ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিক অফ কঙ্গোর দুইটি অঞ্চলে সহিংস বিক্ষোভের ঘটনা ঘটেছে। কঙ্গোর পূর্ব গোমা এবং বুটেম্বোয় সবচেয়ে বেশি মানুষ রাস্তায় নেমেছিলেন। জাতিসংঘের তরফে জানানো হয়েছে, বিক্ষোভকারীরা আচমকাই সহিংস হয়ে ওঠে। তারা পুলিশের কাছ থেকে অস্ত্র ছিনিয়ে নিয়ে জাতিসংঘের কর্মীদের উফর আক্রমণ চালাতে শুরু করে।
জাতিসংঘ জানিয়েছে, বুটেম্বোর ঘটনায় এক শান্তিবাহিনীর সদস্য এবং দুইজন আন্তর্জাতিক পুলিশকর্মীর মৃত্যু হয়েছে। এছাড়াও বেশ কিছু ব্যক্তি আহত হয়েছেন বলে দাবি করা হয়েছে। ঘটনায় সব মিলিয়ে ১৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। জাতিসংঘের দুই কর্মী ভারতীয় বলে জানা গেছে। দুইজনই ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর জওয়ান। জাতিসংঘের মিশনের জন্য তাদের ডিআর কঙ্গোয় পাঠানো হয়েছিল।
ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিক অফ কঙ্গো, সংক্ষেপে ডিআরসি৷ আফ্রিকার দেশটির উত্তরাঞ্চলের মানুষের প্রধান আয়ের উৎস সোনার খনি৷ শ্রমিকরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে খনি থেকে সোনা আহরণ করে৷ বহু হাত ঘুরে, অবশেষে তা পরিণত হয় জ্বলজ্বলে সোনার বারে৷
ছবি: Robert Carrubbaখনির অনেক গভীর থেকে নৈপুণ্যের সাথে মাটি থেকে সোনা আলাদা করছেন এক শ্রমিক৷ খনির দলে থাকেন দুই ধরনের শ্রমিক, যারা খনন করেন, এবং যারা সোনার আকর মাটির ওপরে নিয়ে আসেন৷ একজন শ্রমিককে দিনে ছয় থেকে আট ঘণ্টা খনিতে কাজ করতে হয়৷
ছবি: Robert Carrubbaএই খনিতে এক গ্রাম সোনার জন্য ২০০ কেজি আকরিক সংগ্রহ করতে হয়৷ ছোট ছোট সুড়ঙ্গের মধ্য দিয়ে খনির মধ্য দিয়ে আসা যাওয়া করতে হয় শ্রমিকদের৷ মাটিভর্তি বস্তা আসছে, সেটি বয়ে নিয়ে যেতে হবে বাইরে৷ কৃষিকাজের পর সোনার খনিই শ্রমিকদের সবচেয়ে বড় আয়ের উৎস৷
ছবি: Robert Carrubbaসোনার মাটিভর্তি বস্তা বয়ে নিয়ে যাচ্ছেন একজন শ্রমিক৷ প্রতি বস্তা বহন করার জন্য একজন শ্রমিক পান ৫০০ কঙ্গোলিজ ফ্রাংক (প্রায় ২৫ টাকা) দিন শেষে কয়েকশ টাকা পান শ্রমিকরা৷ খনিতে সবচেয়ে কম বেতন পাওয়াদের মধ্যে আছেন এই বহনকারীরা৷ এদের বেশিরভাগই এসেছেন অন্য এলাকা থেকে৷
ছবি: Robert Carrubbaপাথর ও মাটির খাঁজে খাঁজে আটকে থাকে বিশুদ্ধ সোনা৷ সোনা আহরণের জন্য সেই পাথর ভেঙে টুকরো করতে হয়৷ এজন্যই আছে আলাদা শ্রমিক৷ মেশিনে নয়, প্রচণ্ড পরিশ্রমের এই পুরো কাজটাই হয় হাতে৷ এমন একটি প্লাস্টিকের গামলা থেকে সোনা আলাদা করতে সময় লাগে কয়েক ঘণ্টা৷
ছবি: Robert Carrubbaভাঙা আকরিক পানিতে মিশিয়ে কাদা তৈরি করছেন একজন শ্রমিক৷ ঘনত্ব বেশি হওয়ায় শুধু সোনাই পড়ে থাকে নীচে, বাকি পানি ও মাটি চলে যায় গড়িয়ে৷ তারপর জমে থাকা সোনা পারদের সাহায্যে ছেঁকে তোলা হয় আরেক প্লাস্টিকের গামলায়৷
ছবি: Robert Carrubbaখনির আশেপাশেই দোকান বসিয়ে এই অপরিশোধিত সোনা কিনে নেন কিছু স্থানীয় ব্যবসায়ী৷ ছবিতে দেখা যাচ্ছে সোনা ও পারদের এক ধরনের ধূসর মিশ্রণ৷ ছোট ছোট খনি মালিকরা এই অপরিশোধিত সোনা বিক্রি করেন৷
ছবি: Robert Carrubbaবড় ব্যবসায়ীরা উত্তপ্ত চুলায় অপরিশোধিত সোনা নাইট্রিক অ্যাসিড দিয়ে গলিয়ে ফেলেন৷ উদ্দেশ্য, অপ্রয়োজনীয় জিনিস দূর করা৷ স্থানীয় ব্যবসায়ীদের চেয়ে অনেক বড় পরিমাণে সোনার চালান দিয়ে থাকেন বড় ব্যবসায়ীরা৷ প্রতি সপ্তাহে বিক্রি হয় কয়েক কেজি সোনা৷ ফলে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের চেয়ে লাভের হার কম হলেও মাস শেষে আয়টা হয় বেশ বড়ই৷
ছবি: Robert Carrubbaউত্তপ্ত সোনা ঠান্ডা হওয়ার পর একটি ইলেকট্রনিক দাঁড়িপাল্লায় মাপা হয়৷ এই পর্যায়ে এসে সোনা অন্তত ৯২ থেকে ৯৮ শতাংশ পর্যন্ত পরিশোধিত হয়৷ অবশ্য অনেক ক্ষেত্রে তা নির্ভর করে কোন খনি থেকে আহরণ করা হয়েছে তার ওপর৷
ছবি: Robert Carrubbaএবার ১,৫০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সোনা গলানো হয় আরেকটি উত্তপ্ত চুলায়৷ পরিণত করা হয় একটি মণ্ডে৷ গ্রাফাইট সোনার সাথে বিক্রিয়া করে না৷ তাই গ্রাফাইটের তৈরি একটি ছাঁচে ঢালা হয় তরল সোনা৷ কয়েক কেজি সোনা গলাতে লাগে মাত্র ২০ মিনিট৷
ছবি: Robert Carrubbaএতো উত্তপ্ত সোনা পুরোপুরি ঠান্ডা হতে সময় লাগাই স্বাভাবিক৷ কিন্তু এতো অপেক্ষার ধৈর্য আছে কার! এজন্য মোটামুটি ঠান্ডা হলেই ছাঁচ থেকে সোনা বের করে সরিয়ে রাখা হয় একপাশে৷ ধীরে ধীরে লাল থেকে হলুদ, হলুদ থেকে সোনালি, ফুটে ওঠে মূল্যবান এই ধাতুর আসল চেহারা৷
ছবি: Robert Carrubbaএবার দেশবিদেশে রপ্তানি হওয়ার জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত খনি থেকে আহরিত সেই সোনা৷ ছবির সোনার বারটির ওজন ৪ দশমিক তিন কেজি৷ প্রস্তুতের দিনে ইংল্যান্ডের লন্ডনে এর দাম ছিলো এক লাখ সাতষট্টি হাজার ডলার (প্রায় এক কোটি ৪১ লাখ টাকা)৷ বছরে প্রায় ১১ টনের মতো সোনা উৎপাদন করে কঙ্গো, কিন্তু এর বেশিরভাগই অবৈধভাবে দেশের বাইরে চলে যায়৷ সরকারি হিসেবে ২০১৫ সালে মাত্র ২৫৪ কেজি সোনা রপ্তানি করেছে ডিআরসি৷
ছবি: Robert Carrubba জাতিসংঘের প্রধান আন্তোনিও গুতেরেস ঘটনার তীব্র নিন্দা করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, জাতিসংঘের বিরুদ্ধে যে কোনো আক্রমণই যুদ্ধাপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়। আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তিনি।
কঙ্গোর প্রশাসনকে দ্রুত এই ঘটনার তদন্তের আর্জি জানিয়েছেন গুতেরেস। যে বিক্ষোভকারীদের মৃত্যু হয়েছে, তাদের মৃত্যুর তদন্তের কথাও বলেছেন তিনি। জাতিসংঘ জানিয়েছে, এই ঘটনার তদন্তে কঙ্গোর প্রশাসনকে জাতিসংঘ সমস্তরকমভাবে সাহায্য করবে।
কঙ্গোয় কেন জাতিসংঘ
দীর্ঘদিন ধরেই ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিক অফ কঙ্গোয় জাতিসংঘ কাজ করছে। সেখানে শতাধিক সশস্ত্র বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠী আছে। যারা নিজেদের মধ্যে এবং সরকারের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান চালায়। তাদের হামলার শিকার হন সাধারণ মানুষ। কঙ্গোয় শান্তি বজায় রাখার জন্যই সেখানে জাতিসংঘের কর্মীরা আছেন। কিন্তু অভিযোগ, জাতিসংঘ লড়াই থামাতে যথেষ্ট সচেষ্ট নয়। সে কারণেই বার বার সেখানকার সাধারণ মানুষ জাতিসংঘের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখায়। মঙ্গলবারও তেমনই বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল। পরে তা সহিংস হয়ে যায়।
এসজি/জিএইচ (রয়টার্স, এএফপি)