আমাদের দেশে রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর অনেক ডালপালা। একটা মূল সংগঠন থাকে। সমাজের নানান অংশকে নিয়ে ছড়ানো থাকে তার শাখা-প্রশাখা।
বিজ্ঞাপন
এবারের ডাকসু নির্বাচনকে ঘিরে মূল চ্যালেঞ্জ হলো শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রেখে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছাত্রদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। যদি এটি ভালোয় ভালোয় উৎরে যায়, তাহলে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে তার ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।ছবি: DW
কৃষক, শ্রমিক, নারী, অন্যান্য পেশাজীবী ও সাংস্কৃতিক ব্যাক্তিত্বদের নিয়ে থাকে আলাদা কমিটি। ছাত্রদের জন্য থাকে বিশেষ ব্যবস্থা। আমরা তাদের বলি ছাত্র সংগঠন।
বেশিরভাগ ছাত্র সংগঠনের জন্মহয় রাজনৈতিক দলের ঔরসে। কিছু ব্যতিক্রম আছে। যেমন, ১৯৪৮ সালের জানুয়ারি মাসে জন্ম হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের। প্রায় দেড় বছর পর, ১৯৪৯ সালের জুনে গঠন করা হয় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ। সঙ্গে সঙ্গে ছাত্রলীগ হয়ে যায় আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন। ১৯৭২ সালের জুলাই মাসে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের স্লোগান দিয়ে আওয়ামী বৃত্ত থেকে বিদ্রোহ করে ছাত্রলীগের একটি অংশ স্বতন্ত্র অস্তিত্ব ঘোষণা করে। ওই বছর অক্টোবরে জাসদ নামে নতুন একটি রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠার ঘোষণা এলে বিদ্রোহী ছাত্রলীগ জাসদের সহযাত্রী হয়। এ ছাড়া ছাত্রদের বাকি সব সংগঠন তৈরির পেছনে অনুঘটকের ভূমিকা নিয়েছে মূল রাজনৈতিক দল। দল ভাঙলে তার সহযোগী ছাত্র সংগঠনও ভাঙে। এভাবেই চলে আসছে দশকের পর দশক।
ক্রমে ক্রমে পরিস্থিতি যা দাঁড়িয়েছে, তাতে ছাত্র সংগঠন মূল রাজনৈতিক সংগঠনের সহযোগীহিসেবে আর থাকেনি, তার অঙ্গ সংগঠনে পরিণত হয়েছে। বলা চলে, একটি দলের ছাত্র সংগঠন মানে সেই দলের ক্যাম্পাসভিত্তিক শাখা। ছাত্র সংগঠন নিয়ন্ত্রণ করে রাজনৈতিক দলের নেতারা। ছাত্র সংগঠন হয় রাজনৈতিক দলের শাখা, লেজুড় কিংবা লাঠিয়াল। রাজনীতির মাঠে এক দলের সঙ্গে যে দ্বন্দ্ব, ঝগড়া, মারামারি, তার ষোলোআনা প্রভাব পড়ে ছাত্রদের মধ্যে। তাই দেখা যায়, রাজনীতি যখন সংঘাতময় হয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হয়ে পড়ে অশান্ত। সেটি ঝগড়া আর খুনোখুনিতে গিয়ে শেষ হয়। আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এই চিত্র হরহামেশা দেখা যায়। আর যখন যে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থাকে, তার অঙ্গ সংগঠনের ছাত্ররা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ছাত্রাবাসের দখল নিয়ে নেয়।
১৯৯১ সালে এ দেশে প্রকৃত অর্থে দ্বি-দলীয় রাজনীতি শুরু হয়। দেখা গেছে দেশ পালাক্রমে দেশ শাসন করেছে বড় দুটি রাজনৈতিক দল, বিএনপি আর আওয়ামী লীগ। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রাজত্ব করেছে তাদের ছাত্র শাখ। দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সরকারি দলের আখড়ায় পরিণত হয়েছে।
২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুত্থানের পর চালচিত্র অনেকটা পালটে গেছে। বড় দুই দলের অন্যতম আওয়ামী লীগ দৃশ্যপটে নেই। অন্যেরা ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারে ব্যস্ত। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তাদের মধ্যে চলছে প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতা। কে এগিয়ে আর কে পিছিয়ে, গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ দেখে তা বলা মুশকিল।
শিক্ষাঙ্গনে নির্বাচন নিয়ে শিক্ষার্থী ও বিশ্লেষকদের কথা
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে কেন নির্বাচন হয় না? বাধা কোথায়? কলেজগুলোতেও কি ছাত্র সংসদ নির্বাচন হওয়া উচিত না? এসব বিষয়ে ডয়চে ভেলের সঙ্গে কথা বলেছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও চারটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
ছবি: DW
রাজনৈতিক কর্তৃত্ব বজায় রাখতেই নিয়মিত নির্বাচন হয় না : ডা. জাহেদ উর রহমান, রাজনৈতিক বিশ্লেষক
ছাত্র প্রতিনিধি নির্বাচনে সরকার-বিরোধীরাই অধিকাংশ সময় নির্বাচিত হয়। ফলে ওই সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সরকারী দলের ছাত্র সংগঠনের নিয়ন্ত্রণ খর্ব হয়। এই কারণে অধিকাংশ ক্ষেত্রে সরকারগুলো নিজেদের কর্তৃত্ব বজায় রাখতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন দিতে চায় না।
ছবি: DW
আমি স্বতন্ত্র প্রার্থীকে চাইবো : রিফাত জাহান, শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সবার আগে আমি আমি স্বতন্ত্র প্রার্থীকে চাইবো, যার কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ততা নেই এবং কোনো রাজনৈতিক সংগঠন দ্বারা প্রভাবিত হবে না। প্রার্থীর কাছে আমি প্রতিবাদ করার ক্ষমতা, সচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা দাবি করতে পারি, তবে অবশ্যই সেটা শিক্ষার্থীবান্ধব হতে হবে।
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতি চাই না : রাতুল হাসান রাফি, শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ডাকসু ঐতিহাসিকভাবে শিক্ষার্থীদের অধিকার ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অগ্রভাগে ছিল। তবে বাস্তবে এটি প্রায়ই রাজনৈতিক দলগুলোর প্রভাবাধীন হয়ে পড়ে৷ ফলে, প্রশ্ন ওঠে- ডাকসু কি শিক্ষার্থীদের স্বার্থে কাজ করছে, নাকি দলের এজেন্ডা বাস্তবায়নের হাতিয়ার হচ্ছে? অবশ্য ডাকসুর প্রার্থীরা শিক্ষার্থীদের ভোটে নির্বাচিত হন, তবু তারা সাধারণত নিজেদের রাজনৈতিক দলের প্রতি বেশি দায়বদ্ধ থাকেন। এমন লেজুরবৃত্তিক রাজনীতি চাই না।
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব সন্তোষজনক পর্যায়ে পৌঁছায়নি : অর্পিতা সাহা, শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
নির্বাচনে নারী প্রার্থী এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ ও প্রতিনিধিত্ব এখনো সন্তোষজনক পর্যায়ে পৌঁছায়নি। অথচ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জাতীয় নেতৃত্ব তৈরির অন্যতম প্রধান কেন্দ্র। এই নেতৃত্বে সবার কণ্ঠস্বর সমানভাবে শোনা না গেলে গণতান্ত্রিক চর্চা পূর্ণতা পায় না। তাই নারীদের পাশাপাশি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ বাড়ানো জরুরি।
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর অংশগ্রহণ খুবই সামান্য : পপি রাজবংশী, শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
ছাত্র সংসদ নির্বাচনগুলোতে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ খুবই সামান্য। ছাত্র সংসদে বিভিন্ন পদে কিছু নারী শিক্ষার্থী মনোনয়ন সংগ্রহ করলেও তাদের অবস্থান ভালো না। আবার হল সংসদে অনেক পদে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বীই নেই। সব মিলিয়ে মেয়েদের অংশগ্রহণও সন্তোষজনক নয়। রাকসুতে ‘জাতিসত্ত্বা বিষয়ক সম্পাদক’ পদের সংযুক্তিসহ চার দফা দাবি জানিয়েছিল ‘আদিবাসী’ ছাত্র সংগঠনগুলো। এ দাবিও উপেক্ষিত হয়েছে।
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
নির্বাচিতদের দায়িত্ব অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা : নাঈম ইবনে জামান, শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
দীর্ঘ ৩৫ বছর পর রাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। আমি যাদের ভোট দিবো, তাদের কাছে আমার প্রত্যাশা, দীর্ঘদিন ছাত্র সংসদ না হওয়ায় প্রশাসনিক ও একাডেমিক যেসব অধিকার থেকে আমরা বঞ্চিত হয়েছি তা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। যেমন, একাডেমিক সিলেবাসকে যুগোপযোগী করা, শিক্ষার্থীদের জন্য আবাসিক সুবিধা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিভিন্ন ফান্ডিং ও স্কলারশিপের ব্যবস্থা গ্রহণ।
লেজুড়বৃত্তিক ছাত্রসংগঠনগুলোর অগ্রাধিকার শিক্ষার্থীদের দাবি নয়, বরং দলীয় স্বার্থই হবে - এমন আশঙ্কা বাস্তবসম্মত। যখন ছাত্র সংসদ স্বাধীনভাবে কাজ করেছে, তখন তারা জাতীয় স্বার্থে বড় ভূমিকা রেখেছে। দলীয় রাজনীতির অতীত ইতিহাসের আলোকে বলা যায়, ছাত্র সংসদে দলীয়করণ হলে শিক্ষার্থীদের স্বতন্ত্র কন্ঠস্বর হারিয়ে যাবে, শিক্ষার্থীদের অধিকার নিশ্চিত হবে না। এককেন্দ্রিক রাজনৈতিক মতাদর্শকে হেজেমোনিক করে তুলবে।
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
নির্বাচিতরা যেন শিক্ষার্থীদের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেন : সাদিয়া শরিফ শান্তা, শিক্ষার্থী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
সাধারণ শিক্ষার্থী হিসেবে আমাদের প্রত্যাশা থাকে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা রাজনৈতিক স্বার্থ নয়, শিক্ষার্থীদের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেবেন। কিন্তু যদি পূর্ণ প্যানেল বা অধিকাংশ পদে রাজনৈতিক সংগঠনের প্রার্থীরাই জয়ী হন, তাহলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের বিষয়ে তাদের সঙ্গে মুখোমুখি অবস্থার সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
সৎ ও মেরুদণ্ড থাকা নেতা চাই : মামুন ইসলাম, শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
চাকসু নেতার হতে হবে স্বচ্ছ, তার মধ্যে অবশ্যই কোনো প্রকার দ্বিচারিতা, কিংবা নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর জন্য কাজ করার মানসিকতা থাকতে পারবে না। প্রশ্ন করা ও প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়ার মতো সৎ সাহস এবং ডিসিশন মেইকিংয়ের যোগ্যতা, তথা মেরুদণ্ড থাকা একান্ত জরুরি।
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
সকল সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি থাকা জরুরি : অর্পিতা সুশীল অপি, শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
চাকসু নির্বাচনে অমুসলিম ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিত্ব অত্যন্ত জরুরি। এটি বৈষম্য রোধ, সবার ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত এবং তাদের নির্দিষ্ট সমস্যা ও চাহিদা তুলে ধরতে সহায়ক হবে। এ ধরনের প্রতিনিধিত্ব যতটা বেশি উঠে আসবে, শিক্ষার্থীদের মাঝে পারস্পরিক বোঝাপড়া এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক, বৈষম্যহীন ছাত্র সংসদ গঠনে ততবেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে আমি মনে করি।
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
ক্যাম্পাসে শান্তি ও শিক্ষার্থীদের কল্যাণকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব : বোরহান রব্বানী, শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
রাজনৈতিক বা অরাজনৈতিক পরিচয় নিয়ে অনেক বিতর্ক হচ্ছে। তবে আমরা তেমন কোনো পরিচয়ের ভিত্তিতে ভোট দেবো না। আমরা বিবেচনা করবো-কে বা কারা দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষার্থীদের অধিকার ও স্বার্থ রক্ষায় নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। যারা শিক্ষার্থীদের নায্য অধিকার আদায় করতে পারবে। এছাড়া যাদের ইশতেহারে ক্যাম্পাসের শান্তি, উন্নয়ন এবং শিক্ষার্থীদের কল্যাণকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে- তাদেরই আমরা ভোট দেবো।
জাকসু নির্বাচনে নারী শিক্ষার্থীদের আগ্রহ কম থাকার অন্যতম কারণ হলো- রাজনীতির পরিবেশকে এখনো অনেকেই নিরাপদ মনে করেন না। কেননা, গণঅভ্যুত্থানে নারীদের ব্যাপক ভূমিকা থাকলেও এর পরবর্তী সময়ে নারীদের অনলাইন বুলিংয়ের মাধ্যমে রাজনীতিতে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। পাশাপাশি সামাজিক চাপ, নিরাপত্তার অভাব এবং নেতৃত্বে নারীদের সুযোগ কম থাকায় অনেকেই এগিয়ে আসতে চান না।
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
12 ছবি1 | 12
এ বছর সেপ্টেম্বর থেকে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রসংসদ নির্বাচনের ঘোষণা এসেছে। সবাই নড়চড়ে বসছেন। ছাত্রসমাজের কাছে কোন দল কতটা জনপ্রিয়, নির্বাচনে তার একটা ফয়সালা হয়ে যাবে।
রাজনীতির মাঠে সংগঠনগুলোকে মোটা দাগে চার ভাগে ভাগ করা যায়। এগুলো হচ্ছে – বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি আর বাম ঘরানার বেশ কয়েকটি দল। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সবগুলোর উপস্থিতি কম-বেশি লক্ষ করা যায়। সবার নজর এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে। ছাত্র সংগঠনগুলো ডাকসু নির্বাচনে তাদের প্রার্থীতা ঘোষণা করেছে। নির্বাচনি প্রচার চলছে। দলগুলো পরস্পরের বিরুদ্ধে বিষোদগার করছে। সমালোচনা করতে গিয়ে কেউ কেউ শালীনতার দেয়াল ভেঙে দিচ্ছে। তবে এখন পর্যন্ত বড় ধরনের কোনো অঘটন ঘটেনি। মাঠ কিন্তু তেতে আছে। অবস্থা এমন যে, সামান্য অজুহাতে হাঙ্গামা বেঁধে যেতে পারে।
এবার ডাকসু নির্বাচন হচ্ছে অনেক বছর পর। এখন যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, তারা কেউ এর আগে ডাকসু নির্বাচনে অংশ নেওয়া কিংবা ভোট দেওয়ার সুযোগ পাননি। তাই সবার আগ্রহ এই নির্বাচনকে ঘিরে। আর পাঁচ মাস বাদে জাতীয় নির্বাচন। সেটি ঘিরেও আছে উত্তেজনা আর অনিশ্চয়তা। দলগুলোর মধ্যে একটা মারমার কাটকাট পরিস্থিতি। ডাকসু নির্বাচনকে জাতীয় নির্বাচনের ‘ড্রেস রিহার্সেল' হিসেবে দেখছেন অনেকেই। কেননা, এটিই হবে তরুণদের মধ্যে জনপ্রিয়তা যাচাইয়ের মাপকাঠি। আমরা জানি, সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটার হচ্ছেন তরুণ। জাতীয় নির্বাচনেও তাঁরা প্রথমবারের মতো ভোট দেবেন।
অতীতে ছাত্র রাজনীতির পথ বেয়ে অনেকেই জাতীয় রাজনীতিতে পাকা আসন নিয়েছেন। তাদের শুরুটা হয়েছিল ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। পরবর্তীতে সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, শিক্ষা কমিশনবিরোধী আন্দোলন এবং উনসত্তরের গণআন্দোলনের ভেতর দিয়ে ছাত্রদের যে প্রজন্মটি বেরিয়ে এসেছে, স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতিতে সামনের কাতারে থেকে তারাই নেতৃত্ব দিচ্ছেন। নিয়মিত ছাত্রসংসদ নির্বাচন না হওয়ায় ছাত্র নেতৃত্ব বিকশিত হতে পারেনি। ফলে জাতীয় রাজনীতিতে এক ধরনের শুন্যতা তৈরি হয়েছে। এই সুযোগে রাজনীতিতে সামরিক-অসামরিক আমলা আর ব্যবসায়ীরা জেঁকে বসেছেন।
ছাত্ররাজনীতি বন্ধ হলে কার লাভ, কার ক্ষতি?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে হলগুলোতে ছাত্র রাজনীতি থাকবে কিনা তা নিয়ে শিক্ষার্থীরা বিভক্ত। এই নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নেতা, সাধারণ শিক্ষার্থীদের মতামত।
ছবি: Abdul Goni
বাকের মজুমদার (আহ্বায়ক, গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)
গত বছরের ১৭ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষার্থী হল প্রশাসনের সঙ্গে বসে একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে হলে ছাত্র রাজনীতি করা যাবে না। এখানে লাভ-ক্ষতির চেয়ে বড় কথা হলো শিক্ষার্থীরা কি চায়? তারা একমত যে, হলে তারা ছাত্ররাজনীতি চায় না। আমরা যেহেতু শিক্ষার্থীদের পক্ষে, তাদের চাওয়াই আমাদের চাওয়া। আমরা হলে যেমন ওপেন রাজনীতির বিরোধিতা করছি, তেমনি গুপ্ত রাজনীতির যে কথা শুনতে পাই, সেটাও বন্ধ হওয়া উচিৎ।
ছবি: Samir Kumar De/DW
নুজিয়া হাসিন রাশা (সভাপতি, বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)
রাজনীতি নিষিদ্ধ করার পরিকল্পনা নিজেই একটি রাজনৈতিক প্রজেক্ট - জনগণকে রাজনৈতিকভাবে নিরস্ত্র করার, তাদের সংগঠিত প্রতিরোধ ভেঙে দেওয়ার এবং শাসকগোষ্ঠীর স্বার্থ সুরক্ষিত করার কৌশল। রাজনীতি নিষিদ্ধকরণ মূলত গুপ্ত সংগঠন, সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থগোষ্ঠী, কর্পোরেট এনজিও ও ক্ষমতাসীনদের পক্ষে কাজ করে, যা জনগণের গণতান্ত্রিক স্পেসকে সংকীর্ণ করে। প্রতিরোধের রাজনীতি করা প্রত্যেক নাগরিকের অধিকার।
ছবি: Samir Kumar De/DW
মেঘমল্লার বসু (সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)
রাজনীতি বন্ধ করা সম্ভব না, হয় তা প্রকাশ্যে থাকে নয়তো তা গুপ্ত পথ নেয়। রাজনীতি নিষিদ্ধ করার অর্থ, প্রকাশ্য রাজনীতিকে নিরুৎসাহিত করে গুপ্তপন্থাকে প্রণোদনা দেওয়া। এহেন পদক্ষেপ অন্তর্ঘাতের দরজা খুলে দেয়।
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
আরমানুল হক (সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)
আমি যখন হলে অবস্থান করব, তখন তো আমার পরিচয়কে লুকাতে পারি না! হলে ছাত্র রাজনীতি সমস্যা, নাকি হলের দখলদারিত্ব সমস্যা? হলে যদি ১ম বর্ষ থেকেই প্রশাসনিক তত্ত্বাবধানে বৈধ সিটের ব্যবস্থা করা হয়, তাহলে কীভাবে একটা নির্দিষ্ট দল দখল করতে পারে? আর ডাকসু নির্বাচন পরবর্তী সময়ে হল সংসদকে প্রশ্ন করার জন্য ছাত্র রাজনৈতিক দল ছাড়া ভিন্ন কোন ফোরাম আছে কিনা, তা একটা বড় প্রশ্ন।
ছবি: Samir Kumar De/DW
আশরেফা খাতুন (মুখপাত্র, গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)
বিগত সময়ে আমরা দেখেছি, হলে নিয়োজিত হাউজ টিউটররাও ক্ষমতাসীন দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে গণরুম, গেস্টরুমের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিতে পারেন নাই। হলভিত্তিক রাজনৈতিক দলের কমিটি দেওয়া শুরু হলে আবারও এক চিত্রের আবির্ভাব ঘটবে। আমি চাই, আবাসিক হলগুলোতে নিয়মিত ছাত্র সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই প্রতিনিধিত্ব করুক যাতে দখলদারিত্ব, গণরুম, গেস্টরুমের বিভীষিকা ফিরে না আসে।
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
নাহিদুজ্জামান শিপন (সাধারণ সম্পাদক, ছাত্রদল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)
সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সূতিকাগার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনগুলোর সূত্রপাত ঘটে হলগুলোর শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে। হলে রাজনীতি বন্ধ রাখার এমন সিদ্ধান্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের সাথে সাংঘর্ষিক এবং অগণতান্ত্রিক। এমন অগণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিয়ে ডাকসু নির্বাচনকে অর্থবহ করা যাবে না।
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
এস এম সাইফ কাদের রুবাব (মানবাধিকার বিষয়ক সম্পাদক, ছাত্রদল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)
হল রাজনীতি নিষিদ্ধ করার প্রচেষ্টা আদতে ডাকসুকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যন্ত্রের হাতে কুক্ষিগত করার প্রচেষ্টা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে বিরাজনীতিকরণের প্রক্রিয়া। এমন অগণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের কোন কল্যাণে আসবে না।
ছবি: Samir Kumar De/DW
জাহিদুল ইসলাম তাহসিন (শিক্ষার্থী, আরবী বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)
ক্যাম্পাসের বড় সমস্যাগুলোর একটি সিট সংকট, আর হলে রাজনীতি ফিরে এলে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় নেতারা প্রশাসনকে প্রভাবিত করে ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকদের অগ্রাধিকার দিতে পারে। একই সঙ্গে হলে একক প্রশাসনিক কর্তৃত্ব দুর্বল হয়ে পড়বে, কারণ ভিন্ন ভিন্ন দল নিজেদের অ্যাজেন্ডা নিয়ে সক্রিয় হয়ে উঠবে। এর ফলে হলের অভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলা ভঙ্গ হবে এবং পড়াশোনার পরিবেশ মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হবে।
ছবি: Samir Kumar De/DW
মারুফ হাসান শাহিন (শিক্ষার্থী, ইতিহাস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)
হলে ছাত্র রাজনীতি চালু হলে আগের মতো গণরুম প্রথা ফিরে আসতে পারে, কারণ অতীতে দেখা গেছে সরকার দলের রাজনৈতিক নেতারা প্রশাসনকে নিয়ন্ত্রণ করে বছরের পর বছর অবৈধভাবে হলে অবস্থান করত। একইভাবে পরিচয় পর্ব ও ম্যানার শেখানোর নামে গেস্টরুম প্রথাও আবার শুরু হতে পারে। দলীয় কোন্দল বেড়ে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, কেননা আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনগুলো প্রায়ই ক্ষমতার অপব্যবহার করে থাকে।
ছবি: Samir Kumar De/DW
9 ছবি1 | 9
এর উল্টো পিঠও আছে। ছাত্র রাজনীতির নামেবিশ্ববিদ্যালয়ে লেজুড় সংগঠনগুলো শিক্ষা সংক্রান্ত বিষয়গুলোর চেয়ে দলীয় রাজনীতিই করেছে বেশি। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হয়ে উঠেছে বিকৃত রাজনীতির আখড়া। অনেক ছাত্র আছেন, যারা রাজনীতি সচেতন, কিন্তু নোংরা দলবাজি করেন না। এবারের ডাকসু নির্বাচনে সে রকম ‘নির্দলীয়' প্রার্থী দেখা যাচ্ছে। নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে আগাম আভাস দেওয়া যাচ্ছে না। ফলে সবার আগ্রহ থাকবে ৯ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠেয় ডাকসু নির্বাচন নিয়ে।
এবারের ডাকসু নির্বাচনকে ঘিরে মূল চ্যালেঞ্জ হলো শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রেখে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছাত্রদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। যদি এটি ভালোয় ভালোয় উৎরে যায়, তাহলে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে তার ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। তবে এ নিয়ে আত্মতুষ্টির সুযোগ নেই। জল ঘোলা করার লোকের অভাব নেই। সম্প্রতি চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে হাঙ্গামা হয়েছে। এটি একটি অশনি সংকেত।