ডয়চে বানের সংস্কারে সময় ও বাজেট বাড়ছে, বাড়ছে যাত্রী দুর্ভোগ
১৮ জুলাই ২০২৫
একসময় ‘জার্মান পাংচুয়ালিটি' বলে যে শব্দটি বিশ্বব্যাপী বিখ্যাত ছিল,জার্মানির রেলসেবা তার পুরোপুরি বিপরীত উদাহরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আজকের জার্মানিতে একটি ট্রেন মাত্র ছয় মিনিট দেরি করলেই সেটাকে "সময়নিষ্ঠ"বলে গণ্য করা হয়। এই পরিস্থিতি এতটাই হতাশাজনক যে, যাত্রীরা এখন ট্রেন যাত্রায় 'ধৈর্য্য,সময় এবং ইস্পাতের মতো মজবুত স্নায়ু' নিয়ে বের হন।
ডয়চে বান (ডিবি) এখন একটি বিশাল সংস্কার কর্মসূচি হাতে নিয়েছে যার জন্য সময় ও খরচ দুটোই বিশাল৷ তাই এ নিয়ে সমালোচনা বাড়ছে।
প্রতিবেশী দেশ সুইজারল্যান্ডের সঙ্গে তুলনা
২০২২ সাল থেকে জার্মানিতে মাত্র ৬২ ভাগ ট্রেন নির্ধারিত সময়ে চলেছে। অথচ পার্শ্ববর্তী সুইজারল্যান্ডে এই হার প্রায় ৯৯ ভাগ। জার্মানিতে ট্রেনের দীর্ঘ বিলম্ব এখন নিয়মিত ঘটনা,আর যাত্রা সম্পূর্ণ বাতিল বা মাঝপথে শেষ হয়ে যাওয়ার ঘটনাও কম নয়।
আবহাওয়া একটু বেশি গরম বা ঠাণ্ডা হলেই সমস্যা আরও বেড়ে যায়। ধর্মঘট হলে তো কথাই নেই। ২০২৪ সালে ডিবি যাত্রীদের ক্ষতিপূরণ হিসেবে প্রায় ২০ কোটি ইউরো দিয়েছে ডয়চে বান,যা আগের বছরের তুলনায় ৭ কোটি ইউরো বেশি।
৩০ বছরের সবচেয়ে বড় সংকট
ডিবি-র প্রধান নির্বাহী রিচার্ড লুৎস গত মে মাসে স্বীকার করেছেন, ‘‘ডয়চে বান ৩০ বছরের সবচেয়ে বড় সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।'' ২০১৭ সালে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে তিনি কোম্পানিকে পথে আনতে চেষ্টা করছেন, কিন্তু সফল হতে পারেননি। তিনি বলেছেন,‘‘আমরা যা করতে চেয়েছিলাম এবং আমাদের গ্রাহকরা আমাদের কাছে যা আশা করেন,তা থেকে আমরা অনেক দূরে।'' সমস্যার মূল কারণ হলো পুরাতন অবকাঠামো। ডিবির নেটওয়ার্ক প্রায় ৩৩,৫০০ কিলোমিটার ট্র্যাক জুড়ে বিস্তৃত, যার অনেকটাই ঊনবিংশ শতাব্দীতে তৈরি।
বিশাল সংস্কার প্রকল্প
২০২৪ সালে চালু হওয়া সাধারণ সংস্কার কর্মসূচিতে ৪১টি লাইনের ৪,২০০ কিলোমিটার এলাকা অন্তর্ভুক্ত। এটি ডিবির ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সংস্কার প্রকল্প।
প্রথম কাজ শুরু হয়েছিল ফ্রাঙ্কফুর্ট ও মানহাইমের মধ্যে ৭০ কিলোমিটার দীর্ঘ ‘রিডবান' লাইনে। ছয় মাসে রেল,ব্যালাস্ট,১৫২টি সুইচ এবং ১৪০ কিলোমিটার ওভারহেড লাইন সরিয়ে নতুন করে বসানো হয়েছে। ২০টি স্টেশন,সিগন্যালিং প্রযুক্তি এবং শব্দ বাধাও সংস্কার করা হয়েছে।
তবে ডিজিটাল প্রযুক্তি বসানো প্রত্যাশার চেয়ে অনেক জটিল প্রমাণিত হয়েছে। খরচ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৫০ কোটি ইউরো - যা প্রাথমিক অনুমানের দ্বিগুণ!
বার্লিন-হামবুর্গ লাইন: পরবর্তী চ্যালেঞ্জ
আগামী আগস্ট থেকে জার্মানির দুটি বৃহত্তম শহর বার্লিন ও হামবুর্গের মধ্যে ২৮০ কিলোমিটার লাইন নয় মাস বন্ধ থাকবে। এই লাইনে প্রতিদিন প্রায় ৩০ হাজার যাত্রী এবং ২৩০টি ট্রেন চলাচল করে।
দূরপাল্লার ট্রেনগুলোকে ১০০ কিলোমিটার ঘুরপথ ব্যবহার করতে হবে। আঞ্চলিক ট্রেনের বদলে ১৭০টি বাস চালু করা হবে, যা দিনে ৮৬,০০০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করবে।
খরচের সমালোচনা
কেন্দ্রীয় অডিট অফিস পরিবহণ মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে অবহেলার অভিযোগ এনেছে। তারা বলেছেন, "নির্মাণ কাজের বাজার মূল্য খুব কম সময়ের মধ্যে কয়েকগুণ বেড়ে গেছে।" দক্ষ কর্মী ও নির্মাণ সরঞ্জামের সংকটও রয়েছে।
ফলে ডিবি জানিয়েছে যে,সাধারণ সংস্কার কর্মসূচি আরও ছয় বছর বাড়িয়ে ২০৩৬ সাল পর্যন্ত চলবে। বার্লিন-হামবুর্গ লাইনের খরচ পরিকল্পনা পর্যায়েই বেড়ে ২২০ কোটি ইউরো হয়েছে।
কাঠামোগত সংস্কারের দাবি
কেন্দ্রীয় পরিবহণমন্ত্রী প্যাট্রিক স্নাইডার ২০২৯ সাল পর্যন্ত ১০ হাজার সাতশ কোটি ইউরো বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তবে ফেডারেল অডিট অফিস সতর্ক করেছে যে,শুধু অর্থ দিয়ে ডিবির ‘স্থায়ী সংকট' সমাধান হবে না।
অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন,রেল অবকাঠামো ও পরিবহণ পৃথক করে আরও বেসরকারি কোম্পানি ও প্রতিযোগিতার সুযোগ তৈরি করা উচিত। বেসরকারিকরণের নেতিবাচক দিকগুলিও বিতর্কের কারণ। তবে এই আলোচনা বছরের পর বছর ধরে চলছে,কোনো সমাধান হচ্ছে না।
ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে
কেন্দ্রীয় অডিট অফিস বলেছে,নিকট ভবিষ্যতে ডিবি ‘পরিবহণ ও জলবায়ু নীতির প্রত্যাশা পূরণ' করতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না। এর মানে হলো, জার্মানিতে ট্রেন যাত্রায় এখনও অনেক ধৈর্য্য আর সময় লাগবে।
এসএসজি/এপিবি