‘স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বোঝাপড়া না হলে ডিভোর্স হতেই পারে৷ কিন্তু আমাদের সমাজ নারীবান্ধব নয়, নয় মানববান্ধবও৷ ফলে ডিভোর্স হলে সব দায় যেন নারীর – এ বিষয়টিই উঠে এসেছে মনোবিজ্ঞানী অধ্যাপক মেহেতাব খানমের সঙ্গে কথোপকথনে৷
ছবি: imago/Steinach
বিজ্ঞাপন
[No title]
This browser does not support the audio element.
ডয়চে ভেলে: ডিভোর্স বা বিবাহবিচ্ছেদ ধর্মীয় ও আইনগতভাবে বৈধ৷ এরপরেও ডিভোর্সের কারণে নারীদের নানারকম মানসিক এবং সামাজিক সমস্যা দেয়৷ এ বিষয়টি যদি একটু খুলে বলেন৷
মেহেতাব খানম: এর ‘পজেটিভ', ‘নেগেটিভ' দু'টি দিকই আছে৷ মূলত তিনটি গ্রুপ, যাঁরা বিবাহিত জীবনে ‘সাফার' করছেন, আমাদের কাছে আসেন৷ যাঁরা ডিভোর্স নিয়ে নিয়েছেন তাঁদের কথা আগে বলি৷ আমাদের সমাজ তো নারীবান্ধব সমাজ হয়ে উঠেনি৷ ডিভোর্সের পর সমাজ থেকে একটা মেয়েকে বলা হয়, ‘তোমার উচিত ছিল আরো একটু মানিয়ে চলা৷ বিবাহিত জীবনে এমন তো হতেই পারে৷' আসলে মেয়েটাকে অনেক বেশি দোষারোপ করা হয়৷ অথচ সে হয়ত তো আর পারছিল না৷ দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার পরই সে হয়ত এমন একটা সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে৷ আবার অনেক সময় ছেলে-মেয়ে বড় থাকলে তারাও বলে, ‘মা তুমি এর মধ্যে কেন আছে? তুমি পৃথক হয়ে যাচ্ছো না কেন?' ছোটবেলায় ওরা কিন্তু চায় না বাবা-মা আলাদা থাকুক৷ তবে ওরা যখন বুঝতে শেখে, তখন ওরা বলে, দেখ তোমরা প্রতিদিন ঝগড়া করছো, আমাদের দেখতে ভালো লাগছে না৷' মাকে তারা বলে, ‘তোমার ওপর যে নির্যতন হচ্ছে তা আমরা সহ্য করতে পারছি না৷ তুমি কেন পৃথকভাবে থাকছো না?' এর বড় একটি কারণ অর্থনৈতিক৷ মেয়েরা অর্থনৈতিকভাবে সাবলম্বী নয়৷ কারণ অভিভাবকরাই মেয়েকে ওভাবে ‘সাপোর্ট' দিচ্ছে না৷ আর সমাজ তো বলতেই থাকে, ‘তুমি মানিয়ে নাও৷' ডিভোর্সের পরও বলা হয়, ‘তোমার আরো চেষ্টা করা উচিত ছিল৷'
ভালোবাসার যত্ন
‘ভালোবাসা’-র মানুষকে কাছে পাওয়ার জন্য প্রথমদিকে যেমন আবেগ, উৎসাহ আর আগ্রহ থাকে, ধীরে ধীরে তেমনই তা ম্লান হয়ে যায় যা খুবই স্বাভাবিক৷ তারপরও কীভাবে সম্পর্ককে মধুর, আনন্দময় রাখা যায় – সে বিষয়ে এই ছবিঘরে পাবেন কিছু ‘টিপস’৷
ছবি: Highlight
মিলেমিশে কাজ করা
প্রায়ই দেখা যায় স্বামী-স্ত্রী দু’জনে একসাথে বাইরে থেকে ফিরলেন৷ কিন্তু খাবার তৈরি বা সংসারের অন্য কাজে লেগে গেলেন স্ত্রী৷ আর স্বামী টিভি চালিয়ে বসলেন সোফায়৷ এমনটা না করে বরং সংসারের কাজকর্ম দু’জনে মিলেমিশে শেষ করে, পরে একসাথে দু’জন মিলে টিভি দেখুন বা গল্প করুন৷ সারাদিন কে কী করলেন একে অপরেকে জানান৷
ছবি: Fotolia/Yuri Arcurs
ক্রুটি বড় করে না দেখা
একসাথে থাকতে গেলে অনেক সময় ছোটখাটো অভ্যাসগুলো অসুবিধার কারণ হয়ে দাঁড়ায়৷ একজন হয়ত সব সময় মোজা খুলে বিছানায় রেখে দেন৷ অপরজন চুথপেস্টের ঢাকনা লাগাতে যান ভুলে৷ অনেক পরিবারে এ সব ছোটখানো বিষয় নিয়ে অযথা ঝগড়া শুরু হয়৷ তাই এই সব বিষয়গুলো এড়িয়ে চললে জীবন কিন্তু অনেক মধুর হতে পারে৷
ছবি: Fotolia/dkimages
স্বীকৃতি
সব মানুষই মাঝে মাঝে তাঁর কাজের স্বীকৃতি চায়, এমনকি সংসারের কাজের ক্ষেত্রেও৷ তাই মাঝে মধ্যে একে অপরকে সে কথা জানান৷ আরো রোম্যান্টিক হয়, যদি কথাটা জানানো যায় ছোট্ট একটি ‘নোট’ লিখে অথবা এসএমএস-এর মারফত৷ দেখবেন পরের দিন কাজের আগ্রহ তো বাড়বেই, তার সঙ্গে আপন মানুষটিকে মনে হবে আরো কাছের৷
ছবি: Fotolia/mars
প্রশংসা
অনেকদিন একসাথে থাকার ফলে সব কিছুই কেমন যেন সাধারণ ব্যাপার হয়ে যায়৷ তাই বিশেষজ্ঞরা বলেন, নতুন পোশাক বা হেয়ার স্টাইলে আপনার সঙ্গিকে সুন্দর লাগছে – এ কথা বলতে একদম সংকোচ করবেন না৷ আসলে এমন ছোটখাটো প্রশংসার ‘এফেক্ট’ কিন্তু অনেক বড় হয়৷ অর্থাৎ ‘প্রশংসা ছোট তবে তার এফেক্ট বড়’৷
ছবি: Fotolia/Subbotina Anna
ভালোবাসার স্পর্শ
ভালোবাসা গাছের মতো, যত যত্ন করা যাবে ততই বাড়বে৷ ভালোবাসার স্পর্শে ডালপালা ফলে-ফুলে ভরে যায়, আর অযত্নে যায় শুকিয়ে৷ অনেক দম্পতি মনে করেন, ‘ভালোই তো আছি, আবার ভালোবাসা দেখাতে হবে কেন? অথচ ভালোবাসা দেখালে দাম্পত্য জীবন হতে পারে মধুময়৷ ঠিক গাছের মতোই যত্ন নিন৷ হঠাৎ করেই ফুল বা ছোটখাটো উপহার দিয়ে আপনার প্রিয়া বা প্রিয়তমকে দিন চমকে!
ছবি: Nelson Almeida/AFP/Getty Images
‘হবি’ বা সখ
মাঝে মাঝে কখনো নিজেরা একসাথে এমন কিছু করুন, যাতে অন্য ধরণের গল্প বা আলোচনা হতে পারে৷ একসাথে সাইকেল চালাতে বা হাঁটতে যেতে পারেন৷ খোলা আকাশের নীচে প্রাণ খুলে হাসুন বা কথা বলুন৷ একে অপরের সাথে সব কিছু ভাগাভাগি করার নামই যে বন্ধুত্ব, আর সেটাই তো দীর্ঘ ও সুখি দাম্পত্যের আসল কথা৷
ছবি: Foto: Ahrtal-Tourismus Bad Neuenahr-Ahrweiler e.V.
রাগ পুষে রাখতে নেই
রাগ, অভিমান ছাড়া কি দাম্পত্য জীবন মধুর হয়? রাগ, দুঃখ, অভিমান তো থাকবেই৷ কিন্তু তাই বলে রাগ যেন বেশিক্ষণ না থাকে৷ দিনের শেষে রাগ ভুলে অপরের কাছে এগিযে যান৷ রাগ বা মান ভাঙানোর উত্তম সময় সেটা৷ তা না হলে দু’জনকেই হয়ত না ঘুমিয়ে সারাটা রাত কাটাতে হবে, যার প্রভাব পড়বে পরবর্তীতেও৷
ছবি: Fotolia/drubig-photo
কিছুটা দূরত্ব
মাঝে মধ্যে দাম্পত্য জীবনের সব কিছুই একঘেয়েমি মনে হতে পারে৷ তাই স্বামী তাঁর সহকর্মী বা পুরনো বন্ধুদের সাথে কখনো আড্ডায় যেতে পারেন৷ স্ত্রী তাঁর ছেলেবেলার বন্ধু-বান্ধবী বা কাছের কোনো মানুষের সাথে শপিং বা সিনেমা দেখতে যেতে পারেন৷ এতে নিজেদের অনেকটা হালকা মনে হবে৷ মাঝে মাঝে একটু দূরত্ব কিন্তু স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে একে-অপরকে কাছে পাওয়ার আনন্দ বাড়িয়ে দেয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/I. Wagner
বিবাহিত জীবনের জন্য পুরস্কার
দীর্ঘ বিবাহিত জীবনের জন্য বেশ কয়েকটি দেশে পুরস্কার দেওয়ার রীতি রয়েছে৷ পোল্যান্ডের কোনো দম্পতির ৫০ বছর পূর্ণ হলে তাঁদের প্রেসিডেন্ট পদক দেওয়া হয়৷ অ্যামেরিকায় ৫০ বছর হলে হোয়াইট হাউস থেকে শুভেচ্ছা বার্তা পাঠানো হয়৷ আর ইংল্যান্ডে ৬০ বছরের বিবাহবার্ষিকী পালন করা কোনো দম্পতিকে রানির কাছ থেকে বার্তা পাঠানো হয়৷
ছবি: Fotolia/contrastwerkstatt
ঝগড়া এড়িয়ে চলুন!
ঝগড়া অকালমৃত্যুর কারণ হতে পারে৷ ডেনমার্কের কোপেনহাগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে বের করেছেন যে, যাঁরা খুব বেশি ঝগড়া করেন তাঁদের অকালমৃত্যুর ঝুঁকি অন্যদের তুলনায় দুই থেকে তিনগুণ বেশি৷ কাজেই ঝগড়া এড়িয়ে চলুন!
ছবি: goodluz - Fotolia
গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা পরে
খাওয়ার আগে কখনো কোনো গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় যাবেন না৷ পারলে মিষ্টি কিছু খেয়ে নেবেন৷ কারণ ওহাইয়ো স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞনীরা গবেষণা করে দেখেছেন যে, শরীরে শর্করার পরিমাণ কম হলে একে-অপরের প্রতি রাগ, ক্রোধ কেমন যেন আক্রমণাত্বক হয়ে ওঠে৷ বলা বাহুল্য, গ্লুকোজ বা শর্করা মানুষের শরীরে জ্বালানির মতো কাজ করে৷
ছবি: Highlight
11 ছবি1 | 11
তাহলে যে মেয়ে ডিভোর্স নিয়ে বের হয়ে এসেছেন, সেই মেয়েটির কী কী ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়?
যেহেতু আমাদের সমাজ নারীবান্ধব নয়, সেহেতু সমাজ থেকে মেয়েটিকে খুব একটা গ্রহণযোগ্যতা দেয়া হয় না৷ মেয়েটি যখন তাঁর আত্মীয়স্বজনের কাছে যান, তখন তাঁর দিকে অন্যভাবে তাকানো হয়৷ অনেক সময় তাঁকে বিব্রতকর প্রশ্নও করা হয়, যেটা করা একেবারেই উচিত না৷ হয়ত আত্মীয়স্বজনরা জানেন যে, মেয়েটি আর স্বামীর সঙ্গে নেই৷ তারপরও তাঁরা স্বামীকে নিয়ে প্রশ্ন করেন৷ মানে জেনে-শুনে মেয়েটিকে অপ্রস্তুত করার জন্য প্রশ্ন করা হয়৷ বাচ্চারা যখন স্কুলে যায়, তখনও তারা অনেক কিছু শোনে৷ যেমন‘তোমার বাবা কেন নিতে আসছেন না?' বাচ্চারা বাসায় এসে মাকে এ সব বলে: তখন মেয়েটা কিন্তু কষ্ট পান৷ আমার মনে হয়, এ জায়গাটাই আমাদের সমাজের পরিবর্তনটা দরকার৷
ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের এক হিসেবে দেখা গেছে যে, শহরাঞ্চলে, বিশেষ করে ঢাকা শহরে মেয়েরাই বেশি ডিভোর্স দিচ্ছেন৷ এ তথ্য কি সঠিক?
হ্যাঁ, কথাটা ঠিক৷ তবে ডিভোর্সের মতো সিদ্ধান্ত নিতে মেয়েরা কিন্তু দ্বন্দ্বে ভোগেন৷ এত বড় একটা সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে তাঁরা সাধারণত অনেক চিন্তা করেন৷ কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছু করতে না পেরে বিবাহবিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হন৷ আসলে পড়ালেখার অধিকার, পছন্দসি পোশাক বা ‘ড্রেস' পরার অধিকার, চলাফেরার অধিকার – মেয়েদের কাছ থেকে অনেক সময় এ সবও হরণ করা হচ্ছে৷ আর বিয়ের পর তো মেয়েদের অনেককিছুর সঙ্গে মানিয়ে চলতে হয়৷ অন্যদিকে একটা ছেলেকে এত মানুষের সঙ্গে মানিয়ে চলতে হয় না৷ আমার মনে হয়, এ রকম সাধারণ জায়গাগুলোতে বৈমষ্য দূর না হলে মেয়েদের অবস্থার পরিবর্তন হবে না৷ বর্তমানে খুব কম মেয়েই ডিভোর্সের পর সমাজে সাহস করে চলতে পারছেন৷ কিন্তু বিবাহবিচ্ছেদের পর নিজের প্রতি ভালো একটা অনুভূতি আছে বা আত্মসম্মান নিয়ে চলতে পারছেন – এমন মেয়ে খুব বেশি খুঁজে পাওয়া যাবে না৷ অবশ্য এমনটা যে একেবারে নেই, তা নয়৷ তবে তেমন মেয়ের সংখ্যা খুবই কম৷