1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান
বিচার ব্যবস্থাবাংলাদেশ

ঢালাও মামলায় ঢালাও বিপদ !

শেখ হাফিজুর রহমান
শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন
২২ নভেম্বর ২০২৪

ঢালাও মামলা বাংলাদেশে নতুন কিছু নয়৷ বিগত সরকারের তিন মেয়াদের শেষ ৭/৮ বছর ঢালাও মামলা এক ভয়াবহ আকার ধারন করেছিল৷ পুলিশ মামলা দিয়ে দিতো শত শত মানুষের নামে৷

৫ আগস্টের পর থেকে ঢালাও মামলাও ভয়াবহ হয়ে উঠেছেছবি: Privat

মামলা যাদের নামে দেওয়া হতো, তাদের সকলেই বিরোধী দলগুলোর নেতা-কর্মী৷ এরপর গ্রেপ্তার, পুলিশি হয়রানি, মামলা বাণিজ্য – এসব মিলে আইন ও পুলিশ পরিণত হয়েছিল নিপীড়নের হাতিয়ারে৷

৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরে ৮ আগস্ট অর্ন্তবর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে৷ ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থানের মূল চেতনা ছিল রাষ্ট্র সংস্কার৷ সেই সংস্কারের কেন্দ্রে রয়েছে আইনের শাসন ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা, পুলিশ, প্রশাসন ও বিচার বিভাগের সংস্কার, সামষ্টিক অর্থনীতির শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা, এবং একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা৷ কিন্তু অর্ন্তবর্তী সরকার তাদের প্রথম চ্যালেঞ্জ স্থিতিশীল আইন-শৃঙ্খলা ব্যবস্থা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সফলতার পরিচয় দিতে পারেনি৷ সরকারের প্রথম ১০০ দিন অতিক্রান্ত হওয়ার পরেও পুলিশ শতভাগ সক্রিয়তা নিয়ে কাজ করতে পারছে না৷ ফলে, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, ও হত্যা নৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ এদিকে ৫ আগস্টের পর থেকে ঢালাও মামলাও ভয়াবহ হয়ে উঠেছে৷ সাবেক প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, এমপি, ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হয়েছে একের পর এক৷ সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে যে, ঢালাও মামলা থেকে বাদ পড়েননি সাংবাদিক, লেখক, শিল্পী, ও বিশ্ববরেণ্য ক্রিকেটারগণও৷

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত বাংলাদেশের বিভিন্ন থানায় প্রায় আড়াই শ'র মতো মামলা হয়েছে৷ অধিকাংশ মামলায় শেখ হাসিনা ছাড়া তার সরকারের সাবেক মন্ত্রী, সাবেক সামরিক কর্মকর্তা, আওয়ামী লীগের নেতা, পুলিশের সাবেক আইজিপি, ডিএমপির সাবেক কমিশনারসহ পুলিশের বিভিন্ন পদমর্যাদার কর্মকর্তাকে আসামি করা হয়েছে৷ মামলাগুলোতে অভিযোগ আনা হয়েছে, গত ১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতা=কর্মী ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা গুলি ছোঁড়েন৷ এতে অনেক আন্দোলনকারী গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন৷ আহত হন অনেকে৷  

উদাহরণ হিসেবে চট্টগ্রামের একটি মামলার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে৷ চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী মামুন আলী সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বোন শেখ রেহানা, ছেলে জয়, মেয়ে সায়মা, শেখ রেহানার ছেলে ববি, মেয়ে টিউলিপসহ ৪২৫ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করেন৷ মামলায় বাদীর বক্তব্য গ্রহণের পর মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট সালাউদ্দিন মামলাটি গ্রহণের আগে প্রাথমিক তদন্তের জন্য পিবিআইকে নির্দেশ দিলে আদালতে বাদীর পক্ষের আইনজীবীদের দ্বারা হট্টগোল শুরু হয়৷ তারা দাবি করেন, পিবিআইকে তদন্ত নয়; সরাসরি থানায় মামলা নেওয়ার আদেশ দিতে হবে৷ আদালতের বারান্দায় তখন ১০০ থেকে ১৫০ জন লোক স্লোগান দিতে থাকে আদালতের আদেশের বিরুদ্ধে৷ বিচারক বিব্রত হয়ে খাস কামরায় চলে যান৷ পরে মামলাটি সরাসরি থানায় নেওয়ার আদেশ দেন৷

উল্লেখ্য, জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের সময়ে প্রায় ১ হাজার ৫ শ' জনের মতো মানুষ হত্যাকাণ্ডের শিকার হন৷ তাদের মধ্যে আছেন শিশু, কিশোরসহ নানা বয়সের মানুষ৷ আহতও হয়েছেন কয়েক হাজার৷ কোনো একক আন্দোলনে এত মানুষের মৃত্যু শুধু বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীতেই বিরল৷ এসকল মৃত্যুর ঘটনায় দায়েরকৃত শত শত হত্যা মামলায় এজাহারের ধরন প্রায় একই রকম৷ অসংখ্য আসামির পাশাপাশি প্রায় প্রত্যেকটি মামলাতে অজ্ঞাতনামা কয়েক হাজার আসামি করা হয়েছে৷ এভাবে হাজার হাজার আসামি করে ঢালাও মামলা করার অসুবিধা হচ্ছে, প্রথমত পুলিশ এখানে অজ্ঞাতনামা আসামির তালিকায় যে কারো নাম ঢুকিয়ে দিতে পারে এবং তার কাছ থেকে টাকা নিয়ে নাম কেটে দিতে পারে৷ দ্বিতীয়ত, এসব মামলা তদন্ত করতে গিয়ে অনেক সময় প্রয়োজন হবে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে মামলার তদন্তই শেষ করা যাবে না৷ তৃতীয়ত, বিচারিক প্রক্রিয়াতে গিয়েও অভিযুক্তের সংখ্যা অত্যধিক হওয়াতে সুষ্ঠু বিচার হবে কিনা সেটি নিয়ে সন্দেহ থেকে যায়৷ অনেক অভিজ্ঞ আইনজীবী মনে করেন যে, এ ধরনের ঢালাও মামলা ফৌজদারি বিচারিক প্রক্রিয়ার প্রথম দু' ধাপই অতিক্রম করতে পারবে না৷

এ সকল মামলার এজাহারের ক্ষেত্রে যে ধরনের অসঙ্গতি ও গড়াপেটা লক্ষ্য করা যাচ্ছে, সেটি কেচ্ছা-কাহিনিকেও হার মানায়৷ উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায় যে, ৫ আগস্ট সরকার পতনের আগে বিভিন্ন থানায় ৩৪টি মামলা দায়ের করা হয়েছিল৷ সেসব মামলায় কোটাবিরোধী অজ্ঞাতনামা আন্দোলনকারী, জামায়াত-শিবির, ও বিএনপি নেতা-কর্মীদের আসামি করা হয়েছিল৷ আন্দোলন চলাকালে ১৬ জুলাই নিউমার্কেট এলাকায় এক সংঘর্ষে শাহাজাহান আলী ও সবুজ আলী নামে দু'জন নিহত হন৷ এ ঘটনায় নিহতদের স্বজনরা বাদী হয়ে নিউমার্কেট থানায় দু'টি হত্যা মামলা দায়ের করেন৷

পৃথক দু'টি মামলার এজাহারে বলা হয়েছিল, ঘটনার দিন অজ্ঞাতনামা কোটাবিরোধী আন্দোলনকারী, জামায়াত, শিবির ও বিএনপি নেতা-কর্মীরা এক হয়ে সায়েন্সল্যাব ক্রসিং থেকে বিভিন্ন স্লোগান দিতে দিতে লোহার রড, হকিস্টিক, লাঠিসোঁটা ইত্যাদি দেশীয় অস্ত্রসহ নিউমার্কেটের দিকে এগিয়ে আসে৷ পরে অজ্ঞাতনামা কোটাবিরোধী আন্দোলনকারী, শিবির এবং বিএনপি নেতা-কর্মীরা রড, লাঠি এবং অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে ভিকটিমদের ওপর আক্রমণ করে৷

নিহত শাহজাহানের বাবা ইমাম হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, "ঘটনার সময় আমার স্ত্রী অসুস্থ থাকায় আমরা জানতাম না এজাহারে কী ছিল৷ ওটি থানা থেকে দিয়েছিল৷ পরে যখন জেনেছি আমরা থানায় গিয়ে ওইটা ঠিক করাইছি৷” সপ্তাহ দেড়েক আগে পূর্বের এজাহার পরিবর্তন করা হয় জানিয়ে মি. হোসেন বলেন, "বহুত গ্যাঞ্জাম হইছে এটা নিয়ে৷ প্রথমে এজাহার ঠিক করতে চায় নাই পুলিশ৷ পরে যখন বলি সংবাদ সম্মেলন করবো তখন তারা ঠিক করতে রাজি হয়৷ বিএনপি-জামায়াত এটার সঙ্গে জড়িত ছিল না, কেন তাদের দিছেন এটা বলছি তাদের৷ পরে এজাহারে সালমান এফ রহমান, আনিসুল হক এবং মেজর জিয়াউল হক জিয়াকে আসামি করা হইছে৷ ওই এজাহার আদালতে পাঠানো হয়েছে৷”

এভাবে গড়াপেটা করে এজাহার করলে সেই মামলা টেকানো মুশকিল হবে; কেননা, এজাহার হচ্ছে অপরাধ সংঘটনের প্রাথমিক নথি এবং মামলার অন্যতম প্রধান ভিত্তি৷ এরকম এজাহার যদি আদালতে না টেকে, তাহলে এ ধরনের মামলার কোনো ভবিষ্যৎ নেই৷ ফৌজদারি মামলার প্রধান বিবেচ্য বিষয় হলো, কে বা কারা অপরাধ সংঘটন করলো, ঘটনার স্থান, সময়, কিভাবে ঘটনা সংঘটিত হলো ইত্যাদি৷ এজাহারে এসব বিষয়ের প্রাথমিক তথ্য থাকে৷ তদন্তে আরো তথ্য আসতে পারে৷ কিন্তু এফআইআর দুটো বা দু'ধরনের হতে পারে না৷ তাহলে মামলার ভিত্তি দুর্বল হয়ে যায়, এবং মামলার ভবিষ্যৎ হয়ে পড়ে অনিশ্চিত৷ এসব ঢালাও মামলার ব্যাপারে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন যে, এজাহারে এ ধরনেরে সংশোধনীর কারণে মামলা ইতিমধ্যেই আইনগতভাবে দুর্বল হয়ে গেছে৷ ফলে মামলায় অভিযুক্ত সাবেক মন্ত্রী, ব্যবসায়ী, এমপিদের দোষ প্রমাণ করে শাস্তি হওয়ার সম্ভাবনা কম৷

আমাদের বুঝতে হবে যে, ফৌজদারি মামলার মূল নীতি হচ্ছে - মামলায় আনীত অভিযোগ বা অভিযোগসমূহ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করে দোষী ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের শাস্তি নিশ্চিত করা৷ সেজন্য, বিচারিক আদালতে এজাহার, সুরতহাল রিপোর্ট, ময়না তদন্ত রিপোর্ট, অপরাধের আলামত, ডিএনএ রিপোর্ট, ও অন্যান্য সাক্ষ্য-প্রমাণের মাধ্যমে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে হয় যে, অভিযুক্ত ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ অপরাধটি করেছেন৷ এ জন্য রাষ্ট্র তথা সরকারের পক্ষে পুলিশ কর্মকর্তা ও পাবলিক প্রসিকিউটরদের দক্ষতার সঙ্গে নিখুঁতভাবে কাজ করতে হয়৷ সেটি করা না গেলে ঢালাও মামলা দিয়ে সাাবেক মন্ত্রী, এমপি, ব্যবসায়ী, ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের দৌড়ের ওপর রাখা যাবে সত্যি, যেমনটি আগের সরকার রেখেছিলেন বিএনপি-জামাতের নেতাকর্মীদের; কিন্তু তাতে প্রকৃত দোষীদের বিচারের মাধ্যমে শাস্তি দেওয়াটা থেকে যাবে অনিশ্চিত৷

অক্টোবরের ছবিঘরটি দেখুন...

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

আরো সংবাদ দেখান
স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ