জার্মানিতে ডিজেল গাড়ির দূষণ মাপায় কারচুপি ও বায়ু দূষণ নিয়ে দুশ্চিন্তা সত্ত্বেও গাড়ি কোম্পানিগুলি আপাতত সফটওয়্যার আপডেট করেই রেহাই পেয়ে যাচ্ছে৷ ফলে সরকার সমালোচনার মুখে পড়ছে৷
বিজ্ঞাপন
ডিজেল গাড়ির ধোঁয়া শরীরে জন্য ক্ষতিকর, এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই৷ অত্যাধুনিক মডেলের গাড়িও সেই মারাত্মক নির্গমন তেমন কমাতে পারেনি৷ তার উপর এমিশন বা নির্গমন পরীক্ষায় কারচুপি করতে গাড়ির সফটওয়্যারে রদবদল করা হয়েছে৷ জার্মানির একাধিক গাড়ির কোম্পানি নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া করে এমন অসাধু কাজ করেছে৷ ফলে জার্মানির বেশ কয়েকটি বড় শহরের বাতাসে বায়ু দূষণ – বিশেষ করে নাইট্রোজেন অক্সাইডের মাত্রা কর্তৃপক্ষের দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছে৷ কিন্তু ‘ডিজেলগেট' কেলেঙ্কারির পর বুধবার সরকার ও গাড়ি নির্মাতা কোম্পানিগুলি সহ সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের শীর্ষ বৈঠকের পর বিতর্ক কমার বদলে উলটে আরও বেড়ে গেল৷
চাপের মুখে কোণঠাসা গাড়ি কোম্পানি জার্মানিতে নতুন মডেলের প্রায় ৫০,০০০ লক্ষ ডিজেল গাড়ির সফটওয়্যার আপডেট করে দূষণের মাত্রা কমানোর অঙ্গীকার করেছে৷ সেই বিশাল কর্মকাণ্ডের ব্যয়ভারও তারাই বহন করবে৷ তাদের দাবি, এই পদক্ষেপের মাধ্যমে নাইট্রোজেন অক্সাইডের মাত্রা ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ কমানো সম্ভব হবে৷ তার প্রমাণ পেতে আপডেটের আগে ও পরে গাড়ির এমিশন টেস্ট করা হবে৷ সেইসঙ্গে পুরানো মডেলের ডিজেল গাড়ি পরিত্যাগ করে নতুন মডেলের ডিজেল বা ইলেকট্রিক গাড়ি কিনতে মালিকদের উৎসাহ ও আর্থিক সুবিধা দেবে গাড়ি কোম্পানিগুলি৷ তাছাড়া শহরের গণপরিবহণ ব্যবস্থার টেকসই উন্নয়নের জন্য এক তহবিলে ৫০ কোটি ইউরো জমা দেবে তারা৷
সমালোচকদের মতে, নির্বাচনের প্রায় এক মাস আগে সরকার গাড়ি কোম্পানিগুলির প্রতি অতি উদার মনোভাব দেখিয়েছে৷ তাদের শাস্তি দেবার বদলে অতি সহজে রেহাই দেওয়া হয়েছে৷ সফটওয়্যার নয়, ডিজেল ইঞ্জিনে ব্যাপক রদবদল করে দূষণ সত্যি কমানো সম্ভব বলে তারা মনে করে৷ কিন্তু আরও ব্যয়বহুল এই প্রক্রিয়া থেকে রেহাই পেয়েছে গাড়ি কোম্পানিগুলি৷ তাছাড়া ইউরোপের অন্য অনেক দেশের মতো পেট্রোল-ডিজেল গাড়ি পুরোপুরি বর্জনের লক্ষ্যমাত্রা স্থির করতে ব্যর্থ হয়েছে জার্মানি৷
আত্মপক্ষ সমর্থনে সরকার অবশ্য বলেছে, এই ‘ডিজেল সামিট'-এ প্রাথমিক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে মাত্র৷ সফটওয়্যার আপডেটের মাধ্যমে নাইট্রোজেন অক্সাইডের মাত্রা কমে কিনা, তা পরীক্ষা করা হবে৷ না কমলে কিছু শহরে ডিজেল গাড়ি চলাচল সাময়িক অথবা চূড়ান্তভাবে নিষিদ্ধ করা হতে পারে৷
সেইসঙ্গে কোম্পানিগুলির উপর হার্ডওয়্যারে পরিবর্তনের জন্য আরও চাপ সৃষ্টি করা হতে পারে৷ মোটকথা আপাতত সেই দায়িত্ব আগামী সরকারের উপর তুলে দেওয়া হলো৷ নির্বাচনের আগে গাড়ি শিল্পের সঙ্গে যুক্ত শ্রমিক-কর্মীদের স্বার্থ অনিশ্চিত করে তুলতে চাইছে না জার্মানির দুই বড় রাজনৈতিক দলের মহাজোট সরকার – নিন্দুকরা এমন অভিযোগ করছেন৷
ইউরোপে পেট্রোল-ডিজেলের ভবিষ্যৎ অন্ধকার?
শুধু জার্মানিতে ডিজেলগেট কেলেঙ্কারির কারণে নয়, বায়ুদূষণ কমাতে ডিজেল ও পেট্রোলচালিত গাড়ি ধাপে ধাপে বন্ধ করার জন্য চাপ বাড়ছে গোটা ইউরোপে৷ কিন্তু এমন বৈপ্লবিক পদক্ষেপের পথে রয়েছে অনেক বাধা-বিপত্তি ও জটিলতা৷
ছবি: picture-alliance/dpa/J. Woitas
বিকল্প জ্বালানির ধীর অগ্রগতি
২০১৬ সালের হিসেব অনুযায়ী গোটা ইউরোপে মাত্র ০ দশমিক ২ শতাংশ গাড়ি পুরোপুরি বিদ্যুৎচালিত ছিল৷ হাইব্রিড গাড়ি ধরলে সংখ্যাটা দাঁড়ায় ১ দশমিক ৩ শতাংশ৷ প্রযুক্তির উন্নতি সত্ত্বেও রাজনৈতিক সদিচ্ছা, অবকাঠামোর অভাবের মতো অনেক কারণে ইউরোপে পরিবহণের ক্ষেত্রে বিকল্প জ্বালানির ব্যবহার এখনো নগণ্য৷
ছবি: picture-alliance/dpa/J. Woitas
গাড়ি কোম্পানিগুলির প্রতিরোধ
পেট্রোল-ডিজেল ‘লবি’ প্রচলিত গাড়ির পক্ষে যে সব যুক্তি দেখায়, কর্মসংস্থান তার মধ্যে অন্যতম৷ যেমন জার্মানির গাড়ি শিল্পের সংগঠন ভিডিএ-র দাবি, ২০৩০ সালের মধ্যে প্রচলিত পেট্রোল-ডিজেল ইঞ্জিন উৎপাদন বন্ধ করলে জার্মানিতে প্রায় ছ’লক্ষ মানুষ চাকরি হারাতে পারেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Jan Woitas
বিকল্প জ্বালানি ও কর্মসংস্থান
বিকল্প জ্বালানির সাহায্যে বিদ্যুৎ উৎপানের ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের যে জোয়ার দেখা গেছে, ইলেকট্রিক ও হাইব্রিড গাড়ির ক্ষেত্রেও তেমনটা ঘটবে বলে পূর্বাভাষ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা৷ একটি হিসেব অনুযায়ী ২০১৫ থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে ইউরোপে এক্ষেত্রে ২৫ হাজার নতুন চাকরি হবে৷
ছবি: picture alliance/dpa/U. Zucchi
দুর্বল ব্যাটারি নিয়ে সমস্যা
ইলেকট্রিক গাড়ির অন্যতম সমস্যা ঘনঘন ব্যাটারি চার্জের প্রয়োজনীয়তা৷ তার উপর চার্জিং-স্টেশনের সংখ্যা এখনো কম৷ সেই নেটওয়ার্ক বাড়ালে ও ব্যাটারির দাম কিলোওয়াট-প্রতি ১০০ মার্কিন ডলারে নেমে এলে প্রচলিত গাড়ির সঙ্গে পাল্লা দিতে পারবে ইলেকট্রিক গাড়ি৷ ২০২০ থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে এমনটা সম্ভব হবে বলে পূর্বাভাষ পাওয়া যাচ্ছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/K. Nietfeld
নিষেধাজ্ঞার পথ
ব্রিটেন সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সে দেশে ২০৪০ সাল থেকে কোনো নতুন পেট্রোল ও ডিজেলচালিত গাড়িকে ছাড়পত্র দেওয়া হবে না৷ ইউরোপে একের পর এক দেশ ও শহর এমন লক্ষ্যমাত্রা স্থির করে চলেছে৷ বায়ুদূষণ কমাতে ও বিকল্প জ্বালানিচালিত গাড়ির উৎপাদনকে উৎসাহ দিতে এমন সব সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে৷
ছবি: Getty Images/S.Barbour
‘একলা চলো রে’ নীতির সমস্যা
ইউরোপের গাড়ি শিল্প পরস্পরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত৷ তাই ব্রিটেনের মতো দেশ বা কিছু শহর বিচ্ছিন্নভাবে পেট্রোল-ডিজেল বর্জন করলে নির্গমনহীন গাড়ি তৈরির প্রয়াস উলটে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলে সতর্ক করে দিয়েছে ইউরোপীয় কমিশন৷ আমদানি-রপ্তানির ক্ষতি, যন্ত্রাংশ সরবরাহে বিঘ্নের ফলে বিকল্প জ্বালানির গাড়িতে বিনিয়োগ কমে যাবার আশঙ্কা রয়েছে৷
ছবি: picture alliance/dpa/L. M. Mirgeler
চাপের মুখে গাড়ি শিল্প
জার্মানির দু’টি প্রধান গাড়ি কোম্পানি ‘ক্লিন ডিজেল’ প্রযুক্তিতে বিশাল বিনিয়োগ করেছে৷ কিন্তু ২০১৫ সালে অ্যামেরিকায় গাড়ির কার্বন নির্গমন পরীক্ষায় কারচুপি স্বীকার করে নেয় ফলক্সভাগেন কোম্পানি৷ আউডি, পর্শে সহ কোম্পানির এই অসৎ কাজ জার্মানির পরিবহণ কর্তৃপক্ষ ধরতে পারেনি৷ তাই জার্মান গাড়ি শিল্প ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ চাপের মুখে পড়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/F. Gentsch
পরিবর্তনের শীর্ষে ভলভো
সুইডেনের ভলভো কোম্পানি জানিয়ে দিয়েছে, ২০১৯ সালের পর তারা আর কোনো পেট্রোল ও ডিজেলচালিত গাড়ি উৎপাদন করবে না৷ এই প্রথম কোনো বড় আকারের গাড়ি কোম্পানি এমন সাহসি পদক্ষেপ নিচ্ছে৷ উল্লেখ্য, সুইডেন ২০৪৫ সালের মধ্যে সব ধরনের গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন বন্ধ করার লক্ষ্যমাত্রা স্থির করেছে৷