ডিসেম্বর ১৯৭১: ঢাকায় বিজয়ের পতাকা ও পাকিস্তানের আত্মসমর্পণ
সালেক খোকন
১৬ ডিসেম্বর ২০২৩
১৯৭১-এর ডিসেম্বরে ঢাকার চারদিকে মিত্রবাহিনীর অগ্রযাত্রা দেখে ১৫ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমীর আব্দুল্লাহ খান নিয়াজী বুঝে যান তাদের পতন আসন্ন।
বিজ্ঞাপন
২৬ মার্চ ২০২১ থেকে ৩১ মার্চ ২০২২ পর্যন্ত স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপন করেছে বাংলাদেশ। এক বছর পর, অর্থাৎ, ২০২৩ সালের মার্চ থেকে মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে ফিরে তাকানো শুরু করে ডয়চে ভেলে বাংলা। বীরত্ব, গৌরব ও বেদনার সেই নয় মাসে পর্যায়ক্রমে ফিরে তাকানোর শেষ পর্বে থাকছে ডিসেম্বর ১৯৭১-এ পরাজিত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের কথা...
একাত্তরে বাংলাদেশের মানুষ যখন স্বাধীনতার জন্য লড়াই করছে, তখন পৃথিবীর পরাশক্তিগুলো পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান নেয়। অ্যামেরিকা ও চীন ছিল পাকিস্তানের পক্ষে। অন্যদিকে বাংলাদেশের পক্ষে ছিল ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়ন।
বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের নিকট-বন্ধু ও উন্নয়নের অন্যতম অংশীদার মনে করা হয় চীনকে। অথচ একাত্তরে পাকিস্তানের পাশে ছিল তারা। চীন পাকিস্তানে ‘উপহার' হিসেবে ২৫৫টি ট্যাংক ও এক স্কোয়াড্রন ইল-২৮ বিমান এবং ২০০ সামরিক প্রশিক্ষক পাঠিয়েছিল। শুধু ১৯৭১ সালেই চীন পাকিস্তানকে প্রদান করেছিল ৪৫ মিলিয়ন ডলারের সামরিক উপকরণ, যার বেশিরভাগ ব্যবহার করা হয়েছিল বাঙালি নিধনে।
গণহত্যা শুরুর পর থেকে মুক্তিযুদ্ধের কোনো পর্যায়েই চীন বাংলাদেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গণহত্যার নিন্দা করেনি। তবে ওইসময়ও পিকিংপন্থি কমিউনিস্টদের ব্যাপারে দেশটি ঠিকই খোঁজখবর রাখতো। সেই বিষয়টি উঠে আসে ইয়াহিয়ার বাঙালি উপদেষ্টা জি ডব্লিউ চৌধুরীর লেখা ‘লাস্ট ডেজ অব ইউনাইটেড পাকিস্তান' গ্রন্থে। সেখানে তিনি লিখেছেন, ‘‘১৯৭১ সালের নভেম্বরে অস্ত্র সংগ্রহের উদ্দেশ্যে জুলফিকার আলী ভুট্টো পিকিং গেলে চীনা প্রধানমন্ত্রী চৌ-এন লাই ভুট্টোর কাছে অভিযোগ করে বলেন, পাকিস্তানি সেনা হামলায় ৬৪ জন পিকিংপন্থি রাজনীতিবিদ-কর্মী নিহত হয়েছে। ভুট্টো এর জন্য দুঃখ প্রকাশও করেছিলেন।''
বঙ্গবন্ধু সামরিক জাদুঘরে তিন বাহিনীর গৌরবগাঁথা
ঢাকার বিজয় সরণিতে ১০ একর জমির উপর প্রতিষ্ঠিত বঙ্গবন্ধু সামরিক জাদুঘরে রয়েছে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর ইতিহাস, ঐতিহ্য, সাফল্যের নিদর্শন এবং বিভিন্ন অস্ত্রশস্ত্রের সমৃদ্ধ সংগ্রহশালা।
ছবি: Rashed Mortuza/DW
ইতিহাস
১৯৮৭ সালে প্রথম বাংলাদেশ সামরিক জাদুঘর মিরপুর সেনানিনাবসের প্রবেশপথে উদ্বোধন করেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি লেফটেন্যান্ট জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। ১৯৯৯ সালে জাদুঘরটি স্থায়ীভাবে বিজয় সরণিতে স্থানান্তর করা হয়। ২০০৯ সালে জাদুঘরটি আধুনিকায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয় এবং ব্যাপক সংস্কারের পর নতুন অবকাঠামোটি ২০২২ সালে উদ্বোধন করা হয়।
ছবি: Rashed Mortuza/DW
প্রবেশের টিকিট ও সময়সূচী
বঙ্গবন্ধু সামরিক জাদুঘরে ৫ বছরের বেশি বয়সের দর্শনার্থীদের প্রবেশ মূল্য জনপ্রতি ১০০ টাকা। সার্কভুক্ত দেশগুলোর দর্শনার্থীদের প্রবেশ টিকিট ৩০০ টাকা এবং অন্যান্য দেশের দর্শনার্থীদের প্রবেশ টিকিটের দাম ৫০০ টাকা। জাদুঘরটি বুধবার এবং অন্যান্য সরকারি ছুটির দিন ছাড়া সপ্তাহের বাকি ৬ দিন সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১টা এবং বিকাল ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত সবার জন্য উন্মুক্ত থাকে।
ছবি: Rashed Mortuza/DW
তোশাখানা জাদুঘর
বঙ্গবন্ধু জাদুঘর কমপ্লেক্সে রয়েছে তোশাখানা জাদুঘর নামের একটি পৃথক জাদুঘর। এখানে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি এবং গুরুতপূর্ণ ব্যক্তিদের পাওয়া উপহার এবং পুরস্কারগুলো প্রদর্শন করা হয়।
ছবি: Rashed Mortuza/DW
যা যা রয়েছে
বঙ্গবন্ধু সামরিক জাদুঘর প্রাঙ্গণে রয়েছে থ্রি-ডি আর্ট গ্যালারি, কফি শপ, মাল্টিপারপাস হল, এক্সিবিশন হল, স্যুভেনির শপ, স্টার সিনেপ্লেক্স, ক্যাফেটেরিয়া, মুক্ত মঞ্চ, সেমিনার হল, তোশাখানা জাদুঘর, ভাস্কর্য ইত্যাদি।
ছবি: Rashed Mortuza/DW
পলাশির কামান
বঙ্গবন্ধু সামরিক জাদুঘরের নীচতলায় প্রবেশপথের ডানদিকে ঘুর্ণায়মান একটি স্টেজে রাখা হয়েছে ১৭৫৭ সালে পলাশির যুদ্ধে ব্যবহৃত হওয়া একটি কামান।
ছবি: Rashed Mortuza/DW
বঙ্গবন্ধু কর্ণার
বাংলাদেশের সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন এ জাদুঘরে তিন বাহিনীর জন্য নির্ধারিত গ্যালারিসহ ছয়টি পৃথক অংশ রয়েছে৷ প্রতিটি বাহিনীর গ্যালারিতে একটি বঙ্গবন্ধু কর্নার রয়েছে। এছাড়া ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত সংগ্রাম থেকে স্বাধীনতার ইতিহাস চিত্রায়িত হয়েছে।
ছবি: Rashed Mortuza/DW
বৈচিত্র্যময় নৌকা
বাংলাদেশ নদীবিধৌত অঞ্চল হওয়ায় এদেশে নৌকার ইতিহাস বহু পুরানো। জাদুঘরটিতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বহুল প্রচলিত নৌকার মডেল রাখা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ঘাসি, মালার, চাঁদ নৌকা, ময়ুরপঙ্খী, পদী নৌকা এবং সাম্পান।
ছবি: Rashed Mortuza/DW
ব্রিজ সিমুলেটর
সামরিক জাদুঘরের বেসমেন্টে রয়েছে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর গ্যালারি। সাধারণ দর্শনার্থীদের বড় জাহাজের বাস্তব অভিজ্ঞতা দিতে এখানে স্থাপন করা হয়েছে ব্রিজ সিমুলেটর। নৌবাহিনীর একজন সদস্য দর্শনার্থীদের একটি যুদ্ধ জাহাজ চালিয়ে দেখান।
ছবি: Rashed Mortuza/DW
সমুদ্রের তলদেশে
নৌবাহিনীর গ্যালারিতে অত্যাধুনিক লেজার শো-র মাধ্যমে সমুদ্রের তলদেশের অভিজ্ঞতা দেওয়া হয়েছে। নানা বয়সের দর্শনার্থীরা এখানে আসেন এবং ছবি তুলে ও ভিডিও করে স্মৃতির পাতায় বন্দি করে রাখেন।
ছবি: Rashed Mortuza/DW
জেনারেল ওসমানীর জিপ
মহান মুক্তিযুদ্ধের কমান্ডার-ইন-চিফ জেনারেল এমএজি ওসমানী বাংলাদেশ ফোর্সেস সদর দপ্তর থেকে এই জিপে মুক্তিযুদ্ধের সময় সাতক্ষীরা, যশোর, কুষ্টিয়া, পাবনা, রাজশাহী, পঞ্চগড়সহ সীমান্তবর্তী বিভিন্ন এলাকায় অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাদের অপারেশন, যুদ্ধের প্রস্তুতি, প্রশিক্ষণ ও প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিদর্শন করতেন।
ছবি: Rashed Mortuza/DW
স্ট্রেচার
যুদ্ধক্ষেত্রে অসুস্থ, আহত অথবা নিহত সেনা সদস্যদের স্থানান্তর অথবা উদ্ধারের জন্য স্ট্রেচার ব্যবহৃত হয়। স্বাধীনতার পরে এই ধরনের স্ট্রেচার ব্যবহৃত হলেও এর অসুবিধার কথা বিবেচনা করে ২০১১ সাল থেকে উন্নতমানের স্ট্রেচার ব্যবহার শুরু করা হয়।
ছবি: Rashed Mortuza/DW
আত্মসমর্পণের দলিল
বঙ্গবন্ধু সামরিক জাদুঘরের দ্বিতীয় তলায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর গ্যালারিতে স্থান পেয়েছে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরে পাক হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের দেয়ালচিত্র। পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের দলিলে মুক্তিবাহিনীর পক্ষে স্বাক্ষর করেছিলেন ভারতের লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা এবং পাকিস্তানের পক্ষে স্বাক্ষর করেছিলেন পাকিস্তানের লে. জেনারেল আমির আবদুল্লাহ নিয়াজি।
ছবি: Rashed Mortuza/DW
প্রথম মানচিত্রখচিত পতাকা
বঙ্গবন্ধু সামরিক জাদুঘরের দ্বিতীয় তলায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর গ্যালারিতে রয়েছে বাংলাদেশের প্রথম মানচিত্রখচিত পতাকা। বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় পতাকার মূল নকশাকার শিবনারায়ণ দাস। এটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলার এক সমাবেশে ১৯৭১ সালের ২ মার্চ প্রথম উত্তোলন করা হয়।
ছবি: Rashed Mortuza/DW
পিলখানার শহিদদের স্মরণে
২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকার পিলখানায় বিডিআর সদর দপ্তরে বিদ্রোহী জওয়ানদের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার শহীদদের ব্যবহৃত বিভিন্ন জিনিসপত্র রাখা হয়েছে এ জাদুঘরে।
ছবি: Rashed Mortuza/DW
মুক্তিযুদ্ধে জব্দকৃত কামান
সরাসরি এবং উচ্চ ফায়ার ক্ষমতাসম্পন্ন কিউএফ-২৫ পাউন্ডার হাউইটজার কামানটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটেন এবং কমনওয়েলথের দেশগুলোর মধ্যে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ব্যবহার করা এই কামানটি মুক্তিযোদ্ধারা জব্দ করেন৷ ১৯৮৮ সালে এটি তৎকালীন সামরিক জাদুঘরে রাখা হয়।
ছবি: Rashed Mortuza/DW
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে নারীর ক্ষমতায়ন
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে নারীদের বীরত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ সেনাবাহিনীর গ্যালারিতে একটি আলাদা কর্নারে স্থান পেয়েছে তাঁদের ব্যবহার্য বিভিন্ন জিনিসপত্র। এর মধ্যে রয়েছে জাতিসংঘে প্রথম নারী কন্টিনজেন্ট কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজমা বেগমের নিদর্শন, প্রথম মহিলা পাইলট ক্যাপ্টেন শাহরিনা আনোয়ারের ইনসিগনিয়া, সেনাবাহিনীর প্রথম মেজর জেনারেল সুসানে গীতির ব্যবহার করা বিভিন্ন জিনিস।
ছবি: Rashed Mortuza/DW
ককপিট
বঙ্গবন্ধু সামরিক জাদুঘরের তৃতীয় তলায় বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর গ্যালারিতে সাধারণ দর্শনার্থীদের জন্য এফ-৭এমবি যুদ্ধবিমানের ককপিটে বসার সুযোগ রাখা হয়েছে।
ছবি: Rashed Mortuza/DW
কিলো ফ্লাইট
মহান মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিবাহিনী আকাশ পথে প্রথম অপারেশন পরিচালনা করে ৩ ডিসেম্বর৷ ‘অপারেশন কিলো ফ্লাইট’ নামের সেই অভিযানে তিনটি বিমান ব্যবহৃত হয়৷ অভিযানের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট সুলতান মাহমুদ।
ছবি: Rashed Mortuza/DW
পার্বত্য চট্টগ্রাম গ্যালারি
বঙ্গবন্ধু সমরিক জাদুঘরের ৪র্থ তলায় রয়েছে শান্তি, সম্প্রীতি ও উন্নয়নের পার্বত্য চট্টগ্রাম গ্যালারি। এখানে ১৭৭৭ সাল থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসের ধারা বর্ণনা করা হয়েছে।
ছবি: Rashed Mortuza/DW
জাতিসংঘ শান্তি মিশন গ্যালারি
বঙ্গবন্ধু সামরিক জাদুঘরের ৪র্থ তলায় রয়েছে জাতিসংঘ শান্তি মিশনের গ্যালারি। এখানে ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জাতিসংঘে ভাষণ, ১৯৮৮ সালে ইরান-ইরাকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রথম যুক্ত হওয়া থেকে শুরু করেন আজ অব্দি বিভিন্ন মিশনে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর গৌরবোজ্জ্বল অংশগ্রহণের ইতিহাস বর্ণনা করা হয়েছে।
ছবি: Rashed Mortuza/DW
শান্তিরক্ষা মিশনের শহিদদের স্মরণ
২০১৮ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি আফ্রিকার মালিতে শান্তিরক্ষা কার্যক্রমের অংশ হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় আইইডি বিস্ফোরণে ৪ জন বাংলাদেশি সেনা নিহত এবং ৪ জন আহত হন। পরবর্তীতে ২০২১ সালের ১৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু সামরিক জাদুঘরে প্রদর্শনের নিমিত্তে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী যুদ্ধের স্মারকটি জাদুঘর কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করে।
ছবি: Rashed Mortuza/DW
দেশের সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন জাদুঘর
ঢাকার বিজয় সরণিতে বঙ্গবন্ধু নভোথিয়েটারের পশ্চিমদিকে অবস্থিত বঙ্গবন্ধু সামরিক জাদুঘর দেশের সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন এবং ব্যয়বহুল জাদুঘর। আধুনিক নাগরিক সুযোগ-সুবিধার পাশাপাশি দর্শনার্থীদের মন জয় করতে এতে সব ধরণের নিরাপত্তা ব্যবস্থার সন্নিবেশ ঘটানো হয়েছে।
ছবি: Rashed Mortuza/DW
পরিচ্ছন্নতা
পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতয়া বজায় রাখতে জাদুঘরের অভ্যন্তরে কোনো প্রকার খাবার এবং পানীয় নিয়ে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না।
ছবি: Rashed Mortuza/DW
23 ছবি1 | 23
একাত্তরে দেশের অভ্যন্তরে চীনপন্থি পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির নেতা দেবেন সিকদার, এম. এ. মতিন, মোহাম্মদ আলাউদ্দিনরা চারু মজুমদারের নক্সালবাড়ি নীতি গ্রহণ করেছিলেন। তবে চীনের প্রতি আনুগত্যের অবস্থান থেকে সরে এসে রাশেদ খান মেনন, হায়দার আকবর খান রনো, কাজী জাফর, ক্র্যাক প্লাটুনের বীর যোদ্ধা রুমীর মতো কেউ কেউ স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নেন। বাকিরা পাকিস্তানের প্রতি অনুগত থাকেন। আর সিরাজ সিকদার, মানস ঘোষদের মতো কেউ কেউ মুক্তিযুদ্ধকে ‘দুই কুকুরের লড়াই' আখ্যা দিয়ে পাকবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী উভয়ের বিরুদ্ধেই অবস্থান নেন।
তাদের চীনপ্রীতি স্বাধীন বাংলাদেশেও অব্যাহত ছিল। বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে সিরাজ সিকদারের পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টি ‘স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা' কায়েমের জন্য সশস্ত্র সংগ্রামের ডাক দেয়। আর হক, তোহা, মতিন, আলাউদ্দিন, দেবেন সিকদার, শান্তি সেন, অমল সেনের মতো কিছু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলের নেতারা ‘‘চীনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান'' শ্লোগান দিয়ে ‘শ্রেণি-শত্রু খতম'-এর পথ বেছে নেন। মাওলানা ভাসানীও তাদের হয়ে পল্টনের জনসভায় হুঙ্কার দিয়ে বলেছিলেন, ‘‘আমি নতুন পতাকা ওড়াবো''। ওই ঘোষণার পরপর জুলফিকার আলী ভুট্টো ‘মুসলিম বাংলা' প্রতিষ্ঠার জন্য ভাসানীকে পাকিস্তান সফরেরও আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন।
এসব ঘটনায় এটা স্পষ্ট করে যে, বাংলাদেশ প্রশ্নে চীন ও তার অনুসারীদের কার্যকলাপ স্বাধীনতার পরও অব্যাহত ছিল। ১৯৭২ সালের ২৫ আগস্ট জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যপদ প্রাপ্তির প্রস্তাবে চীন প্রথম ভেটো প্রয়োগ করে। পৃথিবীর অনেক রাষ্ট্র বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলেও চীন সেটি দেয় বহু পরে, ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পরিবারের অধিকাংশ সদস্যের সঙ্গে নিহত হওয়ার পরে। (তথ্যসূত্র:একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংলাদেশের কমিউনিস্টদের ভূমিকা : বদরুদ্দিন ওমর, মূলধারা ৭১: মইদুল হাসান তালুকদার মনিরুজ্জামান-The Bangladesh Revolution and its Aftermath, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র, ১৫ খণ্ড)
একাত্তরে যুক্তরাষ্ট্র ছিল চীনের বন্ধু। মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময় যুক্তরাষ্ট্র পাশে ছিল পাকিস্তানের। মার্কিন কংগ্রেসের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও সে দেশ থেকে অস্ত্র আর অর্থ গিয়েছে পাকিস্তানে। কংগ্রেসের নজরদারি এড়াতে প্রেসিডেন্ট নিক্সন ও তার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার ইরান ও জর্ডানের মাধ্যমে পাকিস্তানে বোমারু বিমান পাঠানোর আয়োজন করেছিলেন। নিক্সন বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঠেকাতে পারমাণবিক যুদ্ধের হুমকি দিতেও দ্বিধা করেননি। সপ্তম নৌবহর পাঠিয়ে বাংলাদেশকে চূড়ান্ত শিক্ষা দেওয়ার পরিকল্পনাও করেছিলেন তিনি।
ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গ্যারি ব্যাস রচিত ব্লাড টেলিগ্রাম নিক্সন-কিসিঞ্জারের ওই সময়কার ষড়যন্ত্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রামাণিক গ্রন্থ। অধ্যাপক গ্যারি নথিপত্র থেকে উদ্ধৃতি দিয়েই একাত্তর প্রসঙ্গে সেখানে বলেছেন , ‘‘নিক্সন-কিসিঞ্জার উভয়েই জানতেন, বাংলাদেশে ভয়াবহ গণহত্যা চলছে। লাখ লাখ মানুষ হতাহত হয়েছে, সিআইএ এবং স্টেট ডিপার্টমেন্ট থেকে তাদের সে কথা জানানো হয়েছিল। ঢাকায় যা হচ্ছে, তা গণহত্যা ভিন্ন অন্য কিছু নয়- এ কথা মার্কিন কূটনীতিকেরাই তাদের জানিয়েছিল। কিন্তু তারা মুখ বুঁজে ছিলেন। শুধু তা–ই নয়, কিসিঞ্জার এ নিয়ে টুঁ–শব্দটি না করতে সরকারি কর্মকর্তাদের নির্দেশও দেন।''
পাকিস্তানের পক্ষে অ্যামেরিকার প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের নির্দেশে মার্কিন নৌবাহিনীর যুদ্ধ জাহাজকে বঙ্গোপসাগরে পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়। সপ্তম নৌ বহর হিসেবে পরিচিত অ্যামেরিকার ওই নৌবহরে ছিল নয়টি জাহাজ। ডিসেম্বর মাসের ১৪ তারিখে পূর্ব পাকিস্তান অভিমুখে ওই রণতরী ভারত মহাসাগরে প্রবেশ করে। কিন্তু তার আগেই সেখানে সোভিয়েত ইউনিয়ন ১২ থেকে ১৫টি রণতরী পাঠায়। তাদের রণতরীতে গাইডেড মিসাইল এবং পরমাণু অস্ত্রবাহী সাবমেরিনও ছিল।
সোভিয়েত রণতরী অবস্থান নেয়ায় যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন পাল্টা সামরিক ব্যবস্থা নেবার কথা চিন্তাও করেনি। বরং মার্কিন রণতরী গতিপথ পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়।
এছাড়া পূর্ব পাকিস্তানের যুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ে ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসের ৪ থেকে ৬ তারিখের মধ্যে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের দীর্ঘ আলোচনা হয়। তখন অ্যামেরিকা চেয়েছিল ভারতের ওপর চাপ প্রয়োগ করে পূর্ব-পাকিস্তানে যুদ্ধ বন্ধ করতে। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন তাতে ভেটো দেয়, কেননা তখন মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয় আসন্ন ছিল।
আবার ১৫ ডিসেম্বর জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থনে পোল্যান্ড একটি প্রস্তাব তোলে। ওই প্রস্তাবের অন্যতম বিষয় ছিল-যুদ্ধবিরতি এবং পূর্ব পাকিস্তান থেকে পাকিস্তানী সেনা প্রত্যাহার। পাকিস্তানের প্রতিনিধি জুলফিকার আলী ভুট্টো এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে ওইদিন পোল্যান্ডের প্রস্তাব সম্বলিত কাগজ ছিঁড়ে টুকরো-টুকরো করে নিরাপত্তা পরিষদ থেকে বেরিয়ে যান। ওই প্রস্তাবকে তিনি অপমানসূচক 'আত্মসমর্পণের দলিল' হিসেবেও বর্ণনা করেছিলেন। অথচ মাত্র একদিন পরেই আত্মসমর্পণ করতে হয়েছিল পাকিস্তানকে। (তথ্যসূত্র:স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র, ১৫ খন্ড, মুক্তিযুদ্ধে সোভিয়েত বন্ধু-হাসান ফেরদৌস)
৩ ডিসেম্বর ১৯৭১। রাত ১২টার পর প্রথমবারের মতো বিমান হামলা করে বাঙালি পাইলটরা। ভারতীয় এয়ারেফোর্সের সহযোগিতায় পরিচালিত ওই অপারেশনটিকে বলা হয় কিলো ফ্লাইট । এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে মুক্তিবাহিনীর বিমান উইংয়ের অবিশ্বাস্য এক যুদ্ধাভিযানের ইতিহাস। দুঃসাহসিক সেই অভিযানের এক অগ্রসেনানী বীর মুক্তিযোদ্ধা ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শামসুল আলম (বীর উত্তম)। তার জীবনদশায় তিনি সেই অভিযান সম্পর্কে এই লেখকের সঙ্গে কথা বলেছিলেন।
তিনি বলেছিলেন, "আমাকে বললো, ‘ফ্লাইট লেফট্যানেন্ট শামসুল আলম, তোমার টার্গেট হলো টু ডিসট্রয়েড চিটাগাং অয়েল রিফাইনারি। সুলতান মাহমুদের টার্গেট দিল নারায়ণগঞ্জের গোদনাইলেন, ইউএসএসও'র তেলের ডিপো ধ্বংস করা। আমি ক্যাপ্টেন, কো পাইলট হলেন ক্যাপ্টেন আকরাম। বোম ফেলবেন সার্জেন্ট হক আর এয়ার গানার ছিলেন রুস্তম আলী।
বিরল ছবিতে বাংলাদেশের ইতিহাস পরিক্রমা
৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ৭১- এর মুক্তিযুদ্ধ এবং ৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন বাংলাদেশের ইতিহাসে গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়৷ এসব অধ্যায় অনেকটাই ফুটে উঠেছে এই ছবিগুলোতে৷
ছবি: Journey/M. Alam
ভাষা আন্দোলন
১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনে শহিদদের খবর প্রকাশিত হয় পত্রিকায়৷ ছবিটি ফটোগ্রাফার রফিকুল হকের তোলা৷
ছবি: Journey/R. Hoque
একুশের প্রভাতফেরি
১৯৫৩ সালে একুশের প্রথম প্রভাতফেরি৷ সেখানে নারীদের সাহসী পদচারণার ছবিটিও তুলেছেন রফিকুল হক৷
ছবি: Journey/R. Hoque
৬৬’র ছাত্র আন্দোলন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যাম্পাসে ১৯৬৬ সালের ছাত্র আন্দোলনের ছবিটি তুলেছেন আজমল হক৷
ছবি: Journey/A. Hoque
মধুর ক্যান্টিন
মধুর ক্যান্টিন৷ বাংলাদেশের অনেক আন্দোলনের সূত্রপাতই এখান থেকে৷ ১৯৬৭ সালে ছবিটি তুলেছেন ফটোগ্রাফার রশিদ আহমেদ৷
ছবি: Journey/R. Ahmed
৬৯-এর প্রভাতফেরি
১৯৬৯ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারির প্রভাতফেরির ছবিটি তুলেছেন এনামুল হক৷
ছবি: Journey/A. Hoque
৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান
১৯৬৯ সালের জানুয়ারিতে পল্টন ময়দানে বক্তব্য রাখছেন তৎকালীন ছাত্রনেতা তোফায়েল আহমেদ৷ ছবিটি তুলেছেন বিখ্যাত ফটোগ্রাফার রশীদ তালুকদার৷
ছবি: Journey/R. Talukder
বঙ্গবন্ধু’র ঐতিহাসিক উচ্চারণ
‘‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম’’৷ ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণের সময় বঙ্গবন্ধুর এ ছবিটি তুলেছেন মোহাম্মদ আলম৷
ছবি: Journey/M. Alam
মুক্তিযুদ্ধে আদিবাসীরা
ছবিটি ১৯৭১ সালে রেসকোর্স ময়দানে তোলা৷ তীর, ধনুক হাতে সেদিন উপস্থিত হয়েছিলেন আদিবাসীরাও৷ ছবিটি তুলেছেন মোহাম্মদ আলম৷
ছবি: Journey/M. Alam
প্রতিবাদী শিল্পীরা
পশ্চিম পাকিস্তানীদের শোষনের বিরুদ্ধে সোচ্চার শিল্পী সমাজ৷ ১৯৭১ সালের ২৪শে মার্চ ছবিটি তোলেন রশীদ তালুকদার৷
ছবি: Journey/R. Talukder
পত্রিকায় ২৫শে মার্চ
১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনী ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নাম দিয়ে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর যে বর্বরোচিত হামলা চালিয়েছিল সেই তথ্য৷
ছবি: Journey
কারফিউ ভঙ্গের অভিযোগে শাস্তি
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে কারফিউ ভাঙার অপরাধে এক বাঙালিকে শায়েস্তা করছে পাকবাহিনী৷ ছবিটি তুলেছেন ফটোগ্রাফার রশিদ আহমেদ৷
ছবি: Journey/R. Ahmed
বধ্যভূমিতে বুদ্ধিজীবীদের মৃতদেহ
১৮ ডিসেম্বর, ১৯৭১৷ রায়েরবাজারের বধ্যভূমিতে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের লাশ পড়ে আছে৷ ১৯৭১ সালের ১৮ই ডিসেম্বর ছবিটি তোলেন ফটোগ্রাফার এনামুল হক৷
ছবি: Journey/A. Hoque
অস্ত্র সমর্পণ
১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারির ছবি এটি৷ ঢাকা স্টেডিয়ামে অস্ত্র সমর্পণ অনুষ্ঠান৷ বঙ্গবন্ধুর কাছে অস্ত্র সমর্পণ করছেন একজন মুক্তিযোদ্ধা৷ ছবিটি তুলেছেন মোহাম্মদ আলম৷
ছবি: Journey/M. Alam
মিত্র বাহিনীর বিদায়
১২ মার্চ, ১৯৭২ সাল৷ মিত্র বাহিনীর বিদায় অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান৷ সঙ্গে ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার জগজিত সিং অরোরা৷ ঐতিহাসিক এই ছবিটি তুলেছেন ফটোগ্রাফার মোহাম্মদ আলম৷
ছবি: Journey/M. Alam
শহিদ মিনারের পরিবর্তে মসজিদের পরিকল্পনা
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭১-এর ১৮ ডিসেম্বর বিধ্বস্ত শহিদ মিনারের সামনে দাঁড়িয়ে ডাকসুর তৎকালীন জিএস আব্দুল কুদ্দুস মাখন৷ পাশে মসজিদ লেখাটি দেখা যাচ্ছে৷ পাকিস্তানিরা শহিদ মিনার গুঁড়িয়ে দিয়ে এখানে মসজিদ নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছিল৷ ছবিটি তুলেছেন এনামুল হক৷
ছবি: Journey/A. Hoque
শহিদ মিনার পুনর্নিমাণ
পাকিস্তানি সেনারা মুক্তিযুদ্ধের সময় শহিদ মিনার ভেঙে ফেলে৷ ১৯৭২ সালে শহিদ মিনার পুনর্নিমাণের ছবিটি তুলেছিলেন আলোকচিত্রী এনামুল হক৷
ছবি: Journey/A. Hoque
অপরাজেয় বাংলার উদ্বোধন
১৯৭৮ সালে ডাকসুর উদ্যোগে নির্মিত অপরাজেয় বাংলা উদ্বোধনের ছবি এটি৷ উদ্বোধন করেন দুই যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা৷ ছবিটি তুলেছেন ফটোগ্রাফার আজমল হক৷
ছবি: Journey/A. Hoque
স্বৈরাচার পতনের আন্দোলন
এরশাদের স্বৈরাচারী সরকারের পতন ঘটাতে সারাদেশে তখন গণজোয়ার৷ ১৯৯০ সালের ২৮শে নভেম্বর ছবিটি তুলেছেন ইউসুফ সাদ৷
ছবি: Journey/Y. Saad
18 ছবি1 | 18
ভারতের ডিমাপুর ছেড়ে আমরা কৈলাশহর চলে যাই। সেখানে একটা তিনহাজার ফিট ছোট্ট রানওয়ে ছিল। ৩ ডিসেম্বর বিকেল তখন ৫টা। মোটরসাইকেলে ইন্ডিয়ান এয়ারফোর্সের এক ফ্লাইং অফিসার আসেন, সিগন্যাল ম্যাসেজ নিয়ে। ম্যাসেজে লেখা এমন, ‘ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শামসুল আলম, কনগ্রাচুলেশন। ইউর ওয়েটিং ডেজ আর ওভার। টু ডেইস ইজ দা ডে ফর ইউর ফাইনাল অ্যাটাক। অল আদারস ব্রিফিং উইল এজ বিফোর।'
সঙ্গে সঙ্গে ক্রুদের বললাম, এয়ারক্রাফট তৈরি করো। রাত পৌনে আটটার দিকে আমরা টেকঅফ করি। ফ্লাইংয়ে আস্তে আস্তে উচ্চতা কমাচ্ছিলাম যাতে পাকিস্তান বিমানবাহিনীর রাডার ধরতে না পারে।
রাত তখন ১২টা পার হয়ে যাচ্ছে। এয়ার ক্রাফটটা আস্তে আস্তে উঁচুতে ওঠালাম। নিচে দেখলাম চট্টগ্রাম এয়ারপোর্টের রানওয়ে দেখা যায়। পাশেই ইস্ট পাকিস্তান অয়েল রিফাইনারি। সারি সারি আলো জ্বলছে সেখানে। প্লেনটাকে একটা চক্কর দিয়েই ফার্স্ট টার্গেটে দুটো রকেট ফায়ার করি। দুই জায়গাতে হিট করলো। কিন্তু কোনো এক্সপ্লোশন হলো না। দ্বিতীয় আরেকটা হিট করলাম। কিন্তু এবারও এক্সপ্লোশন নেই। বেশ অবাক হলাম। তৃতীয় হিটটি করতে যাবো তখনই এয়ারপোর্ট থেকে পাকিস্তানিরা সমানে ফায়ার শুরু করে।
তখনও আমি টার্গেটে অটল। দুটো রকেট হিট করে টার্ন করছি অমনি বিকট শব্দে রিফাইনারির একটা ট্যাংক এক্সপ্লোশন হলো। আরও ৪ থেকে ৬টি রকেট ফায়ার করি। দেখলাম নিচে শুধু আগুন আর আগুন। আনন্দে সবাই চিৎকার দিয়ে উঠি।
প্রায় পৌনে নয় ঘন্টা ফ্লাইংয়ে ছিলাম আমরা। ইতিহাসে এটা ছিল সবথেকে দীর্ঘ মিলিটারি অপারেশন। প্রথম ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধেও কেউ নয় ঘন্টা ফ্লাই করে টার্গেট ডেসট্রয় করে নাই।যা আমরাই রচনা করেছিলাম।”
কিলো ফ্লাইট অপারেশনের খবর বিবিসিসহ বিশ্বের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়। এর ফলে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর তেল সরবরাহ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। নতুন করে তেল সরবরাহেরও সুযোগ ছিল না তাদের। ফলে সারাদেশে পাকিস্তানি বাহিনীর কার্যক্রম পরিচালনা কঠিন হয়ে পড়ে।
সারাদেশেই মুক্তিবাহিনী আক্রমণ চালিয়ে পাকিস্তানিদের মনোবল পুরোপুরি ভেঙে দেয়। ওইসময় জামালপুরের ধানুয়া কামালপুরে পাকিস্তানি সেনাদের শক্তিশালী ঘাঁটি দখলে নিয়ে দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেন ১১ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা।
এ নিয়ে কথা হয় কামালাপুর ক্যাম্পের কমান্ডার বীরপ্রতীক কাজী জয়নাল আবেদীনের সঙ্গে।
তিনি বললেন, ‘আমরা পাকিস্তানি ক্যাম্পটার পেছনের দিক ঘিরে রাখি। ওখানে অবস্থান নেওয়ায় পাকিস্তানি সেনাদের সার্পোট আসতে পারে না। রেশন আসাও বন্ধ হয়ে যায়। গোলাবারুদও কমতে থাকে। তখন কোনঠাসা হয়ে পড়ে। ৪ ডিসেম্বর সারেন্ডার করার জন্য ওদের ক্যাম্পে একটা চিঠি পাঠানো হয় মুক্তিযোদ্ধা বশিরকে দিয়ে।কিন্তু সে গিয়ে আর ফিরে না। সবার মধ্যে তখন উত্তেজনা। মুক্তিযোদ্ধারা চাচ্ছে ভেতরে ঢুকতে।
পরে আরেকটি চিঠি দিয়ে পাঠানো হয় আনিসুল হক সজ্জুকে। সন্ধ্যার দিকে সবাই বের হয়ে আসে। সঙ্গে পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন আহসান মালিক ও তার নেতৃত্বে শতাধিক পাকিস্তানি সেনা। ওরা সারেন্ডার করে বান রোডের ওপরে, ইন্ডিয়ান আর্মির কাছে।'
সময় যত এগোতে থাকে, বাংলাদেশের পক্ষে নানা নাটকীয় ঘটনাও ঘটতে থাকে। ৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশকে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয় ভারত। তার কয়েক ঘন্টা আগেই তারবার্তার মাধ্যমে স্বীকৃতি মিলে ভুটানের কাছ থেকে। ভারতের স্বীকৃতি দানের কয়েক ঘণ্টা পরেই কলকাতায় বাংলাদেশ মিশনে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ায় পাকিস্তান কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে।
ভারতের স্বীকৃতির ফলে ওইসময় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ‘ভারত-পাকিস্তান' যুদ্ধের সমালোচনা থেকে অনেকটাই মুক্তি দেয়। এর ফলে মুক্তিযুদ্ধের গতি আরো বেগবান হয়। মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী প্রতিটি সীমান্ত দিয়ে একযোগে একের পর এক এলাকা মুক্ত করে ঢাকার দিকে অগ্রসর হতে থাকে।
এদিকে পাকিস্তানি সেনা ও তাদের এদেশীয় দোসরাও হত্যাযজ্ঞের নতুন মিশন নিয়ে নামে। তারা তালিকা করে হত্যা করে দেশের সেরা বুদ্ধিজীবীদের। এর মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী।
পাকিস্তানের পরাজয় তখন অবশ্যম্ভাবী। এটা বুঝতে পেরে তিনি ঠান্ডা মাথায় পরিকল্পনা করে মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, আশরাফুজ্জামান, কামারুজ্জামান, মঈনুদ্দীন প্রমুখ আলবদর নেতাদের দায়িত্ব দেন ডিসেম্বরের ১৪ তারিখের মধ্যে তালিকাভুক্ত বুদ্ধিজীবীদের ধরে এনে হত্যা করার। তালিকাভুক্ত বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে ছিলেন ডক্টর রাব্বি, ডক্টর আলীম, মুনীর চৌধুরী, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, সন্তোষ ভট্টাচার্য প্রমুখ। দেশ স্বাধীন হওয়ারর পর গভর্নর হাউজ থেকে রাও ফরমান আলীর একটি ডায়রি পাওয়া যায়। সেখানে অনেক নিহত ও নিখোঁজ বুদ্ধিজীবীর নামও লেখা ছিল। (তথ্যসূত্র: ৭১-গণহত্যার দলিল, একাত্তরের ঘাতক দালাল কে কোথায়?, ফখরুল আবেদীনের তথ্যচিত্র-আলবদর, মুক্তিযুদ্ধ তারপর-গোলাম মুরশিদ)
একাত্তরে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের জন্য ২০১৩ সালে চৌধুরী মুঈনুদ্দীন, আশরাফুজ্জামান খান ও আবুল কালাম আজাদকে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দেয় ঢাকার আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ আদালত। কিন্তু দেশের বাইরে থাকায় তাদের দণ্ড আজও কার্যকর করা যায়নি। পাশাপাশি স্বাধীনতার এত বছরেও শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা চূড়ান্ত করতে পারেনি সরকার।
১৯৭১-এর ডিসেম্বরে ঢাকার চারদিকে মিত্রবাহিনীর অগ্রযাত্রা দেখে ১৫ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমীর আব্দুল্লাহ খান নিয়াজী বুঝে যান তাদের পতন আসন্ন। ইয়াহিয়ার অনুমতি নিয়ে তিনি জাতিসংঘকে অনুরোধ জানান আত্মসমর্পণের ব্যবস্থা করতে। পাশাপাশি ভারতের প্রধান সেনাপতি মানেকশকেও বিষয়টি জানান।
১৬ ডিসেম্বর দুপুরে কলকাতা থেকে ঢাকায় আসেন ভারতীয় মিত্রবাহিনীর কমান্ডার জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার চিফ অফ স্টাফ মেজর জেনারেল জেএফআর জ্যাকব। এরপর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের হেডকোয়ার্টারে চলে আত্মসমর্পণের দলিল তৈরির বৈঠক। সেখানে উপস্থিত ছিলেন পাকিস্তানি বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমীর আবদুল্লাহ নিয়াজী, মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী ও মেজর জেনারেল মোহাম্মদ জামশেদ। যৌথবাহিনীর পক্ষে ছিলেন মেজর জেনারেল জেএফআর জ্যাকব, মেজর জেনারেল গন্ধর্ভ সিং নাগরা ও কাদেরিয়া বাহিনীর কমান্ডার কাদের সিদ্দিকী।
বিকেল ৪টা ৩১ মিনিটে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণের দলিলে সই করেন নিয়াজী। দলিলে পাকিস্তানি নৌ-পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের কমান্ডার রিয়ার-অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ শরিফ, পাকিস্তান বিমানবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় বিমান বাহিনীর কমান্ডার এয়ার ভাইস-মার্শাল প্যাট্রিক ডেসমন্ড কালাঘানও স্বাক্ষর প্রদান করেন।
আত্মসমর্পণের আনুষ্ঠানিকতায় বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিত্ব করেন মুক্তিবাহিনীর ডেপুটি চিফ অফ স্টাফ গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকার। ভারতের পক্ষে সাক্ষী ছিলেন ভারতীয় ৪র্থ কোরের কমান্ডার লে. জেনারেল সগত সিং, পূর্বাঞ্চলীয় বিমান বাহিনীর কমান্ডার এয়ার মার্শাল হরি চাঁদ দেওয়ান ও ভারতীয় পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের সেনা প্রধান মেজর জেনারেল জে এফ আর জ্যাকব।(তথ্যসূত্র: সারেন্ডার অ্যাট ঢাকা- লে জেনারেল জে এফ আর জেকব, নিয়াজির আত্মসমর্পণের দলিল- সিদ্দিক সালিক)
বেশ তড়িঘড়ি করেই আয়োজন করা হয়েছিল আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানটি। তিন হাত বাই দেড় হাত একটি সাদামাটা টেবিল এনে দেন ঢাকার গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা বজলুল মাহমুদ বাবলু (বীরপ্রতীক। সেই টেবিলেই শেষ হয় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের আনুষ্ঠানিকতা৷
সেদিনটির কথা বজলুল মাহমুদ বাবলু জানান এভাবে, ‘‘সারেন্ডারের খবরটা আমরা আগেই পাই। অস্ত্র নিয়ে ওইদিন সকালেই একটা ওপেন জিপে অবস্থান নিই ঢাকা ক্লাবের কাছে, বটগাছের নিচে। জাহেদ আনোয়ার ছিলেন ড্রাইভে। সঙ্গে মিলুও ছিল।
এখন যেখানে শিশু পার্ক, তার ভেতরেই হয়েছিল আত্মসমর্পণের অনুষ্ঠানটি। ইন্ডিয়ান আর্মিদের কয়েকজন এসে বলল একটা টেবিল দরকার। তখন ঢাকা ক্লাব থেকে বের করে আনলাম ওই টেবিলটি। সেটাই ইতিহাস। সারেন্ডারের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলাম। এটাই পরম পাওয়া৷''
এ ক্ষেত্রে মুজিবনগর সরকারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন জনসংযোগ কর্মকর্তা নজরুল ইসলামের ‘একাত্তরের রণাঙ্গন অকথিত কিছু কথা' নামক গ্রন্থে বলা হয়েছে , ‘‘যুদ্ধ-বিগ্রহ, জয়-পরাজয়, আত্মসমর্পণ সম্পর্কে জেনেভা কনভেনশনের আন্তর্জাতিক নীতিমালা রয়েছে। জেনেভা কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী দেশগুলো এ নীতিমালা মানতে বাধ্য। ওই সময় বাংলাদেশ জেনেভা কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী দেশ ছিল না। ফলে কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী মুক্তিবাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণ করতে পারে না।
তাছাড়া শেষের দিকে সশস্ত্র যুদ্ধটি ভারত-বাংলাদেশের যৌথ কমান্ডের অধীনে হলেও যুদ্ধের অপারেটিং পার্টের পুরো কমান্ডে ছিলেন ভারতীয় সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল শ্যাম মানেকশ। এ কারণেই আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে জেনারেল মানেকশ-কে রিপ্রেজেন্ট করেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল অরোরা। সেখানে সাক্ষী হিশেবে বাংলাদেশ বাহিনীর পক্ষ থেকে এ কে খন্দকারও ছিলেন। অর্থ্যাৎ পাকিস্তান ভারতীয় সেনাবাহিনীর নিকট নয় বরং আত্মসমর্পণ করেছিলো যৌথ বাহিনীর কাছে। ফলে এটি ভারতীয় সেনাবাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণ- সেটি বলারও সুযোগ নেই।''
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের আদ্যপান্ত
বাংলাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তুলে ধরার জন্য সম্পূর্ণ বেসরকারি উদ্যোগে কয়েকজন মুক্তিপাগল মানুষের উদ্যোগে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে৷ সেই জাদুঘর নিয়েই এই ছবিঘর৷
ছবি: DW/M.M. Rahman
যাত্রা শুরু
১৯৯৬ সালের ২২ মার্চ ঢাকার সেগুনবাগিচার একটি পুরনো বাড়ি ভাড়া নিয়ে যাত্রা শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর৷ আটজন ট্রাস্টির উদ্যোগে মুক্তিযুদ্ধের নানান স্মারক সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও উপস্থাপনের প্রয়াস নিয়েই যাত্রা হয় এই জাদুঘরের৷
ছবি: DW/M.M. Rahman
নতুন ঠিকানায়
ভাড়া বাড়ির স্থান-স্বল্পতার কারণে সংগৃহীত স্মারকগুলো যথাযথভাবে প্রদর্শন করা সম্ভব না হওয়ায় ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় আগারগাঁও এলাকায় জায়গা বরাদ্দ দেয়া হয়৷ ২০১১ সালের ৪ মে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের নতুন ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন৷ প্রায় ১০২ কোটি টাকা ব্যয়ে তৈরি হয় জাদুঘরের নয়তলা ভবন৷ ২০১৭ সালের ১৬ এপ্রিল নতুন ভবনে যাত্রা শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর৷
ছবি: DW/M.M. Rahman
বীরশ্রেষ্ঠদের প্রতীক
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের সামনে সাত বীরশ্রেষ্ঠর প্রতীক হিসেবে প্রাচীন স্থাপত্যরীতির সাতটি স্তম্ভ রাখা হয়েছে৷ এই স্তম্ভগুলো নওগাঁ জেলার পত্নীতলায় দিবর দিঘিতে স্থাপিত একাদশ শতকের রাজা দিব্যকের স্তম্ভের অনুকৃতি৷ ঐতিহাসিকদের মতে, দিব্যকের সেই স্তম্ভই বাংলার প্রথম বিজয়স্তম্ভ৷ এ কারণেই মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশিদের অবিস্মরণীয় বিজয়ের স্মারক হিসেবে এই স্তম্ভগুলো স্থাপন করা হয়েছে৷
ছবি: DW/M.M. Rahman
বিশাল সংগ্রহশালা
মুক্তিযুদ্ধের নানান স্মারক, মুক্তিযোদ্ধা ও শহিদদের ব্যবহৃত সামগ্রী, অস্ত্র, দলিল, চিঠিপত্র ইত্যাদি মিলিয়ে ১৭ হাজারের বেশি নিদর্শন রয়েছে জাদুঘরের বিশাল সংগ্রহশালায়৷
ছবি: DW/M.M. Rahman
শিখা অম্লান
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের প্রথম তলায় রয়েছে শিখা অম্লান৷ কালো মার্বেল পাথরে পানির ভেতর থেকে জ্বলছে সেই শিখা৷ উদ্বোধনের আগে সেগুনবাগিচার পুরোনো ভবন থেকে মুক্তিযোদ্ধা ও নতুন প্রজন্মের ৭১ জন মানুষ হেঁটে শিখা অম্লানটি নতুন জাদুঘরে নিয়ে আসেন৷
ছবি: DW/M.M. Rahman
বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য
জাদুঘরের প্রথম তলায় শিখা অম্লানের পাশে স্থাপন করা হয়েছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও জাতীয় চার নেতার ব্রোঞ্জ নির্মিত ভাস্কর্য৷
ছবি: DW/M.M. Rahman
মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত বিমান ও হেলিকপ্টার
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের প্রথম তলার দুইপাশে ছাদের সঙ্গে আটকানো রয়েছে একটি যুদ্ধবিমান ও একটি হেলিকপ্টার৷ একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত হয়েছিল বিমান ও হেলিকপ্টারটি৷
ছবি: DW/M.M. Rahman
আমাদের ঐতিহ্য, আমাদের সংগ্রাম
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের প্রথম গ্যালারির নাম ‘আমাদের ঐতিহ্য, আমাদের সংগ্রাম’৷ প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, পাকিস্তান পর্ব, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন হয়ে ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন পর্যন্ত দেশের ভূপ্রকৃতির বৈশিষ্ট্য, ইতিহাস ও সংস্কৃতি তুলে ধরা হয়েছে এ গ্যালারিতে৷
ছবি: DW/M.M. Rahman
প্রথম গ্যালারিতে আর যা কিছু
‘আমাদের ঐতিহ্য, আমাদের সংগ্রাম’ গ্যালারিতে আরও আছে ফসিল, প্রাচীন টেরাকোটা, মৃৎপাত্র, শিলাখণ্ডসহ নানা প্রকার নিদর্শনসহ ঐতিহাসিক ঘটনা ও ব্যক্তির আলোকচিত্র৷
ছবি: DW/M.M. Rahman
দ্বিতীয় গ্যালারি
জাদুঘরের দ্বিতীয় গ্যালারির নাম ‘আমাদের অধিকার আমাদের ত্যাগ’৷ এই গ্যালারি থেকেই দর্শক সরাসরি ঢুকে পড়বেন মহান মুক্তিযুদ্ধের পর্বে৷ স্বাধীনতার দাবিতে রেসকোর্স ময়দানে ১৯৭০ সালের ৩ জানুয়ারির সমাবেশ, ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর সেই ঐতিহাসিক ভাষণের ছবি৷ মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত রাইফেল আর গুলির বাক্সসহ আছে শহিদ ও মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যবহৃত নানা সামগ্রী৷
ছবি: DW/M.M. Rahman
অপারেশন সার্চলাইট
দ্বিতীয় গ্যালারির একটি অংশে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতের গণহত্যার চিত্র৷ অন্ধকার এই গ্যালারিতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ইটের দেয়াল ভেঙে ভেতরে ঢুকছে হেডলাইট জ্বালানো একটি সামরিক যান৷ গাড়ির সেই আবছা আলোয় দেখা যাবে মেঝের চারপাশে পড়ে থাকা গুলিতে নিহত মৃতদেহ৷ আর দেয়ালে আছে ঢাকার বিভিন্ন স্থানে চালানো গণহত্যার আলোকচিত্র৷
ছবি: DW/M.M. Rahman
তৃতীয় গ্যালারি
জাদুঘরের তৃতীয় গ্যালারিটি চতুর্থ তলায়৷ এর নাম ‘আমাদের যুদ্ধ, আমাদের মিত্র’৷ এখানে আছে ভারতে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীদের জীবনযাত্রা, বিদেশি গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের বড় আকারের ডিজিটাল প্রিন্ট৷ মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ, বিভিন্ন সেক্টরে ভাগ হওয়া, রাজাকারদের তৎপরতা, মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা যুদ্ধের আশ্রয়স্থল এসব৷
ছবি: DW/M.M. Rahman
কনসার্ট ফর বাংলাদেশ
তৃতীয় গ্যালারিতে আরো আছে পণ্ডিত রবিশঙ্করের উদ্যোগে যুক্তরাষ্ট্রে আয়োজিত ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ এ বিটলসের বিখ্যাত শিল্পী জর্জ হ্যারিসনের গাওয়া ‘বাংলাদেশ বাংলাদেশ’ গানের জর্জের নিজ হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি ও সুরের স্টাফ নোটেশন৷
ছবি: DW/M.M. Rahman
চতুর্থ ও সবশেষ গ্যালারি
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের সর্বশেষ গ্যালারিটির নাম ‘আমাদের জয়, আমাদের মূল্যবোধ’৷ এতে আছে নৌযুদ্ধের বিভিন্ন নিদর্শন৷ বিলোনিয়ার যুদ্ধের রেলস্টেশনের রেলিং, ট্রলি ইত্যাদি৷ এছাড়া আছে মিত্রবাহিনীর ছত্রীসেনাদের আক্রমণ, দগ্ধ বাড়িঘর৷ সবশেষে বিজয় অর্জন৷ শেষ হয়েছে ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানের অনুলিপিটি দিয়ে৷
ছবি: DW/M.M. Rahman
ভ্রাম্যমাণ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর
বাংলাদেশের স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসার ছাত্রছাত্রীদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে ও মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানাতে বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় জেলায় ঘুরে প্রদর্শনী করা হয়৷ ২০০১ সাল থেকে দু’টি বড় বাসের মাধ্যমে এ ভ্রাম্যমাণ জাদুঘর ইতিমধ্যেই ৬৪ জেলা ভ্রমণ করেছে, তুলে ধরেছে মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় ইতিহাস৷
ছবি: DW/M.M. Rahman
সময়সূচি ও অন্যান্য তথ্য
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের গ্রীষ্মকালীন (মার্চ-সেপ্টেম্বর) সময়সূচি সকাল ১০টা-বিকেল ৬টা৷ আর শীতকালীন (অক্টোবর-ফেব্রুয়ারি) সময়সূচি হলো সকাল ১০টা-বিকাল ৫টা৷ রোজার মাসে জাদুঘর খোলা থাকে সকাল ১০টা থেকে বিকাল সাড়ে ৩টা পর্যন্ত৷ জাদুঘরের সাপ্তাহিক বন্ধ রোববার৷ প্রবেশমূল্য জনপ্রতি ২০ টাকা৷