1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ঢাকা : যে শহরের রাজপথে, অলিগলিতে সহস্র অপরাধ

হারুন উর রশীদ স্বপন ঢাকা
১১ নভেম্বর ২০২২

প্রায় দুই কোটি মানুষের শহর রাজধানী ঢাকা৷ জনবহুল এ শহরে বহু অপরাধীরও বসবাস৷ অপরাধ দমনে কতটা তৎপর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী? কত ধরনের অপরাধের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়? গ্রেপ্তার হয় কতজন অপরাধী?

ঢাকার রাস্তা
ছবি: DW/M. M. Rahman

পুলিশের নথি বলছে, ঢাকা শহরের কিছু এলাকা কম অপরাধপ্রবণ, কিছু এলাকা বেশি অপরাধপ্রবণ৷ অপরাধীদের সংখ্যা নির্ণয়ের চেষ্টাও করে পুলিশ৷ অপরাধীদের প্রেফাইলও রাখা হয়৷ সেখানে দেখা যায় কোনো কোনো অপরাধী একের পর এক অপরাধ করছে, গ্রেপ্তার হচ্ছে এবং তারপর জামিনে ছাড়া পেয়ে আবার একই অপরাধে জড়াচ্ছে৷

পুলিশের কাছে আপরাধের যে হিসাব পাওয়া যায় তা মূলত প্রাপ্ত অভিযোগের ভিত্তিতে তৈরি৷ তবে পুলিশ স্বপ্রণোদিত হয়ে সন্দেহজনকভাবে কাউকে গ্রেপ্তার করলে সেই তথ্যও থাকে হিসেবে৷

‘বায়ান্ন বাজার তেপ্পান্ন গলির শহর’ ঢাকায় মহানগর পুলিশ গত ৯ মাসে (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর) ৪৫ হাজার ৫৫৭ জনকে বিভিন্ন মামলায় গ্রেপ্তার করেছে৷ গড়ে  প্রতি মাসে গ্রেপ্তার হয়েছেন পাঁচ হাজারের বেশি৷এই সময়ে মামলা হয়েছে ২২ হাজার ২৮৭টি৷ গড়ে প্রতি মাসে মামলা হয় আড়াই হজারের মতো৷

অপরাধ ও মামলার রকমফের

অপরাধের তালিকায় হত্যাকাণ্ড, ধর্ষণ, চুরি, ডাকাতি, প্রতারণা- বলতে গেলে সব আছে৷ পুলিশ তাদের নিয়ম অনুযায়ী অপরাধের যে ধরন নির্ধারণ করে, তার মধ্যে আছে ডাকাতি, খুনসহ ডাকাতি, দস্যুতা, খুন, দাঙ্গা, আইন-শৃঙ্খলা ভঙ্গকারী অপরাধ (দ্রুত বিচার আইন), নারী ও শিশু নির্যাতন, অপহরণ, চুরি, ছিনতাই, অস্ত্র, মাদক, প্রতারণা, জালিয়াতি, দুদক, বিশেষ ক্ষমতা আইন, পুলিশের ওপর হামলা, দাঙ্গা, অপহরণ, চাঁদা, মুক্তিপণ, পাচার প্রভৃতি৷ এসব অপরাধের আবার নানা উপ-বিভাগ আছে৷

সবচেয়ে বেশি ধর্ষণ ও নারী ও শিশু নির্যাতন

পুলিশের হিসেবে ঢাকায় সবচেয়ে বেশি যে অপরাধ হয় তা হলো ধর্ষণসহ নারী ও শিশু নির্যাতন৷ ৯ মাসে এ অপরাধের মামলা হয়েছে এক হাজার ৫০৭টি৷ এরপর চুরি- এক হাজার ২৫৫টি৷ এর বাইরে পুলিশ উদ্ধার অভিযানের পর যে মামলা করে তাতে শীর্ষে আছে মাদকদ্রব্য৷ এই সময়ে পুলিশ মাদকের মোট মামলা করেছে ১২ হাজার ৫০৩টি৷ প্রতি মাসে গড়ে এক হাজার ৩৮৯টি মাদকের মামলা করে পুলিশ৷  ৯ মাসে ছিনতাইয়ের মামলা হয়েছে মাত্র ৭২টি!

‘চোরের রাজা’ সিধেল চোর

ঢাকায় অনেক দালান-কোঠা থাকলেও  চুরির মধ্যে সিধেল চুরিই বেশি৷ সিধেল চুরি হলো শাবল দিয়ে সিঁদ কেটে চুরি৷ ওই  ৯ মাসে এই ধরনের চুরি হয়েছে ৫৬১টি৷ এছাড়া আছে গ্রিল কেটে চুরি, তালা ভেঙে চুরি, গাড়ি চুরি, তার চুরিসহ আরো অনেক ধরনের চুরি৷ রাজধানী শহরে গরু চুরির ঘটনাও ঘটেছে চারটি৷

কম ও বেশি অপরাধের এলাকা

সবচেয়ে বেশি চুরি হয় তেজগাঁ এলাকায়৷ তারপরে রয়েছে রমনা ও মিরপুর৷ সবচেয়ে কম চুরি হয় লালবাগ এলাকায়৷ উত্তরা এবং গুলশানেও চোরদের উৎপাত কম নয়৷ ছিনতাইয়েও সবচেয়ে এগিয়ে আছে আছে তেজগাঁ এলাকা৷ তারপরে উত্তরা, মিরপুর ও ওয়ারির অবস্থান৷ ৯ মাসে ঢাকায় ১৩৪টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে৷ বেশি খুন হয়েছে ওয়ারিতে ৩০টি৷ তারপরে মিরপুরে- ২৬টি৷ সবচেয়ে বেশি ডাকাতি হয় মিরপুর এবং ওয়ারিতে৷অন্যদিকে এই সময়ে সবচেয়ে কম ডাকাতি হয়েছে গুলশানে৷

মাদকদ্রব্যে এগিয়ে লালবাগ, মতিঝিল ও মিরপুর৷ তবে ঢাকার সব এলাকায়ই মাদকের ভয়ংকর থাবা দেখা যায়৷ ৯ মাসে সর্বনিম্ন মাদকসংক্রান্ত মামলা হয়েছে রমনা এলাকায়- ৮৪৪টি৷

ধর্ষণসহ নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটেছে ওয়ারি ও মতিঝিলে৷

এক বছর আগে যেমন ছিল ঢাকা

২০২১ সালের ১২ মাসে ঢাকায় বিভিন্ন অপরাধে মামলা হয়েছে ২৭ হাজার ৪৬১টি৷ মাদক দ্রব্যের মামলাই ছিল শীর্ষে- ১৬ হাজার ২১৬টি৷ তারপরে ধর্ষণসহ নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলা- দুই হাজার ২১৮টি৷ তৃতীয় অবস্থানে ছিল চুরি- এক হাজার ৩৪৩টি৷ সেই একবছরে ঢাকায় গরু চুরিও হয়েছে চারটি৷

পুলিশের প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী ২০২১ সালে ঢাকায় হত্যাকাণ্ড ঘটেছে ১৬৬টি, অপহরণ ৪৯টি এবং ডাকাতি ১৬৬টি৷

তৈরি হচ্ছে অপরাধীদের ডাটাবেজ

ঢাকায় বিভিন্ন অপরাধে জড়িতদের ডাটাবেজ তৈরি হচ্ছে৷ আটকের সময়ের তথ্যের ভিত্তিতে এই ডাটাবেজ তৈরির কাজ চলছে৷ তবে এখন পর্যন্ত চোর আর ছিনতাইকারীর ডাটাবেজ তৈরিতেই জোর দেয়া হয়েছে ৷ ঢাকার ৫০টি থানা এলাকায় ৫৪৪ জায়গা চিহ্নিত হয়েছে৷ ওইসব জায়গায় ছিনতাইকারীরা সবচেয়ে বেশি সক্রিয়৷ পাঁচশ'র মতো ছিনতাইকারীর ডাটাবেজ তৈরি হয়েছে৷ তবে তাদের সংখ্যা আরো বেশি বলে জানায় পুলিশ৷ তাই ডাটাবেজে তাদের সংখ্যা বাড়বে৷ অন্যদিকে চার হাজার চোরের একটি ডাটাবেজ তৈরির কাজ চলছে৷ ওই ডাটাবেজে চোরদের নাম-পরিচয় ছাড়াও কোন চোর কোন ধরনের চুরিতে দক্ষ, কতগুলি চুরি করেছে, কতবার গ্রেপ্তার হয়ে ছাড়া পেয়েছে- তা-ও থাকছে৷

ঢাকা শহরে মানুষ যেন নির্লিপ্ত: পুলিশ কর্মকর্তা মশিউর রহমান

This browser does not support the audio element.

ঝোঁক বাড়ছে চুরিতে

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা বিভাগের উপ পুলিশ কমিশনার মশিউর রহমান বলেন, ‘‘ঢাকায় ছিনতাই ও ডাকাতিসহ কিছু অপরাধ কমেছে৷ কিন্তু চুরি বাড়ছে৷ এর কারণ ছিনতাই ও ডাকাতিকে অনেক বেশি ঝুঁকি নিতে হয়৷ ধরা পড়লে শাস্তি বেশি৷ কিন্তু প্রাপ্তি সব সময় ভালো হয় না৷ তাই ওই অপরাধীরা চুরিতে ঝুঁকছে৷ আগে আন্তঃজেলা ডাকাত ছিল এখন আন্তঃজেলা চোর হয়েছে, এমনকি ঢাকায় আগে একেক এলাকায় একেক গ্রুপ চুরি করত, এখন চোররা পুরো ঢাকা শহরেই চুরি করে৷’’

তিনি বলেন, ‘‘এই চোররা এখন ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে৷ তারা ঢাকার বাইরে থেকে এসে রেকি করে যায়, পরে আবার এসে চুরি করে৷ তারা ভুয়া ন্যাশনাল আইডি কার্ড দিয়ে সিম নিয়ে তা ব্যবহার করে৷’’ এমন জালিয়াতির প্রয়োগ ডাকাতি ও ছিনতাইসহ অন্য অপরাধের ক্ষেত্রেও হচ্ছে বলে জানান তিনি৷

‘ঢাকার মানুষ নির্লিপ্ত’

প্রতারণা ও ডিজিটাল অপরাধ বেড়েছে বলেও জানান উপ পুলিশ কমিশনার মশিউর রহমান৷ নারী নির্যাতন,  বিশেষ করে ধর্ষণের পিছনেও আছে ডিজিটাল প্রযুক্তি৷

তিনি বলেন, ‘‘আমরা ডাটাবেজ তৈরি করছি, তাদের ওপর নজরদারিও বাড়িয়েছি৷ চক্রগুলোর সদস্যদের গ্রেপ্তার করছি৷ কিন্তু ঢাকা শহরে মানুষ যেন নির্লিপ্ত৷ একজনের সামনে দিয়ে পাশের বাড়ির কিছু কেউ চুরি করে নিয়ে গেলে তিনি কিছু বলেন না৷ আমাদের আরো সামাজিক হতে হবে আর হতে হবে সচেতন৷’’

আমাদের পুলিশ নানা ধরনের অপরাধ দমনে পুরোপুরি দক্ষ নয়: ঢাবি অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান

This browser does not support the audio element.

অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধিতে সামাজিক বৈষম্যের প্রভাব

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান বলেন, ‘‘দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে আশা করা হয়েছিল ছিনতাই, চুরির মতো অপরাধ কমে যাবে৷ কিন্তু এখন শুধু ঢাকা শহর নয়, সারাদেশেই এটা বেড়ে যাচ্ছে৷ করোনার অভিঘাত ও  অর্থনৈতিক মন্দার কারণে যারা পেশাদার নয়, তারাও এই ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে৷ আর আধুনিকতার অপব্যপব্যবহারে ধর্ষণও উদ্বেগজনকহারে বেড়ে গেছে৷ বেড়েছে কিশোর অপরাধ, মাদক৷’’

তার মতে, ‘‘অপরাধের একটি ঐতিহাসিক ধারা আছে, তার সঙ্গে আবার এখনকার প্রযুক্তি যুক্ত হয়ে অপরাধের নতুন ধারা যুক্ত হয়েছে৷ ঢাকা একটা মেগাসিটি, সে কারণে সব ধরনের অপরাধের প্রবণতা এখানে থাকে৷ আর এই শহরে আছে ব্যাপক আর্থিক এবং সামাজিক বৈষম্য, যা হতাশার সৃষ্টি করে এবং অপরাধ বাড়িয়ে দেয়৷’’

তার কথা, ‘‘আমাদের যে পুলিশ, তারা এই নানা ধরনের অপরাধ দমনে পুরোপুরি দক্ষ নয়৷ তাদের দক্ষতা এবং আধুনিক প্রযুক্তি জ্ঞান আরো বাড়াতে হবে৷’’

‘‘এখানে কিন্তু হোয়াইট কলার ক্রাইম অব্যাহত আছে৷ আরো বাড়বে৷ ঘুস, দুর্নীতি, ব্যাংকের টাকা লুটপাট, অর্থ পাচার বন্ধ হচ্ছে না৷ এটাও প্রভাব ফেলে৷ যাদের নেই, তারাও অপরাধে জড়িয়ে পড়ে,’’ অভিমত এই অপরাধ বিজ্ঞানীর৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ