এ বছর ডয়চে ভেলের ‘ফ্রিডম অফ স্পিচ অ্যাওয়ার্ড' পেলেন মেক্সিকোর অনুসন্ধানী সাংবাদিক আনাবেল হার্নান্দেজ৷ তিনি সরকারের দুর্নীতি, যৌন নিপীড়ন ও মাদক মাফিয়াদের দৌরাত্ম্য নিয়ে লেখালেখি করেছেন৷
বিজ্ঞাপন
মেক্সিকোতে জন্ম নেয়া হার্নান্দেজ ১৯৯৩ সালে তাঁর সাংবাদিকতার ক্যারিয়ার শুরু করেন৷ তিনি মেক্সিকোর বেশ কয়েকজন সরকারি কর্মকর্তা ও মাদক মাফিয়াদের মধ্যকার যোগাযোগ নিয়ে লিখেছেন৷ সেজন্য তাঁকে মূল্যও দিতে হয়েছে৷ এখন তিনি ইউরোপে গা ঢাকা দিয়ে আছেন৷ তিনি ও তাঁর পরিবার অনেকবার মৃত্যুর হুমকি পেয়েছেন৷ তাই মেক্সিকো ছাড়তে হয়েছে তাঁকে৷
২০১২ সালে ‘গোল্ডেন পেন অফ ফ্রিডম’ পুরস্কার নেবার সময়ে দেয়া এক বক্তব্যে হার্নান্দেজ বলেছিলেন, ‘‘মেক্সিকোর ইতিহাসের এমন নাটকীয় সময়ে চুপ থাকা মানে পুরুষ, নারী ও শিশু; সুশীল সমাজের মানুষ ও মানবাধিকার কর্মী; সরকারি কর্মকর্তা ও সাংবাদিক- সবার মৃত্যু৷’’ আবার এই নিরবতা ভাঙতে গেলেও থাকে জীবন হারানোর ঝুঁকি, যোগ করেছিলেন তিনি৷
হেরোইনের আগ্রাসন রুখতে মরিয়া মেক্সিকো
মেক্সিকোর পাহাড়ি এলাকার গভীর জঙ্গল ছেয়ে গেছে গোলাপি রঙের পপি গাছে৷ অবৈধ পপির চাষ এতটাই বেড়েছে, এখন আর আগের মতো লাভও করতে পারছেন না৷ বাধ্য হয়ে পপি উৎপাদন বন্ধে ব্যাপক অভিযানে নেমেছে দেশটির সেনাবাহিনী৷
ছবি: Reuteers/C. Jasso
দুর্গম পাহাড়, পপির অভয়ারণ্য
মেক্সিকোর গ্রীষ্মমণ্ডলীয় সিয়েরা অঞ্চল যেন পপিচাষীদের অভয়ারণ্য৷ দুর্গম পাহাড়ী এলাকা আর ঘন অরণ্য, অবৈধ পপির চাষের জন্য স্বর্গরাজ্য৷ মানুষের চোখের আড়ালে খুব সহজেই এখানে চাষ করা যায় পপি৷
ছবি: Reuters/C. Jasso
অন্য শস্যের আড়াল
মাঝে মাঝে পপিক্ষেত লোকচক্ষুর আড়ালে রাখার জন্য অন্য নানারকম শস্য, যেমন ভুট্টার চাষ করা হয়৷ সরকারও পপি চাষীদের বৈধ শস্য চাষের জন্য নানা সহায়তা করে থাকে৷ কিন্তু পাহাড়ের পাথুরে ঢালে পাতলা মাটির আস্তরণে অন্য কোনো শস্যই তেমন ভালো হয় না৷
ছবি: Reuteers/C. Jasso
পপি চাষের কেন্দ্র
গুয়েরেরো রাজ্যের দরিদ্র পাহাড়ি জেলাগুলোতে অবৈধ পপির চাষ হয় সবচেয়ে বেশি৷ এর মধ্যে এগিয়ে আছে মার্কিন সীমান্ত থেকে ৮০০ মাইল দূরে অবস্থিত হুকিলা ইউকুচানি জেলা৷ দেশটিতে অপরাধের হারও সবচেয়ে বেশি গুয়েরেরো রাজ্যেই৷
ছবি: Reuteers/C. Jasso
পপি বীজে সয়লাব বাজার
চাষ, সরবরাহ, বাজারজাতকরণ, সবকিছুই আইনত দণ্ডণীয় হলেও অনেকটা প্রশাসনের নাকের ডগাতেই চলে পপি বীজের কেনাবেচা৷
ছবি: Reuters/C. Jasso
বাড়িতেও পপি গাছ
এখন আর অনেক ক্ষেত্রে তেমন রাখঢাকেরও প্রয়োজন দেখছেন না পপি চাষীরা৷ কেউ কেউ কষ্ট করে পাহাড়ের ঢালে লুকিয়ে চাষ না করে নিজের বাড়ির উঠানেই বুনছেন গাছ৷
ছবি: Reuteers/C. Jasso
সেনা অভিযান
পপি এবং এ থেকে উৎপাদিত আফিম ও হেরোইনের দৌরাত্ম কমাতে এবার জোরেসোরে মাঠে নেমেছে মেক্সিকোর সেনাবাহিনী৷ দুর্গম পাহাড়ি এলাকাতেও চলছে বিশেষ অভিযান৷
ছবি: Reuteers/C. Jasso
গাছ কেটে সাফ
পাহাড়ে ভাঁজে ভাঁজে তল্লাশি চালিয়ে লুকিয়ে রাখা পপিক্ষেত খুঁজে বের করছেন সেনারা৷ তারপর সেগুলে কেটে কেটে এক জায়গায় জড়ো করা হচ্ছে৷
ছবি: Reuters/C. Jasso
লক্ষ্য– চিরতরে নির্মূল
শুধু পপি গাছ কেটেই নিরস্ত হচ্ছেন না সৈনিকরা৷ পরবর্তীতে গাছের বীজ থেকে যাতে চাষীরা আবার বীজ উৎপাদন করতে না পারেন, সেজন্য জড়ো করা গেছে ধরিয়ে দেয়া হচ্ছে আগুন৷
ছবি: Reuteers/C. Jasso
অসহায় চাষীরাও
দুর্গম এ পাহাড়ি এলাকায় যারা থাকেন, তাঁদের জন্য নেই পর্যাপ্ত নাগরিক কোনো সুযোগ-সুবিধা৷ সবচেয়ে কাছের হাসপাতাল বা স্কুলও কয়েক ঘণ্টার পথ৷ ফলে, ভবিষ্যতের চিন্তায় উদ্বিগ্ন পপি চাষীদের অনেকেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হলেও ভাবছেন সীমানা পাড়ি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যাওয়ার কথা৷
ছবি: Reuteers/C. Jasso
9 ছবি1 | 9
২০০১ সালে হার্নান্দেজের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ অনুসন্ধানী কাজটি প্রকাশিত হয়৷ দেশটির তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ভিসেন্তে ফক্সের ওপর করা সেই প্রতিবেদনটি জাতীয় সাংবাদিকতা পুরস্কার জিতে নেয়৷ কিন্তু এরপর যে পত্রিকায় তিনি কাজ করতেন সেখানে তাঁর আর কোনো লেখা না ছাপানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়৷
২০০৩ সালে হার্নান্দেজ যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় মেক্সিকোর মেয়েদের দাসত্ব ও যৌন নিপীড়ন নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করেন এবং ইউনিসেফের সম্মাননা পান৷ এরপর পাঁচ বছর গবেষণা করে ২০১০ সালে ‘দ্য মেক্সিকান ড্রাগ লর্ডস অ্যান্ড দেয়ার গডফাদার্স’ শীর্ষক একটি বই প্রকাশ করেন, যার ইংরেজি অনুবাদ বের হয় ২০১৩ সালে৷ বইতে তিনি দেখিয়েছেন মাদক সম্রাটদের সঙ্গে দেশটির ব্যবসায়ী, সামরিক কর্মকর্তা ও রাজনীতিবিদরা কীভাবে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছেন৷ তাঁর এই বই বেস্টসেলার হয়েছিল৷
হার্নান্দেজ অসংখ্যবার মৃত্যুর হুমকি পেয়েছেন৷ তাঁর ঘরের সামনে পশুর মাথা কাটা দেহ ফেলে রাখা হয়৷ এ ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘‘পরিতাপের বিষয়, এসব হুমকি আসে দেশের প্রশাসনের কাছ থেকে, দেশের সর্বোচ্চ পুলিশ কর্মকর্তার কাছ থেকে৷’’
২০১৬ সালে ইগুয়ালা শহরে ৪৩ শিক্ষার্থীর গায়েব হওয়া নিয়ে অনুসন্ধান করে আরেকটি বই (২০১৮ সালে ইংরেজিতে অনূদিত) লেখেন তিনি৷ তাঁর বইটি গণহত্যার ফরেনসিক অনুসন্ধান প্রকাশ করে৷
এই বই প্রকাশিত হবার পর তাঁর জীবন আরো ঝুঁকিতে পড়ে৷ তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়াতে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার একটি প্রোগ্রামে যুক্ত হন৷ গবেষণা চলার সময়ই তাঁর এক সোর্সকে হত্যা করা হয়৷ ২০১৮ সালের অক্টোবরে তিনি যুক্তরাষ্ট্র ত্যাগ করে ইউরোপে পাড়ি দেন৷
নিজের জীবন ঝুঁকিতে রেখে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার কাজ চালিয়ে যাওয়ায় ডয়চে ভেলে আনাবেল হার্নান্দেজকে ‘ফ্রিডম অফ স্পিচ অ্যাওয়ার্ড ২০১৯’ প্রদান করে৷
মেলানি হল/জেডএ
গতবছরের অক্টোবরের ছবিঘরটি দেখুন...
অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের ঝুঁকিপূর্ণ জীবন
চলতি বছর এখন পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ৭৩ জন সাংবাদিক ও গণমাধ্যমকর্মী মারা গেছেন৷ অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা দিন দিন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে৷
ছবি: Getty Images/C. McGrath
ভিক্টোরিয়া মারিনোভা, বুলগেরিয়া
৩০ বছর বয়সি এই টিভি উপস্থাপক সম্প্রতি অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের নিয়ে টেলিভিশনে একটি অনুষ্ঠান করেছিলেন৷ ইউরোপীয় ইউনিয়নের তহবিল নিয়ে দুর্নীতির তদন্ত করছিলেন ঐ সাংবাদিকরা৷ সম্প্রতি মারিনোভাকে হত্যা করা হয়েছে৷
ছবি: BGNES
জামাল খাশগজি, সৌদি আরব
আল-আরব নিউজ চ্যানেলের সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ওয়াশিংটন পোস্টের কলামনিস্ট খাশগজি তুরস্কের সৌদি দূতাবাসে যাওয়ার পর থেকে নিখোঁজ৷ নিখোঁজ হওয়ার আগে তিনি সৌদি কর্তৃপক্ষ তাঁকে মেরে ফেলতে পারে বলে আশংকা প্রকাশ করেছিলেন৷
ছবি: Reuters/Middle East Monitor
ইয়ান কুচিয়াক, স্লোভাকিয়া
সরকারের সঙ্গে ইটালির মাফিয়াদের সম্পর্ক নিয়ে তদন্ত করছিলেন স্লোভাকিয়ার এই অনুসন্ধানী সাংবাদিক৷ গত ফেব্রুয়ারিতে তাঁকে তাঁর বান্ধবীসহ হত্যা করা হয়৷ সাবেক এক পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তাঁকে হত্যা করার অভিযোগ উঠেছে৷ কুচিয়াক হত্যার পর বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়লে পদত্যাগে বাধ্য হন দেশটির প্রধানমন্ত্রী৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/D. Voijnovic
মারিয়ো গোমেজ, মেক্সিকো
সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতি নিয়ে কাজ শুরুর পর থেকেই হত্যার হুমকি পাচ্ছিলেন গোমেজ৷ সেপ্টেম্বরে নিজের ঘর থেকে বের হওয়ার পর সশস্ত্রদের গুলিতে প্রাণ হারান ৩৫ বছর বয়সি এই সাংবাদিক৷ চলতি বছরে এখন পর্যন্ত মেক্সিকোয় ১০ জন সাংবাদিককে হত্যা করা হয়েছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/Y. Cortez
সামিম ফারামারাজ ও রমিজ আহমাদি, আফগানিস্তান
সেপ্টেম্বরে কাবুলে একটি বিস্ফোরণের পর সেখান থেকে লাইভ করছিলেন সামিম ফারামারাজ৷ ক্যামেরায় ছিলেন রমিজ আহমাদি৷ লাইভ শেষ করছিলেন এমন সময় কয়েক মিটার দূরে আরেকটি বিস্ফোরণ হলে প্রাণ হারান এই দুই গণমাধ্যমকর্মী৷
ছবি: Getty Images/AFP/S. Marai
মার্লোন ডি কারভালু আরায়ুজু, ব্রাজিল
দেশটির বাহিয়া আঞ্চলিক প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরের দুর্নীতি প্রকাশ করেছিলেন এই সাংবাদিক৷ গত আগস্টের এক ভোরে তাঁর বাড়িতে সশস্ত্র কয়েকজন ঢুকে তাঁকে গুলি করে হত্যা করেন৷
ছবি: Getty Images/AFP/E. Sa
সুজাত বুখারি, কাশ্মীর
জুনে শ্রীনগরে তাঁর সংবাদপত্র অফিসের বাইরে গুলি করে হত্যা করা হয়৷ কাশ্মীর নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে একটি শান্তিপূর্ণ সমাধান চাইতেন ডয়চে ভেলের এই কন্ট্রিবিউটর৷
ছবি: twitter.com/bukharishujaat
দ্য ক্যাপিটাল, যুক্তরাষ্ট্র
গত জুনে এই সংবাদপত্র অফিসে গুলি করে সম্পাদক ওয়েন্ডি উইন্টার্স, তাঁর সহকারী রবার্ট হিয়াসেন, লেখক জেরাল্ড ফিশম্যান, সাংবাদিক জন ম্যাকনামারা ও বিক্রয় সহকারী রেবেকা স্মিথকে হত্যা করা হয়৷ হত্যার দায়ে যাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে সেই ব্যক্তি ঐ পত্রিকার বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করেছিলেন৷