ভারত-বাংলাদেশের বন্ধুত্বের সম্পর্কেও রয়েছে নানা ঘাত-প্রতিধাত৷ ফাঁকফোকড়ও৷ তাকে অবহেলা করা যায় না৷
বিজ্ঞাপন
ভারতের এখন যত প্রতিবেশী দেশ আছে, তার মধ্যে এই মুহূর্তে বাংলাদেশের সঙ্গেই সম্পর্ক সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ এবং বন্ধুত্বের৷ তবে গত পঞ্চাশ বছরে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের মধ্যেও উত্থান-পতন হয়েছে৷ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের সাহায্য এবং তারপর স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনের উচ্ছ্বাসের মধ্যে দিয়ে যে সম্পর্কের সূচনা, বেগম জিয়ার সময়ে তা তলানিতে এসে ঠেকেছিল৷ আবার গত ১২ বছরে শেখ হাসিনার সময়ে তা আবার অত্যন্ত বন্ধুত্বপূর্ণ জায়গায় চলে এসেছে৷ তা সত্ত্বেও বিশেষজ্ঞদের মত হল, এখনো এই সম্পর্কের মধ্যে অনুযোগ আছে, অভিযোগ আছে, উদ্য়োগহীনতা আছে এবং প্রতিশ্রুতি পালনের গুরুতর সমস্যা আছে৷ যার জন্য ভারতকে উদ্যোগী হতে হবে৷ আর ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিও দুই দেশের সম্পর্কে প্রভাব ফেলছে, সে সম্পর্কে সচেতন হতে হবে৷
ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্কে চীনের ছায়াপাতের একটা সমস্যা আছে৷ সম্প্রতি ঢাকায় নিযুক্ত চীনের
রাষ্ট্রদূত বলেছিলেন, বাংলাদেশ যেন কোয়াডে যোগ না দেয়৷ দিলে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হবে৷ কোয়াড মানে ভারত, অ্যামেরিকা, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার জোট, যা মূলত চীনকে ঠেকাতে হয়েছে৷ নয়াদিল্লির থিঙ্ক ট্যাঙ্ক বিবেকানন্দ রিসার্চ ফাউন্ডেশনের সেন্টার হেড শ্রীরাধা দত্তের বক্তব্য, রাষ্ট্রদূতের ওই কথার পরের দিনই গ্লোবাল টাইমসে একই লাইনে একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে৷ অর্থাৎ, চীন ভেবেচিন্তেই এই লাইন নিয়েছে৷ যা ভারতকে ভাবাতে বাধ্য করেছে৷
ডয়চে ভেলেকে শ্রীরাধা জানিয়েছেন, ''চীন বেল্ট রোড ইনিসিয়েটিভে বাংলাদেশকে তেমন বিরাট মাপের কোনো আর্থিক সাহায্য করেনি৷ বরং ভারতের সঙ্গে ট্রান্স বর্ডার ট্রান্সপোর্ট করিডোরের কাজ অনেকটা এগিয়ে গেছে৷'' শ্রীরাধা বলেছেন, ‘‘সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী মোদী যখন বাংলাদেশে গেছিলেন, তখন প্রধানমন্ত্রী হাসিনা বলেছিলেন, মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডের সঙ্গে ভারত যে হাইওয়ে বানাতে চাইছে, তাতে বাংলাদেশও যোগ দিতে পারলে খুশি হবে৷ তাই স্বাভাবিকভাবে চীনের একটা আশঙ্কা থাকা অস্বাভাবিক নয়৷ এর উপর বাংলাদেশ কোয়াডে ঢুকে গেলে চীনের মুশকিল৷ তার উপর চীন চায়, ইন্দো-প্যাসিফিক নিয়ে বেইজিং ও দিল্লির বিরোধের মধ্যে ঢাকা যেন না জড়ায়৷ তাই চীন চাইবে, ভারত নয়, ঢাকা যেন তাদের দিকে থাকে৷’’
ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ইতিবৃত্ত
ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্ক কেমন? এক কথায় তার মূল্যায়ন কঠিন৷ বাংলাদেশের সাথে প্রতিবেশী দেশটির সম্পর্ক মধুর যেমন বলা চলে, তেমনি আবার কিছু তিক্ততাও আছে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/A.M. Ahad
বিপদের বন্ধু
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় অকৃত্রিম বন্ধুর ভূমিকায় ছিল ভারত৷ ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ দেশটির তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের প্রতি তাঁর সরকারের পূর্ণ সমর্থন দেন৷ পাকিস্তানি বাহিনীর অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচাতে বাঙ্গালীদের জন্য খুলে দেয়া হয় দেশটির সীমান্ত৷ নভেম্বরে গঠন হয় মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর যৌথ কমান্ড, যার পথ ধরে আসে বাংলাদেশের স্বাধীনতা৷
ছবি: Getty Images/AFP/
মৈত্রী চুক্তি
দুই দেশের শান্তি ও পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধির জন্য ১৯৭২ সালের ১৯ মার্চ মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষর করেন বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী৷ আঞ্চলিক অখণ্ডতা, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি সম্মান প্রদর্শনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতার মোট ১২ টি ধারা ছিল এতে৷ ১৯৯৭ সালের ১৯ মার্চ মেয়াদ শেষ হওয়ার পর চুক্তিটি আর নবায়ন হয়নি৷
ছবি: Getty Images/G. Crouch
বন্ধনে সংস্কৃতি
ভারতের সাথে বাংলাদেশের রয়েছে অবিচ্ছেদ্য এক সাংস্কৃতিক সম্পর্ক৷ এক সময় পশ্চিমবঙ্গ আর বাংলাদেশ ছিল একই অঞ্চল৷ দুই বাংলার মানুষের ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতিতেও আছে মিল৷ আছে পারস্পরিক যোগাযোগ৷ দুই দেশের মধ্যে সরকারিভাবে সাংস্কৃতিক বিনিময় চুক্তিও রয়েছে৷
ছবি: Getty Images
যোগাযোগে মৈত্রী
ভারতের সাথে বাংলাদেশের সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু আছে বহুদিন থেকে৷ কলকাতা-ঢাকা, শিলং-ঢাকা এবং ঢাকা হয়ে আগরতলা-কলকাতা নিয়মিত বাস যাতায়াত করে৷ ৬টি রেল লাইন ছাড়াও দু’টি ব্রডগেজ রেল সংযোগ আছে দুই দেশের মধ্যে৷ কলকাতা ও ঢাকার মধ্যে 'মৈত্রী এক্সপ্রেস' চলে সপ্তাহে চারদিন৷ ২০১৭ সালে চালু হয়েছে খুলনা-কলকাতা ‘বন্ধন এক্সপ্রেস’৷ এছাড়া বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে কলকাতা থেকে শিলিগুড়ি রেলযোগাযোগ চালুর কাজও চলছে৷
ছবি: DW/P. Mani
ভারসাম্যহীন বাণিজ্য
দুই দেশের বাণিজ্যের আকার ৯১৪ কোটি ডলার৷ ২০১৭-১৮ অথর্বছরে ভারত থেকে ৮৪৬ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করেছে বাংলাদেশ আর রপ্তানি করেছে মাত্র ৬৮ কোটি ডলারের পণ্য৷ রপ্তানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বেশিরভাগ পণ্যে শুল্কমুক্ত ও কোটামুক্ত সুবিধা পেলেও ভারতের বিরুদ্ধে অশুল্ক বা শুল্কবহির্ভূত বাধা তৈরির অভিযোগ রয়েছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/D. Dutta
বাংলাদেশে ভারতের বিনিয়োগ
২০১৭ সালে বাংলাদেশে ভারতের সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ৫১ কোটি ডলার৷ টেলিযোগাযোগ, ঔষধ, অটোমোবাইলসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতে দেশটির প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসা আছে৷ এছাড়া ২০১৭ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরের সময় ভারতের সঙ্গে ১০ বিলিয়ন ডলারের ১৩টি চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/P. U. Ekpei
বিদ্যুৎ আমদানি
বর্তমানে ভারতের ত্রিপুরা থেকে এক হাজার ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করছে বাংলাদেশ৷ ভারতের জাতীয় তাপবিদ্যুৎ কর্পোরেশন (এনটিপিসি) ও বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি)-র অংশীদারিত্বে রামপালে নির্মিত হচ্ছে বিতর্কিত কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র৷ এছাড়াও ২০১৭ সালের এপ্রিলে শেখ হাসিনার দিল্লি সফরকালে দুই দেশের মধ্যে ৩৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন, সরবরাহ ও অর্থায়ন সংক্রান্ত চুক্তি স্বাক্ষর হয়৷
ছবি: Getty Images/AFP/P. Malukas
জ্বালানি সহযোগিতা
বাংলাদেশে যেসব দেশের প্রতিষ্ঠান পরিশোধিত তেল সরবরাহ করে তার একটি ভারতের নুমালিগড় রিফাইনারি লিমিটেড৷ সেখান থেকে ডিজেল আমদানির জন্য শিলিগুড়ি থেকে পার্বতীপুর পর্যন্ত ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী পাইপলাইন নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে দুই দেশের সরকার৷ ২০১৮ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর ভিডিও কনফারেন্সে এর উদ্বোধন করেন শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদী৷
ছবি: Reuters/E. Gaillard
সমুদ্র বিরোধের নিষ্পত্তি
বঙ্গোপসাগরে ২৫,৬০২ বর্গ কিলোমিটার এলাকা নিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বিরোধ ছিল৷ তার মধ্যে ২০১৪ সালের জুলাই মাসে নেদারল্যান্ডসের স্থায়ী সালিশি আদালতের রায়ে ১৯,৪৬৭ বর্গ কিলোমিটার এলাকা পেয়েছে বাংলাদেশ৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/Str
ছিটমহল বিনিময়
২০১৫ সালের জুলাইতে দুই দেশের মধ্যে অমীমাংসিত ছিটমহল বিনিময় চুক্তি বাস্তবায়ন হয়৷ ভারতের ১১১টি ছিটমহল যুক্ত হয় বাংলাদেশের সাথে আর সেখানকার বাসিন্দারা পায় বাংলাদেশের নাগরিকত্ব৷ একইভাবে ভারতের অভ্যন্তরে থাকা বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহলও লীন হয়ে যায় দেশটির সাথে৷
ছবি: AFP/Getty Images
প্রাণঘাতী সীমান্ত
দুই দেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকলেও সীমান্তে দেশটির আচরণে তার প্রতিফলন নেই৷ গত ১০ বছরে ২৯৪ বাংলাদেশি নাগরিককে হত্যা করেছে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিএসএফ৷ সীমান্ত পারাপারে অস্ত্র ব্যবহার করবে না দুই দেশ, ২০১১ সালে বিজিবি-বিএসএফ পর্যায়ে এমন চুক্তি হলেও বন্ধ হয়নি সীমান্ত হত্যা৷
ছবি: AP
ফারাক্কা বাঁধ
গঙ্গা নদীতে বাংলাদেশ সীমান্তের ১৮ মাইল উজানে ফারাক্কা বাঁধ তৈরি করে ভারত৷ ১৯৬১ সালে শুরু হয়ে কাজ শেষ হয় ১৯৭৫ সালে৷ শুস্ক মৌসুমে বাঁধের গেট বন্ধ রেখে বাংলাদেশে পানি প্রবাহে বাধা তৈরি করে ভারত৷ অন্যদিকে বর্ষায় খুলে দেয়া হয় সবগুলো গেট, যার ফলে উত্তরাঞ্চলে দেখা দেয় বন্যা৷
তিস্তা চুক্তি
১৯৮৭ সালের পর থেকে তিস্তার পানি নিয়ে ভারতের সাথে কোনো চুক্তি নেই বাংলাদেশের৷ একতরফাভাবে তিস্তার পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে দেশটি৷ ফলে বাংলাদেশ অববাহিকায় পানিসংকট চলছে৷ ২০১১ সালের ভারতের তখনকার প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং-এর ঢাকা সফরে এই বিষয়ে চুক্তি সই হওয়ার কথা থাকলেও এখনো তা হয়নি৷
ছবি: DW/A. Chatterjee
রোহিঙ্গায় পাশে নেই
রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের পাশে নেই প্রতিবেশী রাষ্ট্রটি৷ শুরু থেকেই এ বিষয়ে মিয়ানমারের অবস্থানকেই বরং সমর্থন জানিয়ে আসছে দিল্লি৷ এমনকি সম্প্রতি জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের (ইউএনএইচআরসি) অধিবেশনে রোহিঙ্গাদের নিয়ে এক ভোটাভুটিতেও বাংলাদেশের বিপক্ষে ভোট দিয়েছে দেশটি৷
ছবি: Getty Images/P. Bronstein
নতুন জটিলতা এনআরসি
সম্প্রতি হালনাগাদ নাগরিকঞ্জি প্রকাশ করে ভারতের আসাম রাজ্য৷ তাতে রাতারাতি নাগরিকত্ব হারিয়েছেন ১৯ লাখেরও বেশি মানুষ, যাদের বেশিরভাগ মুসলিম৷ বাদ পড়াদের অনুপ্রবেশকারী হিসেবে অভিহিত করে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর কথা বলে আসছে ক্ষমতাসীন বিজেপির নেতারা, যা বাংলাদেশের জন্য নতুন উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/A. Nath
ক্রিকেটের উত্তেজনা
বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের ক্রিকেটের সম্পর্কটাও রাজনীতির মতোই ঐতিহাসিক৷ টাইগাররা ঢাকায় প্রথম টেস্ট খেলেছিল ভারতের বিপক্ষেই, ২০০০ সালে৷ তবে ভারতে টেস্ট খেলার সুযোগের জন্য ১৭ বছর অপেক্ষা করতে হয় বাংলাদেশকে৷ দুই দলের মধ্যে ওয়ানডে আর টি-টোয়েন্ট অবশ্য হয়েছে অনেক৷ সেখানে বেশ কিছু টানটান উত্তেজনার ম্যাচও হয়েছে৷ আগামী নভেম্বরে এই প্রথম দুই টেস্টের সিরিজ খেলতে ভারত সফরে যাবে বাংলাদেশ দল৷
ছবি: Getty Images/AFP/P. Singh
16 ছবি1 | 16
পররাষ্ট্র নীতি বিশেষজ্ঞ প্রণয় শর্মা মনে করেন, ‘‘কোনো দেশ তো শুধু একটা দেশের সঙ্গেই ভাল সম্পর্ক রাখে না৷ তারা নিজেদের স্বার্থে আরো অনেক দেশের সঙ্গেই বন্ধুত্ব রাখে৷ ফলে ভারতের সঙ্গে একটা বিশেষ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আছে বলে বাংলাদেশ যে চীনের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখবে না, তা হয় না৷ প্রতিটি দেশ অন্য দেশের সঙ্গে সম্পর্ক রাখে নিজেদের স্বার্থের কারণে৷ পঞ্চাশ বছর আগে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারত যে সাহায্য করেছিল, তা দিয়ে চিরদিন চলতে পারে না৷ ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক রাখাটা যে বাংলাদেশের পক্ষে লাভজনক, সেটা ঢাকাকে বুঝতে হবে৷ ভারতকেও বোঝাতে হবে৷ তাদের অগ্রাধিকারকেও ভারতকে বুঝতে হবে৷’’
তবে প্রণয়ের মতে, ‘‘দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতকে কেউ অগ্রাহ্য করার জায়গায় নেই৷ আর ভারতের অর্থনীতি আরো ভালো হলে তার প্রতিক্রিয়া প্রতিবেশী দেশের উপরেও পড়বে৷ সেক্ষেত্রে ভারতের বিনিয়োগ করার ক্ষমতাও বাড়বে৷ তাছাড়া বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কটা তো কূটনৈতিক বা আর্থিক নয়, সামাজিক এবং দুই দেশের মানুষের সম্পর্কও৷ ভাষা, সংস্কৃতি, পোশাক, খাবারের নৈকট্যের সম্পর্ক৷ সেই সম্পর্কের একটা আলাদা জোর আছে এবং থাকবেও৷’’
তাই বলে ভারতকে নিয়ে বাংলাদেশের অভিয়োগ নেই এমন নয়৷ তার উপর ঢাকায় ভারতের সাবেক হাই কমিশনার দেব মুখোপাধ্যায় মনে করেন, ভারতের অভ্যন্তরীণ নীতিও দুই দেশের সম্পর্কে প্রভাব ফেলেছে৷ ডয়চে ভেলেকে দেব মুখোপাধ্যায় বলেছেন, ‘‘ভারতের অভ্যন্তরীণ বেপরোয়া বিভাজনের রাজনীতির প্রভাব বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে পড়ছে৷ ভারতে যদি মুসলিমদের টার্গেট করে উইপোকা বলা হয়., তার একটা প্রভাব পড়বেই৷ বছর দেড়েক আগে সিএএ, এনআরসি নিয়ে শেখ হাসিনার এক মন্ত্রী বলেছিলেন, তাদেরও জনমত খেয়াল রাখতে হয়৷’’ তার বক্তব্য, ‘‘পশ্চিমবঙ্গের ভোট প্রচারেও বল হলো, না খেতে পেয়ে ওপার থেকে মানুষ চলে আসে৷ অথচ ঘটনা হলো, বছর দুয়েকের যে কোনো পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ভারতের থেকে এগিয়ে৷ অথচ, ভারতের নেতা-মন্ত্রীরা এই ঔদ্ধত্য দেখাচ্ছেন৷’’
দেব মুখোপাধ্যায় মনে করেন, ‘‘ওদের তিস্তার জলের দরকার ছিল, আমরা সেটা দিতে পারিনি৷ কিন্তু যে অভিযোগ ৪৫ বছর ধরে শুনছি, ভারত বাংলাদেশের প্রয়োজন মেটায় না, এর মধ্যে কোনো সত্যতা নেই৷’’
প্রবীণ সাংবাদিক সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায় ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন, ‘‘পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জয়ের পর বাংলাদেশের বিদেশমন্ত্রীর বার্তা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ৷ তিনি মমতাকে চিঠিতে লিখেছিলেন, আমরা আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ৷কারণ, আপনি বাঙালির দীর্ঘ লালিত মূল্যবোধ, ধর্মীয় সম্প্রীতি, ও ভাতৃত্ববোধ ধারণ করেছেন এবং এক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু সারা জীবন অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন৷’’ সৌম্য মনে করেন, ‘‘ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক ভালো আছে ও থাকবেও৷ কিন্তু সামাজিক ও রাজনৈতিক সম্পর্কে একটা টানাপোড়েনের ইঙ্গিত পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বার্তায় আছে৷ বিজেপির বিভাজনের নীতি বাংলাদেশ পছন্দ করছে না৷’’
তাহলে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের ভবিষ্যৎ কী হবে? শ্রীরাধার মতে, ‘‘ভারতকে প্রতিশ্রুতি পালন করতে হবে৷ যে প্রকল্প করবে বলেছে, তা দ্রুত শেষ করতে হবে্৷ ভ্যাকসিন দেব বলে তারপর পিছিয়ে আসা চলবে না৷ আর এটা তো কূটনীতি নয়, এটা বাণিজ্য৷ আর ভারতকে নিজের ব্যবহারও ঠিক করতে হবে৷ ভারতের দাদাগিরির মনোভাব নিয়ে প্রতিবেশী দেশগুলির একটা অভিযোগ আছে৷ সেটা খেয়াল রাখতে হবে৷ তাদের দিকে সাহায্যের হাতও বাড়াতে হবে৷’’
ভবিষ্যতে ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্ক কোনদিকে যাবে? দেব মুখোপাধ্যায়ের মত হলো, ‘‘দুই দেশ যদি বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখে তাহলে দুই দেশেরই লাভ৷ ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সেভাবে তো কিছু বলা যায় না৷ তবে কিছু সংকেত আছে, যা চিন্তার৷’’
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির বড় চ্যালেঞ্জগুলো
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে অর্থনীতিতে বাংলাদেশ ধীরে ধীরে শক্তিশালী হয়ে উঠছে৷ পাল্লা দিয়ে বাড়ছে আঞ্চলিক রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জও৷ বেশ কিছু বিষয়ে যেমন বাংলাদেশের কূটনৈতিক সাফল্য রয়েছে, তেমনিই রয়েছে কিছু অমীমাংসিত ইস্যুও৷
ছবি: Getty Images/AFP/D. Sarkar
ভারতে এনআরসি ও বাংলাদেশবিরোধী মনোভাব
আসাম ও পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনের আগে থেকেই ভারতের কেন্দ্রীয় বিজেপি নেতাদের মুখে শোনা গেছে বাংলাদেশ-বিরোধী নানা মন্তব্য৷ বাংলাদেশ বরাবরই এসব মন্তব্যকে ভারতের ‘অভ্য়ন্তরীণ বিষয়’ বলে এড়িয়ে এসেছে৷ তবে বাংলাদেশও তার বাইরে থাকতে পারেনি৷ ‘অনুপ্রবেশকারীদের’ বাংলাদেশি বলে চিহ্নিত করা, বাংলাদেশের হিন্দুদের নাগরিকত্ব দেয়ার ঘোষণা দিয়ে আইন পাস করার বিষয়টি বড় প্রভাব ফেলছে দুই দেশের সম্পর্কেও৷
ছবি: Mohsin Javed
চীনের অর্থনৈতিক আধিপত্য
বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ-এর মাধ্যমে সিল্ক রোডকে আবার চালু করার চেষ্টা চালাচ্ছে চীন৷ এই উদ্যোগে বঙ্গোপসাগর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ৷ বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অবকাঠামো খাতে বড় বিনিয়োগ নিয়ে হাজির চীন৷ ২০১৯ সালে চীন থেকে বাংলাদেশে নতুন বিনিয়োগ এসেছে এক হাজার ৪০৮ মিলিয়ন ডলার। আমদানিতে চীনের ওপরই বাংলাদেশ বেশি নির্ভর করে৷ তবে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে চীনের এমন একক আধিপত্য নিয়ে অনেকের মধ্যে রয়েছে শঙ্কাও৷
ছবি: Jia Qing/HPIC/picture alliance
ভারত-চীন দ্বন্দ্ব
বিশ্বে সুপার পাওয়ার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে চীন৷ অন্যদিকে দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক সুপার পাওয়ার হতে চায় ভারতও৷ ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানের কারণেই চীন ও ভারত দুই দেশের কাছেই বাংলাদেশ খুব গুরুত্বপূর্ণ৷ দক্ষিণ এশিয়াতে আধিপত্য নিয়ে বেশ কিছু ইস্যুতে মুখোমুখি অবস্থানে দুই দেশ৷ এই দ্বন্দ্বে অর্থনৈতিক উপাদানের পাশাপাশি ভারত-মার্কিন জোট কোয়াডও রয়েছে৷ এই দ্বন্দ্বে বাংলাদেশের অবস্থান কী হয়, সেটিও একটি বড় চ্যালেঞ্জ৷
ছবি: picture-alliance/Photoshot/Z. Ling
অভিন্ন নদীর পানিবন্টন
ভারতের সঙ্গে ৫৪টি অভিন্ন নদী রয়েছে বাংলাদেশের৷ তবে এখন পর্যন্ত গঙ্গা বা পদ্মা ছাড়া অন্য কোনো নদীর পানিবণ্টন নিয়েই ভারত ও বাংলাদেশ মতৈক্যে পৌঁছাতে পারেনি৷ তিস্তা নদীর পানিবণ্টন দুই দেশের সম্পর্কে বড় ধরনের প্রভাব ফেলছে৷ ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির দ্বন্দ্ব কাজে লাগিয়ে এই খাতেও ঘটেছে চীনের প্রবেশ৷ বাংলাদেশে তিস্তার নদী ব্যবস্থাপনায় চীনের মেগাপ্রজেক্ট দুশ্চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে ভারতের কপালেও৷
ছবি: DW/A. Chatterjee
রোহিঙ্গা সংকট
কেবল বাংলাদেশের জন্য নয়, রোহিঙ্গা সংকট আন্তর্জাতিক ইস্যুতে পরিণত হয়েছে৷ তবে সেটিকে আন্তর্জাতিকভাবে মোকাবিলা না করে মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সমাধানে পৌঁছানোর পথ বেছে নিয়েছে বাংলাদেশ৷ একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে গাম্বিয়ার করা মামলায় সহযোগিতাও করছে বাংলাদেশ৷ এই ইস্যুতেও ভারত ও চীনকে বারবার কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার আহ্বান জানানো হলেও এখনও তেমন উদ্যোগ আসেনি কোনো পক্ষ থেকেই৷
ছবি: CARE/T. Haque
ইউরোপের সঙ্গে বাণিজ্য
ইউরোপের সঙ্গে কূটনীতিতে বরাবরই বাণিজ্য গুরুত্ব পেয়ে এসেছে৷ বর্তমানে স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) হিসেবে বাংলাদেশকে পণ্য রপ্তানিতে জিএসপি বা শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার দিয়ে আসছে ইউরোপ৷ ২০২৪ সালে এলডিসি থেকে বের হলে বাংলাদেশ এই সুবিধা হারাতে পারে৷ তবে এরপর ‘জিএসপি প্লাস’ নামে একই ধরনের আরেকটি সুবিধার সুযোগ রয়েছে৷ কিন্তু সেজন্য শ্রম অধিকার, মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নয়নসহ বিভিন্ন শর্ত রয়েছে ইইউ এর৷
ছবি: Daniel Reinhardt/dpa/picture alliance
ইসরায়েল-ফিলিস্তিন দ্বন্দ্ব
সবশেষ ইসরায়েল-হামাস পালটাপালটি রকেট হামলার মধ্যেও নিন্দা জানিয়েছে বাংলাদেশ৷ এই সংকটে বাংলাদেশ যে দুই রাষ্ট্র সমাধানে বিশ্বাসী- সেটিও স্পষ্টভাবেই জানিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়৷ তবে একই সঙ্গে মার্কিন মধ্যস্থতায় মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশের ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয়া এবং বাংলাদেশের পাসপোর্ট থেকে ‘except Israel’ শব্দ দুটি তুলে দেয়ার বিষয়টি কোন পরিবর্তন বয়ে আনে সে বিষয়ে কৌতুহলেরও জন্ম দিয়েছে৷