বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় অনুষ্ঠিত জমকালো বিয়ের অনুষ্ঠান নিয়ে লেখা প্রতিবেদনটি পড়ে অধিকাংশ পাঠকই সমালোচনামূখর হয়ে উঠেছেন ডয়চে ভেলের ফেসবুক পাতায়৷ তবে ভিন্ন মত ও মজার মন্তব্যও করেছেন কেউ কেউ৷
বিজ্ঞাপন
যে সব বিয়ের আয়োজনে শুধুমাত্র হল ভাড়াই পড়ে ৫ থেকে ২০ লাখ টাকা আর সব মিলিয়ে খরচ হয় কোটি টাকারও বেশি, সে সব বিয়ে সম্পর্কে আনোয়ার হোসেনের মত, ‘‘এত ঘটা করে বিয়ে হওয়ার কারণেই নাকি বিয়েগুলো বিয়ে বেশিদিন টেকে না৷''
ডয়চে ভেলের ফেসবুকে পাঠক নিজাম উদ্দিন জমকালো বিয়ে সম্পর্কে লিখেছেন, ‘‘ভালো চরিত্রের মানুষ হওয়াটাই বড়৷ এত টাকা যারা বিয়েতে করচ করে, তাদের বেশিরভাগই চরিত্রহীন৷''
মো. ইরফান দুঃখ করে জানিয়েছেন, যে দেশে মানুষ দু'বেলা পেট ভরে খেতে পায় না, সেদেশে এ সব মানায় না৷ তাঁর মন্তব্যটি ঠিক এরকম: ‘‘এক দিকে মানুষ দু' বেলা খেতে পায় না, চিকিৎসার অভাবে মারা যায়, টাকার অভাবে হাসপাতালে মৃত্যু যন্ত্রণা সহ্য করে৷ আর অন্যদিকে লোক দেখানোর জন্য বিয়ে বাড়িতে কোটি কোটি টাকা অপচয় করে৷ হায়রে মানুষ!''
মো. নাসেরের মতে, ‘‘অপচয়কারীরা শয়তানের ভাই, অবৈধ টাকায় সবই হয়৷''
লাভ ম্যারেজ বা প্রেম করে বিয়ে কেন করবেন
সম্মন্ধ করে বিয়ে ভালো নাকি প্রেমের বিয়েতেই বেশি সুখ? এ নিয়ে নানাজনের নানা মত রয়েছে৷ তবে আজকের যুগে বিয়ে করার আগে হবু স্বামী বা স্ত্রী কেন পূর্ব পরিচিত হওয়া দরকার বা প্রেম করে বিয়ে করার সুবিধাগুলো কী জেনে নিন৷
ছবি: Fotolia/Maridav
পছন্দ বা ভালো লাগা
বিয়ে শুধু দু’টি মানুষের মধ্যে নয়, দু’টি পরিবারের মধ্যেও নতুন সম্পর্কের সূচনা করে৷ তাই নব দম্পতির অনেকটা সময় চলে যায় পরিবারের লোকজনের সঙ্গে পরিচিত হতে৷ নিজেদের পছন্দ-অপছন্দের খবর নেয়ার তেমন সুযোগ পান না তাঁরা৷ ফলে দু’জনের মধ্যে মনোমালিন্যের সৃষ্টি হতে পারে৷ কিন্তু বিয়ের আগে প্রেম বা বন্ধুত্ব থাকলে ভুল বোঝাবুঝির সুযোগ থাকে কম, দাম্পত্যজীবনও হয় মধুময়৷ আর পরবর্তীতে উপহার নির্বাচনেও অসুবিধা হয় না৷
ছবি: picture alliance/blickwinkel/McPHOTO
একে অপরের প্রতি বিশ্বাস
স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের মূল ভিত হলো বিশ্বাস৷ বিশ্বাস ছাড়া কখনো সংসার টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়৷ আর বিয়ের আগে, অর্থাৎ মন দেয়া-নেয়ার সময় একে-অপরের প্রতি বিশ্বাসের প্রমাণ দেওয়া বা পাওয়ারও যথেষ্ট সুযোগ থাকে৷ সুযোগ থাকে অন্যজনের ভালো লাগা-মন্দ লাগা, চিন্তা-ভাবনা সম্পর্কে জানারও৷
ছবি: AV/Fotolia
ভুল-ক্রুটি বা দূর্বলতা
প্রতিটি মানুষই ভুল করে৷ প্রত্যেকের মধ্যেই থাকে নানা ক্রুটি বা দূর্বলতা৷ কিন্তু বিয়ের পরে, হঠাৎ করে এ সব জানার পর অনেক দম্পতির মধ্যেই হতাশার জন্ম নেয়৷ কেউ-ই ‘পারফেক্ট’ নয় – কথাটা যেমন ঠিক, তেমনই বিয়ের আগে এ সমস্ত কথা জানা থাকলে একে-অপরের ক্রুটিগুলো মেনে নেওয়া সহজ হয় বৈকি!
ছবি: Fotolia/ArTo
ভুল বোঝাবুঝির সুযোগ নেই
আজকের যুগের বিয়ের পর অনেক দম্পতির ভেতর তাদের পুরনো প্রেম নিয়ে ঝগড়া-বিবাদ লেগে থাকে৷ কিন্তু প্রেম করে বিয়ে করলে এর কোনো সুযোগ থাকে না৷ বরং স্বামী-স্ত্রীর বুন্ধদের মধ্যে অনেকেই পূর্ব পরিচিত বা ‘কমন ফ্রেন্ড’ হওয়ায় আধুনিক জীবনযাপন আরো সহজ হয়৷
ছবি: picture alliance/Arco Images GmbH
পারিবারিক কলহ এড়াতে...
বিয়ের পর দুই পরিবারের মধ্যে যৌতুকের মতো নানা কারণে যে কলহ বা ভুল বোঝাবুঝি হয়, তা এড়ানো সম্ভব যদি আগে থেকেই ছেলে-মেয়ের মধ্যে বন্ধুত্ব বা প্রেম থাকে৷ কারণ প্রেম করে বিয়ে হলে পরিবারের বড়রা সাধারণত এ সব ব্যাপারে চুপ করে থাকাটাই শ্রেয় বলে মনে করেন৷
ছবি: Fotolia/Sven_Vietense
বিশেষজ্ঞের মত
জার্মানি বা ইউরোপের দেশগুলোতে সাধারণত ভালোভাবে পরিচয়ের পরই মানুষ বিয়ে করে বা অনেকে না করেও একসাথে বসবাস করে৷ তবে বিয়ের আগে একে-অপরের পছন্দ-অপছন্দ, সখ, ইচ্ছে – এ সব খুব ভালো করে জেনে নিয়ে তবেই সারা জীবন একসাথে থাকার প্রতিশ্রুতি দেওয়া বা বিয়ের মতো বড় সিদ্ধান্তটি নেওয়া উচিত বলে মনে করেন জার্মানির পারিবারিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ ব্যার্নহার্ড ভল্ফ৷
ছবি: Fotolia/Maridav
6 ছবি1 | 6
বিয়ের বিশেষ দিনটিতে, বিশেষ সাজে নিজেকে অপরূপা দেখাক কোন মেয়ে না চায়? এমনই মত আমাদের ফেসবুক-বন্ধু নীলাঞ্জনা আর অনিলতার৷ প্রতিবেদনটির সাথে দেয়া বাংলাদেশের সুন্দরী অভিনেত্রী মাহিয়া মাহির বিয়ের সাজের ছবিটি পাঠক অনিলতা চাঁদের খুবই পছন্দ হয়েছে৷ সে কথাই তিনি লিখেছেন ডিডাব্লিউ-র ফেসবুক পাতায়৷ আর মন্তব্যটি পড়ে পাঠক নীলাঞ্জনা, অনিলতাকে লক্ষ্য করে শান্তনা দিয়ে লিখেছেন, ‘‘বোন মন খারাপ করো না, মেয়েদের দুঃখ মেয়েরা বোঝে৷''
ডয়চে ভেলের প্রতিবেদনটিতে জমকালো বিয়েতে এত খরচের ধূম দেখে মো. রিয়াজুল করিম বেশ মজা করে লিখেছেন, ‘‘তাহলে তো প্রেম করে পালিয়ে বিয়ে করাই ভালো৷''
ঢাকার পাঁচতারা হোটেল, সেনাকুঞ্জ, সেনা মালঞ্চ, বসুন্ধরা কনভেনশন সেন্টার, বিজিবি-র দরবার হলে কিংবা বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক কেন্দ্রে এত ঘটা করে আর কোটি টাকা খরচ করে বিয়ে করার খবর জেনে পাঠক নীরব ওয়াসিফ ফেসবুকে শুধু লিখেছেন, ‘‘দেশে প্রতিনিয়ত শিক্ষিত লোকের সংখ্যা বাড়লেও সুশিক্ষিত লোকের সংখ্যা দিনদিন কমছে৷''
বিভিন্ন ধর্মের ও অঞ্চলের বিয়ের রীতি
অনেকে বলবেন, প্রেম পূর্ণতা পায় বিয়ের মাধ্যমে৷ আবার কেউ বলবেন না, বিয়ে মানে শুধুই আনুষ্ঠানিকতা৷ বিবাহের গূঢ় অর্থ যাই হোক না কেন, একেক ধর্মে এর রীতিনীতি আলাদা৷ অঞ্চলভেদেও বিরাট ফারাক এর নিয়মকানুনে৷
ছবি: Getty Images/A. Joyce
মুসলিম বিয়ে
সাক্ষীর উপস্থিতিতে বিয়ে পড়ানো হয়৷ দেনমোহর ধার্য করা হয় ছেলের আর্থিক সামর্থ্য ও অবস্থান অনুযায়ী৷ বিয়ের সময় একজন উকিল থাকেন৷ তিনি প্রথমে কনেকে জিজ্ঞাসা করেন, সে বিয়েতে রাজি আছে কিনা৷ কনে রাজি থাকলে বরকেও একই প্রশ্ন করা হয়৷ এরপর দোয়া কালাম করে সম্পন্ন করা হয় বিয়ে৷
ছবি: Getty Images/AFP
হিন্দু বিয়ে
বিয়ে হয় বেশ কিছু আচার-অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে৷ প্রচলিত নিয়মে প্রথমে বাগদান পর্ব এবং সেখানেই পাটিপত্রে বর-কনের স্বাক্ষর৷ তারপর একে একে আশীর্বাদ, গায়ে হলুদ, তারপর বিয়ের আসর৷ সেখানে দু’টি পর্ব – সাজ বিয়ে ও বাসি বিয়ে৷ সাজ বিয়েতে সাতবার প্রদক্ষিণ শেষে কনে আর বরকে বরণ করে নেয়া হয়৷ হয় মালাবদল৷ আর বাসি বিয়েতে দেবদেবীর অর্চনা শেষে কনের কপালে সিঁদুর দেয় বর৷ তারপর উভয় মিলে সাতবার অগ্নি দেবতাকে প্রদক্ষিণ করেন৷
ছবি: DW/U. Fatima
খ্রিষ্টান বিয়ে
বিয়ের তিন সপ্তাহ আগে পুরোহিতের কাছে বর-কনে নাম লেখান৷ এরপর ‘বান প্রকাশ’ অনুষ্ঠানে বিয়ের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়৷ বিয়ের আগ পর্যন্ত অপশক্তির নজর থেকে রক্ষার জন্য দুজনকে ‘রোজারি মালা’ পরতে হয়৷ বিয়ের দিন ভোরে কনের বাড়ি গিয়ে তাঁকে নিয়ে আসা হয়৷ এসময় বরপক্ষ থেকে দেয়া পয়সা ঘরের মধ্যে ছুড়ে দেন কনে৷ এর অর্থ, বাড়ি ছেড়ে গেলেও, বাড়ির লক্ষী ঘর থেকে চলে যাচ্ছে না৷ এরপর গির্জায় বর-কনে দু’জনের মধ্যে আংটিবদল করা হয়৷
ছবি: Getty Images/J.Moore
বৌদ্ধ বিয়ে
পাত্র-পাত্রী নির্বাচনের পর সামাজিকভাবে সবাইকে জানিয়ে তারিখ ঠিক করে বৌদ্ধবিহারে পাত্র-পাত্রীকে নিয়ে যাওয়া হয়৷ সেখানে মঙ্গল প্রদীপ জ্বালিয়ে বুদ্ধের পূজা করা হয়৷ ত্রি-স্বরণ পঞ্চশীল পূজার মধ্য দিয়ে বৌদ্ধ ভিক্ষুকের আশীর্বাদ গ্রহণের মাধ্যমে বিয়ে সম্পন্ন হয়৷ এরপর একজন গৃহী তাঁদের সামাজিক অনুশাসন প্রদান করে৷
ছবি: dapd
ঢাকাইয়া বিয়ে
‘পানচিনি’ অনুষ্ঠানে ঘটকের মাধ্যমে দুই পক্ষের মধ্যে প্রাথমিক আলোচনার পর ‘মোতাসা-রাই’ বা ‘পাকাকথা’ অনুষ্ঠানে বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করা হয়৷ বিয়ে অনুষ্ঠানের কয়েকদিন আগে দুই বাড়িতে আলাদাভাবে ‘হলদি’ বা ‘তেলাই’ অনুষ্ঠান হয়৷ এরপর অবিবাহিত অবস্থায় নিজের বাড়িতে বর বা কনের শেষ খাওয়া হিসেবে দুই বাড়িতে ‘আইবুড় ভাত’ নামের অনুষ্ঠান হয়৷ এরপর হয় মূল বিয়ের অনুষ্ঠান৷
ছবি: picture-alliance/dpa/N.Islam
চট্টগ্রাম অঞ্চলের বিয়ে
চট্টগ্রামের বিয়ে সাধারণত বেশ আড়ম্বরপূর্ণ হয়৷ বিয়ের প্রাথমিক কার্যকলাপ অন্যান্য অঞ্চলের মতোই সম্পন্ন হয়৷ তবে বিয়ের আগে আয়োজন করা হয় ‘বউ জোড়নি’ অনুষ্ঠান৷ বর ও কনের মধ্যে আলাপ করিয়ে দেয়াই এর মূল লক্ষ্য৷ চট্টগ্রামের আরেকটি বিচিত্র আয়োজন হচ্ছে ‘ঘরজামাই বিয়া’৷
ছবি: STR/AFP/Getty Images
রাজশাহী অঞ্চলের বিয়ে
এই অঞ্চলের বিয়েতে থাকে পিঠার জয়জয়কার৷ বিয়ের কথাবার্তা ঠিক হওয়ার পর আঞ্চলিক গীতের তালে তালে বর-কনেকে নিজ নিজ বাড়িতে মিষ্টিমুখ করানো হয়৷ এই অনুষ্ঠানকে বলা হয় ‘থুবড়া’৷ সাধারণত ক্ষীর ও আন্ধাষা (তেলে ভাজা রাজশাহীর ঐতিহ্যবাহী মিষ্টি পিঠাবিশেষ) তৈরি করা হয়৷ এই মিষ্টি সাধারণত পাড়া-প্রতিবেশীর বাড়ি থেকে তৈরি করে পাঠানো হয় বর-কনের বাড়িতে৷
ছবি: Getty Images/A. Joyce
শেষ কথা
এতক্ষণ রীতির কথা বলা হলো৷ কিন্তু সব মানুষের পক্ষে সব নিয়ম পালন করা সম্ভব হয় না৷ কারণ তাঁদের সেই সামর্থ্য থাকে না৷ আবার এর উলটোটাও ঘটে৷ যাঁদের অনেক সামর্থ্য আছে, তাঁরা রীতির বাইরেও জাঁকজমকভাবে বিয়ের অনুষ্ঠান করে থাকেন৷