বিএনপির নেতৃত্বে বিরোধী ১৮ দল ঢাকাকে সারাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পদত্যাগে বাধ্য করতে চায়৷ এজন্য হরতাল, অবরোধের মতো কর্মসূচি তাঁরা অব্যাহত রাখবেন বলে জানা গেছে৷
বিজ্ঞাপন
এদিকে, শীর্ষ নেতারা এখন গ্রেফতার এড়িয়ে আত্মগোপনে থেকে সারাদেশে আন্দোলনের দিক নির্দেশনা দিচ্ছেন৷ চূড়ান্ত পর্যায়ে তাঁরা প্রকাশ্যেই আন্দোলন পরিচালনা করবেন৷ বিএনপির কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে৷
সোমবার রাতে অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণার পর মাঠে নেই বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর৷ আর ঢাকার আন্দোলন পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা সাদেক হোসেন খোকা এবং মির্জা আব্বাসসহ ৮ নেতাকেও অবরোধে মাঠে দেখা যাচ্ছে না৷ মাঠে নেই জামায়াতসহ বাকি ১৭টি দলের নেতারাও৷ বলতে গেলে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী একাই বিএনপি অফিস আগলে রাখছেন, দিচ্ছেন বিএনপি তথা ১৮ দলের পক্ষে বক্তৃতা, বিবৃতি৷
আগে গ্রেফতার হওয়া মওদুদ আহমেদসহ বিএনপির ৫ শীর্ষ নেতা এখনো কারাগারে৷ সোমবার রাতে গ্রেফতার হন বিএনপির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য হান্নান শাহ৷ তাঁকে হরতালে গাড়ি ভাঙচুরের একটি পুরনো মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে রিমাণ্ডে নেয়া হয়েছে৷ ফলে শীর্ষ নেতারা গ্রেফতার আতঙ্কে আছেন৷
বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা শামসুজ্জামান দুদু ডয়চে ভেলেকে বলেন, সরকার যেভাবে বিরোধী নেতাদের গণহারে গ্রেফতার করছে তাতে প্রকাশ্যে আন্দোলন করে গ্রেফতার হওয়ার চেয়ে কৌশলে আন্দোলন পরিচালনা করা ছাড়া উপায় নেই৷ তাই অনেক সিনিয়র নেতা এখন প্রকাশ্যে নেই৷ তবে তাঁরা ঢাকাসহ সারাদেশে আন্দোলনের দিক নির্দেশনা দিচ্ছেন বলে জানান তিনি৷
বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংকট থামছে না
আগামী বছরের সূচনায় জাতীয় নির্বাচন, কিন্তু দুই মুখ্য রাজনৈতিক জোটের টানাপোড়েন অব্যাহত৷ অথচ দেশে-বিদেশে অনেকেই চান সংকট নিরসনে দুই বৈরী জোটের মধ্যে আলোচনা৷ কিন্তু সেটা কি আদৌ সম্ভব হবে?
ছবি: AP
দু’দলের দ্বন্দ্ব
বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন নির্দিষ্ট হয়েছে ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে৷ তবে মুখ্য বিরোধী দল বিএনপি এখনো নির্বাচনে অংশ নিতে রাজি নয়৷ তারা চায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন, শাসক আওয়ামী লীগের কাছে যা সংবিধান লঙ্ঘনের সমান৷
ছবি: Getty Images/AFP/FARJANA K. GODHULY
জাতিসংঘ চায় সংলাপ
জাতিসংঘ ইতিমধ্যেই দুই বিবাদী জোটের মধ্যে সংলাপের উদ্যোগ নিয়েছে৷ মহাসচিব বান কি-মুন গত ২৩ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধী নেত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে টেলিফোনে কথাবার্তা বলেছেন৷ জাতিসংঘের মহাসচিব উভয় নেতার প্রতি চলতি রাজনৈতিক সংকটের শান্তিপূর্ণ অবসানের জন্য আলাপ-আলোচনায় বসার আহ্বান জানিয়েছেন৷
ছবি: Reuters
হাসিনা চান সংসদে আলোচনা
জাতিসংঘ বাংলাদেশি রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে মহাসচিবের ফোনালাপের কোনো খুঁটিনাটি প্রকাশ করেনি৷ তবে বাংলাদেশের একাধিক দৈনিকে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী হাসিনা ‘‘জাতিসংঘের প্রধানকে জানিয়েছেন যে, তিনি সংবিধান অনুযায়ী সরকারের তত্ত্বাবধানে নির্বাচন অনুষ্ঠান করার পরিকল্পনা করছেন৷’’ বিরোধীপক্ষ যদি গোটা প্রসঙ্গটি সংসদে আলোচনা করার কোনো প্রস্তাব দেয়, তবে তিনি তাকে স্বাগত জানাবেন, এমন আভাসও দিয়েছেন হাসিনা৷
ছবি: dapd
সরকারের তত্ত্বাবধানে নির্বাচনে বিএনপির ‘না’
বান কি-মুনের সঙ্গে ফোনালাপে বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়াও সংকট সমাধানে সংলাপের সপক্ষে মতপ্রকাশ করেছেন, কিন্তু এ-ও স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, ‘‘বিরোধীপক্ষ আওয়ামী লীগ সরকারের তত্ত্বাবধানে আয়োজিত সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না৷’’
ছবি: Reuters
তত্ত্বাবধায়ক সরকার কি ও কেন?
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মূল কাজ হলো মুক্ত ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করা৷ ১৯৯১ সালে এই পদ্ধতি চালু করা হয় কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার ২০০৯ সালে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে সেই পদ্ধতি বাতিল করে৷ বিএনপির নেতৃত্বাধীন বিরোধী পক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার দাবি তুলেছে৷
ছবি: AP
জার্মানি সংলাপ সমর্থন করে
সংলাপকে বাংলাদেশের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক জোটের মধ্যে অচলাবস্থা নিরসনের একমাত্র পন্থা বলে মনে করে জার্মানি৷ ‘ঢাকা কুরিয়ার’ নামক সাপ্তাহিক ম্যাগাজিনের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে ঢাকায় জার্মান রাষ্ট্রদূত ড. আলব্রেশট কনৎসে বলেছেন, ‘‘দু’টি মুখ্য রাজনৈতিক দলের মধ্যে সংলাপ হলো বর্তমান রাজনৈতিক অচলাবস্থা সমাধানের একমাত্র পথ৷’’
ছবি: DW/R. Manzoor
ইউনূস তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ডাক দিলেন
বাংলাদেশের একমাত্র নোবেল পুরস্কার বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূস একটি ‘‘নির্দলীয় নিরপেক্ষ (নির্বাচনকালীন) সরকার’’ বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রতি তাঁর প্রকাশ্য সমর্থন ব্যক্ত করেছেন৷ গত ২২ আগস্ট ইউনূস একটি সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘‘নির্বাচন অতি অবশ্য হওয়া উচিত এবং তা একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে হওয়া উচিত৷’’
ছবি: Getty Images
আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি)
হাসিনা সরকারের সৃষ্ট আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল বা আইসিটি-র উদ্দেশ্য মুক্তিযুদ্ধের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার৷ কিন্তু তা শাসকদল এবং বিরোধীপক্ষের মধ্যে একটি বিতর্কিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ আইসিটি এখন পর্যন্ত ছ’জন অভিযুক্তকে শাস্তি দিয়েছে৷ বিরোধীপক্ষ এই বিচার প্রক্রিয়াকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত আখ্যা দিয়েছে৷ তাদের মতে এই প্রক্রিয়ার বাস্তবিক উদ্দেশ্য ন্যায়বিচার নয়, পুরাতন শত্রুতার প্রতিশোধ৷
ছবি: AP
আন্তর্জাতিক সমালোচনা
হিউম্যান রাইটস ওয়াচও আইসিটি-র সমালোচনা করেছে৷ এইচআরডাব্লিউ বিবৃতিতে বলেছে, জামায়াতে ইসলামীর সাবেক প্রধান গোলাম আযমের বিচার প্রক্রিয়া ‘‘গভীরভাবে ত্রুটিপূর্ণ’’ ছিল৷ প্রতিক্রিয়া হিসেব সরকারি কৌঁসুলির তরফ থেকে এইচআরডাব্লিউ-এর বিরুদ্ধে আদালতের অবমাননার অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে৷ ইতিমধ্যে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মোজেনা বলেছেন, দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে এইচআরডাব্লিউ-এর ‘‘একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা’’ রয়েছে৷
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
ট্র্যাক রেকর্ড
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে ক্ষমতায় আসে৷ বিদ্যুৎ উৎপাদন কিংবা কৃষি খাতে সরকারের সাফল্যের খতিয়ান যাই হোক না কেন, বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পের অর্থায়ন থেকে সরে দাঁড়ানোর পর হাসিনা সরকারের অন্য সব সাফল্য ঐ একটি কেলেঙ্কারির আড়ালে ধামাচাপা পড়ে গেছে৷ আগামী নির্বাচনেও পদ্মা সেতু প্রকল্প প্রসঙ্গটি প্রভাব ফেলতে পারে বলে পর্যবেক্ষকদের ধারণা৷
ছবি: AP
10 ছবি1 | 10
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীও এই কৌশলের কথা জানান৷ তিনি দাবি করেন তাঁদের দিক নির্দেশনার কারণেই অবরোধ কর্মসূচি সফল হচ্ছে৷
শামসুজ্জামান দুদু বলেন সরকার নিজেকে রক্ষার জন্য সারাদেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ৫০ ভাগ সদস্যকে ঢাকায় মোতায়েন করেছে৷ তাই এখন ঢাকার চেয়ে ঢাকার বাইরে আন্দোলন জোরদার করা হচ্ছে৷ এ কারণেই ঢাকায় সবাইকে দেখা না গেলেও ঢাকার বাইরে বিভাগ, জেলা এবং উপজেলা পর্যায়ের নেতারা প্রকাশ্যেই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন৷ ফলে সেসব এলাকা এখন বিরোধী দলের নিয়ন্ত্রণে চলে যাচ্ছে বলে দাবি করেন তিনি৷ এভাবে পুরো দেশ থেকে ঢাকাকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হবে বলে জানান শামসুজ্জামান দুদু৷ ঢাকা বিচ্ছিন্ন এবং অবরুদ্ধ হলেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগে বাধ্য হবেন বলে তাঁর ধারনা৷
দুদু এবং রিজভী দুজনই মনে করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করলেই আর সংকট থাকবে না৷ তবে তিনি কখন পদত্যাগে বাধ্য হবেন তা তাঁরা নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না৷ শামসুজ্জামান দুদু বলেন এর জন্য সময় বেঁধে দেয়া কঠিন৷ তবে লক্ষ্যে পৌঁছতে বিরোধী দল দীর্ঘকালীন আন্দোলনেও প্রস্তুত৷ আন্দোলনের এই পর্যায়ে স্বাভাবিক কারণেই হরতাল অবরোধ থাকবে বলে জানান তিনি৷ দুদু বলেন আওয়ামী লীগের ২২ দিন টানা অবরোধের নজির আছে৷ বিএনপি সেই পথেই হাঁটবে৷