1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ঢাকার পানি সরবে কিভাবে?

হারুন উর রশীদ স্বপন ঢাকা
৩ জুলাই ২০১৭

বছরের পর বছর কথা হলেও বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার জলাবদ্ধতা সমস্যার কোনো সুরাহা হচ্ছে না৷ একটু ভারী বৃষ্টি হলেই পানির নিচে চলে যায় সব৷ বিশ্লেষকরা বলছেন, ঢাকার পানি সরে যাওয়ার কোনো পথই খোলা নেই৷ তাহলে জলাবদ্ধতা হবে না কেন?

ছবি: DW/M. Mamun

গত কোরবানীর ঈদে ঢাকাবাসী এক নতুন পরিস্থতির মুখোমুখি হয়৷ ওইদিন তুমুল বৃষ্টির কারণে কোরবানীর কিছু এলাকায় পশুর রক্তের সঙ্গে বৃষ্টির পানি মিশে যে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয় তা সত্যিকার অর্থেই ছিল নতুন অভিজ্ঞতা৷ কেউ কেউ তখন এর নাম দেন রক্তাবদ্ধতা৷

পরে এই পশুর রক্তমাখা পানি নেমে গেলেও নিম্নাঞ্চলে জমে যাওয়া এই পানি পঁচে দুর্গন্ধ ছড়ায়৷ ছাড়ায় রোগ জীবাণু৷

এ বছর রোজার ঈদের কয়েকদিন আগে টানা বর্ষণে ঢাকা বলতে গেলে পুরোটাই ডুবে যায়৷ জলজট এবং যানজটে নগরী বলতে গেলে অচল হয়ে পড়ে৷ সেই পানি এখন নেমে গেলেও রাজধানীর অনেক এলাকা, বিশেষ করে নিম্নাঞ্চল বেশ কিছুদিন পানিতে ডুবে থাকে৷ সেসব অঞ্চলে ঈদ কেটেছে হাঁটু পানিতে৷ কেউ কেউ বাসায় থাকতে না পেরে বাসা পরিবর্তন করছেন৷ কিন্তু নিম্ন আয়ের মানুষ, যাঁরা এসব বাড়ি বা বস্তিতে থাকেন, তাঁরা চাইলেই বেশি ভাড়ায় নতুন বাড়িতে উঠতে পারেন না৷ ফলে অনেককেই জলাবদ্ধতার সঙ্গেই বসবাস করতে হয়৷

Golam Rahman - MP3-Stereo

This browser does not support the audio element.

ঢাকায় সাধারণত ২৪ ঘন্টায় ৪০ মিলিমিটারের নিচে বৃষ্টি হলে জলাবদ্ধতা হয় না৷ আর এবার জুন মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহেই ঢাকায় ২৪ ঘন্টায় ১৩৩ মিলি মিটার বৃষ্টির রেকর্ড আছে৷ এবার বর্ষার আগে থেকেই বৃষ্টির পরিমান বেশি৷ আর সামনে পড়ে আছে পুরো বর্ষা ঋতু৷ তাই আগের হাঁটু পানির জলাবদ্ধতা এখন কোমড় পানির দিকে যাচ্ছে৷ বৃষ্টি একটু বেশি হলেই ঢাকার সড়কে নৌকা চলে৷ সড়ক পথের যানবাহন পানি ঢুকে বন্ধ হয়ে যায়৷ একমাত্র ভরসা রিকশা৷ তাও পানিতে তলিয়ে যাওয়া খানাখন্দে ভরা সড়কে চলতে গিয়ে যাত্রীসহ প্রায়ই উল্টে যায়৷ কাদাপানিতে একাকার হয়ে যান রিকশাযাত্রী৷

গত বছরেও ঢাকার শান্তিনগর এলাকা ছিল জলাবদ্ধতার মূল কেন্দ্র৷ কিন্তু এবার বর্ষায় তার উল্টো চিত্র দেখা গেছে৷ অন্য এলাকায় জলাবদ্ধতা হলেও শান্তিনগরে তেমন হয় না৷ ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন জানায়, বৃষ্টি হলেই এই এলাকায় হাঁটু পানি সৃষ্টি হতো৷ দীর্ঘ সময় শেষেও এই পানি সরত না৷ এ অবস্থায় বড় একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে দক্ষিণ সিটি৷ ফলে চলতি বর্ষা মৌসূমে শান্তিনগরের জলাবদ্ধতা প্রায় ৮০ ভাগ কমে গেছে৷ মগবাজার মৌচাক ফ্লাইওভার নির্মাণ কাজ শেষ হলে শান্তিনগরের জলাবদ্ধতার পরিমাণ শূন্যের কোঠায় নেমে আসবে বলে আশা দক্ষিণ সিটির৷

ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনে সর্বমোট ২৫০০ কিলোমিটার খোলা ড্রেন এবং ৪০০০ কিলোমিটার ভূগর্ভস্থ ড্রেনেজ সিস্টেম ব্যবস্থাপনা করে আসছে৷ গত চার বছরে ৩০৩ কোটি টাকারও বেশি খরচ করা হয়েছে ড্রেনেজ সিস্টেমের উন্নতি সাধনে৷

বৃষ্টিপাত থেকে যে পানি জমা হয়, তা ‘রানঅফ ওয়াটার' বলে পরিচিত৷ রাজধানীর এই পানি ‘স্টর্ম' ড্রেন দিয়ে নিষ্কাশিত হওয়ার কথা৷ গতবছর থেকে ঢাকা ওয়াসা ‘স্টর্ম ওয়াটার ড্রেনেজ মাস্টার প্ল্যান' বাস্তবায়ন করছে৷ কিন্তু তা কবে শেষ হবে নিশ্চিত নয়

ঢাকা ওয়াসার একটা প্রধান দায়িত্ব হলো, পানি সরবরাহ এবং শহরের ৩৯% ড্রেনেজ সিস্টেমকে সচল রাখা৷ তা করার জন্য ৬৫ কিলোমিটার খোলাখাল এবং ও বক্সকালভার্ট আছে৷ এছাড়াও এদের আছে ড্রেনেজ পাম্পিং সিস্টেম৷ কিন্তু অসময়ে কিছুই কাজে আসে না৷

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, রাজধানী ঢাকায় প্রতিদিন ছয় হাজার ১১০ টন গৃহস্থালি বর্জ্য উৎপাদিত হচ্ছে৷ এর মধ্যে ঢাকার প্রত্যেক নাগরিক ৩৭৭ গ্রাম বর্জ্য উৎপাদন করে, যার ৯৭ শতাংশই জৈব পদার্থ৷ বাকি ৩ শতাংশ বর্জ্য অজৈব৷ গত ১০ বছরে এ মহানগরীতে বর্জ্য উৎপাদন বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ৷ ১০ বছর আগে দৈনিক তিন হাজার ২০০ টন বর্জ্য উৎপাদনের বিপরীতে ৪৩ শতাংশ হারে অপসারিত হতো এক হাজার ৩৭৬ টন৷ এখন দৈনিক ছয় হাজার ১১০ টন বর্জ্য উৎপাদনের বিপরীতে অপসারিত হয় চার হাজার ৫৮২ টন৷ এইসব বর্জ্য ড্রেনেজ সিস্টেম ছাড়াও কঠিন বর্জ্য সরাসরি ডাম্পিংয়ে নেয়া হয়৷ তবে বৃষ্টিতে পানি জমলে কঠিন এবং তরল বর্জ্য একাকার হয়ে যায়৷

রাজধানীর দুই সিটি কর্পোরেশনের মধ্যে জলাবদ্ধতা বেশি উত্তর সিটিতে৷ এর মধ্যে কারওয়ান বাজার, মিরপুর, কালশী, শ্যামলী, মোহাম্মদপুরের বেড়িবাঁধ সংলগ্ন এলাকা, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে নতুন বাজার, খিলখেতসহ বিভিন্ন এলাকা অন্যতম৷

ঢাকার বেগুনবাড়ি, পান্থপথের বিভিন্ন এলাকা, ধানমণ্ডি, কুড়িল, পুরান ঢাকার আলাউদ্দিন রোড, যাত্রাবাড়ী মোড়, জুরাইন, শহীদনগর, মধুবাগে ভয়াবহ জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয় অল্প বৃষ্টিতেই৷ অলি-গলি হাঁটু থেকে কোমড় পানিতে তলিয়ে যায়৷

পূর্ব জুরাইন থেকে ডিএনডি বাঁধ পর্যন্ত এলাকায় বছরের প্রায় প্রতিদিনই পানি জমে থাকে৷ এই এলাকাটি অন্যান্য এলাকার তুলনায় অনেক নিচু হওয়ায় আশপাশের এলাকাসহ বাসা বাড়ির স্যুয়ারেজের পানি জমে জলাদ্ধতা দেখা দেয়৷

গত বছর জলাবদ্ধতা নিরসনে দুই সিটি কর্পোরেশন প্রায় ২১ কোটি টাকা ব্যয়ে দু'টি অত্যাধুনিক 'জেট অ্যান্ড সাকার মেশিন' কিনেছে৷ বলা হয়েছে, এই যন্ত্রটি প্রতিদিন ২২ ঘণ্টা কাজ করতে পারে৷ প্রতি ১০ মিনিটের মধ্যে ১২০ মিটার দীর্ঘ ড্রেন সম্পূর্ণ পরিষ্কার করতে সক্ষম৷ কিন্তু বাস্তবে এর কোনো ফল দেখা যাচ্ছে না৷

বৃষ্টি শুরুর পরই জলাবদ্ধতা দূর করতে দুই সিটি কর্পোরেশন তার কাউন্সিলর ও পরিচ্ছন্নতা পরিদর্শকদের সমন্বয়ে প্রতিটি ওয়ার্ডে একটি করে কমিটি গঠন করেছে৷ ‘ইমার্জেন্সি রেসপন্স টিম' নামে ওই কমিটিতে ১০ জন করে সদস্য আছে৷ সে হিসেবে দুই সিটির ৯১টি ওয়ার্ডে ৯১০ জন কর্মী থাকার কথা৷ বৃষ্টির পর জলাবদ্ধতা হলেই এসব কর্মী মাঠে নেমে ড্রেন ও ম্যানহেলগুলোর ঢাকনা খুলে দেবে৷ একই সঙ্গে বিকল্প কোনও ব্যবস্থা নিতে হলে তা-ও করবে৷ কিন্তু জলাবদ্ধতা হলে এসব কর্মীর কোনও অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া যায় না৷

রাজধানীর এই জলাবদ্ধতা নিরসনের দায়িত্ব ওয়াসারও৷ কিন্তু এ নিয়ে ওয়াসা এবং সিটি কর্পোরেশনের মধ্যে আছে রশি টানাটানি৷ ১৯৮৯ সালে ওয়াসাকে পানি নিষ্কাশনের মূল দায়িত্ব দেওয়া হয়৷ পাশাপাশি এ কাজে যুক্ত হয় ঢাকা সিটি কর্পোরেশনসহ আরও কয়েকটি সংস্থা৷ ওয়াসা ২০১৪ সালের আগস্টে স্থানীয় সরকার বিভাগে পাঠানো এক চিঠিতে জানায়, ‘‘জলাবদ্ধতার দায় ওয়াসা নেবে না৷'' কারণ, ‘‘পানি নিষ্কাশনের কাজ ঢাকা ওয়াসার ওপর ন্যস্ত করা হলেও ওয়াসার চেয়ে সিটি কর্পোরেশনের পাইপলাইনের সংখ্যা বেশি৷ বার্ষিক ক্লিনিংয়ের ব্যাপারেও দুটি সংস্থার মধ্যে সমন্বয় নেই৷ এজন্য সামান্য বৃষ্টিতেই জলজট দেখা দেয়৷''

বিআইডব্লিউটিএ'র সাবেক নির্বাহী প্রকৌশলী এবং নগর বিষেশজ্ঞ তোফায়েল আহম্মেদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘পানির ধর্মকে অস্বীকার করে আমরা ঢাকা শহর থেকে পানি নিস্কাশনের পথ বন্ধ করে দিয়েছি৷ ঢাকার মধ্যে ৪৬টি খাল ছিল, তা আমরা ভরাট করে ফেলেছি৷ ফলে বৃষ্টির পানি সরতে পারে না৷ পানি নীচের দিকে যায়৷ যেতে না পেরে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়৷ ঢাকার প্রাকৃতিকভাবে পানি প্রবাহের পথ রুদ্ধ করে অন্য কোনো ব্যবস্থায় এই জলাবদ্ধতা দূর করা কঠিন৷''

তিনি বলেন, ‘‘ঢাকা কোনো একই উচ্চতার সমতল ভূমি নয়৷ এটা কোথাও উচু আবার কেথাও নিচু আবার কোথাও ঢালু৷ তাই বৃষ্টি হলে ঢালুতে গিয়ে পানি জমা হয়৷ সেখানে যদি পানির আধার থাকে বা সরে যাওয়ার ব্যবস্থা থাকে, তাহলে পানি জমতে পারে না৷ আমরা পানি নিষ্কাশনের জন্য বক্স কার্লভার্ট বানিয়েছি৷ ওই বক্সে পানি যেতে তো সময় লাগে৷ ফলে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়৷ ঢাকা শহরের জিওগ্রাফিক ম্যাপ আছে৷ প্রতি ঘন্টায় সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাতের হিসাব আছে৷ কী পরিমান বৃষ্টিতে কত দ্রুত পানি নিষ্কাশন করলে পানি দাঁড়াতে পারবে না, সেই হিসাব করে আমাদের পানি নিস্কাশন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে৷ আর আমার বিচেনায় তা করতে হলে অনেক সিস্টেম ভেঙ্গে নতুন করে তৈরি করতে হবে৷''

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এবং বাংলাদেশ প্ল্যানার্স ইন্সটিউটের সভাপতি অধ্যাপক গোলাম রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আশির দশকে নগর বন্যার পর ফ্লাড অ্যাকশন প্রোগ্রাম (ফ্যাপ)-এর আওতায় ঢাকার চারপাশ ঘিরে একাংশে শহর রক্ষা বাঁধ তৈরি হয়৷ কিন্তু পুরো কাজ আর হয়নি৷ কথা ছিল ওটা হলে সার্কুলার রোড, ড্রেন এসব তৈরি হবে৷ কিন্তু হয়নি৷ আর ঢাকার চারপাশে নদী৷ থাইল্যান্ডে শহরের ভিতরে ওয়াটার বোট চলে৷ আমাদেরও সুযোগ ছিল৷ কিন্তু আমরা নষ্ট করে ফেলেছি৷ শহরের নদী- খাল ভরাট করে আমরা রাস্তা বানিয়েছি৷ ফলে এখন জলাবদ্ধতা স্থায়ী রূপ নিয়েছে৷''

Tofail Ahmed - MP3-Stereo

This browser does not support the audio element.

তিনি জানান, ‘‘ঢাকা শহরের মধ্যে ৪৬টি খাল ছিল৷ ওয়াসা বলেছিল, এর মধ্যে কমপক্ষে ২৬টি খালকে রক্ষণাবেক্ষন করে পানিপ্রবাহ সচল রাখবে৷ কিন্তু বাস্তবেতো তা আর হচ্ছে না৷''

তিনি বলেন, ‘‘পানি নিষ্কাশনের জন্য বক্স কালভার্ট সিস্টেম এরইমধ্যে ক্ষতিকর প্রমাণিত হয়েছে৷ শুনেছি, এগুলো নাকি ভেঙ্গে ফেলা হবে৷ পাম্পের মাধ্যমে বিপূল পানি নিস্কাষনের চিন্তা সঠিক নয়৷ কারণ, এটা বিশাল খরচের ব্যাপার৷ তাই ঢাকা শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনে কোটি কোটি টাকার প্রকল্প নেয়ার আগে ভাবতে হবে৷''

এই অধ্যাপক বলেন, ‘‘প্রাকৃতিকভাবেই পানি নিষ্কাশনের পথগুলো খুলে দেয়া হলো সহজ পথ৷ আর তা না হলে বিছিন্নভাবে নয়, ন্যাশনাল অ্যাকশন প্ল্যানের মাধ্যমেই এর সমাধান করতে হবে৷ সারাদেশকে নিয়ে পরিকল্পনা করতে হবে৷ শুধু ঢাকা নিয়ে পরিকল্পনা করলে তা তেমন ফল আনবে না৷''

বিশ্লেষকরা বলছেন, পানি নিষ্কাশনের দুটি পথ আছে৷ এক. ভূ-গর্ভে পানি শোষণ করে নেয়া এবং দুই. খাল, বিল ও ড্রেন দিয়ে নদীতে চলে যাওয়া৷ ঢাকায় এই দুটি পথের একটিও কার্যকর নেই৷ এ কারণে জলাবদ্ধতা বাড়ছেই৷

আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য
স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ