ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা মামলায় গার্ডিয়ান পাবলিকেশন্সের মালিক নূর মোহাম্মদকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে৷ ২০১৮ সালের নভেম্বরে করা একটি মামলায় তাকে সোমবার গ্রেপ্তার করা হয়৷
বিজ্ঞাপন
গার্ডিয়ান পাবলিকেশন্সের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহমুদুল হাসান ডয়চে ভেলেকে জানান, সোমবার বিকেল পৌনে চারটার দিকে র্যাবের একটি দল ফকিরাপুলে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানটির অফিসে গিয়ে তাকে আটক করে নিয়ে যায়৷ তাদের সঙ্গে সাদা পোশাকেও দুই জন ছিলেন বলে জানিয়েছেন তিনি৷
মাহমুদুল হাসান জানান, ‘‘তারা মামলার কথা বলে (নূর মোহাম্মদকে) আটক করে নিয়ে যান৷ নিয়ে যাওয়ার সময় আমাদের জিজ্ঞেস করেন তিনি জামিন নেননি কেন? আমরা বলি, মামলার কথাই তো তিনি জানেন না৷'' মঙ্গলবার আদালতে হাজির করা হলে তারা মামলার বিস্তারিত জানতে পারেন৷
মাহমুদুল হাসান
তিনি বলেন, ‘‘২০১৮ সালে একটি মামলা হয় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে৷ ওই মামলায় এনামুল হক মনি নামে একজনকে গ্রেপ্তারও করা হয় তখন৷ কিন্তু ওই মামলায় যে নূর মোহাম্মদকে আসামি করা হয়েছে তা আমরা জানতাম না৷ যদিও মনি তার পরিচিত৷ ফলে তিনি জামিন নেননি বা আদালতে আত্মসমর্পন করেননি৷''
তিনি বলেন, ‘‘মামলায় ফেক নিউজ তৈরি এবং ছড়ানোর অভিযোগ করা হয়েছে৷ আমরা মনে করছি এটার সঙ্গে কোনো বই বা বই প্রকাশের সম্পর্ক নেই৷''
প্রকাশন নূর মোহাম্মদকে মঙ্গলবার ঢাকার আইসিটি ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়৷ আদালতে জামিন আবেদন করলে আদালত তা নাকোচ করে তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন৷ নূর মোহাম্মদের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মুজাহিদ হোসেন জানান, ‘‘২০১৮ সালে নভেম্বরে কমলাপুর রেলওয়ে থানায় মামলাটি দায়ের করা হয়৷ মামলায় তাকে ছয় নম্বার আসামি করা হয়েছে৷ এই মামলায় এ নিয়ে তিন জন আসামি গ্রেপ্তার হয়েছেন এবং তিনজন জামিনে আছেন৷''
অ্যাডভোকেট মুজাহিদ হোসেন
মামলায় আসামীদের বিরুদ্ধে ওই সময়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার ছেলে জয়ের বিরুদ্ধে অনলাইন মাধ্যমে আপত্তিকর এবং মিথ্যা প্রচার প্রচারণার অভিযোগ আনা হয়েছে বলে জানান অ্যাডভোকেট মুজাহিদ৷ তবে তিনি দাবি করেন, ‘‘অন্য আসামিরা এটা করেছেন, নূর মোহাম্মদ এর সঙ্গে জড়িত নন৷''
তিনি আরো জানান, ‘‘প্রধান আসামি মনি কোরিয়া প্রবাসী৷ তিনি ওই সময়ে বাংলাদেশে ছিলেন৷''
রেলওয়ে থানার ওসি রকিবুদ্দিন জানান, পুলিশই এই মামলা করেছিলো৷ গার্ডিয়ান পাবলিকেশন্স চার বছর আগে প্রতিষ্ঠিত হয়৷ এবারের অমর একুশের বইমেলায় তাদের কোনো স্টল নেই৷ মাহমুদুল হাসান জানান, ‘‘এবার আমরা আবেদন করেছিলাম, পাইনি। তবে গত বই মেলায় আমাদের স্টল ছিলো৷''
ইসলামিক ফাউন্ডেশনের বই মেলায়ও তাদের স্টল ছিলো৷ তারা সব ধরনের বই প্রকাশ করলেও ধর্মীয় বই বেশি প্রকাশ করে৷
বাংলাদেশের গণমাধ্যম আইন এখনো পড়ে আছে ব্রিটিশ আমলে
ব্রিটিশ আমল থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের গণমাধ্যম সংক্রান্ত যেসব আইন তৈরি হয়েছে, এবং এখনো বলবৎ আছে, তাতে কী বলা হয়েছে৷ ছবিঘরে জেনে নিন কিছু আশ্চর্য আইনের কথা৷
ছবি: picture-alliance/dpa
ছাপাখানা প্রকাশনা (ঘোষণা ও নিবন্ধীকরণ) আইন ১৯৭৩
ব্রিটিশ আমলে ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করতে বেশ কিছু আইন প্রণয়ন করা হয়েছিল, যার কয়েকটি কিছুটা সংশোধিত আকারে আজও রয়ে গেছে৷ যেমন: ছাপাখানা প্রকাশনা (ঘোষণা ও নিবন্ধীকরণ) আইন ১৯৭৩৷ এ আইন অনুযায়ী, যে কোনো সংবাদপত্র প্রকাশের আগে জেলার ডেপুটি কমিশনারের লিখিত অনুমোদন লাগবে৷ এটি ১৮২৩ সালে ভারতের তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত গর্ভনর জেনারেল জন অ্যাডামের অধ্যাদেশ৷
ছবি: picture-alliance/akg-images
দণ্ডবিধি ১৮৬০
১৮৬০ সালের দণ্ডবিধি ‘১২৪ ক’ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি যদি সরকারের প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করে, তার তিন বছরের কারাদণ্ড বা জরিমানার বিধান রয়েছে৷ এটি একেবারেই মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতার লঙ্ঘন৷ একই আইনের ‘৫০৫ খ’ অনুচ্ছেদে বলা হয়, কোনো প্রতিবেদন বা বিবৃতি যদি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যায়, তাহলে তাকে ৭ বছর কারাভোগ করতে হবে৷ একইভাবে মানহানির জন্য ৪৯৯ এবং ৫০১ অনুচ্ছেদে শাস্তির বিধান রয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বিশেষ ক্ষমতা আইন ১৯৭৪
বাংলাদেশের অবাধ তথ্যের প্রবাহের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা হল অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট ১৯২৩ এবং বিশেষ ক্ষমতা আইন বা স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্ট ১৯৭৪৷ প্রথমটিতে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করা যেতে পারে এমন কোনো বিষয় কাউকে দেয়ার ক্ষেত্রে সরকারি কর্মকর্তাদের উপর বিধি নিষেধ আরোপ করা হয়েছে৷ দ্বিতীয় আইনে রাষ্ট্রের চোখে অনিষ্টকর কোনো তথ্য গণমাধ্যমে কেউ প্রকাশ করলে পাঁচ বছরের কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদ
বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৯ (১) অনুচ্ছেদে ‘চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা’র কথা বলা হয়েছে৷ অথচ ৩৯(২)-এ এই স্বাধীনতা আইনের দ্বারা আরোপিত ‘যুক্তিসঙ্গত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষেই’ নিশ্চিত হবে বলা হয়েছে৷ রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশি রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃংখলা, শালীনতা বা নৈতিকতার স্বার্থে অথবা আদালত অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে এই বাধা-নিষেধের কথা বলা হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/C. Jaspersen
তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা
২০১৩ সালের সংশোধিত আইনে কোনো ব্যক্তি যদি ইন্টারনেটে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যার দ্বারা কারো মানহানি ঘটে, কিংবা আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করতে পারে, বা এ ধরনের তথ্য কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে দেয়া হয়, তাহলে এটি অপরাধ এবং সেই অপরাধে ৭ থেকে ১৪ বছরের কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে৷
ছবি: Schlierner - Fotolia.com
ডিজিটাল আইনের ৩২ ধারা
এ আইনে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি বেআইনিভাবে প্রবেশের মাধ্যমে কোনো সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত বা বিধিবদ্ধ কোনো সংস্থার অতিগোপনীয় বা গোপনীয় তথ্য-উপাত্ত কম্পিউটার, ডিজিটাল যন্ত্র, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, ডিজিটাল নেটওয়ার্ক বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক মাধ্যমে ধারণ, প্রেরণ বা সংরক্ষণ করেন বা করতে সহায়তা করেন, তাহলে সেই কাজ হবে কম্পিউটার বা ডিজিটাল গুপ্তচরবৃত্তির অপরাধ৷
ছবি: Badruddoza Babu
৩২ ধারায় শাস্তি
এই অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ ১৪ বছরের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হবে৷ কেউ যদি এই অপরাধ দ্বিতীয়বার বা বারবার করেন, তাহলে তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ১ কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড ভোগ করতে হবে৷
ছবি: Imago/IPON
তথ্য অধিকার আইন ২০০৯
এই আইনটি বাক স্বাধীনতার পক্ষে৷ বলা হয়েছে, ‘‘এই আইনের বিধানাবলী সাপেক্ষে, কর্তৃপক্ষের নিকট হইতে প্রত্যেক নাগরিকের তথ্য লাভের অধিকার থাকিবে এবং কোন নাগরিকের অনুরোধের প্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তাহাকে তথ্য সরবরাহ করিতে বাধ্য থাকিবে৷’’ আরো বলা হয়েছে, ‘‘তথ্য প্রদানে বাধা সংক্রান্ত বিধানাবলী এই আইনের বিধানাবলীর সহিত সাংঘর্ষিক হইলে, এই আইনের বিধানাবলী প্রাধান্য পাইবে৷’’