করোনাকালে আইসিইউতে চাপ পড়ায় বাংলাদেশের হাসপাতালগুলোতে আগুনের ঝুঁকি বেড়েছে৷ স্বাস্থ্য অধিদপ্তর দেশের সব হাসপাতাল ও ক্লিনিককে অগ্নি নির্বাপণের ব্যবস্থা করতে বললেও সেখানে আগুন লাগার ঝুঁকি কমার লক্ষণ নেই৷
এর বাইরে সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন স্থানের হাসপাতালগুলোতে আগুন লাগার ঘটনাও অনেক ঘটেছে৷ ঢাকা মেডিকেলে গত জানুয়ারি মাসেই আরেকবার আগুন লেগেছিল৷ ওই আগুন লেগেছিল পুরনো ভবনের আইসিইউতে৷
ফায়ার সার্ভিসের হিসেব অনুযায়ী গত বছর (২০২০) সারাদেশে মোট আগুনের ঘটনা ঘটেছে ২১ হাজার ৭৩টি৷ এর মধ্যে বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে আগুনের ঘটনা ঘটেছে ৯০ টি৷ তার আগের বছর, অর্থাৎ ২০১৯ সালে সারাদেশে আগুনের ঘটনা ছিল ২৪ হাজার৷ তারমধ্যে হাসপাতাল ও ক্লিনিকে আগুনের ঘটনা ছিল ৭৭৮টি৷ কিন্তু করোনার সময় আইসিইউতে আগুন লাগার ঘটনায় উদ্বেগ বেড়েছে৷
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. ফরিদ হোসেন জানান, ঢাকা মেডিকেলের আইসিইউতে সর্বশেষ আগুনের ঘটনা সামান্য একটা স্পার্ক থেকে৷ আর তা থেকে ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ে৷ তিনি বলেন, ‘‘আরো অনেকের প্রাণহানি হতে পারতো৷ কিন্তু আল্লাহর অশেষ রহমত দ্রুত রোগীদের সরিয়ে নেয়ায় প্রাণহানি কম হয়েছে৷’’
তিনি জানান, ‘‘করোনার সময়ে হাসপাতালের আইসিইউগুলোতে আগুনের ঝুঁকি বেড়ে গেছে৷ এর প্রধান কারণ লোড বেড়ে যাওয়া৷ আইসিইউতে হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা থাকায় সেখানে অক্সিজেনোর চাপ অনেক বেশি৷ তাই সামান্য একটি স্পার্ক হলেও আগুন ধরে যায়৷ ঢাকা মেডিকেলে তাই হয়েছে৷’’
তিনি বলেন, অনেক ক্ষেত্রে এখন রোগীডের লোড নেয়ার মতো ক্যাপাসিটি নাই৷ ইলেকট্রিক লাইনগুলোও লোড নিতে পারছে না৷ শর্ট সার্কিটের আশঙ্কা আছে৷ তবে হাসপাতালগুলোর এই অবস্থা নতুন নয়৷ ফায়ার সার্ভিসের হিসাব অনুযায়ী, ঢাকার ৪৪২টি হাসপাতালের মধ্যে ৪২২টি হাসপাতালই আগুন ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে৷ শতকরা হিসেবে এটা ৯৭.৫ ভাগ৷ এই হাসপাতালগুলোকে ফায়ার সার্ভিস নোটিশ দিলেও তেমন কাজ হয় না৷ এই তালিকায় ‘সাধারণ ঝুঁকিতে’ আছে ২৪৯টি এবং ‘খুবই ঝঁকিপূর্ণর’ তালিকায় রয়েছে ১৭৩টি৷ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ‘খুবই ঝঁকিপূর্ণ’ তালিকার একটি সরকারি হাসপাতাল৷ ঢাকা শহরের আরো ২০টির মতো বড় সরকারি হাসপাতাল আছে এই তালিকায়৷ ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ‘খুবই ঝঁকিপূর্ণ’ সোরাওয়ার্দী হাসপাতালেও আগুন লেগেছিল৷
ফায়ার সার্ভিসের ঢাকা বিভাগের সহকারী পরিচালক ছালেহ উদ্দিন বলেন, ‘‘আমরা প্রতিবছরই তাদের নতুন করে নোটিশ দিই৷ আমাদের পরিদর্শন টিমও যায়৷ কিন্তু অবস্থার উন্নতি হয় না৷ আমরা সরাসরি তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারি না৷ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে তাদের জানাই৷’’
তিনি বলেন, ‘‘হাসপাতালগুলোর ফায়ার সেফটি খুবই খারাপ অবস্থায় রয়েছে৷ সরকারি-বেসরকারি সব হাসপাতালেরই একই অবস্থা৷ অনেক হাসাপতালে ফায়ার সেফটি বলতেই কিছু নেই৷ কিন্তু প্রত্যেক হাসপাতালে ফায়ার সেফটি থাকা বাধ্যতামূলক৷’’ তবে ফায়ার সার্ভিস মনে করে, করোনার সময় হাসপাতালে আগুন লাগা বেড়ে গেছে সেরকম কোনো তথ্য তাদের কাছে নেই৷ তাদের মতে, ভবনের ফায়ার সেফটি নেশনাল বিল্ডিং কোড-এর সঙ্গে জড়িত৷ তবে যে ভবনে দাহ্য পদার্থ বেশি থাকবে সেই ভবনের অগ্নি নিরাপত্তাও তত ভালো হতে হবে৷ ভবনটি কী কাজে ব্যবহার করা হচেছ তা খুবই জরুরি ফায়ার সেফটি নির্ধারণে৷
পুরনো অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা পর্যাপ্ত নয়: ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক লে. কর্নেল জিল্লুর রহমান
ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন) লে. কর্নেল জিল্লুর রহমান বলেন, ‘‘হাসপাতালে অনেক বেশি ইলেকট্রিক এবং ইলেকট্রনিক সরঞ্জাম থাকে৷ হাসপাতালে এখন অত্যাধুনিক এমআরআই মেশিন, এক্স-রে মেশিন আছে৷ কিন্তু হাসপাতাল ভবনগুলো অনেক পুরনো৷ আবার আইসিইউতে হাই অক্সিজেন ফ্লো থাকে৷ তাই পুরনো অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা পর্যাপ্ত নয়৷’’
তিনি বলেন, তারা হাসপাতালগুলোকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে এবিষয়ে সতর্ক করেন, কিন্তু সরসারি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না৷
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক দাবি করেন, ‘‘সরকারি হাসপাতালের পাশাপাশি বেসরকারি হাসপাতালগুলোকেও ইউনাইটেড হাসপাতালে আগুনের পর সতর্ক করা হয়েছে৷ সব হাসপাতালের আইসিইউ পুরোপুরি ফায়ার প্রুফ করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে৷ এটা আমরা মনিটরিং করবো৷’’
তিনি আরো জানান, আগুনের পর ঢাকা মেডিকেলের আইসিইউ আরো সম্প্রসারণের পরিকল্পনা করা হয়েছে৷
২০১৯ সালের এপ্রিলের ছবিঘরটি দেখুন...
আগুন নেভানোর চমকপ্রদ সব আবিষ্কার
প্রাকৃতিক অগ্নিকাণ্ড সভ্যতার শুরু থেকেই বিপদজনক ঘটনা হলেও শিল্পায়নের এই যুগে মানবসৃষ্ট কারণে এর সংখ্যা বেড়েছে৷ তাই নিত্য গবেষণাও চলে একে মোকাবেলার৷ ছবিঘরে জানুন আগুন নেভানোর কয়েকটি চমকপ্রদ আবিষ্কারের কথা৷
ছবি: Reuters/A. Konstantinidis
ফায়ারফাইটিং ড্রোন
ড্রোনের সুবিধা হলো এটি নীচে দাঁড়িয়ে নিয়ন্ত্রণ করা যায়৷ কয়েকটি কোম্পানি এরই মধ্যে ফায়ারফাইটিং ড্রোন বাজারে ছেড়েছে৷ যেখানে এখন পর্যন্ত ক্রেন দিয়ে সর্বোচ্চ ১০০ মিটারের কিছু বেশি উচ্চতায় পৌঁছানো যায়, সেখানে অ্যারোনেস কোম্পানির ড্রোনগুলো ৩শ’ থেকে ৪শ’ মিটার উচ্চতায় যেতে পারে এবং এগুলো মিনিটে ১০০ লিটার গতিতে পানি ছিটাতে পারে৷ শুধু তাই নয় ১৪৫ কিলোগ্রাম পর্যন্ত ওজনের কোনো ব্যক্তিকেও এটি তুলে আনতে পারে৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/R. Tivony
সাউন্ডওয়েভ ফায়ার এক্সটিনগুইশার
যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ মেসন ইউনিভার্সিটির দুই প্রকৌশল ছাত্র ট্র্যান ও রবার্টসন ২০১৭ সালে এই যন্ত্রটি আবিষ্কার করেন৷ যদিও আগুন নেভানোর জন্য শব্দের ব্যবহারের আইডিয়া আগে আলোচিত বা পরীক্ষা করা হয়েছে, একে বাস্তব যন্ত্রে রূপান্তর করেছেন এই দু’জন৷ যন্ত্রটি দিয়ে ১০০ হার্টজ ফ্রিকোয়েন্সির শব্দ তৈরি করে আগুনে অক্সিজেনের সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া হয়৷ আর ম্যাজিকের মতো মুহূর্তেই আগুন নিভে যায়৷
ছবি: Youtube
বম্বার্ডিয়ার সিএল ৪১৫
এয়ারক্রাফট ফায়ারফাইটার হলো বিরাট আগুন (যেমন, ওয়াইল্ড ফায়ার) নেভানোর কাজে ব্যবহারযোগ্য বিমান৷ এর মধ্যে বম্বার্ডিয়ার সিএল ৪১৫ ক্যানাডায় তৈরি একটি বোমারু বিমান, যেটি আগুনের মধ্যে বোমার মতো পানি ফেলে অল্প সময়েই নিভিয়ে ফেলে৷ মাত্র ১২ সেকেন্ডে এটি ৬ হাজার ১শ’ ৪০ লিটার পানি ছড়াতে পারে৷ এটি উভচর৷
ছবি: picture-alliance/CTK/J. Sulc
স্কাইক্রেন
স্কাইক্রেনও এয়ারক্রাফট ফায়ারফাইটার৷ এটি একটি মার্কিন হেলিকপ্টার৷ এটিও অনেক দ্রুতগতিতে আগুনে পানি ছিটাতে পারে৷ মাত্র ৪৫ সেকেন্ডে ১০ হাজার লিটার পানি ছিটাতে পারে এই স্কাইক্রেনটি৷ এটি একটি মিলিটারি মডেলের হেলিকপ্টার৷ বিখ্যাত অ্যানিমেশন মুভি ‘দি ইনক্রেডিবল হাল্ক’-এ এই মডেলটি ব্যবহার করা হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
ফায়ারফাইটিং রোবট
ছোট ট্যাঙ্কের মতো এই ফায়ারফাইটিং রোবটগুলো অস্ট্রেলিয়ায় তৈরি৷ এগুলো আগুনের খুব কাছে পৌঁছে যেতে পারে৷ এগুলো ৮৫ মিটার বা একটি ফুটবল মাঠের দূরত্বে পানি ছেটাতে পারে৷ এগুলো সিঁড়ি বেয়ে উঠতে পারে, বাধা অতিক্রম করতে পারে৷ ছোট হলেও সামনে ভারী বস্তু ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতে পারে৷ দুইজনকে বহন করতে পারে৷
ছবি: picture-alliance/Zuma/Kalashnikov
ফায়ার এক্সটিনগুইশার বল
এটা বেশ মজার একটি যন্ত্র৷ বলটিতে থাকে আগুন নেভানোর রাসায়নিক পদার্থ ও দাহ্য পদার্থ৷ তাই আগুনের সংস্পর্শে আসলে মাত্র তিন সেকেন্ডের মধ্যে এটি বিস্ফোরিত হয় এবং সেই পদার্থ ছড়িয়ে পড়ে৷ আগুন নিভে যায়৷ এগুলো বাসাবাড়ি ও অফিস আদালতে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে৷
ছবি: Youtube
স্কাই সেভার
ফারুক রূপায়ন টাওয়ার থেকে বাঁচতে অনেকেই অনেক ওপর থেকে লাফ দিয়েছিলেন৷ স্কাই সেভার থাকলে তাঁরা একে একে নিরাপদে নামতে পারতেন৷ এটি শুধু জ্যাকেটের মতো পরে কোনো একটি হুক বা কিছু সঙ্গে ওপরের নবটি আটকে লাফিয়ে পড়তে হয়৷ স্কাই সেভার বডির ওজন অনুযায়ী ব্যক্তিকে অল্পসময়ে আস্তে আস্তে নীচে নামিয়ে নিয়ে আসে৷
ছবি: Youtube
এলইউএফ ৬০
এলইউএফ ৬০ একটি চলনশীল ওয়্যারলেস রিমোট কন্ট্রোল যন্ত্র৷ এটি ১ হাজার ফুট পর্যন্ত সামনের আগুন নিভিয়ে পথ পরিষ্কার করে দেয়৷ এছাড়া মিনিটে ১ হাজার ৮শ’ লিটার পানি ৩৬০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে ছুড়তে পারে৷ বিদ্যুৎ চলে গেলে এতে ম্যানুয়েল কন্ট্রোলও আছে৷ বিশেষ করে ওয়্যারহাউস বা আন্ডারগ্রাউন্ডে আগুন নেভানোর মতো ঝুঁকিপূর্ণ কাজ সহজেই এর মাধ্যমে করা যায়৷
ছবি: Imago Images/imagebroker/strussfoto
হাই ফগ
কোনো অফিস ঘর বা হোটেল রুমে যেসব সাধারণ স্প্রিঙ্কলারগুলো রয়েছে, তাতে আগুন নেভাতে নেভাতে অনেক ক্ষতি হয়ে যায়৷ হাই ফগ এর চেয়ে দশগুণ বেশি গতিতে কাজ করে৷ এর বিশেষত্ব হলো এটি প্রচণ্ড বেগে কুয়াশার মতো পানি ছোড়ে, যা শুধু আগুনই নেভায় না, পরিবেশের তাপমাত্রা কমায় ও আগুনে অক্সিজেনের সরবরাহে বাধা দেয়৷ তাতে আগুন খুব দ্রুত নিভে যায়৷
ছবি: Youtube
অটো ফায়ারম্যান
গাড়িতে আগুন লাগার ঘটনা সচরাচর না ঘটলেও এটি খুব বিপদজনক৷ এই বিপদ এড়াবার জন্য রয়েছে অটো ফায়ারম্যান৷ গাড়ির ইঞ্জিনে একজোড়া অটো ফায়ারম্যান লাগিয়ে রাখলে তা তাপমাত্রা বেড়ে গেলে বা আগুন লেগে গেলে গ্যাসের মতো করে কেমিক্যাল রেজিন ছড়াতে থাকে৷ তাতে আগুন নিভে যায়৷
ছবি: Youtube
স্মার্ট ডিটেকটরস
কোথাও আগুনের সূত্রপাত ঘটলে তা ছড়িয়ে পড়ার আগে জানা গেলে তা নেভানো সহজ৷ স্মার্ট ডিটেকটর বিভিন্ন ধরনের ধোঁয়াকে আলাদা করতে পারে৷ যেমন, কোনটা চুলার রান্নার ধোঁয়া, কোনটা সত্যি আগুনের ধোঁয়া ইত্যাদি৷ এটি আপনার ফোনে নিয়মিত বিভিন্ন ধরনের ধোঁয়ার রিডিং দিতে থাকে৷ যদি কোনো আগুন বা ধোঁয়া বিপদজনক মাত্রায় পৌঁছাতে শুরু করে তখনই এটি আপনাকে এবং ফায়ার সার্ভিস বিভাগকে জানিয়ে দেবে৷