সিদ্দিক বাজারে ভবন বিস্ফোরণের তীব্রতা ও হতাহতে বিস্মিত ও হতভম্ব হয়ে পড়েছেন বিশ্লেষকেরা। তার বলছেন ঢাকা শহরে পর পর দুইটি একই ধরনের ভবন বিষ্ফোরণের ঘটনা রাজধানীতে নতুন দুর্যোগের আভাস দিচ্ছে।
বিজ্ঞাপন
বিশ্লেষকেরা বলছেন, ঢাকা শহরের শহরের ভবনগুলো যেন এখন টাইম বোমায় রূপান্তরিত হয়েছে। সব অনিয়ম এখন পুঞ্জিভূত হয়ে একটার পর একটা বিপর্যয় ঘটছে। এখন সামনে এসেছে গ্যাস, স্যুয়ারেজ এমনকি ওসাসার পানির লাইন বিষ্ফোলন ইস্যু। এধরনে ঘটনা আরো ঘটবে বলে তাদের আশঙ্কা।
সিদ্দিক বাজারের মঙ্গলবারের ঘটনায় এপর্যন্ত ২০ জন নিহত হয়েছেন, আহত একশতের বেশি।
এরইমধ্যে সেনাবাহিনিসহ সরকারের বিভিন্ন বাহিনির বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ দল ঘটনাস্থল পরিদর্শণ করো কোনো নাশকতামূলক বিস্ফোরক বা বিস্ফোরণের আলামত পায়নি। তবে ধারণা করা হচ্ছে গ্যাস লাইনের লিকেজ থেকে বেসমেন্টে গ্যাস জমে এই বিষ্ফোরণের ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। ফায়ার সার্ভিসের সাবেক মহাপরিচালক আলি আহমদ খান বুধবার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে ডয়চে ভেলেকে বলেন, "সব কিছু দেখে, শুনে আমার মনে হয়েছে এটা গ্যাসেরই বিস্ফোরণ। ওখানে অনেক গুলো গ্যাস লাইন আছে। একটি লাইন থেকে আরো লাইন নেয়া হয়েছে অবৈধভাবে। লাইনগুলো অনেক পুরাতন। ওখান থেকে বের হওয়া গ্যাস জমে এই বিস্ফোরণ হয়েছে। সামান্য কোনো স্পার্ক বা দাহ্য আগুন এই বিস্ফোরণ ঘটাতে সহায়তা করেছে হয়তো।”
‘পুরাতন লাইনগুলোয় গ্যাস জমে এই বিস্ফোরণ হয়েছে’
তিনি বলেন,"নারায়ণগঞ্জে মসজিদে এবং মগবাজারে একইভাবে বিস্ফোরণ ঘটেছিলো। বাতাসে শতকরা ৫ ভাগ থেকে ১৭ ভাগ গ্যাস থাকলেই বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। আর এর তীব্রতা নির্ভর করে যেখানে বিস্ফোরণ হয় সেই জায়গাটি কতটা বদ্ধ তার ওপর। সিদ্দিকবাজারে বেজমেন্টে বিস্ফোরণ তীব্রতা বাড়িয়েছে। খোলা থাকলে গ্যাস জমতে পারতো না। বের হয়ে যেত।''
তিনি বলেন," আমার অভিজ্ঞতা বলছে এধরনের ঘটনা আরো ঘটবে। কারণ অনেক ভবন আছে যেখানে অনিয়ন্ত্রিত গ্যাস লাইন আছে।”
ভয়াবহ বিস্ফোরণে তারা বিস্মিত:
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত রসায়ন ও কেমিকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. এম নুরুল আমিন বলেন,"স্যুয়ারেজের লাইন থেকে মিথেন গ্যাস জমেও এধরনের বিস্ফোণের ঘটনা ঘটতে পারে। তবে সিদ্দিক বাজারের ঘটনায় সেটা হয়নি। কারণ যেখানে বিস্ফোরণ ঘটেছে সেখানে স্যুয়ারেজের লাইন থেকে গ্যাস আসার সুযোগ নেই। সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকার ভবনে হয়তো হতে পারে। তবে দুইটি ঘটনায়ই বিষ্ফোরণের যে ভয়াবহতা তা আমাকে অবাক করেছে। তাই গভীর তদন্ত হওয়া প্রয়োজন যে আরো কোনো ইস্যু এইসব ঘটনায় আছে কী না।”
তিনি বলেন, "আমরা সীতকুন্ডে দেখেছি, ওখানে আরো সিলিন্ডার ছিলো। ফলে ওগুলোও বিষ্ফোরিত হয়ে বিষ্ফোরণের তীব্রতা বেড়েছে। এখানে বিষ্ফোরণের তীব্রতায় আমি বিস্মতি হয়েছি। তাই দেখা প্রয়োজন তীব্রতা বাড়াতে আর কোনো উপাদান কাজ করেছে কী না।”
কেন এত তীব্র বিস্ফোরণ:
বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের (বিসিএসআইআর)-পরিচালক ড. রেজাউল করিম বলেন,"বিষ্ফোরণের তীব্রতার কারণ হলো বিস্ফোরণটি বদ্ধ জায়গায় ঘটেছে। খোলামেলা জায়গায় হলে এতটা তীব্র হতো না। আমাদের অনেক মার্কেট এবং ভবন আছে যেগুলো বদ্ধ। ঠিক মতো আলো বাতাস যায়না, ঘিঞ্জি। ফলে আতঙ্কের কারণ আছে।”
ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে ঘেরা ঢাকা শহর
রাজধানীতে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের সংখ্যা বাড়ছে বলে মনে করছেন নগর পরিকল্পনাবিদ ও বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, ঢাকা শহরের ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের সুনির্দিষ্ট তালিকা কখনোই তৈরি হয়নি।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
ভাঙা হচ্ছে না অতি ঝুঁকিপূর্ণ মার্কেট
সাতটি বিশাল মার্কেট ভবনকে প্রায় সাত বছর আগে অতি ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করেছিল বুয়েট, নানা কারণ দেখিয়ে আজ পর্যন্ত তা ভাঙা হয়নি। ভবনগুলো হচ্ছে মোহাম্মদপুর টাউন হল মার্কেট, গুলশান-২ কাঁচা মার্কেট, গুলশান-১ পাকা মার্কেট, কাওরানবাজার কিচেন মার্কেট, কাওরানবাজার ১ এবং ২ নং ভবন মার্কেট, কাওরানবাজার আড়ৎ ভবন ও রায়েরবাজার মার্কেট। (ছবিটি গুলশান-১ ডিএনসিসি পাকা মার্কেটের)
ছবি: Mortuza Rashed/DW
ঐতিহ্যবাহী ‘নিলাম ঘর’ ভেঙে ফেলা হয়েছে
পুরান ঢাকার জজ কোর্টের পিছনের কোর্ট হাউজ স্ট্রিটের ২০০ বছরের পুরাতন ‘নিলাম ঘর’ গত বছর ভেঙে ফেলা হয়েছে। সেখানে তৈরি হচ্ছে ‘বঙ্গবন্ধু ভবন’ যা ঢাকা আইনজীবী সমিতির কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার কথা।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
শুধু চোখের হিসাব
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মেহেদি হাসান আনসারি বলেন, ‘২০০৯ সালের ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের জরিপের কারিগরি কমিটিতে আমি ছিলাম। তখন মাত্র ১০টা ভবনের কারিগরি দিকসহ সবকিছু খুঁটিয়ে দেখা হয়েছিল। বাকি ৪০০ থেকে ৫০০টি ভবন দেখা হয়েছিল সাধারণ পর্যবেক্ষণে চোখের অনুমানের ভিত্তিতে। তখন ঢাকায় ভবনের সংখ্যা ছিল তিন লাখ ২৬ হাজার। ঢাকায় কোথায় কত ঝুঁকিপূর্ণ ভবন অবস্থিত, তা মন্ত্রণালয় আদৌ বলতে পারবে না।‘
ছবি: Mortuza Rashed/DW
‘আমরাও এমন ঝুঁকি নিয়ে বাস করতে চাই না’
পুরান ঢাকার কৈলাশ ঘোষ লেনে প্রায় ১৫০ বছরের পুরোনো ‘ইয়াং প্রেস’ ভবনে বংশানুক্রমে ৫০ বছর ধরে থাকছেন সাবিনা ইয়াসমিন। তিনি বলেন, ‘‘এখানে কোনো বাসা ভাড়া দিতে হয় না। তবে আমরাও এত ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করতে চাই না। সরকার যদি নামমাত্র মূল্যে আমাদের মতো গরিবদের থাকার একটা জায়গা দিত, এখানে আর থাকতাম না।’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
মতিঝিলে বহুতল ভবনে ফাটল
এ বছরের গত ৬ মার্চ ঢাকার মতিঝিলের ৫৩ নম্বর ভবনে ‘মডার্ন ম্যানশন’ নামের ১৫ তলাবিশিষ্ট একটি বাণিজ্যিক ভবনে ফাটল ধরা পড়ে। তবে ভবনটি কোনো দিকে হেলে পড়েনি। ভবন থেকে সকল অফিস ও বাসিন্দাদের অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হলেও গত সাত মাসে ভবনটি ভাঙা এখনো শুরু হয়নি।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
বাণী ভবন
পুরান ঢাকার পাতলা খান লেনে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হল ‘বাণী ভবন’ নামে পরিচিত। শতবর্ষ পুরোনো ঝুঁকিপূর্ণ এ ভবনে দশের বেশি পরিবার থাকে। আগে শিক্ষার্থীরা থাকলেও প্রায় ১৫ বছর প্রতিষ্ঠানটির কর্মীরা থাকছেন। ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় ভবনটির বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছে বলে জানান বাসিন্দারা।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
ব্যবসায়িক কাজ ঝুঁকিপূর্ণ ভবনেই
ঢাকার মহাখালী আমতলিতে ‘রহমান ভবন’ নামের একটি পাঁচ তলা ভবনও ঝুঁকিপূর্ণ। একতলায় মিষ্টি, চায়ের দোকানসহ একাধিক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান চলছে। সেখানে নোটিস দিয়ে বলা হয়েছে যে বিআরটিসি বুয়েট, কর্তৃক তদন্তে ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ এবং অবকাঠামোটি ভেঙে ফেলার প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
একটি ভবনও থাকবে না
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সাবেক চেয়ারম্যান আমিন উল্লাহ নুরী বলেন, ঘিঞ্জি এলাকা পুরান ঢাকাকে প্ল্যানে নিয়ে আসতে হলে কোনো ভবনের অস্তিত্ব থাকবে না, সব ভেঙে ফেলতে হবে। শুরুতে ঢাকায় কোনো পরিকল্পনা না থাকায় শত শত বছর ধরে এ জঞ্জাল তৈরি হয়েছে। তবে ঢাকা যত উন্নত হচ্ছে এসবও উন্নত হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ তিনি ধানমন্ডি, গুলশান, বনানী, ওয়ারির কথা বলেন।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
নেই পরিসংখ্যান ও সূচক
ঢাকায় ভবন ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করার প্রক্রিয়াও প্রশ্নবিদ্ধ, একাধিক কর্তৃপক্ষের তথ্যে রয়েছে বিস্তর অমিল। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় জানায়, ঢাকায় ৭২ হাজার ভবন ঝুঁকিপূর্ণ। ডিএসসিসি থেকে জানা যায়, ঢাকায় ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে ৫০০ ভবন চিহ্নিত হয়েছে। অন্যদিকে রাজউকের মতে ৩২১টি ভবনকে ঝুঁকিপূর্ণ বলা হয়েছে। ফায়ার সার্ভিসের এক জরিপে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের সংখ্যা বলা হয়েছে প্রায় ৫ হাজার।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
সরকারি ভবনে ছাদধস
গত ৩০ সেপ্টেম্বর ঢাকার কারওয়ান বাজারে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের অঞ্চল পাঁচের আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তার ২০১ নম্বর কক্ষের ছাদের একাংশ খসে পড়ে। এতে কেউ হতাহত না হলেও কর্মকর্তা-কর্মীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়েছে। উল্লেখ্য, ২০১৩ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ওই আড়ত ভবনকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
অনেক সমস্যা, অক্ষমতা ও অজুহাত
ঝুঁকিপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও পুরান ঢাকার ভবন মালিকরা আইনের ফাঁকফোকর গলিয়ে ভবনগুলোকে রেখে দিচ্ছেন। এ ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে মালিক ও ভাড়াটেরা বলেন, নতুন করে ভবন তারা গড়তে চান না। ভাড়াটিয়ারা বলেন, মানুষের জীবন মালিকদের কাছে তুচ্ছ, বরং টাকাটাই মুখ্য। ভবন মালিক রমজান আলী জানান, একটি ভবন আরেকটির সঙ্গে গাঁ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। একটি ভবন ভেঙে সেটা ফের বানাতে গেলে নতুন বিপত্তি হবে। তাছাড়া এত অর্থও নেই।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
‘ওয়াহেদ ম্যানশন’ এখন নিরাপদ
পুরান ঢাকার চুড়িহাট্টার হাজী ওয়াহেদ ম্যানশনে ২০১৯ সালে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর ভবনটিকে অতি ঝুঁকিপূর্ণ বলেছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিভেন্স। সাম্প্রতিক সময়ে ভবনটি মেরামত করে সেখানে পুরোদমে ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যবসায়ী বলেন, ‘আমরা যতদূর জানি এটা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র পরিদর্শনে এসে শর্তসাপেক্ষে অনুমতি দিয়েছেন। দোতলায় ব্যাংক ভাড়া হওয়ার পর নিরাপদ ভেবে এসেছি।‘
ছবি: Mortuza Rashed/DW
অনুমোদন এক, বাস্তবে আরেক
২০১৯ সালের ২৮ মার্চ বনানীর ২২ তলা ভবন এফআর টাওয়ারে আগুন লেগে ২৬ জনের মৃত্যু হয়। সেই ভবন থেকে বেরোনোর জন্য কোনো আপৎকালীন রাস্তা ছিল না। এই দুর্ঘটনার পর আরেকটি গুরুতর বিষয় সামনে আসে। ভবনটি নিয়ে সবচেয়ে বড় অভিযোগ হলো নকশা লঙ্ঘন করে রাজউক থেকে ১৮ তলার নকশার অনুমোদন নিয়ে ২৩ তলা করা হয়। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জানায়, ঢাকায় এমন নকশা লঙ্ঘন করা ভবনের অভাব নেই।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
প্রশ্নবিদ্ধ সরকারের উদ্যোগ
ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলোতে দুর্ঘটনা ঘটার পর বেড়ে যায় সরকারের তৎপরতা, গঠিত হয় তদন্ত কমিটি। তদন্তের পর চলে তদন্ত, রিপোর্টও আসে কিন্তু সেসব কার্যকর হয় না। চকবাজারের নিমতলি, চুড়িহাট্টা, বনানী, হাশেম ফুডসে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পরে তদন্ত হলেও সমস্যা সমাধানে কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। মিডিয়া থেকেও ধীরে ধীরে থেমে গিয়েছে আলোচনা সমালোচনা। ফলে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
আরেকটি বড় ভূকম্পনের আশঙ্কা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ুন আক্তার বলেন, সাধারণত প্রতি ১০০ বছর পর বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়ে থাকে। ১৮২২ ও ১৯১৮ সালে মধুপুর ফল্টে বড় ভূমিকম্প হয়েছিল। ভূমিকম্পে সবচেয়ে ঝুঁকি রয়েছে ঢাকার। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচি (সিডিএমপি) ও জাইকার যৌথ জরিপে জানা গেছে, ঢাকায় সাত বা তার বেশি মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হলে, শহরের ৭২ হাজার ভবন ভেঙে পড়বে।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
দরকার একযোগে পদক্ষেপ
বিশেষজ্ঞরা বলেন, প্রতিটি ভবন পরীক্ষা করা ছাড়া ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করার উপায় নেই। ভবনের বিভিন্ন সূচক নির্ধারণ করে সরকারের কয়েকটি বিভাগকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। পুরান ঢাকাকে শৃঙ্খলায় আনার প্রসঙ্গে রাজউক চেয়ারম্যান বলেন, ডিএসসিসিকে সঙ্গে নিয়ে আমাদের প্রথম কাজ, ভবনের পাশের রাস্তাগুলো বড় করা, সেটব্যাক ভেঙে ফেলা এবং যথাসম্ভব ঐতিহ্যবাহী ভবন রক্ষা করা। তবে লোকবলের অভাবে আমাদের কাজ ব্যাহত হয়।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
16 ছবি1 | 16
ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (ডুয়েট) কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. হাসান মোহাম্মদ মোস্তফা আফরোজ বলেন, "তিন কারণে সেখানে বিস্ফোরণ হতে পারে। প্রথমত স্যুয়ারেজ লাইন লিক করে গ্যাস যখন ভবনের মধ্যে বদ্ধ জায়গায় জমতে থাকে তখন সেখান থেকে বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। স্যুয়ারেজের গ্যাসের মধ্যে মিথেন ও হাইড্রোজেন সালফায়েড উভয়ই থাকে। এই দুটো গ্যাসে আগুন ধরে যায়। এটা হতে পারে যখন বাসার ওয়াশরুমের কমোড বা বেসিনটা অনেক দিন ধরে ব্যবহার হচ্ছে না, তখন এটা ফ্ল্যাশ না হওয়ায় পাইপের মধ্যে পানি যাচ্ছে না। এর ফলে গ্যাস জমা হতে পারে। এভাবে কোনো ফ্লোরে বা কক্ষে অনেক দিন ধরে গ্যাস জমা হতে থাকলে বিস্ফোরণ হতে পারে। আর তিতাস গ্যাসের লাইনে যদি লিকেজ থাকে তাহলেও গ্যাস জমে আগুন ধরে যেতে পারে বা গ্যাসের পরিমাণ বেশি জমলে বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। মোট বাতাসের শতকরা পাঁচ ভাগ গ্যাস হলেই বিষ্ফোরণ ঘটবে বা আগুন জ¦লবে। আমার মনে হয় সিদ্দিক বাজারের ভবনটির বেজমেন্টে অনেক বেশি গ্যাস জমেছিলো। তাই এত ভয়াবহ আকারে বিস্ফেরণ হয়েছে। আর সাধারণভাবে গ্যাস লিকেজের কারণে যেসব দুর্ঘটনা ঘটে এতে ভয়বহতা বেশি ছড়ায়। আর এসি থেকেও বিস্ফোরণ হয়। তবে সাধারণ কোনো কারণে এসি বিস্ফোরণ ঘটে না। মেকানিক যখন এসি মেরামত করে তখন অনেক সময় লিকেজ থেকে যায়। ওই লিকেজ থেকে এসির বিস্ফোরণ ঘটে থাকে।”
ডেটলাইন নর্থ সাউথ রোড ১৮০/১
ঢাকার সিদ্দিকবাজারে নর্থ সাউথ রোডে ১৮০/১ নম্বর ভবনের বিস্ফোরণে এখন পর্যন্ত ২০ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে৷ কী ঘটেছিল সেখানে দেখুন ছবিঘরে...
ছবি: Mortuza Rashed/DW
‘ক্যাফে কুইন’ ভবন
বাংলাদেশে ডয়চে ভেলের কনটেন্ট পার্টনার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের তথ্য অনুযায়ী, সাত তলা ভবনের নিচের দুইটি ফ্লোরে ছিল স্যানিটারি সামগ্রীর দোকান ও গুদাম৷ ওপরের কয়েকটি তলা ছিল আবাসিক৷ তৃতীয় তলায় ছিল ‘ক্যাফে কুইন’ নামে একটি রেস্তোরাঁ৷ বেশ কয়েক বছর ধরে বন্ধ থাকলেও দালানটি ‘ক্যাফে কুইন ভবন’ নামেই পরিচিত৷ ভবনের মূল মালিক মারা গেছেন এক দশক আগে৷ তার চার ছেলের দুইজন ওই ভবনের থাকতেন বলে জানা গেছে৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
তিন তলা থেকে সাত
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম স্থানীয় বাসিন্দাদের বরাতে জানিয়েছে, ভবনটি চার দশক আগের তৈরি৷ শুরুতে তিন তলা থাকলেও পরে তা সাত তলায় পরিণত হয়৷ রাজউকের পরিচালক হামিদুর রহমান ভবনটি পরিদর্শনে গিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, “আজ অফিস বন্ধ। তাই ভবনটি বৈধ না অবৈধ, বা কখন অনুমতি নিয়েছে, তা জানা সম্ভব নয়৷”
ছবি: Mohammad Ponir Hossain/REUTERS
যেভাবে ঘটলো
মঙ্গলবার বিকালে কেনাবেচার ব্যস্ত সময়ে ভবনের নিচের অংশে বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে৷ নিচের দুইটি ফ্লোরের ছাদের একাংশ ধসে বেজমেন্টে পড়ে যায়৷ শুধু তাই নয় সামনের সড়কে যানবাহনের যাত্রী ও পথচারীরাও হতাহত হন৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
হতাহত
এই ঘটনায় এখন পর্যন্ত ২০ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে৷ দৈনিক প্রথম আলোর তথ্য অনুযায়ী, বুধবার বিকাল পৌনে পাঁচটার দিকে দুইজনের লাশ উদ্ধার করেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা৷ তবে আরো কেউ নিখোঁজ থাকতে পারেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে৷ নিখোঁজদের স্বজনেরা ভিড় করে আছেন ক্ষতিগ্রস্ত ভবনটির সামনে৷
ছবি: Mohammad Ponir Hossain/REUTERS
নিখোঁজের খোঁজে
বিস্ফোরণের ঘটনায় একটি দোকানের ব্যবস্থাপক মেহেদী হাসান স্বপন নিখোঁজ রয়েছেন৷ তার খোঁজে ভবনের সামনে অপেক্ষায় ভাই সোহাগ ও মামাশ্বশুর আবদুল মান্নান৷ মেহেদীর বাড়ি নোয়াখালী৷ এক ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী তিনি৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
উদ্ধারকাজ
ভবনের পিলারগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় বেজমেন্টে এখনও তল্লাশি চালাতে পারেননি উদ্ধারকর্মীরা৷ ভেতরে কেউ আটকা আছেন কি না, সেটি খুঁজে বের করতে ডগ স্কেয়াডের উপর ভরসা করা হচ্ছে৷ এজন্য র্যাবে পুলিশের কুকুরগুলোর সহায়তা নেয়া হচ্ছে৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
উপায় কী
ভেতরে অভিযান চালাতে রাজউক ও সেনাবাহিনীর পরামর্শের অপেক্ষায় থাকার কথা জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইনউদ্দিন৷ অন্যদিকে বেজমেন্টে অংশে উদ্ধার অভিযান চালাতে একটি ‘জাতীয় কমিটি’ গঠন করা হয়েছে বলে জানান পুলিশের লালবাগ বিভাগের উপ-কমিশনার মো. জাফর হোসেন।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
হাসপাতালে যারা
আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন অর্ধশতাধিক মানুষ৷ এখনও ২১ জন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এবং ১০ জন শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইন্সটিটিউটে ভর্তি রয়েছেন৷
ছবি: Mohammad Ponir Hossain/REUTERS
বিস্ফোরণের কারণ
ভবনটিতে বিস্ফোরণের কারণ সম্পর্কে এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি৷ ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দীন জানান, ‘‘প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে এটা নিছক দুর্ঘটনা৷’’ তিতাসের পরিচালক সেলিম মিয়া জানান, পাইপলাইনের গ্যাস বিস্ফোরণ এর কারণ নয়৷ র্যাবের বম্ব ডিসপোজাল ইউনিটের উপপরিচালক মেজর মশিউর রহমান বলেন, ‘‘আমরা এখানে নমুনা সংগ্রহ করেছি এবং সেগুলো পরীক্ষাগারে পাঠিয়েছি।’’
ছবি: Mohammad Ponir Hossain/REUTERS
এক সপ্তাহে তিন
সীতাকুণ্ডে অক্সিজেন কারখানা এবং ঢাকার মিরপুরে রোডে ভবনে বিস্ফোরণের পর এক সপ্তাহের মধ্যে তৃতীয় বিস্ফোরণে প্রাণহানি ঘটল৷ সবশেষ ঘটনায় ফায়ার সার্ভিস বাহিনীটির পরিচালক (অপারেশনস ও মেনটেইনেন্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরীকে প্রধান করে ৪ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে৷ কমিটিকে ৫ কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে৷
ছবি: Mohammad Ponir Hossain/REUTERS
উৎসুক মানুষ
ঘটনার পর থেকে বিস্ফোরিত ভবনের সামনে অনেক মানুষ জড়ো হন৷ মঙ্গলবার নর্থ সাউথ রোড ও আশেপাশের সড়কে স্থানীয়রা ভিড় করলে দীর্ঘ যানজট তৈরি হয়। এতে উদ্ধার কাজেও বেগ পেতে হয় ফায়ার সার্ভিসসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
ক্ষতিগ্রস্ত পাশের ভবন
বিস্ফোরণ হওয়া ভবনটির পাশে সাকি প্লাজা নামের পাঁচ তলা একটি ভবন রয়েছে৷ তার মধ্যে ওপরে চারটি ফ্লোরে ব্র্যাক ব্যাংকের গুলিস্থান শাখা এবং ব্র্যাক ব্যাংকের এসএমই সার্ভিস সেন্টার আছে৷ বিস্ফোরণের ধাক্কায় কাচ ভেঙে ব্যাংকের অফিস কক্ষগুলোর পর্দা ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়৷ ছবিতে ফায়ার সার্ভিসের এক কর্মীকে দেখা ভবনটি পরীক্ষা করতে৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
12 ছবি1 | 12
শহরে নতুন আতঙ্ক:
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, "এখন শহরে এই প্ল্যাম্বার্স বিস্ফোরণ নতুন আতঙ্ক তৈরি করেছে। ঢাকার শতকরা ৫৫ ভাগ ভবনই ঝুঁকির মধ্যে আছে। সেখানে না আছে অগ্নি নিরাপত্তা, না আছে এই ধরনের বিষ্ফোরণ ঠেকানোর কোনো ব্যবস্থা। শুধু তিতাসের লাইন কেন ওয়াসার লাইনেও গ্যাস জমে তা লিকেজ হয়ে বিষ্ফোরণ ঘটতে পারে। এজন্য রাজউক, তিতাস বা ওয়াসার কোনো দায়িত্ব আছে বলে মনে হয় না। আর নগারিকেরাও উদাসীন। একটি এ্যাপার্টমেন্টের ইলেট্রিক সিস্টেম যা তাতে হয়তো একটি এসি চালানো সম্ভব। কিন্তু চালানো হচ্ছে পাঁচটি। চাপ না নিতে পেরে বিদ্যুতের লাইন জ্বলে যায়, এসি বিস্ফোরণ ঘটে।”
আর বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মেহেদী আহমেদ আনসারী বলেন, "ঢাকার ভবনগুলো যেন এখন টাইম বোমায় পরিণত হয়েছে। যেকোনো ধরনের অপঘাত যেকোনো সময় হতে পারে। মাত্র ১০০ ভবনের অকুপেন্সি সার্টিফিকেট আছে। এটা বিশ্বাস করা যায়! সব ধরনের ব্যবস্থা সঠিক থাকলে এই সার্টিফিকেট দেয়া হয়। আর পাঁচ বছর পর পর তা আবার চেক করে নতুন করে নিতে হয়।
আসলে ভবনগুলো যাদের দেখার কথা তারা দেখছেন না। আমার মনে হয় প্রাইভেট সেক্টরকে এই দায়িত্ব দেয়া যায়।”