ঢাকার এক তৃতীয়াংশ মানুষের শ্রবণশক্তি কমে যাবে!
১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৮
শব্দের মাত্রার একককে বলা হয় ডেসিবেল৷ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, আবাসিক এলাকায় শব্দের মাত্রা দিনের বেলা ৫৫ ডেসিবেল, রাতে ৪৫ ডেসিবেল হওয়া উচিত; বাণিজ্যিক এলাকায় দিনে ৬৫ ডেসিবেল, রাতে ৫৫ ডেসিবেল; শিল্পাঞ্চলে দিনে ৭৫ ডেসিবেল, রাতে ৬৫ ডেসিবেলের মধ্যে শব্দমাত্রা থাকা উচিত৷ আর হাসপাতালে সাইলেন্স জোন বা নীরব এলাকায় দিনে ৫০, রাতে ৪০ ডেসিবেল শব্দ মাত্রা থাকা উচিত৷
বেসরকারি সংস্থা ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ ট্রাস্ট ঢাকা শহরের ১০টি স্থানের শব্দ পরিমাপ করে দেখেছে, ঢাকায় নির্ধারিত মানমাত্রার চেয়ে গড়ে প্রায় দেড় গুন শব্দ সৃষ্টি হয়৷
জরিপে দেখা গেছে, উত্তরার শাহজালাল অ্যাভিনিউতে শব্দমাত্রা সর্বোচ্চ ৯৩ দশমিক ৫ ডেসিবেল, মিরপুর-১ এ সর্বোচ্চ ৯৬ ডেসিবেল, পল্লবীতে সর্বোচ্চ ৯১ দশমিক ৫ ডেসিবেল, ধানমন্ডি বালক বিদ্যালয়ের সামনে সর্বোচ্চ ১০৭ দশমিক ১, ধানমন্ডি ৫ নম্বর সড়কে সর্বোচ্চ ৯৫ দশমিক ৫, নিউমার্কেটের সামনে সর্বোচ্চ ১০৪ দশমিক ১, শাহবাগে সর্বোচ্চ ৯৭ দশমিক ৩ এবং সচিবালয়ের সামনে সর্বোচ্চ ৮৮ ডেসিবেল৷
আর স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের নাক, কান ও গলা বিভাগের অধ্যাপক ডা. মনিলাল আইচ লিটু ডয়চে ভেলেকে বলেন,‘‘এক গবেষণায় দেখা গেছে এইভাবে শব্দদূষণ অব্যাহত থাকলে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে ঢাকা শহরের মোট জনসংখ্যার তিন ভাগের এক ভাগ কানে কম শুনবে৷ একটি অংশ পুরোপুরি বধির হয়ে যাবে৷''
তিনি বলেন, ‘‘ঢাকার শাহবাগ, মহাখালী বা ফার্মগেট এলাকার শব্দের মাত্রা ১২০ ডেসিবেল পর্যন্ত হয়ে থাকে৷ কিন্তু ওইসব এলাকায় ৬০ ডেসিবেলের বেশি শব্দের মাত্রা গ্রহণযোগ্য নয়৷ পুরো ঢাকা শহরে এমন কোনো জায়গা পাওয়া যাবে না, যেখানে শব্দের মাত্রা স্বাভাবিক আছে৷''
ঢাকায় সাধারণভাবে যানবাহন ও হর্নের শব্দই শব্দদূষণের মূল কারণ৷ তবে এর বাইরে রাজনৈতিক, সামাজিক এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠানে উচ্চশব্দে মাইক বা সাউন্ড সিস্টেম ব্যবহার আরেকটি বড় কারণ৷ আর রাস্তা ছাড়া বাড়ি বা আবাসিক এলকায় বিয়েসহ নানা সামাজিক এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠানে উচ্চমাত্রার শব্দযন্ত্র ব্যবহার এবং গানবাজনাই প্রধান কারণ৷ কেউ কেউ নিজের বাসায় উচ্চশব্দে গান শোনেন বা অন্য কোনো সাউন্ড ডিভাইস ব্যবহার করেন৷ এর বাইরে ঢাকাসহ সারাদেশে শিল্পকারখানা এবং যানবাহনকে শব্দ দূষণের কারণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়৷
অথচ অনেকে নিজের বাসায়, কমিউনিটি সেন্টারে সামাজিক অনুষ্ঠানে উচ্চস্বরে গান বাজানোকে কোনো অপরাধই মনে করেন না৷ এর প্রতিবাদ বা প্রতিকার চাইতে গেলে উলটো হেনস্থার শিকার হতে হয়৷ এমনকি প্রতিবাদ করতে গিয়ে মারপিটের শিকার হয়ে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে রাজধানীতে৷
গত ১৮ জানুয়ারি ঢাকার ওয়ারিতে ১১ তলা ভবনের ছাদে একটি বিয়ের গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান ছিল৷ আর সেই অনুষ্ঠানে উচ্চশব্দে গানবাজনা চলছিল৷ সেই ভবনের ৯ম তলায় ছিলেন বাইপাস সার্জারির রোগীনাজমুল হক (৬৫)৷ তাঁর ছেলে নাসিমুল কয়েকবার গিয়ে রোগীর অসুবিধার কথা জনালেও কেউ শোনেননি৷ এতে কথা কাটাকাটি হয়৷ সেখানেই শেষ নয়৷ জোরে গান বাজানোর প্রতিবাদ করায় পরের দিন সকালে নজমুল হকের ছেলেকে ডেকে নিয়ে মারধর করে ফ্ল্যাট মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আলতাফ হোসেন৷ বিয়ের গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানটি ছিল তাঁর ভাইয়ের ছেলের৷ সন্তানকে পেটানোর দৃশ্য দেখে ফেলেন নাজমুল হক৷ছেলেকে রক্ষা করতে এগিয়ে গেলে তিনি অসুস্থ হয়ে পরেন এবং মারা যান৷ ঘটনার পর অবশ্য পুলিশ আলতাফ হোসেনসহ চার জনকে আটক করে৷
বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫-এর ক্ষমতাবলে শব্দ দূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা-২০০৬ প্রণয়ন করা হয়৷ বিধিমালার আওতায় নীরব, আবাসিক, মিশ্র, বাণিজ্যিক ও শিল্প এলাকা চিহ্নিত করে শব্দের মানমাত্রা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে৷ এদিকে আইন অমান্য করলে প্রথমবারের অপরাধের জন্য এক মাস কারাদণ্ড বা অনধিক পাঁচ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড এবং পরবর্তী অপরাধের জন্য ছয় মাস কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার বিধান রয়েছে৷ কিন্তু বাস্তবে এই আইনের তেমন প্রয়োগ দেখা যায় না৷আইনে ধর্মীয় অনুষ্ঠানসহ আরো কিছু বিষয়ে ব্যাতিক্রম আছে৷ তবে সর্বোচ্চ পাঁচ ঘণ্টা এবং রাত ১০টার পর কোনোভাবেই উচ্চ শব্দের কোনো অনুষ্ঠান করা যাবে না৷
আইন অনুযায়ী, পরিবেশ অধিদপ্তরের বাইরে প্রত্যেক থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা এই আইন প্রয়োগের অথরাইজড অফিসার৷ কিন্তু অনেকেই বিষয়টি জানেন না৷ আবার যারা জানেন, তারা থানায় অভিযোগ করেও প্রতিকার পান না বলে জানা যায়৷ ঢাকা মেট্রেপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)-র উপ কমিশনার মাসুদুর রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘শব্দ দূষণ বন্ধে চলতি সপ্তাহেই আমরা একটি নির্দেশনা জারি করেছি৷ আর তাতে উচ্চস্বরে গান বাজনা বা কোনো জনসভার ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছি৷ শব্দ দূষণের বিষয়টি নিয়ে আমরাও উদ্বিগ্ন৷''
ডিএমপি'র ওই নির্দেশনায় বলা হয়, ‘‘পূর্ব অনুমোদন ছাড়া কোনো বাড়ির প্রাঙ্গন, ছাদ, রাস্তা বা উন্মুক্ত স্থানে মাইক্রোফোন অথবা লাউড স্পিকারে গান বাজিয়ে কনসার্ট বা সংগীতানুষ্ঠান আয়োজন করা যাবে না৷ ঢাকা মহানগরীর সাধারণ নাগরিকদের শান্তিপূর্ণ বসবাস নিশ্চিত করতে ঢাকা মহানগরী অধ্যাদেশ ১৯৭৬-এর ২৭ ও ৩১ ধারায় প্রদত্ত ক্ষমতাবলে অনুমোদন ছাড়া এ ধরনের অনুষ্ঠান আয়োজন না করার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে৷''
মাসুদুর রহমান বলেন, ‘‘এছাড়া জনসভা এবং সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানের জন্যও এই ব্যবস্থা প্রযোজ্য৷' তিনি আরো বলেন, ‘‘শব্দ দূষণের শিকার কেউ যদি আমাদের কাছে অভিযোগ করেন, তাহলে আমরা ব্যবস্থা নেবো৷''
পুলিশ শব্দদূষণ রোধে গত বছর যানবাহনের হাইড্রোলিক হর্ন জব্দ শুরু করেছিল৷ আর বেশি শব্দ তৈরি করে এমন ত্রুটিপূর্ণ যানবাহনের বিরুদ্ধ্রে ম্যাজিষ্ট্রেটের সহাতায় অভিযানও চালিয়েছি৷ কিন্তু সেই অভিযানে এখন ভাটা পড়েছে৷ রাজধানীতে শব্দ দূষণের মূলে রয়েছে এই ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন এবং হাইড্রোলিক হর্ন৷ মাসুদুর রহমান বলেন, ‘‘আমরা ১০ হাজার হাইড্রোলিক হর্ন জব্দ ও ধ্বংস করেছি৷ এখনো আমরা নজরদারিতে রেখেছি৷''
তবে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের সভাপতি ডা. আবদুল মতিন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘সরকারের লোকজনই আইন মানেন না৷ সরকারি একটি গাড়িতে এখনো তিন ধরনের হর্ন ব্যবহার করা হয়৷ তারমধ্যে একটি হাইড্রোলিক হর্ন৷''
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (বাপা) গত কছরের জানুয়ারি মাসে ঢাকা মহানগরীর ৪৫টি স্থানে শব্দের মাত্রা পরিমাপ করে৷ তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়, নীরব এলাকায় দিনের বেলা শব্দের মাত্রা সহনীয় মাত্রার (মানমাত্রা) চেয়ে দেড় থেকে দুই গুন, আবাসিক এলাকায় দিনের বেলা শব্দের মাত্রা দেড় গুন ও রাতে শব্দের মাত্রা দেড় থেকে প্রায় দুই গুন, মিশ্র এলাকায় দিনে শব্দের মাত্রা দেড় গুন ও রাতে শব্দের মাত্রা দেড় থেকে দুই গুনেরও বেশি৷ এছাড়া বাণিজ্যিক এলাকায় দিনে শব্দের মাত্রা দেড় গুন বেশি৷ নীরব এলাকায় দিনের বেলা শব্দের মাত্রা সবচেয়ে বেশি ইডেন মহিলা কলেজের সামনে, ১০৪ দশমিক ৪ ডেসিবেল৷ মিশ্র এলাকায় দিনে শব্দের মাত্রা সবচেয়ে বেশি পল্টনে ১০৫ দশমিক ৫ ডেসিবেল৷ আর রাতে শব্দের মাত্রা সবচেয়ে বেশি কলাবাগানে ১০৬ দশমিক ৪ ডেসিবেল৷ অন্যদিকে বাণিজ্যিক এলাকায় দিনে শব্দের মাত্রা সবচেয়ে বেশি হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সামনে, ১০৮ দশমিক ৯ ডেসিবেল৷
ডা.আব্দুল মতিন বলেন, ‘‘এখানে আইনই মূখ্য নয়৷ আইন আছে, প্রয়োগ নাই৷ আর সচেতন করারও কোনো উদ্যোগ নাই৷ ফলে যা হবার তা-ই হচ্ছে৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘আমি নিজেও একজন চিকিৎসক৷ শব্দ দূষণের কারণে শ্রবণশক্তি, মস্তিস্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়৷ মানসিক বৈকল্য দেখা দেয়৷ আর হৃদরোগের আশঙ্কা বাড়ে৷ আর এর প্রধান শিকার শিশু এবং বয়স্করা৷''
ডা. মনিলাল আইচ লিটু বলেন, ‘‘উচ্চমাত্রার শব্দের কারণে মানুষের শ্রবণশক্তি হ্রাস, বধিরতা, হৃদরোগ, মেজাজ খিটখিটে হওয়া, বিরক্তি সৃষ্টি হয়৷ এমনকি গর্ভে থাকা সন্তানও শব্দদূষণে ক্ষতির শিকার হয়৷ বয়স্ক এবং রোগীরা এই শব্দ দূষণের বড় শিকার৷ বিশেষ করে যারা হার্টের রোগী, তারা আরো বড় ক্ষতির মুখে পড়তে পারেন৷ এছাড়া শব্দ দূষণের কারণে সড়ক দুর্ঘটনা বাড়ে৷ কারণ, শব্দ দূষণে মেজাজ খিটখিটে হয়, মনোযোগ নষ্ট হয়৷'' তিনি বলেন, ‘‘ঢাকার এক তৃতীয়াংশ মানুষ এখন শব্দ দূষণে আক্রান্ত৷''
আপনার কিছু বলার থাকলে লিখুন নীচে মন্তব্যের ঘরে৷