ঢাকার ফ্ল্যাট কালো টাকা ও অর্থমন্ত্রী
১৬ জুন ২০২২বিশ্লেষকেরা বলেছেন, অর্থমন্ত্রী যা বলেছেন তার মধ্যে কিছুটা সত্য আছে। কিন্তু এর জন্য সরকারের নীতিই দায়ী। আর যে অর্থমন্ত্রী কালো টাকা ও অপ্রদর্শিত আয়কে এক করে ফেলেছেন। বৈধ আর অবৈধ আয়কে এক কাতারে নিয়ে এসেছেন। তাদের কথা, কালো টাকা হলো অবৈধ টাকা। যে টাকার উৎস অবৈধ বা উৎস জানা যায় না তা হলো কালো টাকা। আর যে টাকা বৈধভাবে আয় করা হয়েছে কিন্তু কর দেয়া হয়নি তা হলো অপ্রদর্শিত আয় বা আনট্যাক্সড মানি। তারা আরো বলেন, এই দুই ধরনের টাকা এক করে গুলিয়ে ফেলায় সংকট তৈরি হয়েছে।
অর্থমন্ত্রী যা বলেছেন:
অর্থমন্ত্রী আসলে ঢাকায় জমি ও ফ্ল্যাটের নিবন্ধন ফি এবং সরকারের পক্ষ থেকে বেঁধে দেয়া প্রসঙ্গে টেনে কালো টাকা নিয়ে কথা বলেছেন। তার বক্তব্যের সারমর্ম হলো ঢাকায় সরকারি হিসেবে এলাকাভিত্তিক একটি ফ্ল্যাটের প্রতি বর্গফুটের যে সর্বনিম্ন দাম নির্ধারণ করা আছে তার ভিত্তিতে ফ্ল্যাট কেনার ক্ষেত্রে সরকারের ধার্য করা কর দিতে হয়। কিন্তু বাস্তবে ওই দাম অনেক বেশি। তাই বেশি দামে ফ্ল্যাট কিনে সরকার নির্ধারিত দামের হিসেবে কর দেয়া হয়। ফলে যে টাকা অতিরিক্ত দেয়া হয় তা হিসেবে থাকে না। আবার যিনি বিক্রি করেন তিনিও সেই অতিরিক্ত টাকা টাকা তার আয় করে প্রদর্শন করেন না। এটা জমির ক্ষেত্রেও একই। ফলে এই সেক্টরে বিপুল পরিমাণ অপ্রদর্শিত আয় থেকে যায়। যাকে অর্থমন্ত্রী বলেছেন কালো টাকা।
বাস্তব উদাহরণ:
বাংলাদেশে মৌজাভিত্তিক জমির দাম এবং এলাকা ভিত্তিক ফ্ল্যাটের দাম সর্বশেষ নির্ধারণ করা হয় ২০১৬ সালে। কিন্তু এটা প্রতি দুই বছর পর আপডেট হওয়ার কথা। আর এটা একেক এলাকায় একেক রকম। সরকারের কর ধার্য করা হয় ওই দামের ওপরই। যেমন ঢাকার গুলশানে ১৪ টি মৌজায় আট ধরনের জমি আছে। ওই এলাকায় গুরুত্ব ভেদে এক শতাংশ জমির দাম এক লাখ থেকে ৫৮ লাখ টাকা। কিন্তু বাস্তবে গুলশানের কোথাও এক কোটি টাকার নিচে এক শতাংশ জমি পাওয়া যাবে না। আবার ধানমন্ডিতে প্রতি শতাংশ জমির দাম সরকারি রেট অনুযায়ী ৪৩ লাখ টাকা থেকে ৯৩ হাজার ৩০০ টাকা। কিন্তু বাস্তবে ধানমন্ডি এলাকায় প্রতি শতাংশ জমির দাম দেড় কোটি টাকার বেশি।
আবার ঢাকায় ফ্ল্যাটের দাম সরকারের নির্ধারিত প্রতি বর্গফুট সর্বনিম্ন এক হাজার ৫০০ টাকা। অন্যান্য শহরে এক হাজার ২০০ টাকা এবং মফস্বলে এক হাজার টাকা। কিন্তু এই রেটে বাংলাদেশের কোথাও ফ্ল্যাট পাওয়া যাবে না। ঢাকায় এখন প্রতি বর্গফুট ২০ হাজার টাকায়ও বিক্রি হচ্ছে। আর সর্বনিম্ন সাত-আট হাজার টাকা।
বাস্তবে দাম যাই হোক না কেন জমি বা ফ্ল্যাট কেনা-বেচার সময় সরকার নির্ধারিত দামের ওপরই কর দেয়া হয়। এতে কর অনেক কম দেয়া যায়। যদিও বাস্তব দামে কর দিতে আইনে বাধা নেই। তারপরও কর ফাঁকির জন্য এটা করা হয়।
জমির ক্ষেত্রে মোট দামের ওপর স্ট্যাম্প ডিউটি দেড় শতাংশ, নিবন্ধন ফি এক শতাংশ, স্থানীয় সরকার কর তিন শতাংশ এবং এলাকাভেদে এক থেকে পাঁচ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর দিতে হয়। আর প্রতিষ্ঠানের জমি-ফ্ল্যাট কেনাবেচা হলে আরো চার শতাংশ উৎসে কর যোগ হয়। ফ্ল্যাট কেনা-বেচায় মোট দামের ওপর ১০ থেকে সাড়ে ১২ শতাংশ কর।
জমি ও ফ্ল্যাটের দরকারি নির্ধারত দাম বাস্তবের চেয়ে কোনো কোনো ক্ষেত্রে তিন চতুর্থাংশ কম। ফলে সরকার যেমন বিপূল পরিমাণ রাজস্ব হারায়। তেমনি বিপুল পরিমাণ অর্থ অপ্রদর্শিত থেকে যায়।”
অপ্রদর্শিত হলেই কি কালো টাকা?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন,"বাংলাদেশ সরকারের যে নীতি তাতে যে টাকার আয়কর দেয়া হয়নি তাকেই আসলে কালো টাকা বলা হচ্ছে। কিন্তু সেই টাকার উৎস আছে বা প্রকাশ করা যায়। তবে আমরা এটাকে বলি অপ্রদর্শিত বা আনট্যাক্সড মানি। কর না দেয়ায় ওই টাকা আয়কর ফাইলে দেখানো হচ্ছে না। কিন্তু যে টাকার উৎস অবৈধ বা জানা যায় না সেটা আসলে অবৈধ টাকা। ওই টাকা ঘুস, দুর্নীতি, মাদক ব্যবসা বা অন্য কোনো অবৈধ ভাবে আয় করা হয়।”
অবৈধ আয় আর অপ্রদর্শিত আয় এক নয়। কিন্তু আমাদের দেশে সাধারণ বিবেবচনায় সব এক করে ফেলা হয়। আর কালো টাকা বলতে অবৈধ আয়ের টাকাকে ধরে নেয়া হয় বলে জানান তিনি। তার কথা,"যখন বলা হয় আয়ের উৎস সম্পর্কে প্রশ্ন করা হবে না। তখন কিন্তু অবৈধ টাকাও সুযোগ পেয়ে যায়।”
তিনি বলেন,"জমি ও ফ্ল্যাটের ব্যাপারে অর্থমন্ত্রী যে কালো টাকার কথা বলেছেন সেটা সিস্টেমের কারণে হয়। সরকার জমি ও ফ্ল্যাটের বাস্তব মূল্য নির্ধারণ করলেই এই সমস্যা থাকে না।”
তবে যারা অবৈধ টাকার মালিক তারাও কিন্তু এর সুযোগ নেয়। তারা জমি ও ফ্ল্যাট কিনে কালো টাকা সাদা করেন। তারা প্রকৃত মূল্যের ওপর কর দিলেও তাদের তাদের লাভ। আর অনেকে বৈধ টাকায় কিনে কর কম দিয়ে সাদা টাকাকেই কালো করে ফেলেন।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআইবি) নির্বাহী পরিচালক অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন," অর্থমন্ত্রী ঢালাওভাবে ঢাকায় জমি ও ফ্ল্যাটের মালিকদের কালো টাকার মালিক বলে ঠিক করেননি। কারণ সরকারের সিস্টেমের কারণেই এই সমস্যা হচ্ছে। সরকার যদি জমি ও ফ্ল্যাটের দাম বেঁধে না নিয়ে প্রকৃত দামের ওপর ট্যাক্স নেয় তাহলেই হল। অথবা প্রকৃত যা দাম তা বেঁধে দিলেই হল।
ঢালাওভাবে বলে আসলে যারা অনুপার্জিত আয় (অবৈধ আয়) করেন তাদের সাথে উপার্জিত আয় গুলিয়ে ফেলা হচ্ছে। বৈধভাবে আয় যার আয়কর দেয়া হয়নি সেটাকে কালো না বলে আনট্যাক্সড মানি বলাই ভালো। তিনি ট্যাক্স দিয়ে না থাকলে নিয়ম মেনে দেবেন। আর ঘুস, দুর্নীতি বা অবৈভাবে যে টাকা অর্জন করা হয় সেটাতো অবৈধ। তাদের তো বৈধ হওয়ার কোনো সুযোগই থাকা উচিত নয়। কিন্তু সরকার যখন বলে উৎস সম্পর্কে প্রশ্ন করা হবে না তখনই তারা সুযোগ পেয়ে যায়।”
আর জাতীয় রজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান ড. নাসির উদ্দিন আহমেদ বলেন,"অর্থমন্ত্রী ঠিক কথা বলেছেন বলে আমি মনে করি না। জমি ও ফ্ল্যাটের ক্ষেত্রে অপ্রদর্শিত আয় থাকতে পারে। সেটার কর দিতে হবে। কিন্তু তাই বলে সবাই কালো টাকার মালিক এটা ঠিক নয়। তাদের আয় তো বৈধ।
আমাদের এখানে অবৈধ আয়কেও সুযোগ দেয়া হয়। এখন আবার পাচারের টাকাও বৈধ করার সুযোগ দেয়া হচ্ছে। এটাই সমস্যা। উৎস সম্পর্কে প্রশ্ন করা হবে না বলে সমস্যা প্রকট করা হয়েছে। এটা অনৈতিক। আসলে যেসব বৈধ আয়ের কর দেয়া হয়নি সেটাকেই করের আওতায় আনার সুযোগ দিতে হবে। কিন্তু অবৈধ আয়কেও সুযোগ দেয়ায় এখন উপার্জিত অনুপার্জিত সব আয়কেই গড়ে কালো টাকা বলা হচ্ছে।”