যে বয়সে শিশুরা মায়ের কোলে মাথা গুঁজে আদর-ভালোবাসা নেয়, হেসে-খেলে কেটে যায় সোনালী দিন, সেই বয়সেই মিরিয়াম রউইককে দেখতে হয়েছে কল্পনাতীত নিষ্ঠুরতা৷ সমসাময়িক পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর যুদ্ধে ঘর-বাড়ি-চারপাশ ধ্বংস হতে দেখেছে সে৷
বিজ্ঞাপন
দিন রাত সময় কেটেছে আতঙ্কেই৷ তবে ভয়ে সে কুঁকড়ে যায়নি৷ বরং ভয়ের সেই সময়গুলোকে সে লিখে রেখেছে ডায়েরিতে৷ যেন যে কোনো সময়েই পাতা উল্টে তাকানো যায় অতীতে৷ এক সময়কার সিরিয়ার অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র আলেপ্পো যখন জঙ্গিরা দখল করে নেয়, তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ৮ বছর৷ তখন শিশুমনের স্মৃতির গাঁথুনিতে একে একে যোগ হয়েছে ভয়ঙ্কর সব দুঃস্বপ্ন৷ মিরিয়াম লিখেছে, ‘‘এক সকালে ভয়ঙ্কর আওয়াজে জেগে উঠি৷ মনে হচ্ছিল যেন সব চুরমার হয়ে যাচ্ছে৷ মানুষ ‘আল্লাহু আকবার' বলে চিৎকার দিচ্ছিল৷''
‘‘আমি প্রচণ্ড ভয় পাই৷ মনে হচ্ছিল, সবকিছু বুঝি শেষ হয়ে যাচ্ছে৷ তীব্র শক্তি দিয়ে আমি আমার পুতুলকে বুকে চেপে ধরি৷ তাকে বলতে থাকি, ভয় পেয়ো না, ভয় পেয়ো না, আমি আছি তোমার সাথে৷''
এভাবে তার ডায়েরির পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে ভয়ঙ্কর সেই সব দিনের উপাখ্যান৷ মাতৃভাষা আরবিতে লেখা সেই ডায়েরির সন্ধান পান একজন ফরাসি সাংবাদিক৷ বার্তা সংস্থা এএফপি তা প্রকাশ করে৷
কোণঠাসা হলেও ফুরিয়ে যায়নি আইএস
তথাকথিত ইসলামিক স্টেট সিরিয়া ও ইরাকে তাদের মূল ক্ষমতাকেন্দ্রে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে৷ তবে মিশর, লিবিয়া, আফগানিস্তানের মতো দেশেও তাদের প্রভাব কম নয়৷ ইউরোপে আইএস ভাবধারায় অনুপ্রাণিত ব্যক্তিদের কার্যকলাপের ঝুঁকিও বাড়ছে৷
ছবি: Reuters/Rodi Said
সিরিয়া ও ইরাকে জমি হাতছাড়া
রাকা শহরকে কেন্দ্র করে বিশাল খিলাফত গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেছিল আইএস৷ সিরিয়া ও ইরাকের বিস্তীর্ণ অংশ তাদের নিয়ন্ত্রণে এসে গিয়েছিল৷ মার্কিন নেতৃত্বে কোয়ালিশন বাহিনীসহ একাধিক শত্রুর চাপে তারা অনেক এলাকার উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে৷
ছবি: Reuters
আর্থিক সংকট
‘খিলাফত’ স্থাপন করতে অর্থের প্রয়োজন৷ রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের মতোই এলাকা দখল করে কর বাবদ টাকা তুলে, সেখানকার প্রাকৃতিক ও অন্যান্য সম্পদ বিক্রি করে এসেছে আইএস৷ তাদের যোদ্ধা ও কর্মীদের বেতন-ভাতাও এসেছে সেখান থেকে৷ বর্তমানে জমি হারিয়ে চরম অর্থাভাবে ভুগছে আইএস৷
ছবি: Reuters/Rodi Said
লিবিয়ায় আবার মাথাচাড়া দেবার প্রচেষ্টা
যেখানেই অরাজকতা, সেখানেই সুযোগ খোঁজার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ে আইএস৷ সিরিয়া ও ইরাকে ধাক্কা খেয়ে লিবিয়ায় আবার উপস্থিতি বাড়াতে চাইছে তারা৷ সে দেশের একনায়ক গাদ্দাফির বিরুদ্ধে সংগ্রামের পর অনেক চরম ইসলামপন্থি গোষ্ঠী আইএস-এর ছত্রছায়ায় চলে আসে৷ প্রাথমিক সাফল্যের পর সেখানেও জমি হারায় তারা৷ এবার নতুন করে উপস্থিতি বাড়াতে চাইছে আইএস৷
ছবি: Reuters/I. Zitouny
ইয়েমেনে কঠিন লড়াই
অরাজকতার সুযোগ নিয়ে ইয়েমেনেও পা রাখতে চেয়েছিল আইএস৷ কিন্তু সেখানে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী কম নয়৷ আল-কায়েদা ও শিয়া বিদ্রোহীদের দৌরাত্ম্যের মাঝে জায়গা করে নিতে আইএস-কে বেগ পেতে হয়েছে৷ শিয়া-সুন্নি সংঘাতের বৃহত্তর কালো ছায়া তাদের অ্যাজেন্ডা অনেকটা দাবিয়ে রেখেছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Y.Arhab
মিশরে উপস্থিতি
মিশরের সিনাই উপদ্বীপে আইএস ঘাঁটি গেড়েছে৷ খ্রিষ্টানসহ অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে হিংসাত্মক কার্যকলাপ চালিয়ে তারা মিশরের প্রশাসনকে বেকায়দায় ফেলছে৷ দু’টি গির্জার উপর সাম্প্রতিক হামলার পর সরকার জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে৷
ছবি: Reuters/A. Aboulenein
আফগানিস্তানে তালেবানকে চ্যালেঞ্জ
দুর্বল রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের সুযোগ নিয়ে এতকাল আফগানিস্তানে চরমপন্থি সন্ত্রাস চালিয়ে এসেছে তালিবান৷ তাদের শক্তিক্ষয়ের ফলে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে, তার অনেকটাই দখল করতে এগিয়ে এসেছে আইএস৷ জেহাদি ভাবধারার সওদাগর হিসেবে নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে চাইছে তারা৷
ছবি: picture-alliance/dpa/TTP
অনুপ্রেরণার উৎস
সরাসরি এলাকার উপর নিয়ন্ত্রণ ও সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ পরিচালনা ছাড়াও ভাবাদর্শ ও জেহাদি রপ্তানির কাজেও সাফল্য দেখিয়েছে আইএস৷ কোনো দেশে সন্ত্রাসী হামলার ডাক দিয়ে এমনকি অচেনা মানুষকেও উদ্বুদ্ধ করে লক্ষ্য হাসিল করেছে এই গোষ্ঠী৷ নিস, প্যারিস, বার্লিন, লন্ডন, স্টকহোম-এর মতো শহরে হামলার ক্ষেত্রে এমনটা দেখা গেছে৷
ছবি: picture alliance/ZUMAPRESS.com
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বনাম আইএস
পূর্বসূরি বারাক ওবামা-র কড়া সমালোচনা করে ডোনাল্ড ট্রাম্প আইএস-কে নির্মূল করার ব্রত নিয়েছেন৷ ক্ষমতায় আসার পর ইয়েমেন ও আফগানিস্তানে সরাসরি আইএস-এর বিরুদ্ধে সামরিক হামলার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি৷ তবে এক্ষেত্রে কোনো সার্বিক নীতি এখনো স্পষ্ট নয়৷
ছবি: picture-alliance/R. Sachs/CNP/AdMedia
8 ছবি1 | 8
ডায়েরি জুড়ে রয়েছে এক কর্মজীবী খ্রিষ্টান পরিবারের গল্প৷ নিজেদের ঘরবাড়ি, পরিচিত জগত ছেড়ে যাওয়ার গল্প৷ কিভাবে জঙ্গিরা ওই এলাকায় আসে, কিভাবে তাদেরকে পরিচিত এই জগৎ ছাড়ার নির্দেশ দেয়, আর তারাও সেটা মানতে বাধ্য হয়– এসবের বর্ণনা৷ ৮ বছর বয়সে আলেপ্পোর পতন দেখা মিরিয়ামের বয়স এখন ১৩ বছর৷
সম্প্রতি এএফপিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে সে বলে, ‘‘যুদ্ধ যখন একটা বিরতি নেয়, তখন মা আমাকে ডায়েরি লিখতে উৎসাহ জোগান৷ আমি ভাবি, হ্যাঁ, আমার ডায়েরি লেখা উচিত, কারণ, এর মাধ্যমেই একদিন আমি স্মরণ করতে পারবো–কী হয়েছিল এই সময়ে৷''
ফরাসি এক সাংবাদিক মিরিয়াম ও তার ডায়েরির কথা জানতে পারেন৷ তিনি বুঝতে পারেন, এই ডায়েরি যুদ্ধকে ভেতর থেকে দেখার একটা দরজা খুলে দিতে পারে৷ ২০১১ সালের নভেম্বর থেকে ২০১৬ সালের ডিসেম্বর পর্য ন্ত সময়ে এই ডায়েরি লেখা হয়৷ যুদ্ধ হোক আর শান্তি হোক, শিশুর বড় হওয়া তো আর থেমে থাকে না৷ লড়াই-সংঘাতের মাঝেই বড় হচ্ছিল মিরিয়াম৷ ডায়েরিতে তাই বড় হওয়ার নানা ধাপের যেন ধারাবিবরণী দিয়েছে মেয়েটি৷ আলেপ্পোর দেয়ালে দেয়ালে সে দেখেছে বিপ্লবী স্লোগান৷ সরকার বিরোধী বিক্ষোভ, নগরের পূর্বাংশে বছরব্যাপী অবরোধ– এ রকম নানা কিছুর অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে তাকে যেতে হয়েছে৷
আলেপ্পোপৃথিবীর প্রাচীনতম নগরগুলোর একটি৷ কিছুদিন আগেও এটি ছিল সিরিয়ার অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র৷ সিরিয়ার লড়াইয়ের মূল কেন্দ্রে পরিণত হওয়ার আগে এটি আগলে রেখেছিল সাংস্কৃতিক ঐশ্বর্যের বহু নিদর্শন৷ তবে বিদ্রোহী আর সরকারি বাহিনীর লড়াইয়ের এক পর্যায়ে নগরটি দুইভাগে ভাগ হয়ে যায়৷ দুইপক্ষ দুই অংশের নিয়ন্ত্রণ নেয়৷ সিরিয়ার এই সংঘাতে কয়েক লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে৷
ওদের কী অপরাধ?
ওরা শিশু, কারো জন্ম মাত্র কয়েকমাস আগে৷ কিন্তু সবাই ভুগছে নানা রোগে৷ কারো কারো পেটে প্রচণ্ড ক্ষুধা, কিন্তু খেতে পারছে না তীব্র অপুষ্টির শিকার হওয়ায়৷ বলছি ইরাকের মোসুলের শিশুদের কথা৷
ছবি: Reuters/S. Salem
যুদ্ধের খেসারত
তথাকথিত জঙ্গি গোষ্ঠী ‘ইসলামিক স্টেট (আইএস)-এর সঙ্গে ইরাকের সামরিক বাহিনীর টানা যুদ্ধের পর মোসুলের অনেকাংশই জঙ্গিদের হাতছাড়া হয়েছে৷ কিন্তু যুদ্ধের ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছে সেখানকার শিশুরা৷ বিশেষ করে যুদ্ধ চলাকালে যাদের জন্ম, তাদের অধিকাংশই তীব্র অপুষ্টির শিকার৷ ছবিতে ছয়মাস বয়সি মেয়ে শিশু নওরশ রাইদের হাত ধরে আছেন ‘মেডেসিন্স স্যান ফ্রন্টিয়াস’ (এমএসএফ)-এর এক নার্স৷
ছবি: Reuters/S. Salem
চাচির কোলে নাওয়াফ
আট বছর বয়সি দুয়া নাওয়াফকে এমএসএফ-এর হাসপাতালে নিয়ে এসেছেন তাঁর চাচি৷ গতমাসে মোসুলে মার্কিন নেতৃত্বাধীন বাহিনীর বিমান হামলায় নাওয়াফের বাবামাসহ একশ’রও বেশি মানুষ নিহত হন৷ তার মাথা ও হাত পুড়ে গেছে সেই হামলায়৷ নাওয়াফের মানসিক সমস্যা দেখা দিয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে৷ বিশেষ করে রাতের বেলা প্রচণ্ড আতঙ্কে ভোগে সে৷
ছবি: Reuters/S. Salem
ওজন কম
ইরাকের কাউজারায় এমএসএফ পরিচালিত এক হাসপাতালে ইরাকি এক শিশুর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করছেন এক চিকিৎসক৷ হাসপাতালের অধিকাংশ শিশুই অপুষ্টির শিকার এবং তাদের ওজন বয়স অনুপাতে অনেক কম৷ ইরাকে মায়েরা সাধারণত শিশুদের বুকের দুধ পান করান না৷ বরং ফর্মুলা মিল্ক পান করান তারা৷ এখন যুদ্ধের কারণে সেই দুধের সংকট তীব্র৷ আর মায়েরা চাইলেও সন্তানদের দুধ পান করাতে পারছেন না, কেননা, তারা নিজেরাও খাদ্য সঙ্কটে ভুগছেন৷
ছবি: Reuters/S. Salem
বোনের সঙ্গে খেলা
পাঁচ বছর বয়সি আয়হাম আহমেদ৷ সে কিছুদিন আগে মোসুলে এক বিস্ফোরণে পরিবারের অন্যান্য সদস্যের সঙ্গে আহত হয়েছিল৷ এখন সে হাসপাতালে বোনের সঙ্গে খেলছে৷ এমএসএফ-এর হাসপাতালে আসা অধিকাংশ রোগীর বয়স ১৫ বছরের নীচে৷ আর সেখানকার শিশু পরিচর্যা ইউনিটে ভিড় এত বেশি যে, প্রতি বিছানায় দু’জন করে রোগী রাখতে হচ্ছে৷ সংশ্লিষ্ট এলাকায় শিশু বিশেষজ্ঞের অভাব রয়েছে৷
ছবি: Reuters/S. Salem
‘ইরাকে এটা নতুন’
হাসপাতালে এক শিশু কাঁদছে৷ সে অপুষ্টির কারণে এত দুর্বল হয়ে পড়েছে যে, তার শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেক কমে গেছে৷ এমএসএফ-এর প্রকল্প সমন্বয়ক ইসাবেলা লিগাল বলেন, ‘‘ইরাকের শিশুদের এমন অবস্থা নতুন৷ ইরাকের অধিকাংশ চিকিৎসকই অতীতে এতটা অপুষ্টির শিকার শিশু দেখেনি৷’’
ছবি: Reuters/S. Salem
আইএস-এর কারণে
হাসপাতালে আসা এক মা অভিযোগ করে বলেন, আইএস-এর কারণে তাদের এত করুণ অবস্থা হয়েছে যে, শিশুদের চিনিমিশ্রিত পানি, দই বা পানিতে মেশানো ময়দা ছাড়া আর কিছু খাওয়াতে পারছেন না৷ ইরাকি সেনাদের সঙ্গে যুদ্ধের কারণে শহরটি খাবার পরিবহণ অনেক কমে গেছে৷
ছবি: Reuters/S. Salem
আর কতদিন?
এমএসএফ-এর হাসপাতালে এক শিশুকে পরীক্ষা করছেন চিকিৎসক৷ সেখানে ভর্তি হওয়া শিশুদের অনেকের শ্বাসকষ্ট এবং নিউমোনিয়ার সমস্যা রয়েছে৷ এছাড়া নানা ভাইরাসেও আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরা৷ প্রশ্ন হচ্ছে, যুদ্ধের কারণে তাদের এমন ভোগান্তি আর কতদিন চলবে?
ছবি: Reuters/S. Salem
7 ছবি1 | 7
ইরান ও রাশিয়ার সহায়তাপুষ্ট সরকারি বাহিনী গত বছরের শেষের দিকে নগরের পূর্বাংশে নিজেদের কর্তৃত্ব ফিরে পেয়েছে৷ মিরিয়াম লিখেছে, আলেপ্পো ছিলএকটা স্বর্গ৷ এটা ছিল আমাদের স্বর্গ৷'' এত সংঘাতের মাঝেও তার শিশুমনের বড় একটা অংশজুড়ে রয়েছে আঁকাআঁকি এবং গান৷ এসব নিয়ে বসলে তার সময় কেটে যায় বেশ৷ তবে এরপরও সে ভুলতে পারে না ২০১৩ সালের সেই অন্ধকার দিনটির কথা৷ যেদিন তাকে এবং তার পরিবারকে পালিয়ে যেতে বাধ্য করা হয়েছিল৷
সে লিখেছে, ‘‘আমি তাড়াহুড়া করে ব্যাগপ্যাকে আমার বইপত্র নিতে শুরু করি৷ আমি আমার বইগুলোকে খুবই ভালোবাসি৷ এগুলো ছাড়া আমি চলতে পারি না৷ ছররা গুলি থেকে বাঁচতে আমি দু'-দু'টো কোটও পরে নিই৷'' ‘‘রাস্তায় আরবীয় পোশাক কালো জেল্লাবা পরা এক ব্যক্তিকে দেখি৷ জঙ্গলের মতো দাড়িওয়ালা ওই লোকের হাতে একটা বন্দুক রয়েছে৷ আমি খুবই ভয় পেয়েছিলাম৷ এরপর ওইদিন একটি নিরাপদ স্থানে যেতে আমাদেরকে অনেকদূর হাঁটতে হয়েছে৷''
সেদিন পরিবারটি শহরের পশ্চিমাংশের সরকার নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকায় পৌঁছায়৷ তবে সেখানকার জীবনও উগ্বেগহীন ছিল না৷বিদ্রোহীরা প্রায়ই এই এলাকা লক্ষ্য করে বোমা নিক্ষেপ করতো৷ ‘‘সবচেয়ে ভয় পেয়েছিলাম মিসাইলে৷ এক সন্ধ্যায় আমি ঘুমাতে যাচ্ছি৷ হঠাৎ শুনি ভয়ঙ্কর এক আওয়াজ৷ কানে প্রায় তালা লেগে যাচ্ছিল৷ তাকিয়ে দেখি পুরো আকাশ যেন লাল হয়ে গেছে৷'' ‘‘আমরা যেখানে ছিলাম, তার পাশের রাস্তায় এসে সেই মিসাইল পড়ে৷''
মিরিয়াম বলেন, ‘‘মা-বাবা তখন আমাকে চিনি দেন৷ দিয়ে বলেন, ‘এটা খাও৷ এতে তোমার ভয় কমবে৷' কিন্তু ওই চিনি খাওয়ার পর আমি আমার মধ্যে কোনো পরিবর্তন দেখিনি৷'' কিভাবে তাদের পরিবার প্রতিবেশীর বাড়িতে আশ্রয় নেয়– সেই সব কথাও বলা আছে ডায়েরিতে৷ কষ্টের সেই দিনের কথা বলতে বলতে বর্ণনায় মজাও নিতে শুরু করে সে৷
সিরিয়ায় আসলে কারা, কাদের বিরুদ্ধে লড়ছে?
মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকার ২০১১ সালের সেই আরব বসন্তের জেরে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধের সূচনা হয়৷ গত ছয় বছরে সেই সংঘাতের বিস্তৃতি অনেক বেড়েছে, যোগ হয়েছে নতুন মিত্র, মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে পুরনো শত্রুতা৷
আসাদের প্রতি অনুগতরা
সিরিয়ার সেনাবাহিনী, যারা আনুষ্ঠানিকভাবে সিরিয়ান আরব আর্মি (এসএএ) হিসেবে পরিচিত, ২০১১ সালের শরতে তারা বড় এক জটিলতার মধ্যে পড়ে যায়৷ সেনাবাহিনীর একটি অংশ বিদ্রোহ করে আসাদ বিরোধী ‘অ্যান্টি-আসাদ ফ্রি সিরিয়ান আর্মি’ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে৷ তবে এসএএকে ন্যাশনাল ডিফেন্স ফোর্সসহ আসাদপন্থি বিভিন্ন মিলিশিয়া গ্রুপ সমর্থন দিচ্ছে৷
ছবি: picture alliance/dpa/V. Sharifulin
মডারেট দল
আসাদের শাসনের বিরুদ্ধে জনগণের প্রতিবাদ সহিংস রূপ নিলে ‘ফ্রি সিরিয়ান আর্মি’ তৈরির পথ প্রশস্ত হয়৷ জিহাদি নয়, এমন বিভিন্ন বিদ্রোহী গ্রুপের সঙ্গে মিলে তারা আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করতে লড়াই করছে৷ উদ্দেশ্য হচ্ছে, সিরিয়ায় গণতান্ত্রিক পথে সরকার গঠন করা৷ তবে বেশ কয়েকটি লড়াইয়ে হারার পর সেই দলের অনেকে বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীতে চলে যায়৷
ছবি: Reuters
সন্ত্রাসের নতুন রূপ
সিরিয়ায় বিশৃঙ্খলার সুযোগ নিয়ে সে দেশ এবং ইরাকের একটা বড় অংশ দখল করে নিজেদের তথাকথিত খেলাফত প্রতিষ্ঠা করে তথাকথিত জঙ্গি গোষ্ঠী ‘ইসলামিক স্টেট (আইএস)’৷ নিজের কালো পতাকাতলে ইসলামের উগ্রতম রূপ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অসংখ্য মানুষকে অত্যাচর এবং হত্যা করেছে জঙ্গি গোষ্ঠীটি৷ রাকা শহরে গোষ্ঠীটি শক্ত অবস্থান গড়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
এক পুরনো জিহাদ
তবে আইএসই সিরিয়ায় অবস্থান নেয়া একমাত্র জঙ্গি গোষ্ঠী নয়৷ আল-কায়দার সঙ্গে সম্পৃক্ত আল-নুসরা ফ্রন্টসহ আরো কয়েকটি জঙ্গি গোষ্ঠী সিরিয়ায় লড়ছে৷ আল-নুসরা ফ্রন্ট নিজেদের মধ্যে লড়াই ছাড়াও আসাদ এবং মডারেট বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধেও লড়ছে৷ সম্প্রতি জঙ্গি গোষ্ঠীটি সমমনা আরো কয়েকটি গোষ্ঠীকে নিয়ে জোট গড়েছে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/Nusra Front on Twitter
আসাদের এক শক্তিশালী মিত্র
প্রেসিডেন্ট আসাদের শক্তিশালী মিত্র ক্রেমলিন৷ সিরিয়ার সেনাবাহিনীকে কয়েকবছর ধরে রসদ সরবরাহের পর ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে আনুষ্ঠানিকভাবে সিরিয়া সংঘাতে যোগ দেয় রাশিয়ার পদাতিক বাহিনী৷ তবে রাশিয়ার বিমান হামলায় অনেক বেসামরিক প্রাণহানির কারণে মাঝেমাঝেই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমালোচনার মুখে পড়ে মস্কো৷
ছবি: picture-alliance/AP/Russian Defense Ministry
অনাগ্রহী পশ্চিম
আসাদের সমালোচনা এবং নীরবে মডারেট বিদ্রোহী গোষ্ঠীকে সমর্থন জানালেও তাদের হয়ে আসাদের বিরুদ্ধে লড়তে পদাতিক বাহিনী পাঠাতে আগ্রহী নয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা অন্য কোনো ন্যাটোভুক্ত দেশ৷ তবে ২০১৪ সালের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে প্রায় ষাটটি দেশের মার্কিন নেতৃত্বাধীন এক জোট সে দেশে ইসলামিক স্টেট এবং অন্যান্য জঙ্গি গোষ্ঠীর আস্তানায় বিমান হামলা চালাচ্ছে৷
ছবি: AFP/Getty Images/John Macdougall
সীমান্তে নিরাপত্তা
সিরিয়ার প্রতিবেশি দেশগুলো নিজেদের সীমান্ত রক্ষার স্বার্থেই এই লড়াইয়ে যোগ দিয়েছে৷ মার্কিন নেতৃত্বাধীন আইএসবিরোধী জোটে থাকা তুরস্কও আসাদবিরোধী জোটকে সহায়তা করছে৷ তবে কুর্দি যোদ্ধাদের মার্কিনিদের সহায়তা নিয়ে সে দেশের সঙ্গে শীতল সম্পর্ক বিরাজ করছে তুরস্কের, কেননা কুর্দরা নিজেদের রাষ্ট্র চায়, যা তুরস্ক সমর্থন করে না৷
ছবি: picture alliance/dpa/S. Suna
প্রক্সি ওয়ার
সিরিয়ার সংঘাতে কার্যত এক প্রক্সি লড়াইও চলছে, যেখানে একদিকে রয়েছে রাশিয়া এবং ইরান, অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তুরস্ক৷ সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষায় আসাদকে ক্ষমতায় রাখতে চায় ইরান৷ ফলে রাশিয়ার পাশাপাশি সে দেশও কৌশলগত সহায়তা, সামরিক প্রশিক্ষণ, এবং পদাতিক সেনা দিয়ে দামেস্ককে সহায়তা করছে৷
ছবি: Atta Kenare/AFP/Getty Images
যুদ্ধ থামার কোনো লক্ষণ নেই
ছয় বছর হয়ে গেলেও সিরিয়ায় বহুমুখী লড়াই বন্ধের কোনো সুস্পষ্ট ইঙ্গিত এখনো দেখা যাচ্ছে না৷ জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় তৈরি বিভিন্ন শান্তি চুক্তি করা হলেও তা তেমন একটা সফল হয়নি৷ ফলে প্রতিদিন সে দেশে নানা হামলায় মারা যাচ্ছেন অসংখ্য মানুষ, যাদের মধ্যে শিশু, নারীসহ অনেক বেসামরিক নাগরিকও রয়েছেন৷
9 ছবি1 | 9
মিরিয়াম বলে, ‘‘আমি আবার কাঁচের টুকরাকে ভয় পেতাম৷ আমাদের জানালা ছিল কাঁচের তৈরি৷ আমার কাছে মনে হতো, এই কাঁচ যে কোনো সময় ভেঙে আমার উপর পড়তে পারে৷ এ কারণে জানালায় ম্যাট্রেস ঝুলিয়ে রাখতাম৷'' হাসতে হাসতে সে বলে, ‘‘আমিতো খুব সুন্দর, আমি সেটা হারাতে চাইতাম না৷'' গত ডিসেম্বরে সর্বশেষ জঙ্গি আত্মসমর্পণ করার পর পরিস্থিতি তুলনামূলকভাবে কিছুটা স্বাভাবিক হয়৷ তবে এখনো বিদ্যুৎ ও পানির সরবরাহ ঠিক হয়নি৷
মিরিয়াম বলে, ‘‘মাথার উপর বোমা পড়তে পারে– এমন ভয় আর নেই৷ আমি আমার শৈশব ফিরে পেতে শুরু করেছি৷ প্রতিবেশী শিশুদের সঙ্গে আমি আবার খেলতে শুরু করেছি৷'' এ কথা যখন বলছিলেন, তখন তার চোখ চকচক করছিল৷ আলেপ্পোর লড়াই শেষ হওয়ার পর তারা তাদের বাড়িতে কেবল একবার গিয়েছে৷
ডায়েরির বর্ণনায় উঠে আসে সে দিনের অনুভূতিও, ‘‘তখন মনে হচ্ছিল, যেন আমার হৃদপিণ্ডে প্রাণ ফিরে এসেছে৷ যদিও সেটা এখন কেবলই ধ্বংসাবশেষ৷ সেখাকার সবকিছু শেষ হয়ে গেছে৷'' ‘‘কিন্তু সেখানকার মুহুর্তগুলো আমি মনে করতে পারি৷ সেটা নিয়ে ‘অতীত-সুখের' অনুভূতি কাজ করে৷ কিন্তু আমি সেখানে বাস করতে আর যাবো না৷''
চারিদিকে ধ্বংস আর তাণ্ডব দেখতে দেখতে বড় হওয়া এই মেয়েটি এখন জ্যোতির্বিজ্ঞানী হতে চায়৷ কারণ, সে তারকারাজিকে ভালোবাসে৷ কে জানে হয়ত মাটির পৃথিবীর অশান্ত পরিস্থিতিই দূর আকাশের তারা প্রতি তার ভালোবাসা সৃষ্টি করেছে৷ আকাশ ছোঁয়ার এই স্বপ্ন দেখার পরও সে কোনোদিনই তাঁর ডায়েরিকে ত্যাগ করেনি৷ সে বলে, এটা একটা অন্য রকম বিষয়৷ যদিও আমি নতুন করে জীবন শুরু করছি৷ তবে আমি আমার অতীতকে ভুলে যেতে চাই না৷ এমনকি গত রাতেও আমি আমার নোটবুকের উপর ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম৷