1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ফেরা : আইনে এখন, নির্বাচনে ‘তখন'

২০ নভেম্বর ২০২৫

আদালতের রায়ে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরে এলেও ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনেই হবে৷ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের সুযোগ থাকবে চতুর্দশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে৷

বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ
সংসদ ভেঙে যাওয়ার ১৫ দিনের মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের বাধ্যবাধাকতা আছেছবি: Mohammad Ponir Hossain/REUTERS

বৃহস্পতিবার সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ সংক্ষিপ্ত আদেশে বলেছেন, ‘‘নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধানাবলী কেবলমাত্র উক্তরূপ ভবিষ্যৎ প্রয়োগযোগ্যতার ভিত্তিতেই কার্যকর হবে৷’’

এই মামলায় অংশ নেয়া আইনজীবীরা বলছেন, এখনই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার অধীনে নির্বাচন সম্ভব নয়৷ কারণ, এই ব্যবস্থা নিয়মিত সরকারের সময় কার্যকর হয়, সংসদ থাকতে হয়৷ একটি নির্বাচিত সরকার ও আরেকটি নির্বাচিত সরকারের মধ্যবর্তী ব্যবস্থা এটা৷ বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার কোনো নির্বাচিত সরকার নয়৷ ফলে এই সরকার নির্বাচন করার পর পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের সময়ই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা কার্যকর হবে৷

তাদের পক্ষ থেকে আরো বলা হয়, আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে যে জাতীয় নির্বাচন হওয়ার কথা আছে, সেটা বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনেই হবে৷

তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষতা তাদের ওপরই নির্ভর করছে৷ তাই যে উপদেষ্টাদের নিয়ে এরই মধ্যে বিতর্ক দেখা দিয়েছে, তাদের নির্বাচনের আগেই পদত্যাগ করা উচিত৷

১৯৯৬ সালে বাংলাদেশে সাংবিধানিকভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার প্রবর্তন হয়৷ ২০১১ সালে ‘অসাংবিধানিক' বলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে রায় দেয় সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ৷ এরপর তার আলোকে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী আনা হয়৷ ওই সংশোধনীতে সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্ত করা হয়৷ সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী এবং তার আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করে আপিল বিভাগ যে রায় দেয়, দুইটিই আদালতে চ্যালেঞ্জ করা হয়৷

আপিল বিভাগ বৃহস্পতিবার তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করে ২০১১ সালের রায়কে একাধিক ত্রুটিযুক্ত বলে বাতিল করে দিয়েছে৷ সাবেক বিচারক ড. শাহজাহান সাজু ডয়চে ভেলেকে  বলেন, ‘‘এই রায়ের ফলে সংবিধানে যেভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছিল, ঠিক সেভাবেই ফিরে এসেছে৷ এটা সংবিধানে আপনাআপনি পুনঃস্থাপিত হয়ে গেছে৷ এটার জন্য সংসদে আলাদা কোনো অনুমোদন লাগবে না৷’’

এই অন্তর্বর্তী সরকার নিয়েও সংবিধানে কিছু নেই: ড. শরীফ ভুঁইয়া

This browser does not support the audio element.

তবে ‘সংসদ কার্যকর থাকতে হবে’- এমন শর্তের বিষয়টি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘‘একটি সংসদ ভেঙে যাওয়ার ১৫ দিনের মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের বাধ্যবাধাকতা আছে, কিন্তু এখন তো আর সংসদ নেই৷ আর সংসদ তো ভেঙে গেছে অনেক দিন আগে৷ ফলে, এই ব্যবস্থা কার্যকর করতে একটি সংসদ লাগবে৷ তাই আগামী সংসদ নির্বাচনের পর এটা কার্যকর হবে৷ ফলে আগামী সংসদ নির্বাচন অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনেই হবে৷”

সেক্ষেত্রে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করার উপায় জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘এই সরকারের নিরপেক্ষতা তাদের নিজেদেরই নিশ্চিত করতে হবে৷ তারা কোনো নির্বাচিত সরকার নয়৷ তাদের কোনো বাধ্যবাধকতাও নাই৷”

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামীলীগ সরকারের পতন হয়৷ তারপর তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল সংক্রান্ত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায় পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) করার জন্য বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, পাঁচ বিশিষ্ট নাগরিক ও এক ব্যক্তি আবেদন করেন৷ বৃহস্পতিবার প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন সাত সদস্যের আপিল বিভাগের রায়ে বলা হয়, " নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার সম্পর্কিত বিধানাবলী এই রায়ের মাধ্যমে পুনরুজ্জীবিত ও সক্রিয় করা হলো৷”

জামায়াতে ইসলামীর আইনজীবী অ্যাডভোকেট শিশির মনির এ বিষয়ে ডয়চে ভেলেকে বলেন, "তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে পুনঃস্থাপিত হলেও সেটা শেষ পর্যন্ত এখন যেভাবে আছে, সেভাবে থাকবে কিনা তা বলা যাচ্ছে না৷ সামনে যে গণভোট আছে, সেখানে যদি ‘হ্যাঁ' জয়ী হয়, তাহলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায়ও পরিবর্তন আসবে৷ কারণ, সংস্কার প্রস্তাবে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থারও সংস্কারের  কথা আছে৷”

তিনি জানান, "জুলাই সনদে বলা আছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হবে একটি পাঁচ সদস্যের সার্চ কমিটির মাধ্যমে৷ সেখানে সদ্য বিদায়ী প্রধান বিচারপতি হলেন সর্বশেষ ‘অপশন'৷ আর এখন সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনে কোনো সার্চ কমিটির বিধান নেই৷ সদ্য বিদায়ী প্রধান বিচারপতি হবেন প্রথম ‘অপশন'৷ তাই যে চার প্রশ্নে গণভোট হবে, সেটা পাশ হলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাঠামো এবং ব্যবস্থাপনায়ও পরিবর্তন হবে৷”

"আর রায়েই বলে দেয়া হয়েছে- এটা প্রসপেক্টিভ৷ ফলে এই নির্বাচন বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনেই হবে৷  তারপর থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে৷ কারণ, এখন তো সংসদ নেই,” বলেন তিনি৷

আর সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)-এর ড. বদিউল আলম মজুমদারের আইনজীবী ড.শরীফ ভুঁইয়া বলেন, "ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করার সুযোগ নেই৷ ওই নির্বাচন অবশ্যই এখনকার অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে হবে৷ কারণ, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যে ধারাগুলো সংবিধানে ফিরে এসেছে, তার মধ্যে একটি ৫৮(গ) ধারা৷ তাতে বলা হয়েছে, সংসদ ভেঙে যাওয়ার ১৫ দিনের মধ্যে  তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করতে হবে৷  সেই ১৫ দিন কোথায় পাবেন? সংসদ কোথায় পাবেন যে, সংসদ ভেঙে দেবেন? সংসদ তো ভেঙে দেয়া হয়েছে এক বছরেরও বেশি সময় আগে৷ ফলে যে বলটা ছুড়ে নির্বাচরকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার স্টার্ট করবেন, সেটাই তো নেই৷”

"এছাড়া বিচারপতি খায়রুল হকের রায়ের মধ্য দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বতিল হয়েছে৷ কিন্তু সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমেও তো তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল হয়েছে৷ সেটা হাইকোর্ট বাতিল করলেও এখনো তো তার আপিল নিস্পত্তি হয়নি৷ আর ওই সংশোধনী হাইকোর্ট বাতিল করলেও তারা কিছু জিনিস ভুল করেছেন৷ ফিরিয়ে আনেননি৷ যেমন, ,শপথ গ্রহণের ধারা, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অন্য লাভজনক পদে যাওয়ার অযোগ্যতার ধারা৷ ফলে পঞ্চদশ সংশোধনীর মামলা নিস্পত্তি হওয়ার আগে এবং আরেকটা সংসদ গঠিত হওয়ার আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার অধীনে নির্বাচনের কোনো সুযোগ নেই৷''

আপিল বিভাগের সাত বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ ২০১১ সালের ১০ মে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করে রায় দেন৷ এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০১১ সালের ৩০ জুন তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করে জাতীয় সংসদে পঞ্চদশ সংশোধনী পাস হয় এবং ৩ জুলাই গেজেট প্রকাশিত হয়৷

সংস্কার প্রস্তাবে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থারও সংস্কারের কথা আছে: শিশির মনির

This browser does not support the audio element.

এক প্রশ্নের জবাবে ড.শরীফ ভুঁইয়া বলেন, "বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষতা নিশ্চিতে সংবিধানে কোনো বিধান নেই৷ আর এই অন্তর্বর্তী সরকার নিয়েও সংবিধানে কিছু নেই৷ এটা সুপ্রিম কোর্টের রেফারেন্সে বিশেষ পরিস্থিতিতে গঠিত সরকার৷ সুতরাং তাদের নিরপেক্ষতা তাদের নিজেদেরই নিশ্চিত করতে হবে৷ তবে ভালো হয়, যে উপদেষ্টাদের নিয়ে বিতর্ক আছে তারা নিজেরাই যদি পদত্যাগ করেন৷”

বিএনপির আইজীবী ব্যারিস্টার রহুল কুদ্দুস কাজল ডয়চে ভেলেকে বলেন, " আইনগত ও সাংবিধানিক কারণেই আগামী নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সম্ভব না৷ অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনেই হবে৷ ”

"আর এই সরকার তো নিরপেক্ষ সরকার৷ সবার মতামতের ভিত্তিতে হয়েছে৷ তবে এই সরকারের সব কিছুই পরবর্তী সংসদে অনুমোদিত হতে হবে৷”

ড. শাহজাহান সাজু বলেন, " নুতন আইন করতে পারে সংসদ৷ সুপ্রিম কোর্ট তো নতুন কোনো আইন করতে পারে না৷ তারা আইনের ব্যাখ্যা দিতে পারে৷ তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের রায়কে অবৈধ ঘোষণা করেছে৷ তাই  তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা আবার ফিরে এসেছে৷ এখন ওই ব্যবস্থায় যা আছে, তাই হবে৷ তার বেশি তো আপিল বিভাগ কিছু বলতে পারে না৷ ফলে,  সংসদ  থাকতে হবে৷ এবং সেটা ভাঙার ১৫ দিনের মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হবে তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন করতে৷ ”

আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে রায়ের পর এক ফেসবুক পোস্টে বলেন, "তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহাল৷ চালু হবে পরবর্তী সংসদ থেকে৷” তবে সরকারের দিক থেকে কেনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানা যায়নি৷

‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে রাজনৈতিক দলগুলোর সদিচ্ছাই বড় কথা’

কিন্তু চতুর্দশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হবেই তার কি কোনো নিশ্চয়তা আছে? পরবর্তী নির্বাচিত সরকার কি কোনোভাবেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলোপ করতে পারবে না? সাবেক বিচারক ড. শাহজাহান সাজু এ বিষয়ে ডয়চে ভেলেকে বলেন,“ সংসদের দুই তৃতীয়াংশ সদস্যের সম্মতিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা আবারো বাতিল করা সম্ভব। কোনো দলের যদি সংসদে দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকে, তাহলে সেই দল চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করতে পারবে। সংবিধান সংশোধন করতে দুই তৃতীয়াংশ সদস্য সদস্যের সম্মতি লাগে।” তার মতে, “ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে রাজনৈতিক দলগুলোর সদিচ্ছাই বড় কথা সংসদ সার্বভৌম। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফের বাতিল করতে গণভোটও লাগবে না। কারণ এটা সংবিধানের মূলনীতি নয়। দুই তৃতীয়াংশ সংসদ সদস্যের সম্মতিই যথেষ্ট। তবে আমার আশা, কোনো দল এই পথে আর যাবে না। তারা অতীত থেকে শিক্ষা নেবে। কারণ, দেশের প্রধান দলগুলোই আদালতে রিট করে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা ফিরিয়ে এনেছে।”

প্রসঙ্গত, ১৯৯৬ সালে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা গ্রহণ করার পর বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়৷ ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সাল - সব মিলিয়ে এই ৩টি জাতীয় নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়েছে৷ এরশাদ সরকারের পতনের পর ১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছিল রাজনৈতিক দলগুলোর সমঝোতার ভিত্তিতে গঠিত অন্তর্বর্তী  সরকারের অধীনে৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ