জুরাসিক পার্ক চলচ্চিত্রের কল্যাণে প্রাগৈতিহাসিক যুগের ডাইনোসরসহ অনেক প্রাণী সম্পর্কে আমাদের স্বচ্ছ ধারণা হয়েছে৷ তবে জার্মানির এক ডাইনোসর পার্কে বিশাল উড়ন্ত প্রজাতির যে কঙ্কাল শোভা পাচ্ছে, তা সত্যি বিস্ময়কর৷
বিজ্ঞাপন
অসাধারণ ঘটনা বটে! প্রায় ৬ কোটি ৬০ লক্ষ বছর আগের ডাইনোসরের বিশালাকার হাড়গুলি জোড়া দেওয়া হচ্ছে৷ সেটা আসলে ছিল এক প্টেরোসর, উড়ন্ত প্রাণী৷ এখনো পর্যন্ত জানা এ ধরনের সবচেয়ে বড় আকারের প্রাণী৷ এই প্রথম জোড়া লাগানো গোটা কঙ্কাল চাক্ষুষ করার সুযোগ পাওয়া যাচ্ছে৷
রোমানিয়ার জীবাশ্মবিদ মাটিয়াস ভ্রেমির এই চমকপ্রদ আবিষ্কার করেছেন৷ এ ক্ষেত্রে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও তিনি আবিষ্কারের পর প্রথমে নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারেননি৷ ভ্রেমির বলেন, ‘‘এটাই আসল আবিষ্কার৷ টেরোসরস সম্পর্কে আমরা যা জানতাম, তার তুলনায় এটা এত বড় যে, আমার মস্তিষ্ক প্রথমে তা মানতেই চায়নি, মনে হয়েছে এটা অসম্ভব৷''
কিছুকাল আগে পর্যন্তও ভাবা যেত না যে, উড়ন্ত ডাইনোসরদের সর্বোচ্চ পরিধি ১০ মিটারের বেশি হতে পারে৷ অথচ এই প্রজাতির পরিধি ১৫ মিটারেরও বেশি! পরিধি বড় ট্রাকের মতো হওয়ায় মানুষ অনায়াসে তার পিঠে চড়ে উড়তে পারতো৷
রোমানিয়ার ট্রানসিলভানিয়া অঞ্চলে ভ্রেমির ২০০৯ সালে সেই জীবাশ্ম আবিষ্কার করেন৷ দূরবীনে পর্যবেক্ষণ করার সময়ে সেটি তাঁর চোখে পড়ে৷ খাড়া পাহাড়ের পাশে হাড়ের প্রান্তগুলি উঁকি দিচ্ছিল৷
কিন্তু সেই জীবাশ্ম অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করা ছিল অত্যন্ত জটিল কাজ৷রাইমুন্ড আলব্যার্টসডর্ফার নিজেও জীবাশ্মবিজ্ঞানী ও অভিজ্ঞ জীবাশ্ম সংগ্রহকারী৷ রোমানিয়ায় জীবাশ্ম উদ্ধারের সময়ে তিনিও উপস্থিত ছিলেন৷ তিনি বিলক্ষণ জানেন, আদৌ কোনো উড়ন্ত ডাইনোসরের জীবাশ্ম আবিষ্কার কত সৌভাগ্যের বিষয়৷ কারণ, স্থলে বিচরণ করা স্বজাতিদের তুলনায় তাদের শরীর অনেক নাজুক ছিল৷ আলব্যার্টসডর্ফার বলেন, ‘‘হাড়ের সবচেয়ে বাইরের স্তর অত্যন্ত পাতলা৷ এমনকি হাড়ের মধ্যের উপকরণও ছিল হড়হড়ে৷ প্রায় ৯০ শতাংশই ছিল ফাঁপা৷ এভাবে কম ওজনের কারণে তাদের আকাশে ওড়ার ক্ষমতা ছিল অনেক বেশি৷ হাড়গোড়ের হালকা গঠনের কারণেই সেটা সম্ভব হতো৷''
ডাইনোসরদের রাজা বার্লিনে
টিরানোসরাস রেক্স-এর সাজানো কঙ্কাল সারা বিশ্বে বেশি নেই, বড়জোর ৫০টি৷ এবার ইউরোপেও: টি-রেক্স আসছে বার্লিনের ‘মিউজিয়াম অফ ন্যাচারাল হিস্টরি’-তে, আগামী তিন বছরের জন্য৷
ছবি: DW/A. Kirchhoff
সুবিশাল মাথা
টিরানোসরাস রেক্স-এর মাথাটা তার বাকি দেহের তুলনায় এত বেশি ভারী যে, সেটা আলাদা করে একটি ডিসপ্লে কেস-এ দেখাতে হয়! ওদিকে টি-রেক্স-এর দেহটাই হলো লম্বায় ১২ মিটার৷ দেড় মিটার লম্বা মাথার খুলিটির প্রায় ৯৮ শতাংশ অক্ষত ছিল, কাজেই এটা টি-রেক্স-এর সবচেয়ে পূর্ণাঙ্গ মাথার খুলি বলা চলে৷
ছবি: DW/A. Kirchhoff
এক্সপ্রেস ডেলিভারি
বার্লিনের প্রাকৃতিক বিজ্ঞান সংগ্রহশালার কর্মীরা মাত্র এক মাস সময় পেয়েছিলেন টি-রেক্স-এর কঙ্কালটি জোড়া দেবার জন্য৷ আদত কঙ্কালটি খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মন্টানা রাজ্যে৷ পরে সেটি বাক্স করে সাগরপাড়ি দিয়ে বার্লিন পাঠানো হয়৷
ছবি: DW/A. Kirchhoff
টি-রেক্স সুপারস্টার
সাড়ে ছ’কোটি বছর আগে টিরানোসরাস রেক্স বিলুপ্ত হয় – তা সত্ত্বেও সে হাল আমলের পপ সংস্কৃতির এক সেলিব্রিটি! বিশেষ করে ‘জুরাসিক পার্ক’ ফিল্মটির কল্যাণে৷ তবে গবেষকদের ধারণা যে, টি-রেক্স যত না শিকারি ছিল, তার চেয়ে বেশি পচা মাংসের খোঁজে থাকত৷
ছবি: DW/A. Kirchhoff
বার্লিনের এই টি-রের্ক্সটির নাম ট্রিস্টান হলো কী করে
ডেনমার্কের বাসিন্দা নিলস নিলসেন চিরকালই ডাইনোসরদের ফ্যান৷ পরে হন লন্ডনের ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকার – এবং এতই সফল যে, টি-রেক্স-এর সবচেয়ে ভালোভাবে সংরক্ষিত কঙ্কালটি কিনতেও তাঁর কোনো অসুবিধা হয়নি৷ নিলসেন কঙ্কালটির নাম রাখেন নিজের ছেলের নামে: ট্রিস্টান৷
ছবি: Niels Nielsen
দৈত্যাকার জিরাফ
ব্রাকিওসরাস ব্রাঙ্কাই সবচেয়ে অতিকায় ডাইনোসরদের মধ্যে গণ্য৷ গণ হিসেবে সরোপড৷ তারও একটি কঙ্কাল রাখা আছে বার্লিনের ন্যাচারাল হিস্টরি মিউজিয়ামে৷ এই জীবটিও জুরাসিক আমলের৷
ছবি: DW/A. Kirchhoff
যে টিকটিকিকে ধরা যায় না
ডাইসালোটোসরাস মানে হলো ‘যে টিকটিকি-কে ধরা যায় না’৷ টি-রেক্স-এর মতো অতটা খ্যাত না হলেও, এই পাঁচ মিটার লম্বা জীবটিও ছিল টি-রেক্স-এর মতোই সর্বভূক, বিশেষ করে ছোট থাকাকালীন – অন্তত বিজ্ঞানীরা তাই বলেন৷
ছবি: Museum für Naturkunde Berlin
জীবাশ্ম-বিজ্ঞানের পথিকৃৎ
বার্লিনের ন্যাচারাল হিস্টরি মিউজিয়াম বহুদিন ধরেই ডাইনোসরদের হাড়গোড়ের খোঁজ চালাচ্ছে৷ বিংশ শতাব্দীর সূচনায় এই মিউজিয়াম থেকে বর্তমান তানজানিয়ার তেঙ্গাদুরু হিল এলাকায় একটি অভিযাত্রী দল পাঠানো হয়, যারা বার্লিনে মোট ২৫০ টন ‘ফসিল’ পাঠায়৷ সেই সব ফসিলের মধ্যে বেশ কিছু এখনও মিউজিয়ামের সেলারে রয়েছে ও তা নিয়ে গবেষণা চলেছে৷
ছবি: Museum für Naturkunde Berlin
বার্লিনের একটি নতুন আকর্ষণ
বার্লিনের প্রাকৃতিক বিজ্ঞান সংগ্রহশালা খোলা হয় ১৮৮৯ সালে৷ এটি জার্মানির বৃহত্তম ন্যাচারাল হিস্টরি মিউজিয়াম৷ টি-রেক্স-কে নিয়ে নতুন প্রদর্শনীটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘সক্রিয় বিবর্তন’৷ বিশ্বের বৃহত্তম ডাইনোসর কঙ্কালের পাশাপাশি রাখা হয়েছে ছোট ছোট পোকামাকড় ও মাছ, যার সব কিছুই বিবর্তনের প্রতীক৷ প্রতিবছর প্রায় পাঁচ লাখ দর্শক আসেন এই মিউজিয়ামে৷
ছবি: DW/A. Kirchhoff
8 ছবি1 | 8
মিউনিখ থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূরে আল্টম্যুলটাল ডাইনোসর পার্কে উড়ন্ত ডাইনোসরের পুনর্গঠিত কঙ্কাল প্রথমবার প্রদর্শিত হয়েছে৷ কিন্তু বিশাল এই উড়ন্ত প্রাণী কীভাবে জমির উপর ঘোরাফেরা করতো? ওড়ার ক্ষমতা পাখির মতো হলেও তারা সম্ভবত ৪ পায়ে হাঁটতেও পারতো৷ সম্ভবত ডানার প্রতিটি প্রান্ত মুড়ে উপরের দিকে তুলে ধরতো৷ কিন্তু কীভাবে তারা ডানা মেলে আকাশে উড়ে যেত, তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে৷
কিছু বিজ্ঞানীর অনুমান, ওড়ার প্রস্তুতির জন্য এই প্রাণীর কোনো খাড়া প্রাচীরের প্রয়োজন হতো৷ এটাও সম্ভব যে, খুব বড় আকারের প্রাণীরা আকাশে ওড়া পুরোপুরি বন্ধ করে দিতো৷
এই আবিষ্কারের কল্যাণে বিজ্ঞানীরা গবেষণার অনেক নতুন দিশা পেয়েছেন৷ ডাইনোসর পার্কের দর্শকদের জন্য বিস্ময়ের আরেকটি উৎস যোগ হয়েছে৷