ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন ব্রেক্সিটের প্রশ্নে কড়া অবস্থান নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের উপর চাপ সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন৷ এখন তিনি নিজেই এমন চাপের মুখে পড়েছেন, যে তাঁর গদি নিয়ে টানাটানি শুরু হয়েছে৷ তিনি প্রয়োজনে আগামী ৩১শে অক্টোবর চুক্তি ছাড়াই ব্রেক্সিট কার্যকর করার হুমকি দিয়ে আসছেন৷ সংসদে এই অবস্থানের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ বাড়ছে৷ প্রথমে স্পিকার জন বার্কো, তারপর প্রধান বিরোধী দলের নেতা জেরেমি কর্বিন প্রধানমন্ত্রীকে সাবধান করে দিয়েছেন৷
লেবার দলের নেতা কর্বিন বুধবার বলেছেন, চুক্তিহীন ব্রেক্সিটের বিপর্যয় এড়াতে তিনি যত দ্রুত সম্ভব সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনতে চলেছেন৷ সব দলের নেতা ও সরকারি দলের সংসদ সদস্যদের উদ্দেশ্যে লেখা এক চিঠিতে তিনি দাবি করেছেন, সরকারের হাতে ‘নো ডিল ব্রেক্সিট'-এর কোনো ম্যান্ডেট বা জনাদেশ নেই৷ কর্বিন জানিয়েছেন, অনাস্থা ভোটে সরকারের পরাজয় ঘটলে তিনি নিজে সীমিত সময়ের জন্য তত্ত্বাবধায়ক প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেবেন৷ তারপর তিনি সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করে ব্রেক্সিটের সময়সীমা বাড়ানোর উদ্যোগ নেবেন৷ নির্বাচনি প্রচারে লেবার দল ইইউ ত্যাগের প্রশ্নে আবার গণভোটের পক্ষে অবস্থান নেবে এবং তার ফলাফল মেনে নেবে, জানান কর্বিন৷
ক্ষমতাসীন টোরি দলের মধ্যেও প্রধানমন্ত্রীর কড়া অবস্থানের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ বাড়ছে৷ বুধবার প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী ফিলিপ হ্যামন্ড বরিস জনসনের বিরুদ্ধে ইচ্ছাকৃতভাবে ইইউ-র সঙ্গে আলোচনা বানচাল করার অভিযোগ এনেছেন৷ সেইসঙ্গে তিনি বলেন, সংসদের হাতে চুক্তিহীন ব্রেক্সিট থামানোর ক্ষমতা রয়েছে৷ দ্য টাইমস সংবাদপত্রে লেখা এক প্রতিবেদনে তিনি মনে করিয়ে দেন, যে ব্রিটিশ জনগণ ও সংসদ চুক্তিহীন ব্রেক্সিটের বিরুদ্ধে স্পষ্ট অবস্থান নিয়েছে৷ তাঁর মতে, আপাতত টোরি দলের কট্টরপন্থিরা সরব থাকলেও সংখ্যার বিচারে তাদের শক্তি কম৷
কোণঠাসা প্রধানমন্ত্রী ঘরে-বাইরে এই প্রতিরোধের সমালোচনা করেছেন৷ তাঁর মতে, সংসদে চুক্তিহীন ব্রেক্সিটের বিরোধিতার ফলে ইইউ-র সঙ্গে আলোচনার টেবিলে ব্রিটেনের সরকারের অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়ছে৷ ফলে ব্রিটেনের সংসদ চুক্তিহীন ব্রেক্সিট বন্ধ করতে সফল হয় কিনা, তা দেখতে ইইউ অপেক্ষা করবে৷
এই অবস্থায় আগামী ৩রা সেপ্টেম্বর গ্রীষ্মকালীন বিরতির পর সংসদের অধিবেশনের দিকে সবার নজর থাকবে৷ তবে ব্রিটেনের অলিখিত সংবিধান বর্তমান সংঘাতকে জটিল করে তুলতে পারে৷ কারণ ব্রেক্সিটকে ঘিরে বর্তমান অচলাবস্থা ব্রিটেনের ইতিহাসে নজিরবিহীন৷ স্বল্পমেয়াদী অধিবেশনে সরকারের হাতে সংসদের কর্মসূচি থাকায় সংসদ সদস্যরা বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বেন৷
এলেমেলো চুল, ব্যতিক্রমী চাহনি আর ঝাজালো বক্তব্যের জন্য খ্যাতিমান নয়া ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন৷ সাংবাদিকতা ছেড়ে রাজনীতির মাঠে আসা জনসনের বেড়ে ওঠার গল্পও বিচিত্র রকম৷
ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের সাবেক কনজারভেটিভ সাংসদ স্ট্যানলি জনসন ও তার প্রথম স্ত্রী চিত্রকর শার্লট ফসেটের সন্তান আলেক্সান্ডার বরিস দে পিফেল জনসনের জন্ম ১৯৬৪ সালের জুনে, যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে৷ তাঁর দাদার বাবা আলি কামাল একজন তুর্কি৷ একারণে নিজেকে মুসলিম উত্তরাধিকারী হিসাবে বলে থাকেন জনসন৷
চার ভাইবোনের মধ্যে সবার বড় জনসনের শৈশব কেটেছে নিউ ইয়র্ক, লন্ডন ও ব্রাসেলসে৷ কম শুনতেন তিনি৷ এ কারণে শৈশবেই তাকে বেশ কয়েকবার অপারেশনের টেবিলে যেতে হয়েছিল; জনসন সেসময় তুলনামূলক চুপচাপ ছিলেন বলে তার আত্মীয়স্বজন জানিয়েছেন৷
ছবি: Getty Images/D. Kitwoodকিংস স্কলারশিপ নিয়ে বার্কশায়ারের ইটন কলেজে পড়ার পর অক্সফোর্ডের বেলিওল কলেজ থেকে ল্যাটিন ও প্রাচীন গ্রীক ক্ল্যাসিকসে ডিগ্রি নেন জনসন। তিনি বিতর্ক সংগঠন অক্সফোর্ড ইউনিয়নেরও প্রেসিডেন্ট ছিলেন; ছিলেন বুলিনডং ক্লাবের সদস্য, যেখানে তার সঙ্গী ছিলেন ডেভিড ক্যামেরনও।
ছবি: Getty Images/L. Drayব্যবস্থাপনা উপদেষ্টা হিসেবে কিছুদিন কাজ করার পর জনসনের সাংবাদিকজীবন শুরু হয়। ১৯৮৭ সালে টাইমসে প্রতিবেদক হিসেবে যোগ দেওয়ার পর একজনের উদ্ধৃতি জাল করায় চাকরি হারাতে হয় তাকে। ডেইলি টেলিগ্রাফে জনসন ইউরোপ বিষয়ক সংবাদদাতা ছিলেন ৫ বছর। পরে ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত তিনি একই প্রতিষ্ঠানের সহকারী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৯-২০০৫ সাল পর্যন্ত ‘দ্য স্পেকটেটর’ ম্যগাজিনের সম্পাদক ছিলেন৷
ছবি: Getty Images/M. Cardyটেলিগ্রাফে থাকার সময় ১৯৯৭ সালে ক্লয়েড সাউথ এলাকা থেকে হাউস অব কমন্সে নির্বাচন করেন জনসন। এরপর ২০০১ সালেহেনলি অন টেমস আসনে বিজয়ী হন৷ সংসদ সদস্য পদ ছেড়ে ২০০৭ ও ২০১২ সালে দুই মেয়াদে লন্ডনের মেয়র হন জনসন৷ ব্রেক্সিট নিয়ে গণভোটের পর আসা প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মে সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হন তিনি৷ এরপর ব্রেক্সিট নিয়ে বিরোধের জেরে পদত্যাগ করেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/PA Wire/J. Stillwellটেলিভিশন ও রাজনৈতিক অঙ্গনে সুপরিচিত হলেও জনসনের রাজনৈতিক উত্থান মোটেও কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। স্পেকটেটরের একটি সম্পাদকীয় প্রকাশের জেরে তাকে লিভারপুল সিটির কাছে ক্ষমা চাইতে হয়েছিল; এক সাংবাদিকের সঙ্গে প্রেমের গুঞ্জনে ছায়া শিল্পমন্ত্রীর দায়িত্ব থেকেও তাকে সরিয়ে দেয়া হয়।
ছবি: Imago Images/PA/I. Infantesযুক্তরাজ্য ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকবে কিনা, তা নিয়ে গণভোটের প্রচারে জনসনকে দেখা যায় ‘ব্রেক্সিটপন্থিদের’ অন্যতম প্রভাবশালী মুখপাত্র হয়ে উঠতে। ২০১৬ সালের বেক্সিটের পক্ষে গণভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা আসার পর তাকে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ভাবা হয়েছিল৷ কিন্তু মাইকেল গোভসহ ঘনিষ্ঠ অনেকে দূরে সরে যাওয়ায় সেবার ডাউনিং স্ট্রিট যাওয়া হয়নি জনসনের৷
ছবি: Reuters/P. Nichollsজনসন প্রথম ১৯৮৭ সালে অ্যালেগ্রা মস্টিন ওয়েনকে বিয়ে করলেও তাদের সংসার বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ১৯৯৩ সালে জনসন আইনজীবী মেরিনা-হুইলারের (ছবিতে বামে) সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধেন। জনসন-হুইলার দম্পতির দুই ছেলে ও দুই মেয়ে রয়েছে৷ দুই যুগ পর গত বছর এই দম্পতি বিচ্ছেদ হয়৷ এখন তিনি বিয়ে না করেই বসবাস করছেন প্রায় ২৫ বছর কম বয়সি বান্ধবী ক্যারি সিমন্ডসের সঙ্গে৷
ছবি: picture-alliance/AP Images/D.L. Olivasপ্রবন্ধ সংকলন ‘লেন্ড মি ইউর ইয়ারস’ ছাড়াও জনসন উপন্যাস ‘সেভেন্টি টু ভার্জিনস’ ও রোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাস নিয়ে ‘দ্য ড্রিম অব রোম’ লিখেছেন। ২০১৪ সালে ঝুলিতে যুক্ত করেন সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলকে নিয়ে লেখা ‘দ্য চার্চিল ফ্যাক্টর: হাউ ওয়ান ম্যান মেইড হিস্টরি’ বইটিও।
ছবি: Getty Images/AFP/T. Akmenবাচনভঙ্গি, শব্দের ক্ষুরধার ব্যবহার, চাহনি, মজা করে কথা বলার অসামান্য ক্ষমতা, এলোমেলো চুল, ব্যক্তিগত জীবন- এসবের বিতর্কের কেন্দ্রে থাকেন বরিস জনসন৷ কিন্তু জনপ্রিয়তা কীভাবে অর্জন করতে হয়, তিনি সেটা অনেকের চেয়ে ভালো জানেন৷ যেমন, সর্বশেষ টোরি দলের প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী পদের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী জেরেমি হান্টের চেয়ে দ্বিগুণ ভোট পেয়েছেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/empics/B. Kendall এসবি/এসিবি (ডিপিএ, রয়টার্স)