গত কয়েক বছরে ঢাকা কেন, গোটা বাংলাদেশে সবচেয়ে আলোচিত ছিল রেলমন্ত্রী মুজিবুল হকের বিয়ে৷ এলাহি কাণ্ড, বহু গণ্যমান্য অতিথির সমাগম, যা নিয়ে কথা বলেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী, দেন আশীর্বাদ৷ বিয়েতে দেনমোহর ধরা হয় পাঁচ লাখ এক টাকা৷
বিজ্ঞাপন
ঢাকার জমকালো বিয়ে বলতে এখন প্রধানত পাঁচতারা হোটেল, সেনাকুঞ্জ, সেনা মালঞ্চ, বসুন্ধরা কনভেনশন সেন্টার বা বিজিবি-র দরবার হলের বিয়ে৷ এছাড়া বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক কেন্দ্রেও মাঝে মাঝে শোনা যায় বিয়ের অনুষ্ঠানের কথা৷ এ সব বিয়ের আয়োজনে হল ভাড়াই পড়ে যায় ৫ থেকে ২০ লাখ টাকা৷ এর সঙ্গে অন্যান্য খরচ তো আছেই৷ সব মিলিয়ে কোটি টাকার ব্যাপার বা তারও বেশি!
এই বছরে চিত্র নায়িকা মাহির বিয়েও ছিল বেশ জমকালো এবং আলোচিত৷ সেনা মালঞ্চের সেই বিয়ের অনুষ্ঠানে নাকি হাজার দুয়েক অতিথি আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন৷ কয়েকজন চিত্র সাংবাদিকও ছিলেন নিমন্ত্রিতদের মধ্যে৷ তাঁদের একজনের মুখে শোনা, ২০শে জুলাই সেই বিয়ের অনুষ্ঠানে ছিল নানা আয়োজন – ডিজে, সেলফি কর্নার, ফটো কর্নার, কফি কর্নার আরো কত কী! আর মাহি বিয়ের পরই হানিমুন করতে পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রে৷ এছাড়া পাত্র-পাত্রীর ছবি দিয়ে নিজস্ব ডিজাইনে তৈরি মাহির বিয়ের আমন্ত্রণ-পত্রও ছিল নজর কাড়ার মতো৷
বিভিন্ন ধর্মের ও অঞ্চলের বিয়ের রীতি
অনেকে বলবেন, প্রেম পূর্ণতা পায় বিয়ের মাধ্যমে৷ আবার কেউ বলবেন না, বিয়ে মানে শুধুই আনুষ্ঠানিকতা৷ বিবাহের গূঢ় অর্থ যাই হোক না কেন, একেক ধর্মে এর রীতিনীতি আলাদা৷ অঞ্চলভেদেও বিরাট ফারাক এর নিয়মকানুনে৷
ছবি: Getty Images/A. Joyce
মুসলিম বিয়ে
সাক্ষীর উপস্থিতিতে বিয়ে পড়ানো হয়৷ দেনমোহর ধার্য করা হয় ছেলের আর্থিক সামর্থ্য ও অবস্থান অনুযায়ী৷ বিয়ের সময় একজন উকিল থাকেন৷ তিনি প্রথমে কনেকে জিজ্ঞাসা করেন, সে বিয়েতে রাজি আছে কিনা৷ কনে রাজি থাকলে বরকেও একই প্রশ্ন করা হয়৷ এরপর দোয়া কালাম করে সম্পন্ন করা হয় বিয়ে৷
ছবি: Getty Images/AFP
হিন্দু বিয়ে
বিয়ে হয় বেশ কিছু আচার-অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে৷ প্রচলিত নিয়মে প্রথমে বাগদান পর্ব এবং সেখানেই পাটিপত্রে বর-কনের স্বাক্ষর৷ তারপর একে একে আশীর্বাদ, গায়ে হলুদ, তারপর বিয়ের আসর৷ সেখানে দু’টি পর্ব – সাজ বিয়ে ও বাসি বিয়ে৷ সাজ বিয়েতে সাতবার প্রদক্ষিণ শেষে কনে আর বরকে বরণ করে নেয়া হয়৷ হয় মালাবদল৷ আর বাসি বিয়েতে দেবদেবীর অর্চনা শেষে কনের কপালে সিঁদুর দেয় বর৷ তারপর উভয় মিলে সাতবার অগ্নি দেবতাকে প্রদক্ষিণ করেন৷
ছবি: DW/U. Fatima
খ্রিষ্টান বিয়ে
বিয়ের তিন সপ্তাহ আগে পুরোহিতের কাছে বর-কনে নাম লেখান৷ এরপর ‘বান প্রকাশ’ অনুষ্ঠানে বিয়ের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়৷ বিয়ের আগ পর্যন্ত অপশক্তির নজর থেকে রক্ষার জন্য দুজনকে ‘রোজারি মালা’ পরতে হয়৷ বিয়ের দিন ভোরে কনের বাড়ি গিয়ে তাঁকে নিয়ে আসা হয়৷ এসময় বরপক্ষ থেকে দেয়া পয়সা ঘরের মধ্যে ছুড়ে দেন কনে৷ এর অর্থ, বাড়ি ছেড়ে গেলেও, বাড়ির লক্ষী ঘর থেকে চলে যাচ্ছে না৷ এরপর গির্জায় বর-কনে দু’জনের মধ্যে আংটিবদল করা হয়৷
ছবি: Getty Images/J.Moore
বৌদ্ধ বিয়ে
পাত্র-পাত্রী নির্বাচনের পর সামাজিকভাবে সবাইকে জানিয়ে তারিখ ঠিক করে বৌদ্ধবিহারে পাত্র-পাত্রীকে নিয়ে যাওয়া হয়৷ সেখানে মঙ্গল প্রদীপ জ্বালিয়ে বুদ্ধের পূজা করা হয়৷ ত্রি-স্বরণ পঞ্চশীল পূজার মধ্য দিয়ে বৌদ্ধ ভিক্ষুকের আশীর্বাদ গ্রহণের মাধ্যমে বিয়ে সম্পন্ন হয়৷ এরপর একজন গৃহী তাঁদের সামাজিক অনুশাসন প্রদান করে৷
ছবি: dapd
ঢাকাইয়া বিয়ে
‘পানচিনি’ অনুষ্ঠানে ঘটকের মাধ্যমে দুই পক্ষের মধ্যে প্রাথমিক আলোচনার পর ‘মোতাসা-রাই’ বা ‘পাকাকথা’ অনুষ্ঠানে বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করা হয়৷ বিয়ে অনুষ্ঠানের কয়েকদিন আগে দুই বাড়িতে আলাদাভাবে ‘হলদি’ বা ‘তেলাই’ অনুষ্ঠান হয়৷ এরপর অবিবাহিত অবস্থায় নিজের বাড়িতে বর বা কনের শেষ খাওয়া হিসেবে দুই বাড়িতে ‘আইবুড় ভাত’ নামের অনুষ্ঠান হয়৷ এরপর হয় মূল বিয়ের অনুষ্ঠান৷
ছবি: picture-alliance/dpa/N.Islam
চট্টগ্রাম অঞ্চলের বিয়ে
চট্টগ্রামের বিয়ে সাধারণত বেশ আড়ম্বরপূর্ণ হয়৷ বিয়ের প্রাথমিক কার্যকলাপ অন্যান্য অঞ্চলের মতোই সম্পন্ন হয়৷ তবে বিয়ের আগে আয়োজন করা হয় ‘বউ জোড়নি’ অনুষ্ঠান৷ বর ও কনের মধ্যে আলাপ করিয়ে দেয়াই এর মূল লক্ষ্য৷ চট্টগ্রামের আরেকটি বিচিত্র আয়োজন হচ্ছে ‘ঘরজামাই বিয়া’৷
ছবি: STR/AFP/Getty Images
রাজশাহী অঞ্চলের বিয়ে
এই অঞ্চলের বিয়েতে থাকে পিঠার জয়জয়কার৷ বিয়ের কথাবার্তা ঠিক হওয়ার পর আঞ্চলিক গীতের তালে তালে বর-কনেকে নিজ নিজ বাড়িতে মিষ্টিমুখ করানো হয়৷ এই অনুষ্ঠানকে বলা হয় ‘থুবড়া’৷ সাধারণত ক্ষীর ও আন্ধাষা (তেলে ভাজা রাজশাহীর ঐতিহ্যবাহী মিষ্টি পিঠাবিশেষ) তৈরি করা হয়৷ এই মিষ্টি সাধারণত পাড়া-প্রতিবেশীর বাড়ি থেকে তৈরি করে পাঠানো হয় বর-কনের বাড়িতে৷
ছবি: Getty Images/A. Joyce
শেষ কথা
এতক্ষণ রীতির কথা বলা হলো৷ কিন্তু সব মানুষের পক্ষে সব নিয়ম পালন করা সম্ভব হয় না৷ কারণ তাঁদের সেই সামর্থ্য থাকে না৷ আবার এর উলটোটাও ঘটে৷ যাঁদের অনেক সামর্থ্য আছে, তাঁরা রীতির বাইরেও জাঁকজমকভাবে বিয়ের অনুষ্ঠান করে থাকেন৷
ছবি: Getty Images/A. Joyce
8 ছবি1 | 8
বাংলাদেশের ঢাকাসহ বড় বড় শহরে এখন বিয়ের অনুষ্ঠানেকে ঘিরে নানা ধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে৷ এই যেমন ‘ওয়েডিং প্ল্যানার'-এর ব্যবসা দারুণ জমাজমাট৷ তাদের কাজ হচ্ছে, একটি নির্ধারিত বাজেটে বিয়ের গায়ে হলুদ, রিসেপশন এবং বিয়ের পর যেসব অনুষ্ঠার থাকে – তার পরিকল্পনা এবং তা বস্তবায়ন৷
‘ওয়েডিং সলিউশন' নামে একটি প্রতিষ্ঠানের প্রধন নির্বাহি কর্মকর্তা (সিইও) হুসাইন এ এইচ আসিফ ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘আমরা বিয়ের আমন্ত্রণ-পত্র থেকে হানিমুন – সবকিছুরই আয়োজন করি৷ বিয়ের খাবার, ডান্স, ডিজে, গায়ে হলুদ, পোশাক, শাড়ি – কিছুই বাদ যায় না৷ এর বিনিময়ে আমরা মোট খরচের ওপর শতকরা ১০ থেকে ১৫ ভাগ সার্ভিস চার্জ নিই৷''
হুসাইন এ এইচ আসিফ
ঢাকায় এখন এমন অনন্ত ২০টি ‘ওয়েডিং প্ল্যানার' প্রতিষ্ঠান আছে৷ তাদের কয়েকটির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সাধারণ মানের বিয়েতে এখন সব মিলিয়ে ১০ লাখ টাকা খরচ হয়৷ আর কোনো কোনো বড় বাজেটের বিয়ের খরচ এক কোটি থেকে দেড়কোটি ঢাকা৷
হলুদের অনুষ্ঠানও আজকাল বিয়ের অনুষ্ঠানের মতোই জমকালো আয়োজনে করা হয়৷ বিয়েতে হাতি- ঘোড়া-পাল্কি ছাড়াও থাকে হেলিকপ্টারের চাহিদা৷ ডিজে পার্টিতে তারকা শিল্পীদের আনেন কেউ কেউ৷ আসিফ বলেন, ‘‘আমরা পাকিস্তান ও ভারত থেকে চাহিদা অনুযায়ী শিল্পীদের নিয়ে আসি৷ বিয়ের অনুষ্ঠান অনেকসময় লাইভ সম্প্রচারও হয়৷ আমারা আমাদের নিজস্ব ওয়েবসাইট বা ফেসবুকে এটা করে থাকি, যাতে স্বজনদের যাঁরা বিয়ের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পারছেন না তাঁরা দেখতে পারেন৷''
তিনি জানান, ‘‘বিয়েতে এখন গান, কাওয়ালিসহ নানা আয়োজন থাকে৷ থাকে নানা ধরনের কর্নার৷ গ্রাহকদের চাহিদামতো আমরা ব্যবস্থা করে দিই৷ এছাড়া বিয়ের স্টেজ সাজানোতেও এসছে নতুনত্ব৷ বিয়ের গাড়ি সাজানো এবং বরযাত্রী – সবকিছুই হয় প্ল্যানিং-এর মাধ্যমে৷ এমনকি বর-কনের পোশাকও আমরা পরিকল্পনা করি৷ ঠিক করি খাবারের মেনু৷ ‘ওয়ানস্টপ সার্ভিস' বলতে যা বোঝাই, এটা ঠিক তাই৷''
‘মিডিয়া ম্যানেজার' নামে আরেকটি প্রতিষ্ঠান থেকে জানা যায়, ‘‘চার-পাঁচ লাখ টাকার মধ্যে যেসব বিয়ে হয়, তাঁরা সেটা নিজেরাই আয়োজন করেন৷ ‘ওয়েডিং ম্যানেজার' দিয়ে করাতে হলে ১০ লাখ টাকার নীচে হয় না৷ আর সেক্ষেত্রে এক থেকে দেড় লাখ টাকা দিতে হয় ওয়েডিং ম্যানেজারদের৷''
লাভ ম্যারেজ বা প্রেম করে বিয়ে কেন করবেন
সম্মন্ধ করে বিয়ে ভালো নাকি প্রেমের বিয়েতেই বেশি সুখ? এ নিয়ে নানাজনের নানা মত রয়েছে৷ তবে আজকের যুগে বিয়ে করার আগে হবু স্বামী বা স্ত্রী কেন পূর্ব পরিচিত হওয়া দরকার বা প্রেম করে বিয়ে করার সুবিধাগুলো কী জেনে নিন৷
ছবি: Fotolia/Maridav
পছন্দ বা ভালো লাগা
বিয়ে শুধু দু’টি মানুষের মধ্যে নয়, দু’টি পরিবারের মধ্যেও নতুন সম্পর্কের সূচনা করে৷ তাই নব দম্পতির অনেকটা সময় চলে যায় পরিবারের লোকজনের সঙ্গে পরিচিত হতে৷ নিজেদের পছন্দ-অপছন্দের খবর নেয়ার তেমন সুযোগ পান না তাঁরা৷ ফলে দু’জনের মধ্যে মনোমালিন্যের সৃষ্টি হতে পারে৷ কিন্তু বিয়ের আগে প্রেম বা বন্ধুত্ব থাকলে ভুল বোঝাবুঝির সুযোগ থাকে কম, দাম্পত্যজীবনও হয় মধুময়৷ আর পরবর্তীতে উপহার নির্বাচনেও অসুবিধা হয় না৷
ছবি: picture alliance/blickwinkel/McPHOTO
একে অপরের প্রতি বিশ্বাস
স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের মূল ভিত হলো বিশ্বাস৷ বিশ্বাস ছাড়া কখনো সংসার টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়৷ আর বিয়ের আগে, অর্থাৎ মন দেয়া-নেয়ার সময় একে-অপরের প্রতি বিশ্বাসের প্রমাণ দেওয়া বা পাওয়ারও যথেষ্ট সুযোগ থাকে৷ সুযোগ থাকে অন্যজনের ভালো লাগা-মন্দ লাগা, চিন্তা-ভাবনা সম্পর্কে জানারও৷
ছবি: AV/Fotolia
ভুল-ক্রুটি বা দূর্বলতা
প্রতিটি মানুষই ভুল করে৷ প্রত্যেকের মধ্যেই থাকে নানা ক্রুটি বা দূর্বলতা৷ কিন্তু বিয়ের পরে, হঠাৎ করে এ সব জানার পর অনেক দম্পতির মধ্যেই হতাশার জন্ম নেয়৷ কেউ-ই ‘পারফেক্ট’ নয় – কথাটা যেমন ঠিক, তেমনই বিয়ের আগে এ সমস্ত কথা জানা থাকলে একে-অপরের ক্রুটিগুলো মেনে নেওয়া সহজ হয় বৈকি!
ছবি: Fotolia/ArTo
ভুল বোঝাবুঝির সুযোগ নেই
আজকের যুগের বিয়ের পর অনেক দম্পতির ভেতর তাদের পুরনো প্রেম নিয়ে ঝগড়া-বিবাদ লেগে থাকে৷ কিন্তু প্রেম করে বিয়ে করলে এর কোনো সুযোগ থাকে না৷ বরং স্বামী-স্ত্রীর বুন্ধদের মধ্যে অনেকেই পূর্ব পরিচিত বা ‘কমন ফ্রেন্ড’ হওয়ায় আধুনিক জীবনযাপন আরো সহজ হয়৷
ছবি: picture alliance/Arco Images GmbH
পারিবারিক কলহ এড়াতে...
বিয়ের পর দুই পরিবারের মধ্যে যৌতুকের মতো নানা কারণে যে কলহ বা ভুল বোঝাবুঝি হয়, তা এড়ানো সম্ভব যদি আগে থেকেই ছেলে-মেয়ের মধ্যে বন্ধুত্ব বা প্রেম থাকে৷ কারণ প্রেম করে বিয়ে হলে পরিবারের বড়রা সাধারণত এ সব ব্যাপারে চুপ করে থাকাটাই শ্রেয় বলে মনে করেন৷
ছবি: Fotolia/Sven_Vietense
বিশেষজ্ঞের মত
জার্মানি বা ইউরোপের দেশগুলোতে সাধারণত ভালোভাবে পরিচয়ের পরই মানুষ বিয়ে করে বা অনেকে না করেও একসাথে বসবাস করে৷ তবে বিয়ের আগে একে-অপরের পছন্দ-অপছন্দ, সখ, ইচ্ছে – এ সব খুব ভালো করে জেনে নিয়ে তবেই সারা জীবন একসাথে থাকার প্রতিশ্রুতি দেওয়া বা বিয়ের মতো বড় সিদ্ধান্তটি নেওয়া উচিত বলে মনে করেন জার্মানির পারিবারিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ ব্যার্নহার্ড ভল্ফ৷
ছবি: Fotolia/Maridav
6 ছবি1 | 6
ওয়েডিং সলিউশন-এর আসিফ জানান, ‘‘এক কোটি থেকে দেড়কোটি টাকা খরচের বিয়ের আয়োজনও আমরা করি৷ মন্ত্রীদের পুত্র-কন্যা এবং বেশ কিছু কর্পোরেট ক্লায়েন্ট আছেন, যাঁরা বিয়েতে কোটি টাকার নীচে খরচ করেন না৷ সাধারণ বিয়েতে কম-বেশি ৩০০ অতিথি হলেও ওই ধরনের জমকালো বিয়েতে হাজারেরও বেশি অতিথি থাকেন৷ এমনকি পাঁচ হাজার অতিথির বিয়েও আমরা আয়োজন করেছি৷''
ঢাকায় বসবাসরত ফাতেমা আবেদিন নাজলা তাঁর অভিজ্ঞাতার আলোকে ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘এখন অনেক বিয়েতে খরচ কমানোর জন্য বর ও কনের পরিবার মিলে একটি যৌথ অনুষ্ঠানের করেন৷ তাতে খরচ কম পড়ে৷ তবে বিলাসী আয়োজন থাকে, সেখানে খরচের কোনো হিসেব নেই৷''
তিনি সম্প্রতি একটি বিবাহ অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে বলেন, ‘‘চারদিন ধরে ওই বিবাহ অনুষ্ঠানে হাতি-ঘোড়া থেকে বানর নাচ সবই ছিল৷ মূল বিয়ের অনুষ্ঠানের মতো হলুদের অনুষ্ঠানও ছিল জমকালো৷''
ফাতেমা আবেদিন নাজলা
তিনি জানান, ‘‘উচ্চবিত্তদের বিয়ের অনুষ্ঠানে গয়না, সাজপোশাক সব কিছুতেই ব্র্যান্ডের প্রশ্ন ওঠে৷ সেখানে টাকা বিষয়টি গৌণ, কী চাই তাই মুখ্য৷ তারা বিয়ের ফটোগ্রাফির জন্যই লাখ টাকার উপরে খরচ করেন৷ আর পার্লারে কনের সাজ কমপক্ষে ৬০ হাজার টাকা৷''
তাঁর মতে, ‘‘নগরবাসীর ব্যস্ততার কারণে এখন অনেকেই ওয়েডিং ম্যানেজারদের বিয়ের অনুষ্ঠানের দায়িত্ব দিয়ে দেন৷ এত সময় বাঁচে, ঝামেলাও এড়ানো যায়৷ কিন্তু চার-পাঁচ লাখ টাকার মধ্যে বিয়ের আয়োজন যাঁরা করেন, তাঁদের জন্য ওয়েডিং ম্যানেজারকে দায়িত্ব দেয়া কঠিন৷''
ওয়েডিং ম্যানেজার মাইনুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘ঢাকার বিয়েতে হেলিকপ্টারের চাহিদাও বেশ৷ তাই এখন অনেক প্রাইভেট এভিয়েশন কোম্পানি ঘণ্টায় ৮০ হাজার থেকে এক লাখ টাকায় হেলিকপ্টার ভাড়া দেয়৷ বর আসেন হেলিকপ্টারে বা কনেকে নিয়ে বাড়ি যাওয়া হয় এতে৷ অলরাউন্ডার ক্রিকেটার সাকিব আল-হাসান বিয়ের পর তাঁর স্ত্রী শিশিরকে নিয়ে হেলিকপ্টারে গ্রামের বাড়ি গিয়েছিলেন৷''
ওয়েডিং সলিউশন-এর আসিফ জানান, চলতি বছরেই দু'টি বিয়েতে তারা হেলিকপ্টার দিয়েছেন৷ দেশের বাইরে থেকে শিল্পীও এনে দিয়েছেন৷ এই দু'টি বিয়ের প্রতিটিতে দুই কোটি টাকার মতো খরচ হয়েছে৷ তবে টাকা থাকলেই যে সবাই খরচ করেন, তা নয়৷ এটা অনেকে করেন শখ করে৷
বিয়ের দেনমোহর নিয়েও আছে অর্থের হেরফের৷ বিবাহ রেজিস্টার মাওলানা আশরাফ উদ্দিন ভুঁইয়া ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘সর্বনিম্ন ১০ হাজার টাকা থেকে শুরু করে দেড়-দু'কোটি টাকাও দেনমোহর ধার্য করা হয়৷ আমি ৫০ লাখ টাকা দেনমোহরের বিয়ে পড়িয়েছি৷''
মাওলানা আশরাফ উদ্দিন ভুঁইয়া
তিনি জানান, ‘‘যত টাকা দেনমোহর ধরা হয়, তার প্রতি লাখে ১২৫০ টাকা হিসেবে ট্যাক্স বা কর দিতে হয়৷ তবে চার লাখ টাকার উপরে হলে লাখে ১০০ টাকা৷''
এই দেনমোহর আদায় হয় কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘এটা যার যার ব্যাপার৷ তবে আদায় করা বাধ্যতামূলক৷''
তিনি আরো জানান, ‘‘যাঁরা বিত্তবান, তাঁরা বেশি টাকার দেনমোহরকে সামাজিক মর্যাদার বিষয় বলে মনে করেন৷''
এদিকে বিয়ের যে খরচ, তার মধ্যে গয়নার খরচকে সাধারণত ধরা হয় না৷ এটা যে যেমন দেয়৷ নাজলা জানান, ‘‘এখন সাধারণ বিয়েতেও দু-তিন লাখ টাকা খরচ হয় শুধু গয়নাতেই৷ কারণ সোনার ভরি এখন প্রায় ৫০ হাজার টাকা৷ একটা বিয়েতে ছয় ভরি সোনার অলঙ্কার স্বাভাবিক৷ আর বিত্তবানরা তো অনেক বেশি খরচ করেন এই খাতে৷''
ওয়েডিং ম্যানেজারদের কথায়, বিয়ের অনুষ্ঠানে একটি শ্রেণির মধ্যে এখন প্রতিযোগিতা দেখা যায়৷ কে কত খরচ করল, কত বেশি আয়োজন করল, কত লোক খাওয়ালো৷ আবার কেউ কেউ আছেন একমাত্র ছেলে বা মেয়ের বিয়ে বলে খরচের দিকে তাকান না৷ তাই কেউ হেলিকপ্টার চড়ে ধানমন্ডি থেকে বসুন্ধরা কনভেনশন সেন্টারে যান বর বা কনেকে নিয়ে৷ আবার একই হেলিকপ্টারে ফেরেন, যাতে সময় লাগে পাঁচ মিনিট৷
এ বিষয়ে আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচে, মন্তব্যের ঘরে৷
বিভিন্ন দেশের বিয়ে
বিয়ের রীতি একেক দেশে একেক রকম৷ আবার ধর্ম, গোত্র অনুসারেও বিয়ের নিয়মকানুন ঠিক হয়৷
ছবি: Jamonline
জার্মানি
প্রথমে কোর্টে ছোট্ট একটি আয়োজনের মাধ্যমে বিয়েটা সেরে ফেলেন বর-কনেরা৷ পরে অন্য এক সময়ে গির্জায় হয় বিয়ের অনুষ্ঠান৷ গির্জার অনুষ্ঠানের আগের রাতে কনের বাড়ির সামনে সেরামিকের বিভিন্ন জিনিস ভাঙেন বর-কনের পরিবারের সদস্যরা৷ এরপর সেটা পরিষ্কার করেন শুধু বর আর কনে৷ এর মাধ্যমে নবদম্পতিকে দলবদ্ধভাবে কাজ করার প্রয়োজনীয়তা বিষয়ে দীক্ষা দেয়া হয়৷
ছবি: DW
টিউনিশিয়া
কনের এই পোশাকটির নাম ‘কিসওয়া’৷ হীরা আর মুক্তা দিয়ে সাজানো বিয়ের এই পোশাকটি ব্যয়বহুল হওয়ায় অনেকেই সেটা একদিনের জন্য ধার করে৷ শুধু এক রাতের জন্য ভাড়া হিসেবে দিতে হয় ২৫ হাজার থেকে এক লক্ষ টাকা পর্যন্ত!
ছবি: picture-alliance / dpa/dpaweb
দক্ষিণ কোরিয়া
দক্ষিণ কোরিয়ায় বিয়ের ক্ষেত্রে এখনও প্রচলিত নিয়মগুলো পালন করা হলেও তরুণরা ইদানীং পশ্চিমা ধাঁচের দিকে ঝুঁকছে৷ সে অনুযায়ী তরুণীরা সাদা গাউন আর তরুণরা কালো জ্যাকেট পরে বিয়ে করছেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
ইথিওপিয়া
বরের পক্ষ থেকে সম্ভাব্য কনের পরিবারের কাছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠানো হয়৷ আর বিয়ের দিন বর তিন চারজন সঙ্গীকে নিয়ে গান গাইতে গাইতে কনের বাড়ি যান৷
ছবি: DW/Yohannes Gegziabher
ভারত
এটি কলকাতার একটি গণবিয়ের অনুষ্ঠানের দৃশ্য৷ বিভিন্ন সামাজিক সংস্থা এভাবে গরিব মানুষদের জন্য বিয়ের আয়োজন করে থাকে৷ কেননা ভারতে নিয়ম মেনে বিয়ে করাটা ব্যয়বহুল – যা অনেকের পক্ষেই জোগাড় করা সম্ভব হয়না৷
ছবি: DW/P.M.Tewari
ইরান
ছবিটি ইরানের হলেও এটি আসলে সেখানকার সংখ্যালঘু গোষ্ঠী ‘তুর্কমেন’-দের একটি বিয়ের অনুষ্ঠান৷ সংখ্যালঘু হওয়ায় তুর্কমেনদের ভাষা ও সংস্কৃতি খোদ ইরানিদের কাছে ততটা পরিচিত নয়৷ তিন-চারদিন ধরে তাদের বিয়ের অনুষ্ঠান হয়৷