বাংলাদেশের এলিট ফোর্স র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন র্যাব ‘ডেথ স্কোয়াড’ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, এইচআরডাব্লিউ৷ র্যাব ভেঙে দেয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে একটি চিঠি দিয়েছে সংগঠনটি৷
বিজ্ঞাপন
ভেঙে দেয়ার আগ পর্যন্ত সামরিক বাহিনীর সব সদস্যকে সরিয়ে নিয়ে র্যাবকে পুরোপুরি বেসামরিক বাহিনীতে পরিণত করারও দাবি জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এই মানবাধিকার সংগঠনটি৷
এইচআরডাব্লিউ'র এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক ব্র্যাড অ্যাডামস প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো চিঠিতে বলেছেন, ‘‘স্বাধীন আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর হিসাব অনুযায়ী, গত ১০ বছরে প্রায় ৮০০ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় র্যাব দায়ী৷'' সোমবার সংগঠনটির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে আধা-সামরিক বাহিনীটি ভেঙে দেয়ার দাবি জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লেখার বিষয়টি জানানো হয়৷
র্যাব – বিতর্কিত এক বিশেষ বাহিনী
শুরুটা হয়েছিল ২০০৪ সালে৷ সেসময় বাঘা বাঘা জঙ্গিদের কুপোকাত করে ব্যাপক প্রশংসা কুড়ায় ব়্যাব৷ কিন্তু অসংখ্য ক্রসফায়ার, অপহরণ, হত্যার দায়ে এখন সমালোচিত এই ‘এলিট ফোর্স’৷ র্যাব নিয়ে আমাদের ছবিঘর৷
ছবি: Getty Images/AFP
‘এলিট ফোর্স’
বাংলাদেশে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন বা র্যাব নামক ‘এলিট ফোর্স’-এর যাত্রা শুরু হয় ২০০৪ সালে৷ এই বাহিনীর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ‘‘পুলিশ বাহিনীর কার্যক্রমকে আরো গতিশীল ও কার্যকর করার লক্ষ্যে সরকার একটি এলিট ফোর্স গঠনের পরিকল্পনা করে৷’’ তবে এই বাহিনী এখন তুলে দেয়ার দাবি জানিয়েছে বিভিন্ন মহল৷
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
সমন্বিত বাহিনী
বাংলাদেশ পুলিশ, সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে র্যাব গঠন করা হয়৷ এই বাহিনীর উল্লেখযোগ্য কর্মকাণ্ডের মধ্যে রয়েছে সন্ত্রাস প্রতিরোধ, মাদক চোরাচালান রোধ, দ্রুত অভিযান পরিচালনা এবং জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন কার্যক্রমে নিরাপত্তা প্রদান৷
ছবি: Getty Images/AFP
জঙ্গি তৎপরতা দমন
শুরুর দিকের ব়্যাবের কার্যক্রম অবশ্য বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছিল৷ বিশেষ করে ২০০৫ এবং ২০০৬ সালে বাংলাদেশে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠা উগ্র ইসলামি জঙ্গি তৎপরতা দমনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে র্যাব৷
ছবি: AP
জেএমবির শীর্ষ নেতাদের গ্রেপ্তার
বাংলাদেশের ৬৩ জেলায় ২০০৫ সালে একসঙ্গে বোমা ফাটিয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করা জেএমবির শীর্ষ নেতাদের আটক ব়্যাবের উল্লেখযোগ্য সাফল্য৷ ২০০৬ সালের ২ মার্চ শায়খ আব্দুর রহমান (ছবিতে) এবং ৬ মার্চ সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাইকে গ্রেপ্তারে সক্ষম হয় ব়্যাব৷ একাজে অবশ্য পুলিশ বাহিনীও তাদের সহায়তা করেছে৷
ছবি: DW
ভুক্তভোগী লিমন
২০১১ সালে লিমন হোসেন নামক এক ১৬ বছর বয়সি কিশোরের পায়ে গুলি করে এক ব়্যাব সদস্য৷ গুলিতে গুরুতর আহত লিমনের বাম পা উরুর নীচ থেকে কেটে ফেলতে হয়৷ এই ঘটনায় ব়্যাবের বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা এবং প্রতিবাদের ঝড় ওঠে৷ তবে এখনো সুবিচার পায়নি লিমন৷ উল্টো বেশ কিছুদিন কারাভোগ করেছেন তিনি৷
ছবি: DW
‘মানবাধিকার লঙ্ঘন’
জঙ্গিবাদ দমনে সাফল্য দেখালেও ক্রসফায়ারের নামে অসংখ্য ‘বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের’ কারণে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব়্যাবের বিরুদ্ধে সমালোচনা ক্রমশ বাড়তে থাকে৷ হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ব়্যাবের বিলুপ্তি দাবি করে জানিয়েছে, প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এই বাহিনী ‘সিসটেমেটিক’ উপায়ে মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে৷
ছবি: DW
‘ক্রসফায়ার’
বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পর্যালোচনা প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৩ সালে ব়্যাবের ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছেন ২৪ জন৷ অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের দাবি অনুযায়ী, ২০০৪ থেকে ২০১১ সালের আগস্ট পর্যন্ত সময়কালের মধ্যে কমপক্ষে সাতশো হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ব়্যাব জড়িত ছিল৷
ছবি: picture-alliance/dpa
আলোচিত সাত খুন
২০১৪ সালের মে মাসে ব়্যাবের বিরুদ্ধে ৬ কোটি টাকা ঘুসের বিনিময়ে সাত ব্যক্তিকে অপহরণ এবং খুনের অভিযোগ ওঠে৷ নারায়ণগঞ্জে আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তিন ব়্যাব কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তারও করেছে পুলিশ৷ এই ঘটনার পর ব়্যাবের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আবারো বিতর্ক শুরু হয়েছে৷
ছবি: DW
প্রতিষ্ঠাতাই করছেন বিলুপ্তির দাবি
নারায়ণগঞ্জের আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া, ব়্যাবের বিলুপ্তি দাবি করেছেন৷ অথচ তিনি প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন ২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এই ‘এলিট ফোর্স’৷
ছবি: DW/M. Mamun
বিলুপ্তির দাবি নাকচ
বাংলাদেশে এবং আন্তর্জাতিক স্তর থেকে ব়্যাবকে বিলুপ্তির দাবি উঠলেও বর্তমান সরকার সেধরনের কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না৷ বরং তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু ব়্যাব বিলুপ্তির দাবি নাকচ করে দিয়েছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘র্যাবের কোনো সদস্য আইন ভঙ্গ করলে তাদের চিহ্নিত করে বিচারিক ও আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয়৷’’
ছবি: Getty Images/AFP
10 ছবি1 | 10
তবে এইচআরডাব্লিউ'র রিপোর্ট প্রত্যাখ্যান করে র্যাবের মুখপাত্র ‘লিগ্যাল এন্ড মিডিয়া উইং'এর পরিচালক উইং কমান্ডার এটিএম হাবিবুর রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘র্যাব গঠনের পর থেকেই এইচআরডাব্লিউ এই বাহিনীর পেছনে লেগে আছে৷ তারা কোন জায়গা থেকে তথ্য পায়, সেই তথ্যের সত্যতাই বা কি? আর এই ধরনের রিপোর্ট এবারই প্রথম নয়, কিছুদিন পরপরই তারা র্যাবের বিরুদ্ধে একটা করে রিপোর্ট প্রকাশ করে৷ ষড়যন্ত্রমূলকভাবেই এটা করা হচ্ছে৷''
এটিএম হাবিবুর রহমান বলেন, ‘‘বিশ্বের বহু জায়গায় ভয়াবহ মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা ঘটছে৷ কিন্তু এইচআরডাব্লিউর সেদিকে কোনো নজর নেই৷ বাংলাদেশে আইন-শৃঙ্খলার দায়িত্বে নিয়োজিত গুরুত্বপূর্ণ এই বাহিনীকে ধ্বংস করার জন্য তাদের চক্রান্ত চলছে৷ প্রধানমন্ত্রীর কাছে এই চিঠি তাদের চক্রান্তেরই অংশ৷''
তিনি বলেন, ‘‘বাংলাদেশে জনগণের চাহিদা অনুযায়ী সরকার র্যাব গঠন করেছে, সরকারের সিদ্ধান্তেই এই বাহিনী পরিচালিত হয়৷ জনগণের নিরাপত্তার জন্য বাহিনীটি কাজ করে৷ বিদেশি কোনো সংস্থার সিদ্ধান্তে র্যাব বিলুপ্ত হবে না৷''
এইচআরডাব্লিউর চিঠিতে বলা হয়েছে, র্যাব ‘সিরিয়াল ও সিস্টেম্যাটিক হত্যাকাণ্ডে জড়িত৷' এইচআরডাব্লিউসহ মানবাধিকার সংগঠনগুলো গত এক দশক ধরে র্যাবের বিরুদ্ধে বিপুল সংখ্যক বিচার বহির্ভূত হত্যা, আইন বহির্ভূতভাবে আটক ও আইনি কাঠামোর সুযোগ নিয়ে ‘পদ্ধতিগত' নির্যাতনের অভিযোগ জানিয়ে আসছে৷
চিঠিতে আরো বলা হয়, ২০০৪ সালে বিএনপি সরকারের আমলে র্যাব প্রতিষ্ঠিত হয়৷ ঐ সরকারের পর ২০০৭ সালে ক্ষমতায় আসে সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার৷ তাদের বিদায়ের পর ২০০৯ সাল থেকে ক্ষমতায় আছে আওয়ামী লীগ সরকার৷ এইচআরডাব্লিউ তাদের প্রতিবেদনে দাবি করে, আগের সরকারগুলোর মতো এখনকার ক্ষমতাসীনরা প্রতিষ্ঠানটিকে দায়মুক্তি দেয়ায় র্যাব ‘গুরুতর' ও ‘পদ্ধতিগত' অপরাধের দিকে ঝুঁকে পড়েছে৷ র্যাবের বিরুদ্ধে নির্বিচারে গ্রেফতার ও নিষ্ঠুর নির্যাতনসহ গত ১০ বছরে প্রায় ৮০০ লোককে হত্যার অভিযোগ রয়েছে৷
চিঠির বিষয়ে এইচআরডাব্লিউর এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘‘গত এপ্রিলে নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের ঘটনায় র্যাব সদস্যদের ভাড়াটে খুনি হিসাবে কাজ করার তথ্য-প্রমাণ পাওয়ার পর বাংলাদেশে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়৷ র্যাব সদস্যরা ক্ষমতাসীন দলের এক নেতার হয়ে ওই কাজ করে বলে অভিযোগ রয়েছে৷ র্যাব যে আসলে একটি ‘ডেথ স্কোয়াড' হিসাবে কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে, এটি তার আরেকটি উদাহরণ৷ বাংলাদেশ সরকার র্যাব সংস্কারের মধ্য দিয়ে এ বাহিনীর জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার অঙ্গীকার করে এলেও তা পূরণে ‘পুরোপুরি ব্যর্থ' হয়েছে৷''
বিবৃতিতে আরো বলা হয়, ‘‘র্যাবকে এখন আর সংস্কার করে চালানো সম্ভব বলে আমরা বিশ্বাস করি না৷ আইনের ঊর্ধ্বে থেকে কোনো ধরনের জবাবদিহিতার তোয়াক্কা না করে র্যাব পরিচালনার একটি সংস্কৃতি তৈরি হয়ে গেছে৷ এই অবস্থায় এ বাহিনীকে শিগগিরই বিলুপ্ত করতে হবে, যাতে বাংলাদেশে হত্যাকাণ্ড বন্ধ হয়৷''