ডায়াবেটিস পুরোপুরি নিরাময় করতে জার্মানিতে অভিনব উদ্যোগ
২২ এপ্রিল ২০১৯
ডায়াবেটিস আজও বিশ্বব্যাপী এক বড় সমস্যা৷ রোগীদের সাধারণত সারা জীবন ধরে ওষুধ ও ইনসুলিন ইঞ্জেকশনের উপর নির্ভর করতে হয়৷ কিন্তু প্রথম পর্যায়ে ওজন কমিয়ে ও কিছু নিয়ম মেনে এই রোগ পুরোপুরি দূর করা সম্ভব৷
ছবি: NDR
বিজ্ঞাপন
জার্মানিতে প্রায় ৬০ লক্ষ ডায়াবেটিসের রোগী রয়েছেন৷ প্রতিদিন প্রায় হাজারখানেক মানুষ সেই তালিকায় যুক্ত হচ্ছেন৷ নাটকীয় এই পরিস্থিতির মাঝে এক গবেষণা অনুযায়ী, শুধু ওজন কমিয়ে ডায়াবেটিসের মোকাবিলা করা সম্ভব৷ পুষ্টি বিশেষজ্ঞ ড. মাটিয়াস রিডেল বলেন, ‘‘আমার কাছে এটা একটা মাইলফলক৷ এটা স্পষ্ট, যে ডায়াবেটিস নিরাময় করা সম্ভব৷ আগের মতো এই রোগকে আর নিয়তি হিসেবে মেনে নিতে হবে না৷''
ইংল্যান্ডের এই গবেষণায় প্রমাণ পাওয়া গেছে, যে রোগ দেখা দেওয়ার পর প্রথম ৬ মাসের মধ্যে শুধু ওজন কমিয়ে সেটি নিরাময় করা সম্ভব৷ তাতে কোনো ওষুধের প্রয়োজন পড়ে না৷
এক পরীক্ষার আওতায় খাদ্য তালিকার অত্যন্ত কড়া নিয়ম অনুযায়ী অংশগ্রহণকারীদের খেতে দেওয়া হয়েছিল৷ তিন মাস ধরে তাঁদের দিনে শুধু ৯০০ ক্যালোরি পরিমাণ নিউট্রিশন শেক খেতে হয়েছে৷ সেইসঙ্গে মনস্তাত্ত্বিক ও পুষ্টি বিশেষজ্ঞরা তাঁদের পরামর্শ দিয়েছেন৷ বেশ কিছু ব্যায়ামও করতে হয়েছে৷ তার ফল ছিল বেশ চমকপ্রদ৷
যারা ৭ কিলোগ্রাম পর্যন্ত ওজন কমাতে পেরেছেন, তাঁদের মধ্যে ৭ শতাংশ মানুষ পুরোপুরি ডায়াবেটিস ট্যাবলেট ছাড়াই সুস্থ হয়ে উঠেছেন৷ যারা ১৫ কিলো ওজন কমাতে পেরেছেন, তাঁদের মধ্যে ৮৬ শতাংশ এই লক্ষ্য পূরণ করতে পেরেছেন৷ ড. মাটিয়াস রিডেল এ বিষয়ে বলেন, ‘‘এই গবেষণা ডায়াবেটিস চিকিৎসার ক্ষেত্রে বিপ্লব এনেছে৷ ডাক্তার ও রোগীদের নতুন করে ভাবতে হবে৷ সারা জীবন ধরে ট্যাবলেট ও ইনসুলিন গ্রহণ না করেও রোগ নিরাময় সম্ভব৷''
ডিয়র্ক ফন গ্রুবে নিজের ওজন কমিয়ে ইনসুলিন ইঞ্জেকশনের উপর নির্ভরতা কাটাতে পেরেছেন৷ আগে তিনি সব সময়ে কিছু না কিছু খেয়ে যেতেন৷ প্রচুর পরিমাণ কার্বোহাইড্রেট ও তার মাঝে মিষ্টি জাতীয় খাদ্য৷ এভাবে তিনি মোটা হতে হতে ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্ত হন৷ ড. মাটিয়াস রিডেল এই প্রক্রিয়ার ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘‘শরীরের ইন্দ্রিয়গুলি ও পেটে মেদের আধিক্যই ডায়াবেটিসের প্রধান কারণ৷ যত বেশি চর্বি, তত বেশি ইনসুলিনের প্রয়োজন হয়৷ ইনসুলিনের প্রয়োজনীয়তা যত বাড়ে, তত বেশি মেদ জমা হয়৷ এই দুষ্টচক্র অনেক মানুষের জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক৷ এমনকি মৃত্যুও হতে পারে৷ তাই সেই চক্র ভেঙে দিতে হবে৷''
শরীর কার্বোহাইড্রেটকে গ্লুকোজে পরিণত করে৷ প্যানক্রিয়া বা অগ্ন্যাশয় ইনসুলিন উৎপাদন করে, যা রক্ত থেকে শর্করা শরীরের কোষে পাঠায়৷ এভাবে রক্তে শর্করার মাত্রা কম থাকে৷
অতিরিক্ত চিনি খেলে কোষগুলি ইনসুলিন প্রতিরোধ করতে শেখে৷ ফলে দীর্ঘমেয়াদী ভিত্তিতে অগ্ন্যাশয়ের উপর বেশি চাপ পড়ে৷ কোনো এক সময় ইনসুলিন উৎপাদন কমে যায়৷ তখন শর্করা আর রক্ত থেকে কোষের মধ্যে যায় না৷ সেই শর্করা ভাঙতে তখন ইনসুলিন ইঞ্জেকশন দিতে হয়৷ ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ ড. ক্র্যোগার বলেন, ‘‘ওজন যত বেশি হবে, ইনসুলিনের প্রভাব তত খারাপ হবে৷ অর্থাৎ আমি ওজন কমানোর চেষ্টা না করলে আমার শরীরের মধ্যের ইনসুলিনের প্রভাবের আরও অবনতি হয়৷ এমনকি আমি ইনসুলিন ইঞ্জেকশন নিলে তার প্রভাবও খারাপ হয়৷ ফলে সহজেই ওজন বাড়তে থাকে৷''
ডিয়র্ক ফন গ্রুবে একজন পুষ্টি বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিয়ে নিজের খাদ্যাভ্যাস বদলে ফেলেছিলেন৷ এভাবে তিনি ২৩ কিলো ওজন কমিয়েছিলেন৷ ফলে তিনি ওষুধ খাওয়াও অনেক কমাতে পেরেছিলেন৷ ড. রিডেল তাঁকে মনে করিয়ে দেন, ‘‘যখন আপনি আমাদের কাছে এসেছিলেন, তখন অনেক ইঞ্জেকশন নিতে হতো৷ আর এখন সামান্য কিছু ট্যাবলেট খেতে হয়৷ এমনটা অব্যাহত থাকলে আরও উন্নতি হবে৷''
ডিয়র্ক ফন গ্রুবে রক্তের শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছেন৷ তবে তিনি অত্যন্ত ব্যতিক্রমী এক দৃষ্টান্ত৷ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই চিকিৎসা হিসেবে পুষ্টি ও ব্যায়ামের উপকারিতা পরখ করার আগেই ডাক্তার ট্যাবলেট ও ইঞ্জেকশন লিখে দেন৷
উলরিকে হাইমেস/এসবি
ডায়েবেটিস থেকে সাবধান!
গত ৩৫ বছরে ‘টাইপ টু’ ডায়েবেটিস রোগী চারগুণ বেড়েছে৷ বর্তমানে সারা বিশ্বে ‘টাইপ টু’ ডায়েবেটিস রোগীর সংখ্যা ৪৪ কোটি ২০ লক্ষ৷ জেনে নিন এ রোগ থেকে দূরে থাকার কিছু উপায়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/F. Rumpenhorst
হালকা খাবার
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ডায়েবেটিস রোগীর সংখ্যা বাড়ার মূল কারণ, অতিরিক্ত ওজন৷ ডায়েবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে ও ওজন কমাতে রাতে হালকা খাবার খাওয়া উচিত৷ রাতে ফুল প্লেট ভাত, পাস্তা বা নুডল খাওয়া থেকে বিরত থাকার পরামর্শ জার্মান পুষ্টি গবেষণা কেন্দ্রের৷ কারণ রাতে শর্করা জাতীয় খাবার গ্রহণ করলে তা রক্তে চিনির মাত্রা বাড়িয়ে দেয়৷
ছবি: picture-alliance/ZB
স্যাকারিন নয়!
ডায়েবেটিস রোগীদের অনেকেই চিনির বিকল্প হিসেবে স্যাকারিন খান৷ তবে রক্তে চিনির মাত্রা কমে গেলে অনেকেই যখন মিষ্টি খাওয়ার প্রয়োজন বোধ করেন, তখন কিন্তু স্যাকারিন তা দমন করতে পারে না৷ আসল চিনিই কেবল সেক্ষেত্রে উপকারী৷ এ কথা জানিয়েছে সুইজারল্যান্ডের ল্যুজানে বিশ্ববিদ্যালয়৷
ছবি: Imago/teutopress
নিয়মিত চোখ পরীক্ষা করানো
যদি কেউ হঠাৎ করে সকালে চোখে ঝাপসা এবং বিকেলে স্পষ্ট দেখেন, তার খুব তাড়াতাড়ি চোখের ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিত, কারণ, এটা ডায়েবেটিস শুরু হওয়ার প্রথম লক্ষণ হতে পারে৷ চিনির মাত্রার ওঠা-নামার কারণে চোখের মণিতে পানি জমে তা চোখের রক্তের ধমনীর ক্ষতি করতে পারে৷ এ কথা জানিয়েছে, জার্মানির অপথ্যালমলোজিক্যাল সোসাইটি৷
ছবি: Colourbox/Monkey Business Images
সাইকেল চালান, ডায়েবেটিসকে দূরে রাখুন
ডেনমার্কের একটি বিশ্ববিদ্যলয়ের ৫২,০০০ জন মানুষকে নিয়ে করা এক সমীক্ষার ফলাফল থেকে দেখা গেছে, তাদের মধ্যে যারা সাইকেল চালান, তাদের ডায়বেটিস ‘টাইপ টু’-র ঝুঁকি অনেক কম৷
ছবি: picture alliance / dpa
শিশুকে বুকের দুধ পান করান
শিশুকে বুকের দুধ পান করালে তা মা ও শিশু দু’জনের জন্যই উপকারী৷যে মা শিশুকে তার দুধ পান করান, পরবর্তী দশ বছর তার ডায়েবেটিস ‘টাইপ টু’ হওয়ার ঝুঁকি শতকরা ৪০ ভাগ কমে যায়৷ এই তথ্য জানাচ্ছে, জার্মানির মিউনিখ শহরের হেল্মহল্জ সেন্টারের একটি গবেষণা৷
ছবি: Svetlana Fedoseeva - Fotolia.com
5 ছবি1 | 5
ওষুধ ছাড়া ডায়বেটিসকে দূরে রাখার কিছু উপায়
আগে বলা হতো, একবার ডায়বেটিস হলে তা নাকি সারাজীবন থাকে৷ যা আর এখন সত্য নয়, বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন সমীক্ষার মাধ্যমে এ ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছেন৷ তাঁদের মতে, সতর্কভাবে সঠিক খাবার খাওয়া হলে ডায়বেটিস থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব৷
ছবি: Colourbox/L. Dolgachov
খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন এনে ওজন কমানো
খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন এনে অতিরিক্ত ওজন কমানোর মাধ্যমে ডায়বেটিস শতকরা ৯০ ভাগ কমানো সম্ভব৷ যদি সে রোগীর ডায়বেটিসে ভোগার সময়কাল চার বছরের কম হয়ে থাকে৷ একথা জানান, জার্মান ডায়বেটিস বিশেষজ্ঞ প্রফেসার স্টেফান মার্টিন৷
ছবি: Colourbox
নুডলস যখন ‘বিষ’
নুডলস বা মিষ্টি জাতীয় খাবারের শর্করা রক্তে চিনির মাত্রা মুহূর্তের মধ্যেই বাড়িয়ে দেয়, যার ফলে শরীরের কোষে ইনসুলিন হরমোন ছড়িয়ে পড়ে৷
ছবি: dapd
দিনে মাত্র ৬০০ ক্যালোরি
২০০ ডায়বেটিস রোগী নিয়ে করা একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, ডায়বেটিস রোগীরা কড়া ডায়েটিং করে, অর্থাৎ দিনে মাত্র ৬০০ ক্যালরি প্রোটিনযুক্ত খাবার খাওয়ার পর ঔষুধ সেবন বন্ধ করতে পেরেছেন৷ তাছাড়া দীর্ঘ তিন মাস শর্করা জাতীয় খাবার পুরোপুরি বাদ দিয়ে শুধু প্রোটিনযুক্ত খাবার খেয়েও একই ফল পাওয়া গেছে৷
ছবি: picture alliance/chromorange
তিন বেলা প্রোটিন
তিন সপ্তাহ ধরে তিন বেলাই প্রোটিনযুক্ত খাবার খেলে অবশ্যই রক্তে চিনির মাত্রা কমে যাবে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞ স্টেফান মার্টিন৷ মাছ, মুরগি, ডিম, মটরশুটি এবং দুধ জাতীয় খাবারে রয়েছে প্রচুর প্রোটিন৷
ছবি: picture-alliance/Food and Drink Photos/H. Tupper
বাদামও খুব উপকারী
ডায়বেটিস রোগীকে প্রতিদিন এক মুঠো বাদাম, আখরোট খাওয়ার কথা পরামর্শ দেন ডাক্তাররা, কারণ, বাদামের ম্যাগনেশিয়াম ইনসুলিনের প্রভাবকে নিয়ন্ত্রণে রাখে৷
এ সবে ক্যালরি প্রায় নাই বললেই চলে৷ তবে এতে থাকা পানি পেট ভরায় এবং খুব ধীরে ধীরে রক্তে প্রবেশ করে৷ সালাদের সাথে অলিভ অয়েল মিশিয়ে নিলে অনেকক্ষণ খিদেও পায় না৷ তাই প্রচুর সালাদ খাওয়ার পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা৷
ছবি: colourbox.de
colourbox.de
colourbox.de
স্ট্রবেরি, আপেল
এ সব ফলে অন্যান্য ফলের তুলনায় অনেক কম শর্করা রয়েছে৷ কাজেই ওজন কমাতে এবং ব্লাডপ্রেশার নিয়ন্ত্রণে রাখতে কোনো চিন্তা না করে এ ধরনের ফল যত খুশি খাওয়া যায়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/A. Burgi
বাইরের কেনা খাবার একেবারেই বাদ রাখুন
ডায়বেটিস রোগীর এক প্লেট খাবারের অর্ধেকটাই হতে হবে সালাদ বা সবজি৷ আর বাকি অর্ধেকে চার ভাগের তিন ভাগ প্রোটিনযুক্ত খাবার আর এক ভাগ থাকতে পারে শর্করা জাতীয় খাবার৷ বাইরের কেনা খাবার একেবারেই বাদ রাখুন৷ এই নিয়মগুলো মেনে চললে ডায়বেটিসকে নিয়ন্ত্রণে রাখা মোটেই কষ্টকর নয়৷