প্রস্তাবিত ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের চারটি ধারা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) এবং ১০টি দেশ৷ তারা মনে করে, ওই চারটি ধারা বাকস্বাধীনতা এবং স্বাধীন মত প্রকাশকে বাধাগ্রস্ত করবে৷
বিজ্ঞাপন
রবিবার মন্ত্রনালয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের সঙ্গে দেখা করেন ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), সুইডেন, যুক্তরাষ্ট্র, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, ক্যানাডা, যুক্তরাজ্য, স্পেন, নরওয়ে এবং সুইজারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূতরা৷ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন জার্মান রাষ্ট্রদূত ড. টোমাস প্রিন্স৷ আইনমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে জার্মান রাষ্ট্রদূত সাংবাদিকদের বলেন, ‘‘আইনমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে প্রস্তাবিত ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের ধারা ২১, ধারা ২৫, ধারা ২৮ এবং ধারা ৩৫ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছি৷ ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের এই ধারাগুলো জনগণের বাকস্বাধীনতা ও মুক্তমত প্রকাশকে বাধাগ্রস্ত করবে বলে আমরা মনে করি৷ এই আইনের শাস্তি, জামিন অযোগ্য ধারা এবং এই আইনের অপব্যবহার এই তিনটি বিষয় নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন৷''
এদিকে আইনমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, ‘‘তাঁরা বেশ কয়েকদিন আগে থেকেই এই বিষয়ে কথা বলার জন্য সময় চেয়েছিলেন৷ সেই কারণে আজ (রবিবার) এই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হয়েছে৷ আমাদের আলোচনা ফলপ্রসূ হয়েছে৷ এখন আমরা নিজেরা বসে আলোচনা করে পরবর্তী করণীয় ঠিক করবো৷''
কী আছে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের ৪টি ধারায়
গত ২৯ জানুয়ারি জেল জরিমানার বিধান রেখে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮-এর খসড়ায় চূড়ান্ত অনুমোদন দেয় মন্ত্রিপরিষদ৷ আইনটি সংসদে পাস হলে আইসিটি অ্যাক্টের ৫৪, ৫৫, ৫৬, ৫৭ ও ৬৬ ধারা পুরোপুরি বিলুপ্ত করা হবে৷
নূর খান
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২১ ধারা:
যদি কোনো ব্যাক্তি ডিজিটাল মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা জাতির পিতার বিরুদ্ধে কোনো প্রকার প্রপাগান্ডা বা প্রচারনা চালায় বা উহাতে মদত প্রদান করেন, তাহলে অনধিক ১৪ বছর কারাদণ্ড, এক কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন৷
যদি কেউ এই অপরাধ দ্বিতীয়বার বা পূনঃ পুনঃ সংঘটন করেন, তাহলে তিনি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা তিন কোটি টাকা অর্থদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন৷
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৫ ধারা:
যদি কোনো ব্যক্তি ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেকট্রিক বিন্যাসে,- (ক) ইচ্ছাকৃতভাবে বা অজ্ঞাতসারে, এমন কোনো তথ্য প্রেরণ করেন যা আক্রমণাত্মক বা ভীতি প্রদর্শক, (খ) এমন কোনো তথ্য সম্প্রচার বা প্রকাশ করেন, যা কোনো ব্যক্তিকে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ করিতে পারে (গ) মিথ্যা বলে জানা থাকা সত্ত্বেও কোনো ব্যক্তিকে বিরক্ত, অপমান, অপদস্ত বা হেয় প্রতিপন্ন করবার অভিপ্রায়ে কোনো তথ্য-উপাত্ত প্রেরণ, প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, বা (ঘ) রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি বা সুনাম ক্ষুন্ন করবার, বা বিভ্রান্তি ছড়াবার উদ্দেশ্যে, অপপ্রচার বা মিথ্যা বলে জানা থাকা সত্বেও কোনো তথ্য সম্পূর্ন বা আংশিক বিকৃত আকারে প্রকাশ, প্রচার বা সম্প্রচার করেন বা করতে সহায়তা করেন, তাহলে তিন বছরের কারাদণ্ড অথবা তিন লাথ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন৷ এই অপরাধ যদি দ্বিতীয় বার বা পুনঃ পুনঃ সংঘটন করেন, তাহা হইলে তিনি পাঁচ বছরের কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন৷
শেখ হাফিজুর রহমান
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৮ ধারা:
ওয়েবসাইটে বা কোনো ইলেকট্রিক বিন্যাসে ধর্মীয় মূল্যবোধ বা অনুভূতিতে আঘাত করে এমন কোনো তথ্য প্রকাশ, সম্প্রচার, ইত্যাদি৷
(১) যদি কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী ইচ্ছাকৃতভাবে বা জ্ঞাতসারে ধর্মীয় মূল্যবোধ বা অনুভূতিতে আঘাত করবার উদ্দেশ্যে ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন বা করান, যা ধর্মীয় অনুভূতি বা ধর্মীয় মূল্যবোধের উপর আঘাত করে, তাহলে তিনি সাত বছরের কারাদণ্ড বা ১০ লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন৷ এই অপরাধ যদি একই ব্যক্তি দ্বিতীয়বার বা পুনঃ পুনঃ সংঘটন করেন, তাহলে দশ বছরের কারাদণ্ড বা ২০ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হবেন৷
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩৫ ধারা:
যদি কোনো ব্যক্তি এই আইনের অধীন কোনো অপরাধ সংঘটনে সহায়তা করেন, তাহলে সেটাও অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে৷ অপরাধ সংঘটনে সহায়তা করার অপরাধের ক্ষেত্রে মূল অপরাধটির জন্য যে দণ্ড নির্ধারিত রয়েছে, সহয়তাকারী ব্যক্তি সেই একই দণ্ডে দণ্ডিত হবেন৷
বিশ্লেষদের মিশ্র প্রতিক্রিয়া:
ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের এই চারটি ধারা নিয়ে বিদেশি কূটনীতিকদের উদ্বেগের সঙ্গে একমত পোষণ করেন মানবাধিকার কর্মী এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রেরসাবেক নির্বাহী পরিচালক নূর খান৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘মুক্ত আলোচনা ও মুক্ত মত প্রকাশে যে কোনোরকম বাধার বিরুদ্ধেই আমার অবস্থান৷ ধর্ম বা কোনো ব্যক্তি বিশেষকে নিয়ে আলোচনার বিষয় যদি আসে আর সেই আলোচনা করার সুযোগ যদি সীমিত করে দেয়া হয়, তাহলে দেখা যাবে এর প্রভাব অন্যান্য আলোচনায়ও পড়ে৷ আসলে কোনো কিছুই আলোচনার ঊর্ধে থাকা উচিত না৷''
ডিজিটাল বাংলাদেশ ‘রূপকল্প ২০২১’
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে বর্তমান সরকার ‘রূপকল্প ২০২১’ ঘোষণা করেছিল৷ ইতোমধ্যে জেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে ইন্টারনেট সেবাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে৷
ছবি: Munir Hasan
আওয়ামী লীগের ইশতেহার
নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার ‘দিন বদলের সনদ’-এর অংশ হিসেবে ‘২০২১ সালের মধ্যে ডিজিটাল বাংলাদেশ’-এর উদ্ভব৷ ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনকে সামনে রেখে ২০০৮ সালের ১২ ডিসেম্বর এ ঘোষণা দেয়া হয়৷
ছবি: dapd
কম পরিশ্রমে, স্বল্প ব্যয়ে মানুষের দোরগোড়ায় সেবা
ডিজিটাল বাংলাদেশ হলো তথ্যপ্রযুক্তিসমৃদ্ধ বাংলাদেশ যেখানে আধুনিক তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির সকল সুবিধা ব্যবহার করে অল্প সময়ে, কম পরিশ্রমে, স্বল্প ব্যয়ে, মানুষের দোরগোড়ায় তথ্য ও সেবা পৌঁছানোর নিশ্চয়তা দান৷
ছবি: D.net/Amirul Rajiv
কৃষিক্ষেত্রে সুবিধা
কৃষিক্ষেত্রেও লেগেছে তথ্যপ্রযুক্তির ছোঁয়া৷ সারাদেশে স্থাপিত প্রায় ২৪৫ কৃষি তথ্য যোগাযোগ কেন্দ্রে ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের কৃষি সেবা প্রদান করা হচ্ছে৷
ছবি: DW/M. Mamun
উন্নত স্মার্ট জাতীয় পরিচয়পত্র
দশ আঙুলের ছাপ ও চোখের কনীনিকার (আইরিশ) প্রতিচ্ছবি সংগ্রহ করে নিবন্ধিত নাগরিকদের ‘স্মার্ট’ জাতীয় পরিচয়পত্রের পরীক্ষামূলক বিতরণ শুরু হয়েছে বাংলাদেশে৷ যাদের জাতীয় পরিচয়পত্র আছে বা যারা ভোটার হওয়ার জন্য নিবন্ধন করেছেন, তারা এই ‘স্মার্ট’ এই পরিচয়পত্র পাবেন৷ (এখানে পুরানো পরিচয়পত্রের ছবি)
ছবি: DW/S. Kumar Day
মোবাইল ব্যাংকিং চালু
মোবাইল ব্যাংকিংয়ে সব ধরণের জরুরি সেবাই পাওয়া যায়৷ এ সবের মধ্যে রয়েছে – টাকা জমা, টাকা তোলা ও পাঠানো, বিভিন্ন ধরণের বিল প্রদান (বিদ্যুৎ বিল,গ্যাস বিল,পানি বিল ), কেনাকাটা করা, বেতন ভাতা প্রদান ও গ্রহণ, মোবাইল ফোন টপ আপ ইত্যাদি৷
ছবি: TAUSEEF MUSTAFA/AFP/Getty Images
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সেবা
২০ হাজারের বেশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম নির্মাণ ও ল্যাপটপসহ ইন্টারনেট সংযোগ প্রদান করা হয়েছে৷ ডিজিটাল কন্টেন্ট শেয়ার করার জন্য ‘শিক্ষক বাতায়ন’ নামে একটি ওয়েবপোর্টাল চালু করেছে সরকার৷
ছবি: Munir Hasan
২২টি কর্মপন্থা
ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় ২২ কর্মপস্থা নির্ধারণ করে তা বাস্তবায়নে জোর দেয়া হচ্ছে৷ এগুলো হচ্ছে – সরকারি অফিস আদালতে ই-সেবা চালু করা, ই-গভর্নেন্স চালুর মাধ্যমে সরকারি কর্মকাণ্ডের গতি বাড়ানো, ভূমি রেকর্ড ডিজিটাইজেশন, সরকারি সেবাসমূহ ইউনিয়ন অফিস থেকেই প্রদানের ব্যবস্থা, তথ্য অধিকার আইন বাস্তবায়ন, মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপনের মাধ্যমে শিক্ষার গুণগতমান বৃদ্ধি৷
ছবি: play.google.com
ঘরে বসে অর্থ উপার্জন
আইসিটি খাতে উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গেই ঘরে বসে অর্থ উপার্জনের ধারণা বাংলাদেশের মানুষের কাছে পৌঁছাতে শুরু করেছে৷ বর্তমানে দেশে তরুণ ফ্রিল্যান্সার একটি গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে৷ তথ্যমতে, বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় সাড়ে ৪ লাখ ফ্রিল্যান্সার রয়েছে৷ লাখো তরুণ বিভিন্ন পর্যায়ে আউটসোর্সিংয়ের কাজ করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে নিজে সাবলম্বী হয়ে দেশের উন্নয়নে অবদান রেখে চলেছেন৷
ছবি: Getty Images/AFP/M.U. Zaman
ডট বাংলা ডোমেইন
ইন্টারনেট জগতে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ডোমেইন (ইন্টারন্যাশনালাইজড ডোমেইন নেম-আইডিএন) ডট বাংলা (.বাংলা) ব্যবহারের জন্য বরাদ্দ পেয়েছে বাংলাদেশ৷ ইন্টারনেটে একটি রাষ্ট্রের জাতীয় পরিচয়ের স্বীকৃতি হিসেবে কাজ করে এই ডোমেইন৷
ছবি: Ministry of Women and Children Affairs
তথ্য আদান-প্রদান
দেশে বর্তমানে নানা ধরনের সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম রয়েছে৷ স্বল্প খরচে এ সব মাধ্যম ব্যবহার করে অনায়াসেই এক স্থান থেকে আরেক স্থানে তথ্য আদান প্রদান ও ভাবের বিনিময় হচ্ছে৷ ভিডিওতে কথা বলার জন্য রয়েছে একাধিক সফটওয়্যার৷ স্কাইপ, ইমো, ফেসবুক, গুগুল ছাড়াও যে কোনো মোবাইল অপারেটিং সিস্টেম ব্যবহার করে থ্রি জি প্রযুক্তির সংযোজনের ফলে ভিডিও বার্তার মাধ্যমে সব ধরনের তথ্য ও ভাবের আদান প্রদান করা যায়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
অনলাইনে আয়কর রিটার্ন, ড্রাইভিং লাইসেন্স
এখন আয়কর রিটার্ন ফরম অনলাইনে পূরণ করা যায়৷ অনলাইনে ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য আবেদন করা যায়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
রেলওয়ে ও বাস টিকেট
অনলাইনে অনেক সহজে টিকেট কাটা ও সিট বুকিং করা যায়৷ এসএমএস-এর মাধ্যমে বাংলাদেশ রেলওয়ে কর্তৃক যাত্রীদের জন্য তথ্যসেবা প্রদান করা হয়৷ এছাড়া বাসের টিকেট কাটা যায় অনলাইনেই৷
ছবি: picture-alliance/dpa/A. Warnecke
সব ইউনিয়নে ইন্টারনেট সংযোগ
২০২০ সালের মধ্যে দেশের সকল ইউনিয়নে ইন্টারনেট সংযোগ প্রদান করার প্রচেষ্টা আছে সরকারের৷ এছাড়া ২০১৮ সালের মধ্যে ব্রডব্যান্ডের সম্প্রসারণ ৪০ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে৷
ছবি: DW/A. Islam
13 ছবি1 | 13
তিনি আরো বলেন, ‘‘ধর্ম নিয়েও অনেকের অনেক প্রশ্ন থাকতে পারে৷ দেশে অনেক ধর্মাবলম্বী আছেন৷ আর বিভিন্ন বিষয় আলোচনার সময়ে এক ধর্মের অনুসারী অন্য ধর্ম নিয়ে অথবা নিজ ধর্ম নিয়ে সেই ধর্মের মানুষের মধ্যেই জানার আগ্রহ থাকতে পারে, প্রশ্ন থাকতে পারে, যুক্তিপূর্ণ বক্তব্য থাকতে পারে৷ সেটিকে থামিয়ে দেয়া বা দমিয়ে দেয়া যৌক্তিক না৷ঠিক তেমনি জাতির জনক অথবা গুরুত্বপূর্ণ কোনো ব্যক্তির ব্যাপারে জানার আগ্রহ থাকে, কিছু বলার থাকে অথবা সেই জানা বলার মধ্যে সে যদি কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হয় অথবা চেষ্টা করে সেটাকে থামিয়ে দেয়াকে আমি মনে করি কন্ঠরোধ করার শামিল৷''
তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘‘অনুভূতির সীমানা কী? অনুভূতি, আলোচনা বা সমালোচনার সীমানা কী? কতটুকু অতিক্রম করলে তা অপরাধের পর্যায়ে পড়ে? বা কী ধরনের শব্দ ব্যবহার করলে এক্ষেত্রে অপরাধের পর্যায়ে পড়ে, সেটা যতক্ষন না পর্যন্ত চিহ্নিত করা হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত এই আইনের মিসইউজের সম্ভাবনা থেকেই যাচ্ছে৷''
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন একই প্রসঙ্গে ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘কোনো আইনের যদি অপব্যহার হয়, তাহলে তাদের উদ্বেগটা আমলে নেয়া যেতে পারে৷ তবে এই অইনে মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অপপ্রচার, প্রোপাগান্ডার ব্যাপারে যে ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা হয়েছে, তাকে আমি যথার্থ মনে করি৷ এটাতে তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করার কী কারণ থাকতে পারে, আমি জানি না৷''
তিনি বলেন, ‘‘একটা দেশ তার মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ব্যাপারে আইন করতে পারে, সুরক্ষারও ব্যবস্থা নিতে পারে৷ মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমেই দেশটির জন্ম হয়েছে৷ এতে তো কোনো সমস্যা আমি দেখি না৷ এ ব্যাপারে তাঁদের উদ্বেগ আমার কাছে যথার্থ মনে হয় না৷ তবে ডিজিটাল গুপ্তচরবৃত্তি বা মুক্ত সংবাদপত্রকে বাধাগ্রস্ত করারব্যাপারে তাঁরা কোনো উদ্বেগ জানালে সেটাকে আমি যথেষ্ট যুক্তিসংগত মনে করি৷ কারণ, সংবাদমাধ্যম বা সংবাদপত্র তো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ফোর্থ স্টেট৷ এটা মুক্ত সমাজ , গণতন্ত্র এবং নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করার অন্যতম শর্ত৷ সেটার ব্যাপারে তাঁরা উদ্বেগ জানালে আমি যথেষ্ট যৌক্তিক মনে করি৷ আইনের অপব্যবহার যাতে না হয়৷ কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে প্রপাগান্ডা বন্ধের আইনকে আমি যথেষ্ট বিবেচনাপ্রসূত মনে করি৷''
বাংলাদেশের গণমাধ্যম আইন এখনো পড়ে আছে ব্রিটিশ আমলে
ব্রিটিশ আমল থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের গণমাধ্যম সংক্রান্ত যেসব আইন তৈরি হয়েছে, এবং এখনো বলবৎ আছে, তাতে কী বলা হয়েছে৷ ছবিঘরে জেনে নিন কিছু আশ্চর্য আইনের কথা৷
ছবি: picture-alliance/dpa
ছাপাখানা প্রকাশনা (ঘোষণা ও নিবন্ধীকরণ) আইন ১৯৭৩
ব্রিটিশ আমলে ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করতে বেশ কিছু আইন প্রণয়ন করা হয়েছিল, যার কয়েকটি কিছুটা সংশোধিত আকারে আজও রয়ে গেছে৷ যেমন: ছাপাখানা প্রকাশনা (ঘোষণা ও নিবন্ধীকরণ) আইন ১৯৭৩৷ এ আইন অনুযায়ী, যে কোনো সংবাদপত্র প্রকাশের আগে জেলার ডেপুটি কমিশনারের লিখিত অনুমোদন লাগবে৷ এটি ১৮২৩ সালে ভারতের তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত গর্ভনর জেনারেল জন অ্যাডামের অধ্যাদেশ৷
ছবি: picture-alliance/akg-images
দণ্ডবিধি ১৮৬০
১৮৬০ সালের দণ্ডবিধি ‘১২৪ ক’ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি যদি সরকারের প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করে, তার তিন বছরের কারাদণ্ড বা জরিমানার বিধান রয়েছে৷ এটি একেবারেই মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতার লঙ্ঘন৷ একই আইনের ‘৫০৫ খ’ অনুচ্ছেদে বলা হয়, কোনো প্রতিবেদন বা বিবৃতি যদি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যায়, তাহলে তাকে ৭ বছর কারাভোগ করতে হবে৷ একইভাবে মানহানির জন্য ৪৯৯ এবং ৫০১ অনুচ্ছেদে শাস্তির বিধান রয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বিশেষ ক্ষমতা আইন ১৯৭৪
বাংলাদেশের অবাধ তথ্যের প্রবাহের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা হল অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট ১৯২৩ এবং বিশেষ ক্ষমতা আইন বা স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্ট ১৯৭৪৷ প্রথমটিতে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করা যেতে পারে এমন কোনো বিষয় কাউকে দেয়ার ক্ষেত্রে সরকারি কর্মকর্তাদের উপর বিধি নিষেধ আরোপ করা হয়েছে৷ দ্বিতীয় আইনে রাষ্ট্রের চোখে অনিষ্টকর কোনো তথ্য গণমাধ্যমে কেউ প্রকাশ করলে পাঁচ বছরের কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদ
বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৯ (১) অনুচ্ছেদে ‘চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা’র কথা বলা হয়েছে৷ অথচ ৩৯(২)-এ এই স্বাধীনতা আইনের দ্বারা আরোপিত ‘যুক্তিসঙ্গত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষেই’ নিশ্চিত হবে বলা হয়েছে৷ রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশি রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃংখলা, শালীনতা বা নৈতিকতার স্বার্থে অথবা আদালত অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে এই বাধা-নিষেধের কথা বলা হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/C. Jaspersen
তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা
২০১৩ সালের সংশোধিত আইনে কোনো ব্যক্তি যদি ইন্টারনেটে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যার দ্বারা কারো মানহানি ঘটে, কিংবা আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করতে পারে, বা এ ধরনের তথ্য কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে দেয়া হয়, তাহলে এটি অপরাধ এবং সেই অপরাধে ৭ থেকে ১৪ বছরের কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে৷
ছবি: Schlierner - Fotolia.com
ডিজিটাল আইনের ৩২ ধারা
এ আইনে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি বেআইনিভাবে প্রবেশের মাধ্যমে কোনো সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত বা বিধিবদ্ধ কোনো সংস্থার অতিগোপনীয় বা গোপনীয় তথ্য-উপাত্ত কম্পিউটার, ডিজিটাল যন্ত্র, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, ডিজিটাল নেটওয়ার্ক বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক মাধ্যমে ধারণ, প্রেরণ বা সংরক্ষণ করেন বা করতে সহায়তা করেন, তাহলে সেই কাজ হবে কম্পিউটার বা ডিজিটাল গুপ্তচরবৃত্তির অপরাধ৷
ছবি: Badruddoza Babu
৩২ ধারায় শাস্তি
এই অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ ১৪ বছরের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হবে৷ কেউ যদি এই অপরাধ দ্বিতীয়বার বা বারবার করেন, তাহলে তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ১ কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড ভোগ করতে হবে৷
ছবি: Imago/IPON
তথ্য অধিকার আইন ২০০৯
এই আইনটি বাক স্বাধীনতার পক্ষে৷ বলা হয়েছে, ‘‘এই আইনের বিধানাবলী সাপেক্ষে, কর্তৃপক্ষের নিকট হইতে প্রত্যেক নাগরিকের তথ্য লাভের অধিকার থাকিবে এবং কোন নাগরিকের অনুরোধের প্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তাহাকে তথ্য সরবরাহ করিতে বাধ্য থাকিবে৷’’ আরো বলা হয়েছে, ‘‘তথ্য প্রদানে বাধা সংক্রান্ত বিধানাবলী এই আইনের বিধানাবলীর সহিত সাংঘর্ষিক হইলে, এই আইনের বিধানাবলী প্রাধান্য পাইবে৷’’
ছবি: picture-alliance/dpa/Dinodia Photo Library
8 ছবি1 | 8
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘ধর্ম প্রত্যেক মানুষের ব্যক্তিগত বিশ্বাসের বিষয়৷আপনি আপনার ধর্ম পালন করবেন৷ গণতান্ত্রিক দেশ যে নীতিমালায় পরিচালিত হয় যে রাষ্ট্র ও ধর্ম পৃথক থাকবে, ব্যক্তি তার ধর্ম পালন করবেন, অন্যের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করবে না- এগুলো হলো বেসিক প্রিন্সিপাল৷ এর ভিত্তিতেই সবকিছু পরিচালিত হওয়া উচিত৷''
তিনি বলেন, ‘‘ইউরোপীয় দেশের বাস্তবতা আর বাংলাদেশের বাস্তবতা তো এক নয়৷ সেই বাস্তবাতার নিরিখেও অনেক কিছু দেখতে হবে৷''