কিশোরী মডেল সোনালী খাতুন যখন মঞ্চে ওঠেন উপস্থিত দর্শকরা বিপুল উৎসাহে তাকে স্বাগত জানান৷ তবে তিনি সাধারণ কোনো মডেল নন, যে ফ্যাশন শো-তে তাকে দেখা গেছে সেটিও সাধারণ কোনো শো নয়৷
বিজ্ঞাপন
সোনালী এবং আরো ১৪ জন মডেলের সবাই অতীতে অ্যাসিড হামলার শিকার হয়েছেন৷ বাংলাদেশে অ্যাসিড হামলার ঘটনা মাঝেমাঝেই ঘটে৷ প্রেমের প্রস্তাবে সাড়া না দেয়ায় কিংবা কোনো কারণে পরিবারের অসন্তুষ্ট কোনো সদস্য অ্যাসিড ছুড়ে মারেন প্রতিশোধ নিতে৷
মঙ্গলবার রাতে ঢাকায় আয়োজিত ফ্যাশন শো-তে উপস্থিত ছিলেন অনেক ফ্যাশনপ্রেমী, মানবাধিকার অ্যাক্টিভিস্ট এবং বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূতসহ কয়েকজন কূটনীতিক৷ অ্যাসিড সন্ত্রাসের ভয়াবহতা সম্পর্কে জানাতে এই শো'র আয়োজন করা হয়, যেখানে কার্যত সৌন্দর্যের গতানুগতিক সংজ্ঞাকেই চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে৷
১৪ বছর বয়সি সোনালীর কাছে অবশ্য এই ইভেন্ট নারীর ক্ষমতায়নের কোনো ব্যাপার নয়৷ জন্মের মাত্র কয়েকদিন পরই অ্যাসিড হামলার শিকার হন তিনি৷ জমিজমা নিয়ে বিরোধকে কেন্দ্র করে চালানো হামলায় আহত হন তিনি৷ তার চেহারা এবং হাত অ্যাসিডে ঝলসে যায়৷ সুস্থ হয়ে উঠতে তিন বছর হাসপাতালে থাকতে হয়েছে সোনালীকে, ছোট্ট দেহে অপারেশন হয়েছে আটবার৷ কিন্তু হামলাকারী কখনোই ধরা পড়েনি৷
‘‘আমি এখানে আসতে পেরে অত্যন্ত আনন্দিত'', ব়্যাম্পে বললেন সোনালী৷ নিজের স্বপ্ন সম্পর্কে জানাতে গিয়ে বললেন, ‘‘আমি চিকিৎসক হতে চাই৷''
অ্যাসিড হামলার শিকার মডেলদের মধ্যে তিনজন পুরুষও ছিলেন৷ ফ্যাশন শো-তে তাঁরাও বাংলাদেশে ডিজাইন করা তাঁতে বোনা পোশাক পরেছেন৷ শো-র কোরিওগ্রাফার ছিলেন স্থানীয় ডিজাইনার বিবি রাসেল৷ আয়োজকরা আশা করছেন যে, অ্যাসিড ভিক্টিমরা যে সমাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, সেটা সবাইকে জানাতে সক্ষম হয়েছেন৷ মুসলিমপ্রধান দেশ বাংলাদেশে তাঁরা দৃশ্যত উপেক্ষিত৷
ফ্যাশন শো-তে দর্শকের সারিতে থাকা অ্যাকশনএইড বাংলাদেশের ফারাহ কবির বলেন, ‘‘আমি প্রায়ই তাদের কাছ থেকে অনুপ্রেরণা নেই৷ তাদের অনেক সাহস৷''
প্রসঙ্গত, গত কয়েকদশক ধরেই অ্যাসিড হামলা প্রতিরোধে সংগ্রাম করছে বাংলাদেশ৷ কয়েকবছর আগে অ্যাসিড হামলার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করা হয়৷ এছাড়া অ্যাসিড হামলার শিকারদের চিকিৎসায় চিকিৎসকদের বিশেষ প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে৷ পাশাপাশি অ্যাসিড বিক্রির ক্ষেত্রে নিয়মনীতি কড়া করা হয়েছে৷ তা সত্ত্বেও অ্যাসিড হামলা পুরোপুরি বন্ধ করা যায়নি৷ গত বছরও অ্যাসিড হামলার শিকার হয়েছেন অন্তত ৪৪ জন৷
একটা সময় বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমে প্রায়ই আসতো নারীর ওপর অ্যাসিড নিক্ষেপের খবর৷ এমন বর্বরোচিত হামলা এখনও হয় কিছু দেশে৷ কয়েকটি দেশ ঘুরে জার্মান ফটোগ্রাফার অ্যান-ক্রিস্টিন ভোর্ল-এর তোলা ছবি নিয়ে আজকের ছবিঘর৷
ছবি: DW/M. Griebeler
বাংলাদেশের ফরিদা
ফরিদার স্বামী ছিলেন ড্রাগ এবং জুয়ায় আসক্ত৷ ঋণের দায়ে একসময় বাড়িটাও বিক্রি করে দেয় নেশাগ্রস্ত লোকটি৷ রেগেমেগে ফরিদা বলেছিলেন, এমন স্বামীর সঙ্গে আর ঘর করবেন না৷ সেই রাতেই হলো সর্বনাশ৷ ঘুমন্ত ফরিদার ওপর অ্যাসিড ঢেলে দরজা বন্ধ করে দিল পাষণ্ড স্বামী৷ যন্ত্রণায় চিৎকার করছিলেন ফরিদা৷ প্রতিবেশীরা এসে দরজা ভেঙে উদ্ধার করে তাঁকে৷
ছবি: Ann-Christine Woehrl/Echo Photo Agency
মায়ের স্নেহে, বোনের আদরে...
অ্যাসিডে ঝলসে যাওয়ার সময় ফরিদা ছিলেন ২৪ বছরের তরুণী৷ ১৭টি অস্ত্রোপচারের পর এখন কিছুটা সুস্থ৷ তবে সারা গায়ে রয়েছে দগদগে ঘায়ের চিহ্ন৷ পুড়ে যাওয়া জায়গাগুলোর ত্বক মসৃণ রাখতে প্রতিদিন মালিশ করে দেন মা৷ নিজের কোনো বাড়ি নেই বলে মায়ের সাথেই বোনের বাড়িতে থাকেন ফরিদা৷
ছবি: Ann-Christine Woehrl/Echo Photo Agency
উগান্ডার ফ্লাভিয়া
ফ্লাভিয়ার ওপর এক আগন্তুক অ্যাসিড ছুড়ে মেরেছিল ৫ বছর আগে৷ আজও ফ্লাভিয়া জানেন না, কে, কেন তাঁর ওপর হামলা চালালো৷ বিকৃত চেহারা নিয়ে অনেকদিন ঘরেই ছিলেন৷ বাইরে যেতেন না৷ এক সময় ফ্লাভিয়ার মনে হলো, ‘‘এভাবে ঘরের কোণে পড়ে থাকার মানে হয় না৷ জীবন এগিয়ে চলে৷ আমাকেও বেরোতে হবে৷’’
ছবি: Ann-Christine Woehrl/Echo Photo Agency
আনন্দময় নতুন জীবন
এখন প্রতি সপ্তাহে একবার সালসা নাচতে যায় ফ্লাভিয়া৷ আগের সেই রূপ নেই, তাতে কী, বন্ধুদের কাছে তো রূপের চেয়ে গুণের কদর বেশি! ফ্লাভিয়া খুব ভালো নাচ জানেন৷ তাই একবার শুরু করলে বিশ্রামের সুযোগই পান না৷ এভাবে পরিবার আর বন্ধুদের সহায়তায় আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছেন ফ্লাভিয়া৷
ছবি: Ann-Christine Woehrl/Echo Photo Agency
ভারতের নীহারি
নীহারির বয়স তখন ১৯৷ একরাতে আত্মহত্যা করার জন্য আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলেন নিজের শরীরে৷ স্বামীর মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন থেকে মুক্তি পাওয়া জরুরি মনে হয়েছিল তখন৷
ছবি: Ann-Christine Woehrl/Echo Photo Agency
নতুন রূপ
যে ঘরটিতে বসে নীহারি তাঁর চুল ঠিক করছেন এটা ছিল বাবা-মায়ের শোবার ঘর৷ এখানেই নিজেকে শেষ করে দিতে চেয়েছিলেন৷ দেয়াশলাইয়ের বাক্সে একটা কাঠিই ছিল৷ তা দিয়েই আগুন জ্বালিয়েছিলেন শরীরে৷ তবে এখন আর দুর্বল মনের মেয়েটি নেই নীহারি৷ নিজেকে সামলে নিয়ে একটা সংস্থা গড়েছেন৷ সংস্থাটির নাম, ‘পোড়া মেয়েদের রূপ’৷
ছবি: Ann-Christine Woehrl/Echo Photo Agency
পাকিস্তানের নুসরাত
দু-দুবার অ্যাসিড ছোড়া হয়েছে নুসরাতের ওপর৷ প্রথমে স্বামী আর তারপর দেবর৷ ভাগ্যগুণে বেঁচে আছেন নুসরাত৷ ভালোই আছেন এখন৷
ছবি: Ann-Christine Woehrl/Echo Photo Agency
আশার আলো
দু-দুবার অ্যাসিড হামলার শিকার হওয়ায় মাথার অনেকটা চুলও হারিয়েছেন নুসরাত৷ ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে মাথার ক্ষতস্থান পুরোপুরি সারিয়ে চুল এবং আগের হেয়ারস্টাইল ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করছেন তিনি৷
ছবি: Ann-Christine Woehrl/Echo Photo Agency
বন্ধুদের মাঝে...
নিজের ভাবনা, যন্ত্রণার অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করতে কিংবা গল্প করতে প্রায়ই অ্যাসিড সারভাইভারস ফাউন্ডেশন (এএসএফ)-এ যান নুসরাত৷ সেখানে এমন অনেকেই আসেন যাঁদের জীবনও অ্যাসিডে ঝলসে যেতে বসেছিল৷ এখন সকলেই জানেন, তাঁরা আর একা নন৷