আনতে মহাশূন্যে একটি অবতরণযান পাঠাবেন৷ ধূমকেতুর উপরে গর্ত করে পরীক্ষা চালানোরও পরিকল্পনা রয়েছে ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির৷ এর ফলে ধূমকেতু সম্পর্কে আরও তথ্য জানা যাবে বলে বিজ্ঞানীদের ধারণা৷ হয়ত নভেম্বরে ধুমকেতুটির বরফস্তরে প্রবেশ করতে পারে রোসেটা৷
রোসেটা প্রকল্পের সাথে যুক্ত এক বিজ্ঞানী অবশ্য সংবাদ সংস্থা এএফপিকে জানালেন, ‘‘মিশন ইমপসিবল, অর্থাৎ যানটির অবতরণ অসম্ভব একটি কাজ৷ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঐ কর্মকর্তা জানান অবরতরণে ব্যর্থ হলেও ২০১৫ সালের শেষ পর্যন্ত ঐ ধূমকেতুকে প্রদক্ষিণ করার সময় বেশ কিছু নতুন তথ্য পাওয়া যেতে পারে৷''
প্রাচীন মিশরের সাংকেতিক লিপি ‘হায়ারোগ্লিফিকস'-এর জনক রোসেটা স্টোনের নামে এই মহাকাশ গবেষণাযানের নাম দেওয়া হয়েছে ‘রোসেটা'৷