1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ডিজিটাল সংস্করণে আকাশবাণীর নাটক

পায়েল সামন্ত কলকাতা
২২ মার্চ ২০১৮

আত্মবিস্মৃত বাঙালির ইতিহাস রক্ষায় অনীহা চিরকালের৷ বিপরীতে হেঁটে আকাশবাণীর নাটক বিভাগ হারানো নাটকের ডিজিটাল সংস্করণ তৈরি করছে৷ কিন্তু, যে অবহেলায় বেতার নাটক হারিয়ে গিয়েছে, তার জবাবদিহি কে করবে?

ছবি: DW/P. Samanta

আকাশবাণীর বেতার নাটকের সমৃদ্ধ ইতিহাস অনেক বছরের৷ সেই বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের সময় থেকে আকাশবাণী নাটকে জনপ্রিয়তা পেয়েছে৷ অভিযোগ উঠেছে, সেই বেতার নাটকের অমূল্য ভাণ্ডার থেকে বহু পুরোনো নাটক নাকি হারিয়ে গিয়েছে! অভিযোগের অন্তর্তদন্তে ডয়চে ভেলে পৌঁছে গিয়েছিল আকাশবাণী কলকাতার নাটক বিভাগে৷

এফএম চ্যানেল আসার পর সাবেক রেডিও-র এএম সম্প্রচার অনেকটা কোণঠাসা৷ স্মার্ট ফোন আর গ্যাজেটের যুগে ট্রানজিস্টরের বিকল্প মোবাইল৷ তবে যতই কেবল টিভি, বেসরকারি এফএম চ্যানেল বা অন্য বিনোদনের রমরমা হোক না কেন, রেডিওরও কিন্তু নির্দিষ্ট শ্রোতা আছে৷ বেতার নাটকের জনপ্রিয়তা মূলত তাঁদের জন্যই৷ এই কথাটাই বুঝিয়ে বলছিলেন আকাশবাণীর নাটক বিভাগের প্রধান সিদ্ধার্থ মাইতি৷ পুরনো বেতার নাটকগুলির ডিজিটাল সংস্করণ তৈরি করে সংরক্ষণের মূল কান্ডারী তিনিই৷ প্রসারভারতীর তরফ থেকেই আর্কাইভের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ শুরু হয়েছে ৫ বছর আগে৷ পূর্বাঞ্চলের আর্কাইভ বিভাগও তৈরি হয়েছে৷ কিন্তু কলকাতা বেতার কেন্দ্রের নাটক বিভাগের কাজটা একদমই আলাদা৷ বেতার নাটকের আর্কাইভ্যাল ভ্যালু বুঝে কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে সিদ্ধার্থ মাইতি সংরক্ষণে জোর দিয়েছেন৷ গত এক বছর ধরে ৬৫টি দুষ্প্রাপ্য নাটক তিনি ডিজিটাল মাধ্যমে সংরক্ষণ করেছেন৷

তিনি জানালেন, ২০০৫ সালের আগে কলকাতা বেতারে অ্যানালগ রেকর্ডিং হতো৷ ফলে কারিগরী দিকের অসুবিধা তো কিছু ছিলই৷ অ্যানালগের দীর্ঘদিন পুরনো ফিতে ভঙ্গুর হয়ে নষ্ট হয়ে যায়৷ সেগুলো থেকে ফের তুলে নিতে হতো নাটকগুলো৷ জটিল প্রক্রিয়া৷ অ্যানালগ প্রক্রিয়ার জন্য নাটক মুছে যাওয়ার সম্ভাবনাও একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না৷ সে জন্যই হয়তো শংকরের কাহিনী অবলম্বনে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের প্রযোজনায় ‘কত অজানারে’ নাটকটি খুঁজে পাওয়া যায়নি আর৷ এই তালিকায় জুড়েছে বহু নাটক৷ তার মধ্যে বনফুলের কাহিনি নিয়ে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের ‘শ্রী মধুসূদন’ বা রঞ্জন বাগচির ‘তৃতীয় নয়ন’ ইত্যাদি নাটকও আছে৷ তবুও পুনরুদ্ধার করা নাটকের তালিকায় ১৯৬৩-এর ‘আলিবাবা’, ১৯৬৮-এর ‘পদ্মানদীর মাঝি’, সত্যজিৎ রায়ের ‘আংটি ও আধুলি’র নাম রয়েছে৷

‘দুষ্প্রাপ্য নাটক আজও শ্রোতারা আগ্রহভরে শোনেন’

This browser does not support the audio element.

বেতার নাটক পুনরুদ্ধার করে কি বেতারের জনপ্রিয়তা ফিরিয়ে আনা সম্ভব? প্রায় ৩০ বছর বেতার নাটকের সঙ্গে যুক্ত সিদ্ধার্থ মাইতি বললেন, ‘‘রেডিও নাটকের আজও জনপ্রিয়তা আছে৷ নইলে প্রাইভেট চ্যানেলগুলোর নাটকের সিডি হইহই করে বিক্রি হতো না৷ সেটা দেখেই মনে হয়েছিল, আকাশবাণীর এই বিপুল নাটকের ভাণ্ডার তো কোনও অংশে কম নয়৷ বরং আরও সমৃদ্ধ৷ তাহলে এগুলোর জন্য এমন ভাবা যায় না কেন? যেমন, সদ্যপ্রয়াত সুপ্রিয়া দেবীর জীবনের একটি মাত্র বেতারনাটক আকাশবাণীর কাছে গচ্ছিত৷ এমন দুষ্প্রাপ্য নাটককে আজও শ্রোতারা আগ্রহভরে শোনেন৷ তাঁদের জন্যই এমন দুষ্প্রাপ্য নাটক সংরক্ষণ করছি৷’’

বেতারনাটকের এই গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসে বাংলা থিয়েটার বা চলচ্চিত্র উভয় জগতের রথী-মহারথীরা জড়িয়ে৷ একদিকে আকাশবাণীর বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র-শ্রীধর ভট্টাচার্য, অন্যদিকে থিয়েটারের শম্ভু-অজিতেশ-তৃপ্তি-রুদ্রপ্রসাদ, চলচ্চিত্রের বিকাশ রায়, ছবি বিশ্বাস, পাহাড়ি স্যান্যাল, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, ছায়া দেবী— এঁদের নাটক শোনার আগ্রহ আজও বিন্দুমাত্র কমেনি৷ এই জনপ্রিয়তাকেও আকাশবাণীর বেতারনাটকের ইউএসপি বলা যেতে পারে৷ এ সত্যিও অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে নাটক পুনরুদ্ধারের পেছনে৷ স্বীকার করলেন বিভাগীয় প্রধান৷ বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতির জন্য আকাশবাণীর কর্মীসংখ্যা কমেছে৷ পাশাপাশি মৈত্রী চ্যানেল বা দুটো এফএম চ্যানেলের জন্য প্রতি মাসে ৬০ খানা নাটক দরকার৷ মাসে ৬০ খানা নতুন নাটক করার পরিস্থিতি এই মুহূর্তে নেই৷ অনেক ক্ষেত্রে সেই পুরোনো নাটকের ওপর ভরসা করতে হচ্ছে৷ কাজেই পুরোনো নাটকের ভাণ্ডার ক্ষতির মুখে পড়লে চলবে কী করে?

ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের ক্ষেত্রে আকাশবাণী যেমন সদর্থক ভূমিকা পালন করেছিল, তেমনই বেতার নাটককে জনপ্রিয় করে তোলায় আকাশবাণীর ভূমিকা অনস্বীকার্য৷ কিন্তু শুধুমাত্র প্রযুক্তির জন্য, বলা ভালো, মোবাইলে এফএমের নাটক শোনা যেতো বলে বেসরকারি চ্যানেলগুলোর আধিপত্য বেড়েছিল৷ তাই প্রযুক্তিকে খাটো করে দেখেনি আকাশবাণী৷ অ্যানড্রয়েড অ্যাপ এবং ডিটিএইচ নিয়ে এসে শ্রোতাদের আবার আকাশবাণীমুখী করে তোলা হয়েছে৷ কিন্তু যেখানে সেই সুযোগ নেই, সেখানে আবার রেডিও সেট বিক্রি শুরু হয়েছে৷ এবার শুধু একদিনের মহালয়া বা ৭টা ৪৫-এর রবীন্দ্রসঙ্গীতের জন্য নয়, বেতার নাটকের জনপ্রিয়তাই আবার শ্রোতাদের প্রাচীন ও বর্ষীয়ান রেডিওটির ভক্ত করে তুলছে৷ এর প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে বৈকি! গিরিশ ঘোষের লেখা ‘প্রফুল্ল’ নাটকটির কথাই ধরা যাক৷ সিদ্ধার্থ মাইতি বললেন, ‘‘গিরিশ ঘোষের জনপ্রিয়তম নাটকগুলোর মধ্যে অন্যতম এই নাটকে শম্ভু মিত্র, তৃপ্তি মিত্র, অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় সকলেই ছিলেন৷ '৯৩ সালেই দেখেছি রেকর্ডিংয়ের ফিতে ছিঁড়ে যাচ্ছিলো৷ তাই নাটক বিভাগের দায়িত্বে এসে নাটকটিকে ডিজিটাইজড করে ঝকঝকে করে তুললাম৷ এবার যখন আকাশবাণীতে সে নাটক প্রচারিত হলো, আমাদের নাটক বিভাগে আর ডিউটি রুমে শ্রোতাদের প্রচুর ফোন এসেছে৷ এত কল আসে যে ফোন নামিয়ে রাখা যায়নি৷’’

নাটকের ডিজিটাল সংস্করণ করে বাজারে আনার ব্যাপারে কী ভাবছে আকাশবাণী? ইতিমধ্যে গানের ক্ষেত্রে তা রূপায়িত হয়েছে৷ ডয়চে ভেলেকে সিদ্ধার্থ মাইতি জানালেন, ‘‘চেষ্টা চলছে৷ তবে অনেক কলাকুশলীর সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না৷ ফলে তাঁদের রয়্যালটি নিয়ে ধোঁয়াশা আছে৷ তাঁদের খোঁজ চলছে৷’’

ইদানীং আকাশবাণীর নাটক সংরক্ষণের চেষ্টা থাকলেও অতীতে এ ব্যাপারে আন্তরিকতার অভাব ছিল, এমন অভিযোগ উঠছে৷ ডয়চে ভেলের প্রশ্ন শুনে এ নিয়ে ক্ষোভ উগড়ে দিলেন কিংবদন্তী নাট্যকার মনোজ মিত্র৷ এক দশক তিনি বেতার নাটক করেছেন নিয়মিতভাবে৷ কিন্তু অনেক নাটকেরই হদিশ পাননি বলে অভিযোগ৷ তিনি বলেন, ‘‘নরেন্দ্রনাথ মিত্রের ময়ূরী গল্প নিয়ে নাটকটি পরবর্তীকালে থিয়েটারের জন্য ভাবতে গিয়ে আর হদিশ পাইনি৷ অন্নদাশঙ্কর রায়ের একটি গল্পের সুপারহিট নাটকেরও এমন দশা৷ বারংবার চেষ্টা করেও সেগুলির খোঁজ মেলেনি৷ কোনওদিন ভাবিনি রেডিও নাটকের কপি আমার কাছে রেখে দিতে হবে৷ যখন নাটক লিখে ২৫ টাকা পেতাম, সেই তখন থেকেই আকাশবাণীতে নাটক লিখেছি৷ আজ এই নাটকগুলো আমি হাতে পেলে থিয়েটারের জন্য অন্যভাবে ভাবতে পারতাম তো!’’

ক্ষোভের কথা বলছেন নাট্যকার মনোজ মিত্র

This browser does not support the audio element.

নাটক বিভাগের সাম্প্রতিক উদ্যোগে খুশি প্রবীণ নাট্যব্যক্তিত্ব, কিন্তু পূর্বতনদের উপর ক্ষোভ তাতে কমে না৷ বললেন, ‘‘ক্রিয়েটিভ আর্টিস্টদের নিয়ে যাঁরা কাজ করছেন, তাঁদের আরও বেশি সর্তক হওয়া উচিত ছিল৷ আরও দায়িত্ব নিয়ে কাজ করা উচিত ছিল৷ কেন একটা রেডিও নাটক উধাও হয়ে যাবে?’’ একই মত আকাশবাণীর বহু বিখ্যাত নাটকের প্রযোজক সমরেশ ঘোষেরও৷ তাঁর প্রযোজনায় অনেক নাটকের খোঁজ মেলে না৷ এর মধ্যে উল্লেখ্য ‘রস' নাটকটি৷ তাঁরও আক্ষেপ, ঠিক সময়ে যত্ন নিলে বাংলার অনেক অনবদ্য সৃষ্টি রক্ষা করা যেতো৷

দেরিতে হলেও কাজ শুরু হয়েছে, এটা স্বস্তির৷ কিন্তু, এত বছরের উদাসনীতায় বেতারমোদী বাঙালি যে মণিহারা হলো, তার মাশুল কে দেবে!

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ