সাভারের রানা প্লাজা ধসে নিহতদের মধ্যে অজ্ঞাত ১৫৭ জনের পরিচয় ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে নিশ্চিত করা গেলেও, ১৬৫ জনের পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত করে কিছু বলা যাচ্ছে না৷ ডিএনএ টেস্টে কোনো ত্রুটি আছে কিনা – তা পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে৷
বিজ্ঞাপন
গত ২৪শে এপ্রিল সাভারের রানা প্লাজা ধসে ১,১৩৪ জন নিহত হন৷ তাঁদের মধ্যে অজ্ঞাত হিসেবে দাফন করা ৩২২ জনের ডিএনএ টেস্টের উদ্যোগ নেয় ঢাকা মেডিকেল কলেজের ডিএনএ ল্যাবরেটরি৷ ডিএনএ ল্যাবের প্রধান ড. শরীফ আখতারুজ্জামান ডয়চে ভেলেকে জানান, এর মধ্যে ১৫৭ জনের ডিএনএ ‘প্রোফাইল' তাঁদের আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে মিলেছে৷ কিন্তু বাকি ১৬৫ জনের ডিএনএ এখনও তাঁদের আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে মেলেনি৷
তিনি জানান, তারা প্রতিটি মৃতদেহের দাঁত ও হাড়ের নমুনা থেকে ডিএনএ প্রোফাইল তৈরি করেছেন৷ তারপর তাঁদের আত্মীয় বলে দাবি করা ৪৫০টি পরিবারের মোট ৫৪৮ জন তাঁদের রক্তের যে নমুনা জমা দিয়েছেন, তা থেকে আত্মীয়স্বজনের ডিএনএ প্রোফাইল তৈরি করা হয়েছে৷ নিহতদের ডিএনএ-র সঙ্গে তাঁদের ডিএনএ মিলিয়ে এ পর্যন্ত ১৫৭ জনের পরিচয় জানা গেছে৷ তবে বাকিদের পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়নি৷ এর মানে হলো, তাঁদের ডিএনএ-র সঙ্গে কারুর ডিএনএ মেলেনি৷ ড. আখতারুজ্জামান জানান, ডিএনএ নমুনা নেয়ার ক্ষেত্রে তারা মা-বাবা এবং ভাই-বোনকে প্রাধান্য দিয়েছেন৷ এই ডিএনএ পরীক্ষায় এফবিআইএ-র একটি সফটওয়ার ব্যবহার করা হয়েছে বলেও জানিয়েছেন তিনি৷
মৃত্যুকূপ থেকে যেভাবে ফিরলেন রেশমা
সাভারে ধসে পড়া ভবন থকে ১৭ দিন পর উদ্ধার করা হয় জীবিত রেশমাকে৷ এই সতের দিন তিনি কিভাবে কাটিয়েছেন? প্রশ্ন অনেকের মনে৷ চলুন উত্তর খোঁজা যাক৷
ছবি: Getty Images/AFP/STRDEL
সুস্থ আছেন রেশমা
সাভারে ধসে পড়া ভবন থকে ১৭ দিন পর উদ্ধার করা হয় জীবিত রেশমাকে৷ তিনি এখন সুস্থ আছেন৷ কিন্তু ধসে পড়া রানা প্লাজার মধ্যে কিভাবে সতের দিন কাটিয়েছেন তিনি? প্রশ্ন অনেকের মনে৷ চলুন ছবিতে উত্তর খোঁজা যাক৷
ছবি: Reuters
উদ্ধার অভিযান
১০ মে স্থানীয় সময় বিকেল সোয়া ৩টার দিকে সেনাবাহিনীর উদ্ধারকর্মী রাজ্জাক ধসে পড়া ভবনের মধ্যে বেঁচে থাকা একজন মানুষের উপস্থিতি টের পান৷ সেই মানুষটি রেশমা৷ তিনি একটি ভাঙা পাইপ দিয়ে নিজের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেন এবং তাঁকে বাঁচানোর অনুরোধ জানান৷ এরপর রড কেটে ভিতরে ঢুকে বিকেল ৪টা ২৫ মিনিটে রেশমাকে বাইরে নিয়ে আসা হয়৷
ছবি: Getty Images/STRDEL
যেভাবে টিকে ছিলেন রেশমা
১৭ দিন রেশমা কি খেয়ে টিকে ছিলেন সেই প্রশ্ন অনেকের৷ উদ্ধারকর্মী রাজ্জাক জানান, ‘‘রেশমা যে তলায় আটকে ছিলেন সেটা অন্যান্য তলার মতো মিশে যায়নি৷ সেখানে হাঁটা-চলা এবং নড়া-চড়া করার কিছুটা সুযোগ ছিল৷ রেশমা তাঁকে জানান যে, ঐ জায়গায় বিভিন্ন ধরনের শুকনা ও জুস জাতীয় খাবার ছিল, যা তিনি খেয়েছেন৷ ৭ মে শুকনা খাবার শেষ হয়ে যায় আর রসালো খাবার যায় পচে৷ ফলে শেষের দু’দিন ধরে তিনি অভুক্ত ছিলেন৷’’
ছবি: Getty Images/AFP/STRDEL
চিকিৎসকের ব্যখ্যা
ধ্বংসস্তূপের নীচে রেশমার এই ১৭দিন বেঁচে থাকার ঘটনাকে ডয়চে ভেলের কাছে ব্যাখা করেছেন মিটফোর্ড হাসপাতালের চিকিত্সক অধ্যাপক ডা. মনি লাল আইচ৷ তিনি বলেন, ‘‘রেশমা ১৭ দিনে হৃদরোগ বা নিউরোলোজিক্যাল সমস্যায় পড়তে পারতেন৷ হয়ত মানসিক জোর এবং বেঁচে থাকার প্রবল ইচ্ছার কারণেই তাঁকে সেই সমস্যায় পড়তে হয়নি৷ আর গবেষণায় প্রমাণিত যে নারীদের মানসিক চাপ সহ্য করার ক্ষমতা পুরুষের তুলনায় অনেক বেশি৷’’
ছবি: Reuters
গোটা বিশ্বে আলোড়ন
রেশমাকে ১৭ দিন পর জীবিত উদ্ধারের খবরে গোটা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি হয়৷ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দ্রুত সাভারে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে এই তরুণীকে দেখতে যান৷ রেশমাকে কেউ যাতে মানসিকভাবে পীড়া না দেয় সেজন্যও সবাইকে নির্দেশনা দেন শেখ হাসিনা৷
ছবি: dapd
তৃতীয় নারী রেশমা
১৭ দিন ধরে অন্ধকারে ডুবে থাকা রেশমাকে উদ্ধারের খবরের সঙ্গে একটি পরিসংখ্যান প্রকাশ করে বিবিসি৷ এতে দেখা যাচ্ছে, এর আগে পাকিস্তানে একই রকম পরিস্থিতিতে নাকাশা বিবি নামক এক নারী পচা খাবার আর পানি খেয়ে টিকে ছিলেন ৬৩ দিন৷ আর হাইতির ইভান্স মোনসিজনাক টিকে ছিলেন ২৭ দিন৷ এই সময়ের পর তাদের জীবিত উদ্ধার করা হয়৷
ছবি: Getty Images
পরিবারের সঙ্গে দেখা
রেশমার মা জোবেদা খাতুন, দুই ভাই ও বোন আসমা গত কয়েকদিন ধরেই রয়েছেন সাভারে৷ হাসপাতালে রেশমার সঙ্গে দেখা করেছেন তারা৷ রেশমার বড় ভাই জাহিদুল ইসলাম জানিয়েছেন, ‘‘বর্তমানে রেশমা ভালো আছে, সুস্থ আছে৷’’
ছবি: Reuters
বাড়ছে মৃতের সংখ্যা
এদিকে, সাভারে ভবন ধসে মৃতের সংখ্যা ক্রমশ বেড়েই চলেছে৷ গত ২৪ এপ্রিল ভবন ধসের পর ১২ মে অবধি উদ্ধার করা হয়েছে ১,১২৭ টি মৃতদেহ৷ নিহতদের মধ্যে ঠিক কতজন নারী আর কতজন পুরুষ – সেই হিসেব এখন আরা জানা যাচ্ছে না৷ অনেক মরদেহ পচে গেছে৷ গোটা বিশ্বে স্মরণকালের মধ্যে ভয়াবহতম ভবন ধস এটি৷
ছবি: picture-alliance/dpa
তবুও কি সতর্ক আমরা?
সাভার ভবন ধসের পর কতটা সতর্ক হয়েছে বাংলাদেশ? এই প্রশ্ন অনেকর মনে৷ বিশেষ করে, যে পোশাক খাত বাংলাদেশকে গোটা বিশ্বের কাছে পরিচিত করে তুলছে, সেই খাতের শ্রমিকদের নিরাপত্তায় সরকার কতটা সচেষ্ট? সর্বশেষ খবর হচ্ছে, শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার৷ রানা প্লাজা ধসের পর পোশাক শিল্পের যে নেতিবাচক ‘ইমেজ’ তৈরি হয়েছে, তা থেকে বেরিয়ে আসতেই এই পদক্ষেপ৷
ছবি: Reuters
‘আমাদের ব্যর্থতার প্রতীক’
শান্তিতে নোবেল জয়ী বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদ প্রফেসর মোহাম্মদ ইউনূস গত ৯ মে একটি নিবন্ধের একাংশে লিখেছেন, ‘‘সাভার ট্র্যাজেডি জাতি হিসেবে আমাদের ব্যর্থতার প্রতীক৷ রানা প্লাজার ফাটল ফেটে ভবন ধসে দেখিয়ে দিলো আমাদের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় যে বিশাল ফাটল ধরেছে সেটা আমলে না নিলে জাতিও এরকম ধসের ভেতর হারিয়ে যাবে৷’’
ছবি: AP
10 ছবি1 | 10
অধ্যাপক শরীফ আখতারুজ্জামান জানান, তাদের কাছে মনে হয়েছে কিছু ডিএনএ পরীক্ষায় বেশ কিছু দুর্বলতা থাকতে পারে৷ তাই তারা সেগুলো চিহ্নিত করে আবারো মিলিয়ে দেখবেন৷ তাতে হয়ত নতুন কিছু অজ্ঞাতের পরিচায় জানা যেতে পারে৷ তবে নিশ্চিত করে কিছুই বলা যাচ্ছে না৷
ঢাকার জেলা প্রশাসক হারুন অর রশীদ ডয়চে ভেলেকে জানান, সনাক্ত হওয়া ১৫৭ জনের তালিকা তারা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এবং শ্রম মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছেন৷ এই ১৫৭ জনের আত্মীয়স্বজনকেও জানানো হয়েছে৷ তাঁরা এখন জুরাইন কবরস্থানে গিয়ে তাঁদের ডিএনএ নাম্বার দিয়ে নিহতদের কবর সনাক্ত করতে পারবেন৷ কারণ, প্রতিটি কবরেই ডিএনএ নাম্বার দেয়া আছে৷ প্রসঙ্গত, অজ্ঞাত পরিচয় সবাইকে জুরাইন কবরস্থানে দাফন করা হয়৷
যাঁদের পরিচয় সনাক্ত হয়েছে, তাঁদের পরিবারের লোকজন এখন আর্থিক সহায়তা পাবেন কিনা জানতে চাইলে ঢাকার জেলা প্রশাসক জানান, এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় সিদ্ধান্ত নেবে৷ যাঁদের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি তাঁদের ব্যাপারে আর কোনো করণীয় আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ডিএনএ টেস্টেও পরিচয় জানা না গেলে আর কিছুই করার নেই৷