1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ঢালাও হত্যা মামলার আবহে সাংবাদিক ও সাংবাদিকতা

সমীর কুমার দে ঢাকা
২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪

অভ্যুত্থানের মাধ্যমে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে বাংলাদেশে সাংবাদিকতা কেমন চলছে? সাংবাদিক, সম্পাদক, সাংবাদিকতার শিক্ষক, গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বরা কী বলেন?

হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার সাংবাদিক শাকিল আহমেদ এবং ফারজানা রুপা
অনেক মামলার বাদি জানিয়েছেন, এজাহারে থাকা সাংবাদিকদের তারা চেনেনই নাছবি: AFP

শাহনাজ শারমীন একটি বেসরকারী টেলিভিশনের সিনিয়র রিপোর্টার৷ গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের দিন সকাল ৯টা থেকে মহাখালীর রাওয়া ক্লাবের সামনে থেকে অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তাদের কার্যক্রম নিয়ে ঘন্টায় ঘন্টায় লাইভ দিয়েছেন৷ বেলা ১টা পর্যন্ত তিনি সেখানে ছিলেন৷ ৩টায় তার দায়িত্ব পড়ে বঙ্গভবনের সামনে৷ রাত ১১টা পর্যন্ত বঙ্গভবনের গেইট থেকে লাইভ করেছেন তিনি৷ অথচ ৫ আগস্ট বিকেলে মিরপুরের ভাষানটেক এলাকায় মো. ফজলু (৩১) নামে এক যুবকের গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুর ঘটনায় আসামী করা হয়েছে শাহনাজ শারমীনকে৷ এই মামলায় এজাহারনামীয় ১৬৫ জন আসামীর মধ্যে ৫০ নম্বরে রয়ে তার নাম৷

শাহনাজ শারমীন ডয়চে ভেলেকে বলেন, "আমি গত দুই বছরের মধ্যে কোনোদিন ভাষানটেকে যাইনি৷ বাদি বা নিহত ব্যক্তিকে চিনি না৷ সহকর্মীদের মাধ্যমে মামলার কথা জানতে পারি৷” এই মামলার ৪০ নম্বর আসামী করা হয়েছে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সভাপতি সৈয়দ শুকুর আলী শুভকে৷ কেন এমন একটি হত্যা মামলায় তাকে আসামী করা হলো? সৈয়দ শুকুর আলী শুভ এ প্রশ্নের জবাবে ডয়চে ভেলেকে বলেন, "কেন করেছে সেটা তো জানি না৷ ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি একটি অরাজনৈতিক সাংবাদিক সংগঠন৷ এখানে কোনো দলীয় প্যানেলে ভোট হয় না৷ সহকর্মীদের সঙ্গে আলোচনা করে ধারণা করছি, আগামী ৩০ নভেম্বর রিপোর্টার্স ইউনিটির ভোটে যারা লড়তে চান এমন জনপ্রিয় অনেককেই এই মামলায় আসামী করা হয়েছে৷ আমার ধারণা, নির্বাচন থেকে বিরত রাখা বা নির্বাচনের সময় হয়রানি করার উদ্দেশ্যে মামলা দায়ের করা হতে পারে৷”

সহকর্মীদের মাধ্যমে মামলার কথা জানতে পারি: শাহনাজ শারমীন

This browser does not support the audio element.

বাদি চেনেন না ‘আসামি' সাংবাদিককে

মো. ফজলু হত্যাকাণ্ডের মামলার বাদি তার ভাই মো. সবুজ৷ ডয়চে ভেলের পক্ষ থেকে তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, মামলার এজাহারে থাকা সাংবাদিকদের তিনি চেনেন না৷ আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীদের সঙ্গে আলোচনা করে তিনি মামলার এজাহারে সাংবাদিকদের নাম উল্লেখ করেছেন৷

বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের একাংশের সাবেক যুগ্ম মহাসচিব পুলক ঘটক লিখেছেন, শুধু এই দুই সাংবাদিক নন, এমন ১০৬ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে৷ ইতিমধ্যে ৪ জন সাংবাদিক গ্রেপ্তার হয়েছেন৷ ফলে সাংবাদিকরা কতটা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছেন সেটা তো বোঝাই যাচ্ছে৷

ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের একাংশের সাধারণ সম্পাদক আকতার হোসেন ডয়চে ভেলেকে বলেন, "সাংবাদিকতায় কোনো পরিবর্তন এসেছে বলে আমার মনে হচ্ছে না৷ আগে এক পক্ষ থেকে সাংবাদিকদের কাছে নির্দেশনা আসতো, এখন আরেক পক্ষ থেকে আসে৷ ফলে আগেও সাংবাদিকরা স্বাধীন ছিলেন না, এখনো নেই৷ বরং শতাধিক সাংবাদিক হত্যা মামলার আসামী হওয়ার ফলে তারা আতঙ্কের মধ্যে আছেন৷ সাংবাদিক সংগঠনগুলো আগে এক পক্ষ নিয়ন্ত্রণ করতেন, এখন আরেক পক্ষ নিয়ন্ত্রণ করছে৷ অভ্যুত্থানের মাধ্যমে একটা সরকারের পতনের পর নতুন সরকারের কাছে মানুষের যে আকাঙ্খা ছিল, সেটা পূরণ হচ্ছে না৷”

‘পত্রিকা বা টেলিভিশনগুলো সরকারকে খুশি করার সাংবাদিকতা করছে'

৫ আগস্টের পরে সাংবাদিকতায় কী কী পরিবর্তন এসেছে জানতে চাইলে দ্য ডেইলি স্টারের বাংলা বিভাগের সম্পাদক গোলাম মোর্তোজা ডয়চে ভেলেকে বলেন, "এত দ্রুত তো গুণগত পরিবর্তন দেখা যায় না৷ এর জন্য আরো কিছুটা সময় লাগবে৷ এটা খুব বেশি দৃশ্যমান না৷ একটা পরিবর্তন আছে ,সেটাতে পত্রিকায় বা টেলিভিশনে কী প্রভাব পড়ছে তার চেয়ে বড় বিষয় হলো, আগে যে ভয়ের সংস্কৃতি ছিল সেটা কিছুটা দূর হয়েছে৷ কিন্তু পত্রিকা বা টেলিভিশনগুলো সরকারকে খুশি করার সাংবাদিকতা করছে৷ বিএনপিকে খুশি রাখার একটা চেষ্টাও আছে৷ এটা পরিবর্তনের ক্ষেত্রে একটা নেতিবাচক দিক৷ আগে যেসব বিষয় নিয়ে কথা বলা যেতো না, এখন কথা বলা যাচ্ছে৷ ভয়ের সংস্কৃতি যদি না থাকে, তাহলে সামনের দিনে হয়ত একটা ইতিবাচক চিত্র দেখা যাবে৷ তবে ভয়ের সংস্কৃতি দূর হচ্ছে বলা হলেও আরেক ধরনের ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি হচ্ছে৷ সেটা সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ঢালাওভাবে হত্যা মামলা দায়ের করা হচ্ছে৷ কেউ কোনো অপরাধ করলে সেটার তদন্ত বা বিচার হতে পারে, কিন্তু ঢালাও হত্যা মামলা বা হয়রানি ইতিবাচক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে বাধা৷”

পত্রিকা বা টেলিভিশনগুলো সরকারকে খুশি করার সাংবাদিকতা করছে: গোলাম মোর্তোজা

This browser does not support the audio element.

তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম গত বুধবার সাংবাদিকদের বলেছেন, "কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের মধ্যে যারা ফ্যাসিবাদের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, কিংবা গণহত্যায় উসকানি দিয়েছেন, তাদের অবশ্যই বিচারের আওতায় আনা হবে৷ যারা বিভিন্ন লেখনী ও মতামতের মাধ্যমে জনমত তৈরি করে গণহত্যার পক্ষে পরোক্ষভাবে কাজ করেছেন এবং গণহত্যার জন্য উসকানি দিয়েছেন, তাদের অবশ্যই বিচারের আওতায় আনা হবে৷ কেবল সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও কবি পরিচয়ে কেউ রেহাই পাবেন না৷”

সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে করা হত্যা মামলা সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে নাহিদ ইসলাম বলেন, "মামলাগুলো সরকার করছে না, জনগণ তাদের জায়গা থেকে করছে৷ অনেক ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত শত্রুতার জায়গা থেকেও মামলা করা হচ্ছে৷ সেই জায়গা থেকে আমরা নির্দেশনা দিয়েছি এবং আশ্বস্ত করেছি যে, এই মামলাগুলো দ্রুততম সময়ের মধ্যে পর্যালোচনা করা হবে৷ তদন্ত করে কারো বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা প্রমাণিত না হলে তাকে মামলা থেকে রেহাই দেওয়া হবে৷”

কিছু মুখোশের পরিবর্তন?

রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর মাঠের সাংবাদিকতায় কি কোনো পরিবর্তন এসেছে? এ প্রসঙ্গে দৈনিক সমকালের বিশেষ প্রতিনিধি মশিউর রহমান খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, "এখন পর্যন্ত কিছু মুখোশের পরিবর্তন ছাড়া গুণগত কোন পরিবর্তন ঘটেনি৷ গণতন্ত্রের মতো সাংবাদিকতা একটা চর্চার বিষয়৷ গত কয়েক দশকে গণমাধ্যমে সাংবাদিকতার চর্চাটা দারুণভাবে অনুপস্থিত ছিল৷ এমন পরিস্থিতিতে ৫ আগস্টের পর রাতারাতি পরিবর্তন আশা করাও ঠিক না৷ দুঃখজনক হলো, পরিবর্তনের কোনো লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না৷ গত এক মাসে আমরা দেখেছি, এক দলের পরিবর্তে আরেক দলের লোক এসেছে৷ সাংবাদিকতার যেসব প্রতিষ্ঠান আছে, সেই সব জায়গায় যোগ্য লোকটিকে বসানোর চেষ্টা করা হয়েছে তেমনটিও আমরা দেখিনি৷ ফলে ইতিবাচক চেষ্টা যে হচ্ছে, সেটাও বলা যাচ্ছে না৷ গণমাধ্যমগুলোতেও কিছু ব্যক্তির পরিবর্তন হচ্ছে৷ এতে ইতিবাচক কোনো ভূমিকা রাখবে বলে আমার মনে হচ্ছে না৷ তবে আগে যে গোয়েন্দা সংস্থা থেকে খবরদারি করা হতো, এখন সেটা হচ্ছে না৷ কিন্তু আমরা ক্ষমতাধরদের তুষ্ট করার এক ধরনের প্রবণতা দেখছি৷”

এত মামলা হলেও কোনো সাংবাদিককে কিন্তু হয়রানি করা হচ্ছে না: কাদের গনি চৌধুরী

This browser does not support the audio element.

‘আমার জন্য কোনো পরিস্থিতিই নতুন না'

৫ আগস্টের আগে ও পরের সাংবাদিকতার পার্থক্য প্রসঙ্গে দ্য নিউ এইজ পত্রিকার সম্পাদক নুরুল কবির ডয়চে ভেলেকে বলেন, "আমি আগে যেভাবে সাংবাদিকতা করেছি, এখনো সেভাবেই করছি৷ আমার জন্য কোনো পরিস্থিতিই নতুন না৷”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. সাইফুল আলম চৌধুরী ডয়চে ভেলেকে বলেন, "আমরা যদি ধরনের দিক থেকে দেখি, তাহলে বলব ৫ আগস্টের আগে বিশেষ করে ২০১৪ সালের পর থেকে বিশেষ ইস্যুতে এক ধরনের রাখ-ঢাক ছিল৷ যেমন আওয়ামী লীগ বা ছাত্রলীগ কারো উপর হামলা চালালে আমরা বলতে দেখেছি, দুর্বৃত্তরা এটা করেছে৷ তাদের নাম বলা যাবে কিনা সেটা সরকার বা গোয়েন্দা সংস্থা ঠিক করে দিতেন৷ এটার জন্য চাপ ছিল৷ এর জন্য ডিজিটাল সিকিউরিট অ্যাক্টের কথা বলা হতো৷ আমার মনে হয়, এর চেয়েও বেশি ছিল রাষ্ট্রের ১৫টি গোয়েন্দা সংস্থার চাপ৷ ২০১৫ সালে ডয়চে ভেলে একটা রিপোর্ট করেছিল, একটা রিপোর্টের কারণে প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের বেসরকারী বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দেওয়া হয়৷ এটাও এক ধরনের চাপ৷ এটা দিয়ে অন্যদের ভয় দেখানো হয়৷ তা সত্বেও ১৬ জুলাই সাধারণ ছাত্রদের উপর ছাত্রলীগের হামলার পর যখন ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হয়. তখন কিন্তু সংবাদপত্রগুলোই ছিল মানুষের তথ্যের একমাত্র উৎস৷ সেখানে আমরা দেখেছি, সংবাদপত্রগুলো চাপ সত্বেও সঠিক তথ্য দিয়েছে৷ এখন ৫ আগস্টের পর মিডিয়ায় এক ধরনের পরিবর্তন হয়েছে৷ প্রটোকল নিউজ এখনো বন্ধ হয়নি৷ অর্থাৎ, সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিদের সংবাদ গুরুত্ব দিয়ে ছাপা হচ্ছে৷ গত দুই সপ্তাহ গণমাধ্যম দেখলে মনে হচ্ছে, তারা এক ধরনের অদৃশ্য চাপে আছে৷ অনেক সংবাদ হয়ত তারা ছাপছে, কিন্তু টোনটা শব্দচয়নে মাইল্ড করে দিচ্ছে৷ ওয়ান ইলেভেনে এক ধরনের চাপ ছিল, তখন আমরা এই ধরনের সাংবাদিকতা দেখেছি৷ আরেকটা বিষয় হলো মব জাস্টিস৷ এটা নিয়েও ভয়ের মধ্যে আছে মিডিয়া৷ ফলে এক ধরনের চাপ এখনও রয়ে গেছে বলে আমার মনে হচ্ছে৷”

‘আগে সাংবাদিকদের মধ্যে ভয়ের সংস্কৃতি ছিল৷ এখন সেটা নেই'   

তবে ৫ আগস্টের পর সাংবাদিকতায় ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের একাংশের মহাসচিব কাদের গনি চৌধুরী৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, "আগে সাংবাদিকদের মধ্যে ভয়ের সংস্কৃতি ছিল৷ এখন সেটা নেই৷ সাংবাদিকরা স্বাধীনভাবে লিখতে পারছেন৷ বিগত সরকারের সময় ৬৪ জন সাংবাদিককে হত্যা করা হয়েছে৷ গোয়েন্দা সংস্থা থেকে চাপ দেওয়া হতো৷ এখন সাংবাদিকদের কি কেউ চাপ দিচ্ছে? তবে হ্যাঁ, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে গণহারে যে হত্যা মামলা হচ্ছে সেটার বিরোধিতা আমরা করেছি৷ আমরা আজই (বৃহস্পতিবার) আইন উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করে বিষয়টি বলেছি৷ তিনি আমাদের আশ্বস্ত করেছেন, তদন্তের আগে কাউকে হয়রানি করা হবে না৷ অথচ আগে আমরা দেখেছি, সাংবাদিকদের ধরে নিয়ে তারপর মামলা দেওয়া হতো৷ এখন এত মামলা হলেও কোনো সাংবাদিককে কিন্তু হয়রানি করা হচ্ছে না৷ আগে শফিক রেহমানের মতো সব্যসাচী সম্পাদককে দেশ ছাড়তে হয়েছে৷ অনেক সাংবাদিক লিখতে না পারার কারণে পেশা ছেড়েছেন, অনেকে সরকারের চাপে দেশত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন৷ এখন অন্তত এই ধরনের কোনো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি৷ আমরা আশা করবো ভবিষ্যতেও হবে না৷”

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ