জেলা প্রশাসকের (ডিসি) ডিজিটাল আইনের মামলায় কিশোরগঞ্জের একজন সাংবাদিককে কারাগারে পাঠানো হয়েছে৷ ওই সাংবাদিক ফেসবুক লাইভে জেলা প্রশাসনের বিরুদ্ধে মানহানিকর বক্তব্য দিয়েছেন বলে অভিযোগ করা হয়েছে৷
ছবি: Johannes Eisele/AFP/Getty Images
বিজ্ঞাপন
আটক সাংবাদিকের নাম আকিব হৃদয়৷ তিনি ‘প্রতিদিনের সংবাদ’ নামে একটি দৈনিকের কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধি৷ এছাড়া তিনি ‘আনন্দ টিভি’ এবং ‘দেশ টাইম’ নামে একটি অনলাইন নিউজ পোর্টালেরও সাংবাদিক বলে জানা গেছে৷
সোমবার বেলা আড়াইটার দিকে শহরের সার্কিট হাউজ এলাকায় ভ্রাম্যমাণ আদালত তাকে মোটরবাইকসহ আটক করে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করে৷
পরে বিকেলের দিকে আকিব ফেসবুক লাইভে অভিযোগ করেন, ‘‘ভ্রাম্যমাণ আদালতের ম্যাজিষ্ট্রেটকে ‘স্যার' না বলে ‘ভাই' বলায় তাকে সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়৷ আর সাংবাদিক পরিচয় দেয়াতে তারা ক্ষুব্ধ হন৷’’
এরপর ওই রাতেই ডিসি সারোয়ার মুর্শেদ চৌধুরী নিজে বাদি হয়ে ডিজিটাল আইনে থানায় মামলা করেন৷ রাতেই তাকে উকিল পাড়ার বাসা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়৷ মঙ্গলবার তাকে আদালতে হাজির করলে কারাগারে পাঠান বিচারক৷
ডিসি সরাসরি মামলা করবেন কেন: বাচ্চু খান
This browser does not support the audio element.
ডিসির অভিযোগ, ‘‘তার (আকিব) কোনো ড্রাইভিং লাইসেন্স ও হেলমেট ছিলো না৷ এমনকি সে মাস্কও পরেনি৷ ফলে আইন অনুযায়ী জরিমানা করেছে ভ্রাম্যমাণ আদালত৷ কিন্তু এরপর সে ডিসি অফিসের সামনে গিয়ে ফেসবুক লাইভে বলে, ম্যাজিস্ট্রেটকে স্যার না বলায় তাকে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে৷ সে আরো অবমাননাকর কথা বলেছে৷ তার অভিযোগ মিথ্যা৷ এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটেনি৷ সে লাইভে আরো বলে, ‘‘ডিসিকে আমরা ভাই বলব না তাহলে কী বলব? বাবা বলব, ডিসি আব্বা বলব’’
জেলা প্রশাসকের মতে, সে যেহেতু ফেসবুকে জেলা প্রশাসনের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করছে তাই ডিজিটাল আইনে মামলা করা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিলো না৷ তিনি আরো বলেন, ‘‘বিষয়টি নিয়ে আমি সাংবাদিকদের সাথে বৈঠক করেছি৷ তারাও আমার সাথে একমত হয়েছেন৷’’
এই মামলায় আরো দুইজনকে আসামি করা হয়েছে৷ তারা হলেন, মোস্তাফিজুর রহমান ও সারোয়ার হোসেন রনি৷ তারাও আকিবের সঙ্গে ফেসবুক লাইভে ছিলেন বলে অভিযোগ করা হয়েছে৷
ফেসবুক লাইভে আকিব দাবি করেন, তার হেলমেট ও মাস্ক ছিলো৷ ড্রাইভিং লাইসেন্স ছিল না৷ আর তাকে প্রথমে ১০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে ২ মাসের কারাদণ্ডের কথা বলা হয়৷ পরে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়৷ সে আরো অভিযোগ করে যে, তাকে বার বার বলা হচ্ছিল, ‘‘সাংবাদিকদের আমরা বেশি জরিমানা করি৷’’
কিশোরগঞ্জ প্রেসক্লাব এখন তালাবদ্ধ৷ কমিটিও ভেঙে দেয়া হয়েছে৷ সাংবাদিকদের দুই গ্রুপের দ্বন্দ্বে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষায় এই মাসের প্রথম দিকে সেখানে জেলা প্রশাসন তালা লাগিয়ে দেয়া হয়। তবে প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি আহমেদ উল্লাহ বলেন, ‘‘এখানে দুই পক্ষই বাড়াবাড়ি করেছে৷ আমার মনে হয় ডিজিটাল আইনে মামলা করে তাকে কারাগারে না পাঠিয়েও বিষয়টির সমাধান করা যেত৷ আমাদের সাথে এনিয়ে প্রশাসনের বৈঠক হয়েছে৷’’
তার ড্রাইভিং লাইসেন্স ও হেলমেট ছিলো না: ডিসি
This browser does not support the audio element.
আকিবের বাবা বাচ্চু খান বলেন, ‘‘তাদের স্যার না বলায় তাকে সর্বোচ্চ জরিমানা করা হয়েছে৷ প্রতিহিংসা আর ক্ষমতা দেখাতেই ডিজিটাল আইনে মামলা করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে৷ নয়তো একজন ডিসি সরাসরি মামলা করবেন কেন?’’
তিনি আরো বলেন, ‘‘আমরা ছেলে ডিসি অফিসের সবাইকে চিনত৷ সে কারণেই হয়তো মটর সাইকেল থামানোর পর ভাই বলেছে৷’’
আকিবের ফেসবুস পোস্টের একটি ছবিতে দেখা যায় যে কয়েকদিন আগে তিনি ডিসিকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছাও জানিয়েছেন৷ স্থানীয় কয়েকজন সাংবাদিকও জানান, আকিবের সঙ্গে জেলা প্রশাসনের অনেকেরই সখ্য ছিল৷
আকিব গত তিন বছর ধরে ‘প্রতিদিনের সংবাদ’ এর কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধি হিসেবে কর্মরত৷ পত্রিকাটি ঢাকার তেজগাঁ এলাকা থেকে প্রকাশিত হয়৷ পত্রিকাটির সহ সম্পাদক ও অনলাইন ইনচার্জ রিহাব মাহমুদ জানান, ‘‘আকিব আমাদের ঘটনার পর পরই জানিয়েছিলেন যে সে ম্যাজিস্ট্রেটটদের স্যার না বলায় তাাকে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে৷ আমরা এ নিয়ে খবরও প্রকাশ করেছি৷ বিষয়টি আমরা এখন পর্যবেক্ষণ করছি৷’’
ডিজিটাল আইনের মামলায় কারাগারে পাঠানো এই আইনটির অপব্যবহারের আরেকটি উদাহরণ বলে মনে করেন মানবাধিকার কর্মী নূর খান৷ তিনি বলেন, ‘‘আমাদের কাছে এপর্যন্ত ওই ঘটনায় যেসব তথ্য রয়েছে তাতে বিষয়টি আলাপ আলোচনার মাধ্যমেই সমাধান করা যেত৷ তা না করে এই আইনটি হয়রানির উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়েছে বলেই মনে হচ্ছে৷’’
এর মাধ্যমে ক্ষমতার অপব্যবহার করা হয়েছে বলে তিনি মনে করেন৷
যেসব অভিযোগে ডিজিটাল আইনে মামলা
করোনা মহামারি শুরুর পর বাংলাদেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলার সংখ্যা বেড়ে গেছে৷ কী অভিযোগে এসব মামলা হচ্ছে, জানুন ছবিঘরে৷
ছবি: facebook.com/michelkumirthakur
মুশতাক আহমেদ
বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ, করোনা ভাইরাস নিয়ে গুজব, রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করতে অপপ্রচার চালানোর অভিযোগে ২০২০ এর ৫ মে ১১ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে র্যাব-৩৷ তাদের একজন মুশতাক আহমেদ৷ এজাহারে বলা হয়েছে, ‘‘তিনি ‘আই এম বাংলাদেশি’ পেজের এডিটর৷ তিনিও গুজব ছড়িয়েছেন৷ এছাড়া হোয়াটসঅ্যাপ ও ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক চ্যাটিংয়ের প্রমাণ পাওয়া গেছে৷’’ ২৫ ফেব্রুয়ারি কারাগারে তার মৃত্যু হয়৷
ছবি: facebook.com/IamBangladeshi.71
কার্টুনিস্ট আহমেদ কবীর কিশোর
ব়্যাবের মামলার গ্রেপ্তার হওয়া চারজনের একজন কিশোর৷ তার ফেসবুক পাতায় রাষ্ট্রবিরোধী পোস্ট, করোনা, সরকারদলীয় বিভিন্ন নেতার কার্টুন দিয়ে গুজব ছড়িয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টির প্রমাণ পাওয়া গেছে বলে এজাহারে বলা হয়৷ এছাড়া তার ব্যবহৃত ফোনে তাসনিম খলিল, শায়ের জুলকারনাইন, শাহেদ আলম ও আসিফ মহিউদ্দিনের সঙ্গে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক চ্যাটিংয়ের প্রমাণ পাওয়া গেছে বলেও জানানো হয়৷ ৪ মার্চ তিনি জামিনে মুক্তি পান৷
ছবি: facebook.com/AKK30M
দিদারুল ভূঁইয়া
ব়্যাবের মামলায় গ্রেপ্তার আরেকজন দিদার ‘রাষ্ট্রচিন্তা’ নামে একটি সংগঠনের সদস্য৷ ব্রিটিশ মানবাধিকার সংস্থা ‘আর্টিকেল ১৯’ বলছে, দিদার করোনা মহামারির বিরুদ্ধে লড়তে বাংলাদেশ সরকার যে ত্রাণ কার্যক্রম শুরু করেছে, তা মনিটর করার জন্য গঠিত একটি কমিটির সদস্য৷ নিজের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনেস দিদার অভিযোগ করেন, সবচেয়ে গরিব মানুষেরাই সরকারি ত্রাণের সবচেয়ে কম অংশ পেয়েছেন৷ সম্প্রতি তিনি হাইকোর্ট থেকে জামিন পান৷
ছবি: Facebook/didarul.bhuiyan
তাসনিম খলিল
ব়্যাবের মামলার ১১ আসামির একজন সুইডেন প্রবাসী সাংবাদিক তাসনিম খলিল৷ তার সম্পর্কে এজাহারে বলা হয়েছে, তার ফেসবুক আইডিতে জাতির জনক, মুক্তিযুদ্ধ, করোনা ভাইরাস, সেনাবাহিনীসহ বিভিন্ন নিরাপত্তা বাহিনীর প্রধান ও বাহিনী সম্পর্কে অবমাননাকর মন্তব্য ও রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করার বা বিভ্রান্তি ছড়াতে অপপ্রচার বা গুজবসহ বিভিন্ন ধরনের পোস্ট পাওয়া গেছে৷
ছবি: Facebook/tasneem.khalil
শফিকুল ইসলাম কাজল
২০২০ সালের ৯ মার্চ ঢাকার শেরেবাংলা নগর থানায় ফটো সাংবাদিক কাজলসহ ৩২ জনের বিরুদ্ধে ডিজিটাল আইনে মামলা করেন মাগুরা-১ আসনের সাংসদ সাইফুজ্জামান শেখর৷ যুব মহিলা লীগের নেত্রী শামীমা নূর পাপিয়ার ওয়েস্টিন হোটেলকেন্দ্রিক কারবারে ‘জড়িত’দের নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনের কারণে এই মামলা করেছিলেন তিনি৷ এছাড়া কাজলের বিরুদ্ধে হাজারীবাগ ও তেজগাঁও থানায়ও ডিজিটাল আইনে আরও দুটি মামলা হয়৷
ছবি: Facebook/Shafiqul Islam Kajol
বেরোবি শিক্ষক
ফেসবুকে সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী নাসিমের মৃত্যু নিয়ে ‘অবমাননাকর’ পোস্ট দেয়ায় ডিজিটাল আইনের মামলায় রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) বাংলা বিভাগের শিক্ষক সিরাজুম মনিরাকে ২০২০ সালের ১৩ জুন গ্রেফতার করা হয়৷ পোস্টটি দেয়ার কিছুক্ষণ পর তিনি তা মুছে দিয়েছিলেন৷
ছবি: bdnews24.com
রাবি শিক্ষক
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক কাজী জাহিদুর রহমানকে গতবছর ১৮ জুন গ্রেপ্তার করা হয়৷ পুলিশ কর্মকর্তা মো. গোলাম রুহুল কুদ্দুস জানান, সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী নাসিমকে নিয়ে ফেসবুকে ‘আজেবাজে কথা লিখে কটূক্তির অভিযোগে’ তাকে গ্রেপ্তার করা হয়৷ বার্তা সংস্থা ডিপিএ বলছে, ২ জুন প্রকাশিত এক পোস্টে তিনি স্বাস্থ্যখাতে দুর্নীতি নিয়ে কথা বলেছিলেন৷ যদিও নাসিমের নাম উল্লেখ করেননি৷ পোস্টটি তিনি পরে মুছেও দেন৷
ছবি: DW/A. Khanom
নবম শ্রেণির ছাত্র ইমন
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে ফেসবুকে কটূক্তির অভিযোগে ময়মনসিংহের ভালুকায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা এক মামলায় নবম শ্রেণির ছাত্র মো. ইমনকে ২০২০ সালের ২০ জুন গ্রেপ্তার করা হয়৷ এরপর তাকে কিশোর শোধনাগারে পাঠানো হয়৷ ভালুকার ওসি জানিয়েছেন, ইমন পরে পোস্টটি মুছে ক্ষমা চেয়েছিল৷
ছবি: Reuters/M. Ponir Hossain
সুশান্ত দাশ গুপ্ত
‘আমার হবিগঞ্জ’ পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক৷ এই পত্রিকায় স্থানীয় সাংসদ আবু জাহিরের অনিয়ম ও দুর্নীতির খবর প্রকাশের জেরে ২০২০ সালের ২০ মে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেন হবিগঞ্জ প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক সায়েদুজ্জামান জাহির৷ এর পরদিন সুশান্তকে গ্রেপ্তার করা হয়৷ ১৪ জুন তিনি জামিন পান৷