ঢালাও মামলা বাংলাদেশে নতুন কিছু নয়৷ বিগত সরকারের তিন মেয়াদের শেষ ৭/৮ বছর ঢালাও মামলা এক ভয়াবহ আকার ধারন করেছিল৷ পুলিশ মামলা দিয়ে দিতো শত শত মানুষের নামে৷
বিজ্ঞাপন
মামলা যাদের নামে দেওয়া হতো, তাদের সকলেই বিরোধী দলগুলোর নেতা-কর্মী৷ এরপর গ্রেপ্তার, পুলিশি হয়রানি, মামলা বাণিজ্য – এসব মিলে আইন ও পুলিশ পরিণত হয়েছিল নিপীড়নের হাতিয়ারে৷
৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরে ৮ আগস্ট অর্ন্তবর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে৷ ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থানের মূল চেতনা ছিল রাষ্ট্র সংস্কার৷ সেই সংস্কারের কেন্দ্রে রয়েছে আইনের শাসন ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা, পুলিশ, প্রশাসন ও বিচার বিভাগের সংস্কার, সামষ্টিক অর্থনীতির শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা, এবং একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা৷ কিন্তু অর্ন্তবর্তী সরকার তাদের প্রথম চ্যালেঞ্জ স্থিতিশীল আইন-শৃঙ্খলা ব্যবস্থা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সফলতার পরিচয় দিতে পারেনি৷ সরকারের প্রথম ১০০ দিন অতিক্রান্ত হওয়ার পরেও পুলিশ শতভাগ সক্রিয়তা নিয়ে কাজ করতে পারছে না৷ ফলে, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, ও হত্যা নৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ এদিকে ৫ আগস্টের পর থেকে ঢালাও মামলাও ভয়াবহ হয়ে উঠেছে৷ সাবেক প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, এমপি, ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হয়েছে একের পর এক৷ সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে যে, ঢালাও মামলা থেকে বাদ পড়েননি সাংবাদিক, লেখক, শিল্পী, ও বিশ্ববরেণ্য ক্রিকেটারগণও৷
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত বাংলাদেশের বিভিন্ন থানায় প্রায় আড়াই শ'র মতো মামলা হয়েছে৷ অধিকাংশ মামলায় শেখ হাসিনা ছাড়া তার সরকারের সাবেক মন্ত্রী, সাবেক সামরিক কর্মকর্তা, আওয়ামী লীগের নেতা, পুলিশের সাবেক আইজিপি, ডিএমপির সাবেক কমিশনারসহ পুলিশের বিভিন্ন পদমর্যাদার কর্মকর্তাকে আসামি করা হয়েছে৷ মামলাগুলোতে অভিযোগ আনা হয়েছে, গত ১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতা=কর্মী ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা গুলি ছোঁড়েন৷ এতে অনেক আন্দোলনকারী গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন৷ আহত হন অনেকে৷
উদাহরণ হিসেবে চট্টগ্রামের একটি মামলার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে৷ চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী মামুন আলী সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বোন শেখ রেহানা, ছেলে জয়, মেয়ে সায়মা, শেখ রেহানার ছেলে ববি, মেয়ে টিউলিপসহ ৪২৫ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করেন৷ মামলায় বাদীর বক্তব্য গ্রহণের পর মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট সালাউদ্দিন মামলাটি গ্রহণের আগে প্রাথমিক তদন্তের জন্য পিবিআইকে নির্দেশ দিলে আদালতে বাদীর পক্ষের আইনজীবীদের দ্বারা হট্টগোল শুরু হয়৷ তারা দাবি করেন, পিবিআইকে তদন্ত নয়; সরাসরি থানায় মামলা নেওয়ার আদেশ দিতে হবে৷ আদালতের বারান্দায় তখন ১০০ থেকে ১৫০ জন লোক স্লোগান দিতে থাকে আদালতের আদেশের বিরুদ্ধে৷ বিচারক বিব্রত হয়ে খাস কামরায় চলে যান৷ পরে মামলাটি সরাসরি থানায় নেওয়ার আদেশ দেন৷
উল্লেখ্য, জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের সময়ে প্রায় ১ হাজার ৫ শ' জনের মতো মানুষ হত্যাকাণ্ডের শিকার হন৷ তাদের মধ্যে আছেন শিশু, কিশোরসহ নানা বয়সের মানুষ৷ আহতও হয়েছেন কয়েক হাজার৷ কোনো একক আন্দোলনে এত মানুষের মৃত্যু শুধু বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীতেই বিরল৷ এসকল মৃত্যুর ঘটনায় দায়েরকৃত শত শত হত্যা মামলায় এজাহারের ধরন প্রায় একই রকম৷ অসংখ্য আসামির পাশাপাশি প্রায় প্রত্যেকটি মামলাতে অজ্ঞাতনামা কয়েক হাজার আসামি করা হয়েছে৷ এভাবে হাজার হাজার আসামি করে ঢালাও মামলা করার অসুবিধা হচ্ছে, প্রথমত পুলিশ এখানে অজ্ঞাতনামা আসামির তালিকায় যে কারো নাম ঢুকিয়ে দিতে পারে এবং তার কাছ থেকে টাকা নিয়ে নাম কেটে দিতে পারে৷ দ্বিতীয়ত, এসব মামলা তদন্ত করতে গিয়ে অনেক সময় প্রয়োজন হবে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে মামলার তদন্তই শেষ করা যাবে না৷ তৃতীয়ত, বিচারিক প্রক্রিয়াতে গিয়েও অভিযুক্তের সংখ্যা অত্যধিক হওয়াতে সুষ্ঠু বিচার হবে কিনা সেটি নিয়ে সন্দেহ থেকে যায়৷ অনেক অভিজ্ঞ আইনজীবী মনে করেন যে, এ ধরনের ঢালাও মামলা ফৌজদারি বিচারিক প্রক্রিয়ার প্রথম দু' ধাপই অতিক্রম করতে পারবে না৷
এ সকল মামলার এজাহারের ক্ষেত্রে যে ধরনের অসঙ্গতি ও গড়াপেটা লক্ষ্য করা যাচ্ছে, সেটি কেচ্ছা-কাহিনিকেও হার মানায়৷ উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায় যে, ৫ আগস্ট সরকার পতনের আগে বিভিন্ন থানায় ৩৪টি মামলা দায়ের করা হয়েছিল৷ সেসব মামলায় কোটাবিরোধী অজ্ঞাতনামা আন্দোলনকারী, জামায়াত-শিবির, ও বিএনপি নেতা-কর্মীদের আসামি করা হয়েছিল৷ আন্দোলন চলাকালে ১৬ জুলাই নিউমার্কেট এলাকায় এক সংঘর্ষে শাহাজাহান আলী ও সবুজ আলী নামে দু'জন নিহত হন৷ এ ঘটনায় নিহতদের স্বজনরা বাদী হয়ে নিউমার্কেট থানায় দু'টি হত্যা মামলা দায়ের করেন৷
আদালতে বিচারপ্রার্থীদের যত দুর্ভোগ
আদালত অঙ্গনে গিয়ে বিচারপ্রার্থীদের অভিজ্ঞতার কথা শুনেছে ডয়চে ভেলে৷ তাদের নানা ধরনের দুর্ভোগের কথা থাকছে ছবিঘরে...
ছবি: DW/M. Mostafigur Rahman
সন্তানের জন্য মায়ের সংগ্রাম
সাভারের অ্যানি আক্তার তার মেয়ে রাবিয়া বুসরিকে নিয়ে তিন মাসে একবার ঢাকার আদালতে আসেন সন্তানের ভরণপোষণের টাকা নিতে। রাবিয়ার বাবার সঙ্গে বিচ্ছেদের পর আদালতের মাধ্যমে মাসিক তিন হাজার টাকা ভরণপোষণের জন্য নির্ধারিত হলেও সেই টাকা তুলতে ঢাকায় যাতায়াত ও অন্যান্য কাজে প্রায় দেড় হাজার টাকা খরচ হয়। বাকি টাকায় মেয়ের খরচ চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন অ্যানি। তবুও মেয়ের ভবিষ্যতের জন্য অ্যানি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন।
ছবি: Abdul Goni
শারমিনের অভিজ্ঞতা
ঢাকার মিরপুরের শারমিন আক্তার। তার ভাই ইব্রাহিম সরকার পালিয়ে একটি মেয়েকে বিয়ে করেন। ইব্রাহিম ও শারমিনের বিরুদ্ধে ওই মেয়েটির বাবা ধর্ষণ মামলা করেছেন। সেই মামলায় শারমিন ছয় মাস জেলও খেটেছেন। একজন নারী হওয়া সত্ত্বেও তার বিরুদ্ধে ধর্ষণ মামলা দেয়ায় তিনি বিস্মিত ও হতাশ৷ ন্যায় বিচারের আশায় তাকে প্রতি মাসেই আদালতে আসতে হয়। শারমিন জানালেন, মামলার পেছনে তার অনেক টাকাও খরচ হয়েছে।
ছবি: Abdul Goni
বিগত সরকারের আমলের মামলার কারণে আদালতে আসা-যাওয়া
কৃষক দলের সদস্য হারুনুর রশিদ সুমন। রাজনীতির কারণে বিগত সরকারের আমলে তার বিরুদ্ধে ৩৬টি মামলা হয়েছে। ৫ আগস্টের পট পরিবর্তনের পর অনেকের মামলা প্রত্যাহার করা হলেও সুমনের মামলাগুলো আগের মতোই আছে। কিভাবে মামলা প্রত্যাহার হবে, কার কাছে যাবেন, কাকে ধরলে কাজ হবে জানেন না তিনি। তারপরও মামলা প্রত্যাহার হবে এমন আশায় প্রতিদিনই আসছেন পুরনো ঢাকার কোর্টে।
ছবি: Abdul Goni
ছেলেকে নিয়ে আদালতে
ছেলে আলামিন শুভর স্ত্রী গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। ছেলের কারণে গত দুই বছর ধরে আদালতের বারান্দায় ঘুরছেন আব্দুর রাজ্জাক। তার দাবি, স্বামীর সঙ্গে অভিমান করে শুভর স্ত্রী আত্মহত্যা করেছে। কিন্তু শুভর স্ত্রীর পরিবারের সদস্যরা প্রভাবশালী হওয়ায় হত্যা মামলা করেছে। সেই মামলায় জেল খেটেছে শুভ। এখন প্রতিনিয়তই হাজিরা দিতে ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে আসেন আব্দুর রাজ্জাক।
ছবি: Abdul Goni
মামলার নিষ্পত্তিতে ধীর গতি
মামলা নিষ্পত্তিতে অনেক সময় লাগছে বলে মনে করেন ঢাকা আইনজীবী সমিতির সভাপতি খুরশিদ মিয়া আলম। বর্তমান সরকারের কাছে মানুষের যে প্রত্যাশা, সেই গতিতে মামলার নিষ্পত্তি হচ্ছে না বলেই মত তার। তিনি বলেন, লাখ লাখ রাজনৈতিক মামলা ছিল। সেগুলোর নিষ্পত্তি হচ্ছে কিছু কিছু। কিছু মামলা রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তের বিষয়। ঘন ঘন জজদের বদলিতেও বিচার কিছুটা বিঘ্ন হচ্ছে। বিচারপ্রার্থীদের ন্যায় বিচার, সুবিচার পেতে সময় লাগছে।
ছবি: Abdul Goni
‘নারী নির্যাতন-মাদকসহ অন্যান্য মামলায় প্রশাসনের নজর কম’
অন্তর্বর্তী সরকারের তিন মাসে মানুষের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি বলে মনে করেন আইনজীবী মোরশেদ হোসেন শাহীন। তার মতে, ‘‘উল্টো দুর্ভোগ বেড়েছে। রাজনৈতিক মামলার কারণে নারী-মাদকসহ স্বাভাবিক সময়ে যে মামলাগুলো হয়, সেগুলো হচ্ছে না। এসব মামলার দিকে প্রশাসন নজর দিতেও পারছে না। প্রশাসনকে অস্থির মনে হচ্ছে। এই সরকারের আমলে ন্যায় বিচারের প্রত্যাশা ছিল, সেটা পূরণ হচ্ছে না।’’
ছবি: Privat
আদালতেও বৈষম্য
আদালতেও এক ধরনের বৈষম্য হচ্ছে বলে মনে করেন আইনজীবী আমিনুল গনি টিটো। তার মতে, রাজনৈতিক মামলা কিছুটা কমলেও অন্যান্য মামলা আগের মতোই আছে। আদালতে বিচারপ্রার্থী বা আইনজীবীদের ওপর হামলার ঘটনায় এক ধরনের বৈষম্য তৈরি হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘‘আগে কিন্তু আইনজীবীদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেনি। এই পরিস্থিতিতে আইনজীবীরা আদালতে দাঁড়াতে ভয় পাচ্ছেন। এভাবে তো আদালত চলতে পারে না।’’
ছবি: Privat
‘সাধারণ বিচারপ্রার্থীদের দুর্ভোগ আগের মতোই’
আগে জজ সাহেবরা অনেক বেশি চাপে থাকতেন বলে মনে করেন আইনজীবী তরিকুল ইসলাম। এখন জজ সাহেবদের উপর সেই চাপ নেই। পরিস্থিতিতে এক ধরনের ইতিবাচক গতি এসেছে। তবে তিনি মনে করেন, সাধারণ বিচারপ্রার্থীদের দুর্ভোগ আগের মতোই আছে। এখন একজন বিচারপ্রার্থী এক বছর পর একটি ডেট পান। সেদিনও যদি শুনানি না হয় তাহলে তারা তো হতাশ হবেনই।
ছবি: Privat
ন্যায় বিচারের আশায়
তিন সন্তানকে নিয়ে কেরানীগঞ্জের পলি আক্তারের এখন দিন কাটছে থানা আর আদালতের বারান্দায়। ন্যায়বিচারের আশায় সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত আদালতেই থাকছেন। তার স্বামী মো. কবির তার দেখাশোনা করে না। কিস্তিতে ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা দিয়ে একটি গাড়ি কিনে দিয়েছিলেন পলি। সেই গাড়ি নিয়ে কবির তাকে ছেড়ে চলে যায়। এখন স্বামীর বিচার চেয়ে ঘুরছেন আদালতের দরোজায়।
ছবি: Abdul Goni
9 ছবি1 | 9
পৃথক দু'টি মামলার এজাহারে বলা হয়েছিল, ঘটনার দিন অজ্ঞাতনামা কোটাবিরোধী আন্দোলনকারী, জামায়াত, শিবির ও বিএনপি নেতা-কর্মীরা এক হয়ে সায়েন্সল্যাব ক্রসিং থেকে বিভিন্ন স্লোগান দিতে দিতে লোহার রড, হকিস্টিক, লাঠিসোঁটা ইত্যাদি দেশীয় অস্ত্রসহ নিউমার্কেটের দিকে এগিয়ে আসে৷ পরে অজ্ঞাতনামা কোটাবিরোধী আন্দোলনকারী, শিবির এবং বিএনপি নেতা-কর্মীরা রড, লাঠি এবং অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে ভিকটিমদের ওপর আক্রমণ করে৷
নিহত শাহজাহানের বাবা ইমাম হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, "ঘটনার সময় আমার স্ত্রী অসুস্থ থাকায় আমরা জানতাম না এজাহারে কী ছিল৷ ওটি থানা থেকে দিয়েছিল৷ পরে যখন জেনেছি আমরা থানায় গিয়ে ওইটা ঠিক করাইছি৷” সপ্তাহ দেড়েক আগে পূর্বের এজাহার পরিবর্তন করা হয় জানিয়ে মি. হোসেন বলেন, "বহুত গ্যাঞ্জাম হইছে এটা নিয়ে৷ প্রথমে এজাহার ঠিক করতে চায় নাই পুলিশ৷ পরে যখন বলি সংবাদ সম্মেলন করবো তখন তারা ঠিক করতে রাজি হয়৷ বিএনপি-জামায়াত এটার সঙ্গে জড়িত ছিল না, কেন তাদের দিছেন এটা বলছি তাদের৷ পরে এজাহারে সালমান এফ রহমান, আনিসুল হক এবং মেজর জিয়াউল হক জিয়াকে আসামি করা হইছে৷ ওই এজাহার আদালতে পাঠানো হয়েছে৷”
এভাবে গড়াপেটা করে এজাহার করলে সেই মামলা টেকানো মুশকিল হবে; কেননা, এজাহার হচ্ছে অপরাধ সংঘটনের প্রাথমিক নথি এবং মামলার অন্যতম প্রধান ভিত্তি৷ এরকম এজাহার যদি আদালতে না টেকে, তাহলে এ ধরনের মামলার কোনো ভবিষ্যৎ নেই৷ ফৌজদারি মামলার প্রধান বিবেচ্য বিষয় হলো, কে বা কারা অপরাধ সংঘটন করলো, ঘটনার স্থান, সময়, কিভাবে ঘটনা সংঘটিত হলো ইত্যাদি৷ এজাহারে এসব বিষয়ের প্রাথমিক তথ্য থাকে৷ তদন্তে আরো তথ্য আসতে পারে৷ কিন্তু এফআইআর দুটো বা দু'ধরনের হতে পারে না৷ তাহলে মামলার ভিত্তি দুর্বল হয়ে যায়, এবং মামলার ভবিষ্যৎ হয়ে পড়ে অনিশ্চিত৷ এসব ঢালাও মামলার ব্যাপারে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন যে, এজাহারে এ ধরনেরে সংশোধনীর কারণে মামলা ইতিমধ্যেই আইনগতভাবে দুর্বল হয়ে গেছে৷ ফলে মামলায় অভিযুক্ত সাবেক মন্ত্রী, ব্যবসায়ী, এমপিদের দোষ প্রমাণ করে শাস্তি হওয়ার সম্ভাবনা কম৷
আমাদের বুঝতে হবে যে, ফৌজদারি মামলার মূল নীতি হচ্ছে - মামলায় আনীত অভিযোগ বা অভিযোগসমূহ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করে দোষী ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের শাস্তি নিশ্চিত করা৷ সেজন্য, বিচারিক আদালতে এজাহার, সুরতহাল রিপোর্ট, ময়না তদন্ত রিপোর্ট, অপরাধের আলামত, ডিএনএ রিপোর্ট, ও অন্যান্য সাক্ষ্য-প্রমাণের মাধ্যমে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে হয় যে, অভিযুক্ত ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ অপরাধটি করেছেন৷ এ জন্য রাষ্ট্র তথা সরকারের পক্ষে পুলিশ কর্মকর্তা ও পাবলিক প্রসিকিউটরদের দক্ষতার সঙ্গে নিখুঁতভাবে কাজ করতে হয়৷ সেটি করা না গেলে ঢালাও মামলা দিয়ে সাাবেক মন্ত্রী, এমপি, ব্যবসায়ী, ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের দৌড়ের ওপর রাখা যাবে সত্যি, যেমনটি আগের সরকার রেখেছিলেন বিএনপি-জামাতের নেতাকর্মীদের; কিন্তু তাতে প্রকৃত দোষীদের বিচারের মাধ্যমে শাস্তি দেওয়াটা থেকে যাবে অনিশ্চিত৷
অক্টোবরের ছবিঘরটি দেখুন...
কী হচ্ছে আদালত পাড়ায়?
অন্তর্বর্তী সরকারে সময়ে গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের পক্ষে আদালতে দাঁড়াতে গিয়ে হয়রানির শিকার হচ্ছেন আইনজীবীরা৷ ছাত্রদের দাবির মুখে ১২ বিচারপতিকে বিচারকাজ থেকে বিরত রাখার মতো ঘটনাও ঘটেছে৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
‘মারধরের শিকার হয়েছি’
আইনজীবী মোশারফ হোসেন শাহীন বলেন, ‘‘গত আড়াই মাসে যাদের গ্রেপ্তার করে আদালতে নেওয়া হয়েছে, তাদের সবাইকে অপদস্থ করা হয়েছে৷ যারা ডিফেন্স করতে যাচ্ছেন, তাদের উপরও হামলা করা হচ্ছে৷ আক্রমণ করা হচ্ছে৷ এই ধরনের কাজের মাধ্যমে বাইরে খারাপ বার্তা যাচ্ছে৷ আমি নিজেও ডিফেন্স করতে গিয়ে মরধরের শিকার হয়েছি৷ আশা করবো, সবাই যেন সহকর্মীদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকেন৷’’
ছবি: Privat
‘আসামি পক্ষের কোনো আইনজীবীই আদালতে যেতে পারছেন না’
সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী সাইদ আহমেদ রাজা বলেন, ‘‘ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে বাদী ও আসামি দুই পক্ষেই আইনজীবী থাকতে হয়৷ কিন্তু বর্তমান সরকারের সময় আসামি পক্ষকে আইনজীবী রাখার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না৷ প্রত্যেক আসামির আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ থাকে৷ সেই সুযোগও পাচ্ছেন না তারা৷ আমি নিজেও কোনো মক্কেলের পক্ষে দাঁড়াতে পারছি না৷ শুধু আমি নই, আসামি পক্ষের কোনো আইনজীবীই আদালতে যেতে পারছেন না৷
ছবি: Privat
‘আসামির পক্ষে আইনজীবীর অধিকার নিশ্চিত করা হচ্ছে না’
সিনিয়র আইনজীবী মনজিল মোরশেদ বলেন, ‘‘আসামির পক্ষে আইনজীবীর দাঁড়াতে পারাটা অধিকার, সেটাই নিশ্চিত করা হচ্ছে না৷ সবাই নাগরিক কিনা সেটাই এখন প্রশ্ন৷ একটা পক্ষ বলতে চাচ্ছে, আরেকপক্ষ এদেশের নাগরিকই না৷ আমরা আগের পথেই চলে গেছি কিনা সেটাও ভাববার বিষয়৷ একটাই পার্থক্য শুধু পুলিশ গুলি করছে না৷ দেশে সরকার দুইটা কিনা সেটাও প্রশ্ন! ছাত্ররাও সিদ্ধান্ত দিচ্ছে, আবার যারা শপথ নিয়েছেন (উপদেষ্টারা) তারাও চালাচ্ছেন৷’’
ছবি: DW
‘এভাবে চললে অভিযুক্তরা ন্যায় বিচার-বঞ্চিত হবেন’
সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী আহসানুল করিম বলেন, ‘‘সংবিধানে ন্যায় বিচার নিশ্চিত করতে আইনজীবী নিযুক্ত করার কথা বলা হয়েছে৷ এখন যারা ডিফেন্স করতে যাবেন, তারা তো ভয়ের মধ্যে আছেন৷ প্রধান বিচারপতি বারবার বলছেন, অভিযুক্তকে আইনজীবী প্রাপ্তির সুযোগ দিতে৷ কিন্তু আইনজীবীরা মারধরের শিকার হচ্ছেন৷ অভিযুক্তরা নিজের কথাও বলতে পারছেন না৷ কোর্টও ভয়ের শিকার হন৷ এভাবে চললে অভিযুক্তরা ন্যায় বিচার-বঞ্চিত হবেন৷’’
ছবি: Privat
‘এই বিচারব্যবস্থার জন্য তো তারা জীবন দেননি’
ব্যারিস্টার ওমর ফারুক বলেন, ‘‘আমাদের বিচারব্যবস্থা সামনের দিকে এগোচ্ছে কিনা সেই প্রশ্ন করলে আমি বলবো- ‘না’৷ বিগত সরকারের সময়ে ছাত্রলীগ-যুবলীগ যেটা করেছে, আমরা তো সেটা চাই না৷ আজকের যে বাংলাদেশ, সেটার জন্য কিন্তু যাদের অবদান, তাদের অনেকে কবরে শুয়ে আছে৷ অনেকে অন্ধ হয়ে হাসপাতালের বিছানায়৷ আমার কাছে একজন এসেছেন, যিনি ৪০ বছর ধরে বিচারের জন্য আদালতে ঘুরছেন৷ এই বিচারব্যবস্থার জন্য তো তারা জীবন দেননি৷’’
ছবি: Privat
‘ছাত্ররা আদালতে মিছিল না করে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করলেই ভালো হতো’
আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি তারিক উল হাকিম বলেন, ‘‘ছাত্ররা যেভাবে আদালতের ভেতরে এসে মিছিল করে দাবি জানিয়েছে, সেটা না করে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করলেই ভালো হতো৷ তারপর দাবি পূরণ না হলে আন্দোলন করতে পারতো৷ বিগত সরকারের সময়ের চেয়ে এখন কোনো পার্থক্য দেখা যাচ্ছে কিনা সেটা বুঝতে হলে আমাদের আরেকটু অপেক্ষা করতে হবে৷’’
ছবি: Privat
‘আদালতের তো নিজস্ব কোনো বাহিনী নেই যে, তারা নিরাপত্তার ব্যবস্থা করবে’
অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ ড. শাহজাহান সাজু বলেন, ‘‘কোন বিচারককে বেঞ্চ দেবেন আর কোন বিচারককে বেঞ্চ দেবেন না সেটা প্রধান বিচারপতির এখতিয়ার৷ ছাত্ররা যেভাবে উচ্চ আদালতের ভেতরে এসে মিছিল করলো, সেখানে পুলিশ তো বাধা দিলো না৷ এখন আদালতেরও তো নিজস্ব কোনো বাহিনী নেই যে, তারা নিরাপত্তার ব্যবস্থা করবে৷ ফলে তাদের আন্দোলনের কারণেই ভয়ে বা চাপে পড়ে প্রধান বিচারপতি এটা করেছেন সে কথা তো আপনি বলতে পারবেন না৷
ছবি: Privat
‘প্রথম দিকে কিছুটা সমস্যা হলেও এখন আসামী পক্ষের আইনজীবীদের দাঁড়াতে সমস্যা হচ্ছে না’
সুপ্রিম কোর্ট বারের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার এম বদরুদ্দোজা বাদল বলেন, ‘‘ছাত্রদের দাবির মুখে কয়েকজন বিচারককে ছুটিতে পাঠানো হয়েছে, এমন নয়৷ আমরা আইনজীবীরাও তাদের অপসারণের দাবিতে আন্দোলন করেছি৷ আমাদের কাছে তাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট প্রমানও আছে৷ সব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে প্রধান বিচারপতি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন৷ প্রথম দিকে কিছুটা সমস্যা হলেও এখন কিন্তু আসামী পক্ষের আইনজীবীদের দাঁড়াতে সমস্যা হচ্ছে না৷