হিন্দু পুরোহিত এবং সেবক হত্যার পর এবার ঢাকার রামকৃষ্ণ মিশনের অধ্যক্ষ স্বামী ধ্রুভেশানন্দ মহারাজকে চিঠি দিয়ে হত্যার হুমকি দেয়া হয়েছে৷ বলা বাহুল্য, এ সব হত্যা এবং হুমকির ঘটনায় আতঙ্কে আছেন বাংলাদেশের হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা৷
বিজ্ঞাপন
কাজল দেবনাথ
নিরপত্তার কারণে ঢাকেশ্বরী মন্দিরে দু'মাস ধরে বন্ধ আছে সব রকম সামাজিক অনুষ্ঠান৷ পুরোহিত, হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতা এবং সাধারণ অনুসারীদের কথায়, তাঁরা এখনো ধর্ম পালনে কোনো বাধার মুখে না পড়লেও দিন দিন আতঙ্ক বাড়ছে৷
বুধবার তথকথিত ইসলামিক স্টেট বা আইএস-এর নামে পাঠানো চিঠিতে রামকৃষ্ণ মিশনের অধ্যক্ষকে বলা হয়, ‘‘বাংলাদেশ একটি ইসলামি রাষ্ট্র৷ এখানে ধর্মপ্রচার করতে পারবি না৷ ধর্মপ্রচার করা হলে ২০ থেকে ৩০ তারিখের মধ্যে তোকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হবে৷''
এ বিষয়ে স্বামী ধ্রুভেশানন্দ মহারাজ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘হুমকির পর আমাদের নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে৷ যাঁরা মিশনে আসেন তাঁদের তল্লাশি করা হয়৷ আমরা আতঙ্কে থাকলেও আমাদের ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান ঠিকমত করছি৷ তাতে কোনো সমস্যা হচ্ছে না৷''
কাজল দেবনাথ
তিনি জানান, ‘‘এর আগেও বালিয়াটি রামকৃষ্ণ মিশনের অধ্যক্ষকে হত্যার হুমকি দেয়া হয়েছিল৷ সারাদেশে রামকৃষ্ণ মিশনের ১৪টি শাখা আছে৷ এছাড়া ব্যক্তিগত উদ্যোগে আছে আরো ১০০টি আশ্রম৷ আমরা সবাইকে সাবধানে, সতর্কতার সঙ্গে চলাফেরা এবং দৈনন্দিন কাজ করতে বলেছি৷ যেখানে প্রয়োজন হবে সেখানে পুলিশের সহযোগিতা নেয়ারও পরামর্শ দিয়েছি৷''
মিশন অধ্যক্ষ বলেন, ‘‘সারাবিশ্বেই এখন উগ্রবাদী-সন্ত্রাসী তৎপরতা বাড়ছে৷ বাংলাদেশও তার বাইরে নয়৷''
এদিকে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি মণ্ডলির সদস্য কাজল দেবনাথ ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘সারাদেশে ২৪ হাজারের মতো মন্দির আছে৷ ঢাকাসহ বড় বড় কিছু মন্দিরে পুলিশের নিরপত্তা আছে৷ তবে সব মন্দিরে পুলিশ দিয়ে সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা দেয় সম্ভব নয়৷ এরজন্য প্রয়োজন সামাজিক উদ্যোগ এবং সচেতনতা৷''
স্বামী ধ্রুভেশানন্দ মহারাজ
তিনি বলেন, ‘‘এটা সত্য যে পুরোহিত ও সেবক হত্যা, মন্দিরে হামলাসহ নানা ঘটনায় হিন্দুসহ সংখ্যালঘুরা আতঙ্কে আছেন৷ কিন্তু পূজা অর্চনায় কোনো বাধা নেই এবং সমস্যাও হচ্ছে না৷''
ভিন্ন এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘ঢাকার ঢাকেশ্বরী মন্দিরে নিয়মিত পূজা-অর্চনা হলেও সামাজিক অনুষ্ঠান বন্ধ আছে গত দু'মাস ধরে৷ পুরিস্থিতি বিবেচনায় পুলিশ চিঠি দিয়ে সামাজিক অনুষ্ঠান বন্ধ রাখতে অনুরোধ করেছে৷ আমরাও তাই বন্ধ রেখেছি৷''
সামাজিক অনুষ্ঠানের ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, ‘‘পূজা-অর্চনা ছাড়াও ঢাকেশ্বরী মন্দিরে বিয়ে, শ্রাদ্ধসহ নানা সামাজিক অনুষ্ঠান হয়৷ এখানে কমিউনিটি সেন্টার আছে৷ আপাতত এ সব অনুষ্ঠান বন্ধ আছে৷''
ওদিকে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও আতঙ্ক আছে৷ পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলার তিনটি মন্দিরের সেবক তপন ভৌমিক ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘আমরা এখনো কোনো হুমকি পাইনি৷ আমাদের পূজা বা ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালনেও কোনো সমস্যা হচ্ছে না৷ তবে চারদিকে যা শুনি তাতে ভয় পাই৷''
তবে হিন্দু সম্প্রদায়ের এই নেতা ও পুরোহিত এবং সেবকরা বলেন, ‘‘বাংলাদেশে এখনো ধর্মীয় সম্প্রীতি অটুট আছে৷ সব ধর্মের অনুসারীরা মিলে মিশেই আছেন৷ রাষ্ট্র এবং সরকার সহযোগিতা দিচ্ছে৷''
মালোপাড়ার হিন্দুদের কান্না থামেনি
বাংলাদেশের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট দেয়াকে ঘিরে যশোরের অভয়নগর উপজেলার মালোপাড়ায় ৫ জানুয়ারি সন্ধ্যায় হিন্দুদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়ার পাশাপাশি লুটপাটও করা হয়৷
ছবি: DW
নেই নিরাপত্তাকর্মীর সাড়া
যশোরের অভয়নগরের চাপাতলী গ্রামের প্রবেশপথে পুলিশের সতর্ক অবস্থান৷ গত ৫ জানুয়ারি জাতীয় নির্বাচনের দিন এই গ্রামের নিম্নবর্ণের হিন্দু অধ্যুষিত মালোপাড়ায় বসবাসরতদের উপর সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটে৷ আক্রান্তরা জানান, ঘটনাস্থলের মাত্র পাঁচ কিলোমিটার দূরে থানার অবস্থান হলেও অনেক ফোন করেও সে সময়ে পুলিশ কিংবা কোনো নিরাপত্তাকর্মীর সাড়া মেলেনি৷
ছবি: DW
‘নদী ঠাকুর’
দুর্বৃত্তদের হামালায় লণ্ডভণ্ড মায়া রানি বিশ্বাসের একমাত্র মাথা গোঁজার ছোট্ট নিবাস৷ সেদিন হামলা শুরু হলে পাশের বুড়ি ভৈরব নদীতে ঝাঁপ দিয়ে ওপারে উঠে প্রাণে বেঁচে যান বিধবা এই নারী৷ তাঁর ভাষায় ‘নদী ঠাকুর’ সেদিন না থাকলে জানটা হয়ত থাকতো না৷
ছবি: DW
প্রাণ বাঁচাতে নদীতে
নিজের ঘরের ভাঙা আসবাব, টেলিভিশনের পাশে মালোপাড়ার গৃহবধু উজ্জ্বলা বিশ্বাস৷ হামলাকারীদের ভয়াবহ রূপ সামান্য দেখেছিলেন তিনি৷ প্রাণ বাঁচাতে তিনিও ঝাঁপ দেন বুড়ি ভৈরবে৷ হামলার সময়ে তাঁর মনে হয়েছিল যে ভগবান সেদিন পাশে ছিলেন না৷
ছবি: DW
বই-পত্র পুড়িয়ে দিয়েছে
কলেজ পড়ুয়া মঙ্গলা বিশ্বাসের বই-পত্র, এমনকি সার্টিফিকেটও পুড়িয়ে দিয়েছে হামলাকারীরা৷
ছবি: DW
সুন্দর স্বপ্নে চির
হামলাকারীদের ভেঙে দেয়া আয়নায় কলেজ পড়ুয়া মঙ্গলা বিশ্বাসের প্রতিবিম্ব৷ বাড়ির দেয়ালে টাঙানো এই ভাঙা আয়নার মতোই মঙ্গলার সুন্দর স্বপ্নেও চির ধরিয়েছে হামলাকারীরা৷ মঙ্গলার আক্ষেপ, তাঁর বই-পত্র আর সার্টিফিকেট কী দোষ করলো?
ছবি: DW
আত্মীয়দের বাড়িতে আশ্রয়
হামলার ছয় দিন পরে এঁরা ফিরছেন বাড়িতে৷ হামলার সময় পার্শ্ববর্তী গ্রামে আত্মীয়দের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন তাঁরা৷
ছবি: DW
হামলার প্রত্যক্ষদর্শী
৮৬ বছর বয়সি মৃত্যুঞ্জয় সরকার সেদিনের হামলার প্রত্যক্ষদর্শী৷ ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ও দেশ ছাড়েননি তিনি৷ কিন্তু হামলার পর তাঁর মনে হচ্ছিল যে, সে সময়ে ছেড়ে যাওয়াটাই উচিত ছিল তাঁর৷
ছবি: DW
গাছও রেহাই পায়নি
বাড়ি-ঘরের পাশাপাশি মালোপাড়ার গাছও জ্বালিয়ে দিয়েছিল দুর্বৃত্তরা৷
ছবি: DW
পলাতক জামায়াত নেতা
মালোপাড়ায় হামলার পরে চাপাতলী গ্রামের পার্শ্ববর্তী গ্রাম বালিয়াডাঙ্গায় স্থানীয় জামায়াতে ইসলামীর থানা আমীর মাওলানা আব্দুল আজিজের বাড়ি ভাঙচুর করে যৌথবাহিনী৷ ঘটনার আগে থেকেই পলাতক রয়েছেন এ জামায়াত নেতা৷
ছবি: DW
আক্রান্তদের অভিযোগ
জাতীয় সংসদের সাবেক হুইপ আওয়ামী লীগ নেতা শেখ আব্দুল ওহাব৷ মালোপাড়ায় সাম্প্রদায়িক হামলার জন্য জামায়াত শিবির ছাড়াও স্থানীয় আওয়ামী লীগের দলীয় কোন্দলকেও দায়ী করেছেন অনেকে৷ সাবেক এই সাংসদ দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পেতে ব্যর্থ হয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে লড়েছেন৷ সেখানে নতুন প্রার্থী হিসেবে রণজিৎ রায় মনোনয়ন পাওয়ায় এই দুই জনের সমর্থকদের মাঝে বেশ উত্তেজনা ছিল পুরো নির্বাচনের সময়টায়৷
ছবি: DW
গণধর্ষণ
যশোরের আরেক ভয়াল জনপদ মনিরামপুর উপজেলার হাজরাইল গ্রামের দাসপাড়ার বাসিন্দা অনারতী দাস৷ ৭ জানুয়ারি রাতে তাঁর সামনেই অস্ত্রের মুখে একদল দুবৃত্ত গণধর্ষণ করে পুত্রবধু মনিমালা দাস আর ভাতিজি রূপালী দাসকে৷
ছবি: DW
ভয়াবহ দৃশ্যের প্রত্যক্ষদর্শী
কার্তিক দাসকেও সেদিন রাতে সেই ভয়াবহ দৃশ্যের প্রত্যক্ষদর্শী হতে হয়েছিল৷ দাসপাড়ায় গণধর্ষণের শিকার নিম্নবর্ণের হিন্দু মনিমালা দাসের শ্বশুর ও রূপালী দাসের চাচা তিনি৷
ছবি: DW
বাড়িঘর ছেড়েছেন
দাসপাড়ায় গণধর্ষণের শিকার হওয়া পরিবার দুটি আতঙ্কে বাড়িঘর ছেড়েছেন৷
ছবি: DW
শুধুই আতঙ্ক
দাসপাড়ার এক নারী৷ দাসপাড়ার নারীদের এখন নির্ঘুম রাত কাটে আতঙ্কে৷