বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার ৯৫ ভাগ শিশুর শরীরে ক্ষতিকর নিকোটিনের উপস্থিতি পাওয়া লক্ষ্য করা গেছে৷ এই নিকোটিনের উপস্থিতির কারণ পরোক্ষ ধূমপান৷ প্রধানত পরিবারের বয়স্ক সদস্যদের ধূমপানের প্রভাবেই শিশুরা নিকোটিনের শিকার হচ্ছে৷
বিজ্ঞাপন
‘সেকেন্ডহ্যান্ড স্মোক এক্সপোজার ইন প্রাইমারি স্কুল চিলড্রেন: আ সার্ভে ইন ঢাকা, বাংলাদেশ' শিরোনামে এই গবেষণাটি যৌথভাবে পরিচালনা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অফ ইয়র্ক, ইউনিভার্সিটি অফ এডিনব্যার্গ এবং লিডস সিটি কাউন্সিলের জনস্বাস্থ্য বিভাগ৷
ঢাকার মিরপুর এবং সাভারের মোট ১২টি স্কুলে ৪৭৯টি শিশুর ওপর এই গবেষণা পরিচালনা করা হয়৷ তাদের অধিকাংশের বয়স ছিল ১১ থেকে ১৩ বছরের মধ্যে৷ দু'ভাবে শিশুদের তথ্য নেয়া হয়৷ প্রথমত শিশুদের লালা সংগ্রহ করা হয়৷ সেই লালা বিশেষ ব্যবস্থায় যুক্তরাজ্যে পাঠানো হয়৷ যুক্তরাজ্যের এবিএস ল্যাবে লালা পরীক্ষা করা হয়৷ তারপর আর তাদের প্রশ্ন করে তথ্য সংগ্রহ করা হয়৷
ড. রুমানা হক
গবেষণায় দেখা যায়, ঐ শিশুদের ৪৫৩ জনের শরীরে উচ্চমাত্রার নিকোটিন আছে, যা শতকরা হিসেবে ৯৫ ভাগ৷ এই শিশুদের ২২০ জন ছেলে এবং ২৩৩ জন মেয়ে৷ এদের মধ্যে মাত্র ২৬ জনের শরীরে নিকোটিনের উপস্থিতি পাওয়া যায়নি৷
গবেষণা দলের সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. রুমানা হক ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এই শিশুদের কেউই ধূমপায়ী নয়৷ তাদের শরীরে আমরা ০ দশমিক ১ মাত্রার বেশি নিকোটিন পেয়েছি, যা শরীরের জন্য ক্ষতিকর৷ এ সমস্ত শিশুরা আসলে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার৷ তারা যদি নিজেরা ধূমপায়ী হতো, তাহলে নিকোটিনের মাত্র আরো বেশি হতো৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘এই শিশুদের প্রশ্ন করে আমরা জেনেছি যে তাদের পরিবারের কেউ না কেউ বাসায় ধূমপান করেন৷ বাসায় বসে ধূমপান করলে বাসায় অন্য যাঁরা থাকেন, তাঁদের শরীরেও নিকোটিন প্রবেশ করে৷ এমনকি আলাদা রুমে ধূমপান করলেও ধোঁয়া অন্য রুমে ছড়িয়ে পড়ে৷ এমনকি জানালার পর্দা, সোফার কাভার, কাপড়-চোপড়ে নিকোটিন লেগে যায়৷ শতকরা ৪৩ ভাগ শিশু বলেছে যে তাদের ঘরে অন্তত একজন ধূমপান করেন৷''
এর বাইরে রাস্তায়, বাসে, দোকানে, হোটেলে অনেকেই ধূমপান করেন৷ সেখান থেকেও শিশুরা পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হয়৷ ৮৭ ভাগ শিশু জানায় যে তারা ‘পাবলিক প্লেস'-এ বহু মানুষকে ধূমপান করতে দেখেছে৷
ডা. লেনিন চৌধুরী
এই গবেষক জানান, ‘‘বাংলাদেশে প্রকাশ্যে ধূমপান শাস্তিযোগ্য অপরাধ হলেও, অনেকেই ‘পাবলিক প্লেস' বিষয়টি ঠিক বোঝেন না৷ আবার অনেকে সচেতনও নন৷''
এই গবেষণার এখন দ্বিতীয় পর্যায় চলছে৷ সেখানে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার এই শিশুদের ওপর কী ধরনের শারীরিক প্রতিক্রিয়া হয়, তা জানার চেষ্টা করা হবে৷ প্রশ্নোত্তরের মাধ্য ১৩টি উপসর্গ সম্পর্কে জানা হবে৷ তার শ্বাসকষ্ট, সকালে কাশি হয় কিনা, তার কাজকর্ম বা দৌড়াতে কষ্ট হয় কিনা হত্যাদি৷ অধ্যাপক রুমান হক বলেন, ‘‘আমরা শিশুদের ‘ব্রিদিং টেস্ট' করেছি৷ এখন সেটা ‘এনালাইজ' করে দেখা হচ্ছে৷''
‘প্রিভেনটিভ মেডিসিন'-এর বিশেষজ্ঞ ডা. লেনিন চৌধুরী ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘নিকোটিন একটি বিষাক্ত পদার্থ৷ এটা ফুসফুসের ক্যান্সারের জন্য দায়ী৷ তবে প্রাথমিকভাবে এর প্রকাশ ঘটে শ্বাসকষ্টের মাধ্যমে৷ এছাড়া নিকোটিনের কারণে খাদ্য পরিপাক তন্ত্রের স্বাভাবিক কাজ ব্যহত হয়, নারী-পুরুষ উভয়ের প্রজনন ক্ষমতা কমিয়ে দেয়৷ কিডনির ক্ষতি করে এবং আসক্তি তৈরি করে যা মানুষের স্বাভাবিক আচরণকে প্রভাবিত করে৷''
তিনি বলেন, ‘‘শিশুদের ওপরও নিকোটিনের প্রভাব একই৷ তাদের শরীরে নিকোটিন প্রবেশ করলেও তারাও একই ক্ষতির মুখে পড়ে৷''
এমনকি ড. রুমানা হকের কথায়, ‘‘বাইরে থেকে ধূমপান করে হাত-মুখ না ধুয়ে শিশুদের সংস্পর্শে গেলেও শিশুরা নিকোটিনের শিকার হয়৷''
ধূমপান ত্যাগ করুন – দ্রুত সুস্বাস্থ্য ফিরে পাবেন
সিগারেটের ধোয়ায় দু’শ-রও বেশি ‘টক্সিন’ রয়েছে, যা শরীরের ক্ষতি করে৷ তবে ধূমপান ত্যাগ করার পর দ্রুতই শরীর সে ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারে৷
ছবি: Fotolia/Rumkugel
সিগারেট ছাড়া বিশ মিনিট
ধূমপানের প্রায় ২০ মিনিট পর আপনার শরীরের রক্তচাপ এবং ‘পালস রেট’ আবারো স্বাভাবিক হতে শুরু করে৷ ধূমপানের সময় এগুলো বেড়ে যায়, কেন না নিকোটিন আপনার দেহের ‘সিম্পেথিটিক নার্ভাস সিস্টেম’ সক্রিয় করে দেয়৷ তখন অনেকটা জরুরি অবস্থার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় দেহে৷
ছবি: Fotolia/Andrei Tsalko
ধূমপানবিহীন ১২ ঘণ্টা
শেষ ধূমপানের ১২ ঘণ্টা পর আপনার রক্তে কার্বন মনোক্সাইডের পরিমাণ কমতে থাকে এবং অক্সিজেনের লেভেল বেড়ে স্বাভাবিক পর্যায়ে পৌঁছায়৷ ধূমপানের সময় আপনার শরীরে প্রবেশ করা কার্বন মনোক্সাইড রক্তে অক্সিজেনের স্বাভাবিক প্রবাহে বাধা দেয়৷
ছবি: Fotolia/ Gina Sanders
সিগারেট ছাড়া দু’দিন
সিগারেট ছাড়ার দু’দিন পর আপনার গন্ধ নেয়ার এবং স্বাদ গ্রহণের ক্ষমতা ফিরতে শুরু করে৷ নিয়মিত ধূমপান এ সবকে দুর্বল করে দেয়৷
সিগারেট ছাড়া তিনদিন
সিগারেট ছাড়ার তিনদিন পর আপনার শ্বাসনালী শিথিল হতে শুরু করে৷ তখন শ্বাসপ্রশ্বাস আরো সহজ হয়৷ একইসঙ্গে আপনার শরীরও নিকোটিনমুক্ত হয়, যার বিরূপ প্রভাবও দেখা দিতে পারে৷ যেমন আপনার মাথাব্যথা করতে পারেন, বমি বমি ভাব হতে পারে, এমনকি আপনার মধ্যে হতাশা বা অকারণে দুশ্চিন্তাও দেখা দিতে পারে৷ তবে এ সব ব্যাপার সাময়িক৷
ছবি: Andrzej Wilusz/Fotolia
সিগারেট ছাড়া কয়েকমাস
ধূমপান ছাড়ার কয়েকমাস পর আপনার দেহের মধ্যকার রক্ত সরবরাহ ব্যবস্থা আগের তুলনায় ভালো হয়৷ ফুসফুসের অক্সিজেন গ্রহণের পরিমাণ বাড়ে ৩০ শতাংশ৷ কাশিও কমে যায়৷ কেননা ফুসফুসের মধ্যে আবারো গজাতে শুরু করে ‘নেত্রলোম’৷ এগুলো ফুসফুসকে পরিষ্কার রাখতে সহায়তা করে৷
ছবি: Fotolia/Sebastian Kaulitzki
সিগারে ছাড়া এক, দশ, কিংবা ১৫ বছর
হার্ট অ্যাটাকের আশঙ্কা অধূমপায়ীদের চেয়ে ধূমপায়ীদের ৭০ শতাংশ বেশি৷ তবে সিগারেট ছাড়া এক বছর কাটানোর পর হৃদরোগের আশঙ্কা ৫০ শতাংশ কমে যায়৷ ধূমপান ত্যাগের দশ বছরের মধ্যে ফুসফুসে ক্যানসারের আশঙ্কা কমে যায় অর্ধেকে৷ এছাড়া ধূমপান ত্যাগের ১৫ বছর পর করোনারি হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা যাঁরা কখনো ধূমপান করেননি, তাঁদের সমান হয়ে যায়৷
ছবি: Fotolia/Alexander Raths
6 ছবি1 | 6
তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘‘এই গবেষণার জন্য শিশুদের লালা পরীক্ষার যন্ত্রপাতি হয়ত বাংলাদেশে পাওয়া যেত, কিন্তু দক্ষ জনবল না থাকায় আমরা পরীক্ষাটি দেশের বাইরে করিয়েছি৷''
বিশ্বের ৪০ শতাংশ শিশু পরোক্ষ ধূমপানের শিকার৷ কিন্তু রাজধানী ঢাকায় এই হার এত বেশি (৯৫ ভাগ) কেন? এই প্রশ্নের জবাবে রুমানা হক বলেন, ‘‘বাংলাদেশে ধূমপায়ীর হারও অনেক বেশি৷ এছাড়া সচেতনতার অভাবে এখানে শিশুদের এড়িয়ে ধূমপান করার প্রবণতা কম৷ আমাদের এই গবেষণায় হয়ত পুরো বাংলাদেশের চিত্র উঠে আসেনি৷ কিন্তু আমরা মনে করি, সারা বাংলাদেশেই এখন একটা সার্ভে হওয়া প্রয়োজন৷ তাতে হয়ত প্রকৃত চিত্র পাওয়া যাবে৷ কিন্তু আমাদের এই গবেষণায় যে চিত্র পাওয়া গেছে, তা ভয়াবহ৷''
গত ৭ ডিসেম্বর গবেষণাটি যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড থেকে প্রকাশিত ‘নিকোটিন অ্যান্ড টোব্যাকো রিসার্চ' সাময়িকীতে এই গবেষণা প্রতিবেদনটি ছাঁপা হয়৷ অধ্যাপক ড. রুমানা হকের সঙ্গে আরো যাঁরা গবেষণায় অংশ নেন তাঁরা হলেন – সারোয়াত শাহ. মোনা কানান, আজিজ শেখ, ওমারা ডোগার, হিদার থমসন, স্টিভ প্যারোট এবং কামরান সিদ্দিকী৷
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং বিশ্ব ফুসফুস ফাউন্ডেশন ধূমপানের ক্ষতি সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য নানা ধরণের কর্মসূচি পালন করে৷ তারপরও ধূমপান খুব একটা কমানো যাচ্ছে না৷ ছবিঘরে দেখুন বিশ্বের কোন দেশে কত ধূমপায়ী...৷
ছবি: Colourbox/A. Armyagov
সার্বিয়ায় সবচেয়ে বেশি
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডাব্লিউএইচও) তথ্য অনুযায়ী, শতকরা হারে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি মানুষ ধূমপান করে সার্বিয়ায়৷ দেশের মোট জনসংখ্যার ৪১ ভাগই ধূমপায়ী৷ সার্বিয়ার একজন ধূমপায়ীর প্রতি বছর গড়ে মোট ২ হাজার ৮৬১টি সিগারেট লাগে৷
ছবি: Getty Images/C. Hondros
বুলগেরিয়ার ধূমপায়ীরাও কম যান না
মাথাপিছু মোট সিগারেটের হিসেবে সার্বিয়ার পরই আছে ইউরোপের আরেক দেশ বুলগেরিয়া৷ সেখানে মোট জনসংখ্যার ৩৫ শতাংশই ধূমপানে অভ্যস্ত৷ ইউরোপে সিগারেটের অনেক দাম৷ তারপরও ধূমপায়ীরা কিন্তু সিগারেট ঠিকই কিনছেন৷ বুলগেরিয়ায় একজন ধূমপায়ী গড়ে প্রতিবছর ২ হাজার ৮২২টি সিগারেটের ধোঁয়া পান করেন৷
ছবি: Getty Images/N. Doychinov
গ্রিসও বা কম কিসে!
শতকরা হারে আবার গ্রিস বুলগেরিয়ার চেয়ে এগিয়ে৷ সে দেশের মোট জনসংখ্যার ৪৪ শতাংশই ধূমপায়ী৷ আশেপাশের দেশগুলোর তুলণায় গ্রিসে সিগারেটের দাম অনেক বেশি৷ তারপরও ধূমপায়ী খুব একটা কমছে না৷ গ্রিসের একজন স্বাভাবিক ধূমপায়ীর বছরে গড়ে ২,৭৯৫টি সিগারেট লাগে৷
ছবি: Getty Images/A. Messinis
রাশিয়ার শতকরা ৩৮ ভাগ মানুষ ধূমপায়ী
এই ৩৮ ভাগ অবশ্য সার্বিয়া, গ্রিস এবং বুলগেরিয়ার তুলনায় কমই৷ ওই দেশগুলোর তুলনায় রাশিয়ার সিগারেটের দামও কম৷ তাই সে দেশের একজন স্বাভাবিক ধূমপায়ীর বছরে গড়ে ২ হাজার ৭৮৬টি সিগারেটের দরকার হতেই তো পারে৷
ছবি: Getty Images/A. Utkin
ইউক্রেনে নারী ধূমপায়ী বাড়ছে
ইউক্রেনে গত কয়েক বছরে নারী ধূমপায়ীর সংখ্যা বেশ বেড়েছে৷ সিগারেটের বিক্রিও বাড়ছে বৈ কমছে না৷ ইউক্রেনের একজন ধূমপায়ী বছরে অন্তত ২ হাজার ৪০১টি সিগারেট পান করেন৷
ছবি: Getty Images/A. Stepanov
এশিয়ায় প্রবণতা কিছুটা কম
সার্বিয়া, গ্রিস, বুলগেরিয়া, রাশিয়া, ইউক্রেনের পর একে একে এসেছে বসনিয়া, বেলারুশ ও চেক প্রজাতন্ত্রের নাম৷ অর্থাৎ ওপরের দিকে সবই ইউরোপীয় দেশ৷ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবার আগে আছে দক্ষিণ কোরিয়া৷ সরকার সে দেশে ধূমপান কমানোর জন্য সিগারেটের দাম দ্বিগুণ করেছে৷ এখনো একজন ধূমপায়ীর সেখানে বছরে গড়ে ১ হাজার ৯৫৮টি সিগারেট দরকার হয়৷ দামবৃদ্ধির ফলে তাঁদের ধূমপানের প্রবণতা কমবে বলেই মনে করছে সরকার৷
ছবি: Getty Images/AFP/J. Yeon-Je
বাংলাদেশে কি অবস্থা একটু ভালো?
তা বলা মুশকিল৷ কেননা ডাব্লিউএইচও যে পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে, তা ২০১০ সালের৷ তখনই বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার শতকরা ২৪ ভাগই ছিলেন ধূমপায়ী৷ তাছাড়া মোট পুরুষের ৪৫ ভাগই তখন ধূমপান করতেন৷ অবশ্য মোট নারীর মধ্যে মাত্র একভাগ তখন নিয়মিত বা অনিয়মিতভাবে ধূমপান করতেন৷