শুধু টাইটানিক নয়, বহু শতক ধরে অনেক জাহাজেরই সলিল সমাধি ঘটেছে৷ কিন্তু সমুদ্রের তলদেশেও সেগুলির উপযোগিতা কমেনি৷ উদ্ভিদ ও প্রাণীদের আবাসনে পরিণত হয়েছে জাহাজের কঙ্কাল৷
বিজ্ঞাপন
ডুবে যাওয়া জাহাজ ডুবুরিদের জন্য রোমাঞ্চের উৎস৷ রহস্যের জালে ভরা ধাতু আর কাঠের কঙ্কাল যেন বিপদকে হাতছানি দিয়ে ডাকে৷ এবার বিজ্ঞানীরাও সে দিকে মনোযোগ দিচ্ছেন৷
ধ্বংসস্তুপের পরিবেশ কীভাবে বদলে যায়, তা পর্যবেক্ষণ করতে চান তাঁরা৷ ঠিক যেন মনে হয়, প্রকৃতি আমাদের দেখাতে চাইছে যে জঞ্জাল থেকেও স্বর্গরাজ্য সৃষ্টি করা যায়৷
কিছু জাহাজের কঙ্কাল যেন ব্যস্ত শহরের মতো৷ প্রবাল দিয়ে ঢাকা সেই শহরে মাছের ঝাঁক ঘুরে বেড়ায়৷ নীল সমুদ্রের বুকে তারা যেন প্রাণে ভরপুর দ্বীপের মতো৷ অসংখ্য প্রাণী সেখানে খাদ্য ও বাসস্থান খুঁজে পায়৷
এই জ্ঞান এখন ভূমধ্যসাগরে ফ্রান্সের উপকূলের কাছের অংশের উন্নয়নে কাজে লাগবে৷ উপকূলবর্তী অনেকটা এলাকা বর্তমানে কার্যত ‘মৃত' হয়ে রয়েছে৷ দূষণ ও মাত্রাতিরিক্ত মাছ ধরার ফলে জলের নীচের জগত মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে৷
এই অবস্থায় ভূমধ্যসাগরে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সংরক্ষণ প্রকল্প শুরু হয়েছে৷ মার্সেই উপসাগরে এক বিশাল কৃত্রিম প্রবাল প্রাচীর সৃষ্টি করা হচ্ছে৷ ভূমধ্যসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সঁদ্রিন রুইতোঁ এই প্রকল্পের বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা৷ উপকূলের কাছেই বিশাল ইস্পাতের কাঠামো সমুদ্রে ফেলা হয়েছে৷ তার উপর তৈরি হচ্ছে ‘সিটি অফ দ্য সি'৷
ইতিহাস গড়া কাঠের জাহাজ
‘ফ্রাম’ নামে ওক গাছের কাঠ দিয়ে তৈরি একটি জাহাজকে ‘বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী কাঠের জাহাজ’ বলা হয়৷ কারণ এটা দিয়ে উত্তর ও দক্ষিণ মেরুর সবচেয়ে দূরবর্তী স্থানে যাওয়া সম্ভব হয়েছে৷ কাঠের তৈরি অন্য কোনো বাহন দিয়ে যেটা সম্ভব হয়নি৷
ছবি: DW/ M. Z. Haque
‘ফ্রাম’ বা ফরোয়ার্ড
ওক কাঠ দিয়ে তৈরি জাহাজটির নাম ‘ফ্রাম’ – যার অর্থ ফরোয়ার্ড বা অগ্রসর৷ ৩৯ মিটার দীর্ঘ ও ১১ মিটার প্রস্থের এই জাহাজকে ‘বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী কাঠের জাহাজ’ বলা হয়৷ কারণ এটা দিয়ে উত্তর ও দক্ষিণ মেরুর সবচেয়ে দূরবর্তী স্থানে যাওয়া সম্ভব হয়েছে৷
ছবি: DW/M. Z. Haque
পেছনের কারিগর
ফ্রিটইওফ নানজেন নামের ছবির এই মানুষটিই ছিলেন ‘ফ্রাম’ তৈরির মূল উদ্যোক্তা৷ তাঁর ইচ্ছা ছিল এমন একটি জাহাজ তৈরির যেটা দিয়ে উত্তর মেরুর অনেক দূর যাওয়া যায় যে পর্যন্ত আগে কেউ যেতে পারেনি৷ নরওয়ের নাগরিক নানজেনের উদ্যোগে জাহাজটি তৈরি করেছিলেন কলিন আর্চার৷ নরওয়ের সরকারও এতে কিছু আর্থিক সহায়তা দিয়েছিল৷
ছবি: DW/ M. Z. Haque
উত্তর মেরু অভিযান (১৮৯৩-১৮৯৬)
১৮৯৩ সালের ২৪ জুন থেকে ১৮৯৬ সালের ৯ সেপ্টেম্বর – এই তিন বছর উত্তর মেরুতে অভিযান করে ফ্রাম৷ এ সময় জাহাজটি উত্তর মেরুর ৮৫°৫৭' পর্যন্ত পৌঁছাতে পেরেছিল, যেখানে আগে কোনো কাঠের জাহাজ যেতে পারেনি৷ তাই ফ্রাম যখন অভিযান শেষে ফিরে আসে তখন নরওয়ের রাজা অভিযাত্রীদের অভ্যর্থনা জানান৷ ছবিটি অভিযান শুরুর সময়কার৷ নানজেন ছাড়াও অভিযাত্রী ছিলেন ১২ জন৷
ছবি: DW/ M. Z. Haque
দক্ষিণ মেরু অভিযান (১৯১০-১৯১২)
নরওয়ের আরেক অভিযাত্রী রোয়াল্ড আমুন্ডসেন হলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি দক্ষিণ মেরুতে পৌঁছেছিলেন৷ তিনি তাঁর অভিযানেও ব্যবহার করেছিলেন ফ্রামকে৷ সেসময় ফ্রাম দক্ষিণ মেরুর ৭৮°৪১' পর্যন্ত যেতে পেরেছিল৷ এটাও কাঠের তৈরি জাহাজের জন্য একটা রেকর্ড৷
ছবি: picture-alliance/United Archives/TopFoto
এখন স্থান জাদুঘরে
উত্তর ও দক্ষিণ মেরুতে ইতিহাস সৃষ্টিকারী ফ্রাম এর এখনকার অবস্থান নরওয়ের রাজধানী অসলোর ফ্রাম মিউজিয়ামে৷
ছবি: DW/ M. Z. Haque
রান্নাঘর
এবার চলুন যাওয়া যাক সেই ঐতিহাসিক জাহাজের ভেতরে৷ এটি সেই জাহাজের রান্নাঘর৷
ঝড়, দুর্যোগ, প্রচণ্ড শীত, আইস – এসব নিয়ে ভাবতে ভাবতে জীবন যেন অতিষ্ট হয়ে না ওঠে সেজন্য বিনোদনেরও ব্যবস্থা ছিল ফ্রামে৷
ছবি: DW/ M. Z. Haque
8 ছবি1 | 8
সঁদ্রিন খুব কাছে থেকে এই কৃত্রিম প্রবাল প্রাচীর পর্যবেক্ষণ করেন৷ ইস্পাতের খাঁজে নানা কাঠামো বিভিন্ন আকারের মাছেদের আশ্রয় দেয়৷ এই মুহূর্তে সেটি দেখতে তেমন চমকপ্রদ না লাগলেও প্রাথমিক মূল্যায়ন অনুযায়ী এলাকায় আবার প্রাণের স্পন্দন ফিরে আসছে৷ উদ্ভিদ ও ক্ষুদ্র প্রাণী ইস্পাতের কাঠামোয় বাসা বাঁধছে৷ তাদের পেছন পেছন আসছে মাছও৷
এই প্রকল্পের সাফল্য বা ব্যর্থতা অনেক বিষয়ের উপর নির্ভর করছে – বিশেষ করে সমুদ্রের স্রোত, গভীরতা এবং কাঠামোর উপর৷ সঁদ্রিন সব খুঁটিনাটি পরিবর্তন সযত্নে নথিভুক্ত করছেন৷
ভূমধ্যসাগরের অন্য অংশেও স্থানীয় জীবজগতের সুরক্ষা ও পুনর্গঠন সংক্রান্ত গবেষণা চালানো হয়েছে৷ যেমন পর্কারল দ্বীপের কাছে প্রায় ৭০ বছর আগে একটি জাহাজ ডুবে গিয়েছিল৷ ৫০ মিটার গভীরে দু'টি দ্বীপের মাঝে একটি চ্যানেলে সেটি পড়ে রয়েছে৷ সেখানে স্রোতের টানের ফলেও ধ্বংসাবশেষকে ঘিরে রঙিন জীবজগত সৃষ্টি হয়েছে৷
মৃত এই জাহাজের সর্বত্র জীবনের স্পন্দন৷ দুই ধারে যেন বর্ধিষ্ণু ‘আন্ডারওয়াটার গার্ডেন' শোভা পাচ্ছে৷ বিশাল আকারের ‘সি ফ্যান' চারিদিকে বেড়ে উঠছে৷ স্রোতের টানে খাদ্য ভেসে এলে তারা তাদের ফ্যানের মাধ্যমে সেগুলি ফিল্টার করে নেয়৷ জাহাজের ডেকের উপর এমন জীবের ঝাঁক দেখা যায়৷ ডেকের অনেক অংশ দেখতে কঙ্কালের মতো হয়ে উঠেছে৷
জাহাজডুবির ট্র্যাজেডি হয়ে উঠছে নতুন এক আবাসনের কাহিনি৷ মার্সেই শহরের কাছে কৃত্রিম রিফ বা প্রাচীর যদি সে রকম কিছু একটা হয়ে উঠতে পারে, সেটা হবে এক বিশাল সাফল্যের কাহিনি৷ আগামী দশকগুলিতে তার গুরুত্ব বোঝা যাবে৷
জাহাজ যখন কফিন!
অষ্টম শতকের শেষ থেকে শুরু করে একাদশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত ইউরোপ ও এশিয়ায় রাজত্ব করেছিল ভাইকিংরা৷ সে সময়কার তিনটি জাহাজের গল্প নিয়ে এই ছবিঘর৷
ছবি: DW/ M. Z. Haque
ওসেব্যার্গ শিপ
৮৫০ সালের দিকে এই জাহাজে করে দুজন নারীকে দাফন করা হয়েছিল৷ যতদূর জানা যায় এর মধ্যে একজন ছিলেন রানি, অন্যজন তাঁর সেবিকা৷ তাদের ‘মৃত্যু-পরবর্তী জীবন’-এ সুখ নিশ্চিত করতে সঙ্গে দিয়ে দেয়া হয়েছিল খাবার থেকে শুরু করে জামা-কাপড়, অলংকার ও নিত্য-ব্যবহার্য জিনিস৷ ১৯০৪-০৫ সালে জাহাজটি উদ্ধার করা হয়৷
ছবি: DW/M. Z. Haque
গোকস্টাট শিপ
১৮৮০ সালে খোঁড়াখুঁড়ি করে বের করা এই জাহাজে ৫০ থেকে ৭০ বছর বয়সি একটি পুরুষের কঙ্কাল পাওয়া গেছে৷ ধারণা করা হয় ৯০০ সালের দিকে এই জাহাজ-কাম-কফিনটি ‘সমাধি টিলা’য় সমাহিত করা হয়েছিল৷
ছবি: DW/ M. Z. Haque
টুনে শিপ
১৮৬৭ সালে খুঁজে পাওয়া এই জাহাজটি গোকস্টাটের মতোই ৯০০ সালের দিকেই সমাহিত করা হয়েছিল৷ গোকস্টাটের মতোই তাতেও একজন উঁচু ব়্যাংকের পুরুষের কঙ্কাল পাওয়া গিয়েছিল৷
ছবি: DW/ M. Z. Haque
‘ভাইকিং শিপ মিউজিয়াম’
এতোক্ষণ যে তিনটি জাহাজের কথা বলা হলো সেগুলো সব ভাইকিং যুগের এবং এগুলো এখন সংরক্ষিত আছে ছবির এই ভবনটিতে, যার নাম ভাইকিং শিপ মিউজিয়াম৷ অবস্থান নরওয়ের রাজধানী অসলোতে৷ ওক কাঠের তৈরি এই জাহাজগুলো শুরুতে ব্যবসা-বাণিজ্যের কাজে ব্যবহৃত হতো৷
ছবি: DW/ M. Z. Haque
খাবারের ব্যবস্থা
আগেই বলা হয়েছে ‘মৃত্যু পরবর্তী জীবন’-এ মৃত ব্যক্তিদের সুখ নিশ্চিত করতে সম্ভব সব ধরনের চেষ্টাই করা হয়েছিল৷ উপরের ছবিটি তারই একটি প্রমাণ৷
ছবি: DW/ M. Z. Haque
স্বর্ণালঙ্কার
এসব অলংকার আর ঘড়িরও সন্ধান পাওয়া গেছে জাহাজগুলোতে৷ যদিও সেই যুগেও ডাকাতদের কবলে পড়ে অনেক কিছু হারিয়ে গেছে৷ ছবিতে অলংকার ছাড়াও দেখা যাচ্ছে নিত্য প্রয়োজনীয় একটি উপকরণ৷
ছবি: DW/ M. Z. Haque
মৃতের সৌন্দর্য চর্চা
দুই মৃত নারীর জন্য ওসেব্যার্গ শিপে দিয়ে দেয়া হয়েছিল চিরুনি’ও৷
ছবি: DW/ M. Z. Haque
স্লেজগাড়ি
ওসেব্যার্গ শিপের খননকাজের সময় চারটি ঘোড়ায় টানা স্লেজগাড়ি পাওয়া যায়৷ উপরের ছবিতে তারই একটি দেখা যাচ্ছে৷ পাওয়া গেছে ঘোড়ার কঙ্কালও৷
ছবি: DW/ M. Z. Haque
ঘোড়ার গাড়ি
চার চাকার এই ‘উডেন-কার্ট’-টিও পাওয়া গেছে ওসেব্যার্গ শিপের সঙ্গে৷