কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্রী ও নাট্যকর্মী নিহত সোহাগী জাহান তনুর ময়নাতদন্ত নিয়ে প্রশ্ন ওঠায়, কবর থেকে লাশ তুলে দ্বিতীয় দফা ময়নাতদন্তের নির্দেশ দিয়েছে আদালত৷ ২০ মার্চ কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় তনুর লাশ পাওয়া যায়৷
বিজ্ঞাপন
তনুকে ধর্ষণ ও হত্যার অভিযোগে মামলা হয়েছে৷ কিন্তু গত ন'দিনেও পুলিশ অপরাধীদের আটক বা চিহ্নিত করতে পারেনি৷ জানা গেছে, তনুর লাশ কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের ভিতরের জঙ্গলে পাওয়া গেলেও, সেখানে লাশের বিস্তারিত প্রতিবেদন করা হয়নি৷ প্রথমে লাশ কুমিল্লা সিএমএইচ-এ নেয়া হয়৷ পরে লাশের সুরতেহাল করা হয়৷ ময়নাতদন্তেও যথাযত প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়নি৷ এখনও পর্যন্ত কোনো অপরাধীকে চিহ্নিত করা না গেলেও, র্যাব ও গোয়েন্দ বিভাগ (ডিবি) তনুর মা'সহ পরিবারের সদস্যদের ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে৷
তনুর বাবা ইয়ার আলি কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে সিভিল চাকরি করেন৷ ঘটনার রাতে তনু তাদের ক্যান্টনমেন্টের বাসা থেকে ক্যান্টনমেন্টের ভেতরেই আরেকটি বাসায় ছাত্র পড়াতে গিয়েছিলেন৷ তনুর বড় ভাই নাজমুল হোসেন অভিযোগ করেন, ‘‘আমরা এখন আমাদের বাসা থেকে বাইরে যেতে পারি না৷ কথাও বলতে পারি না৷ এমনকি তদন্ত কী হচ্ছে তাও আমরা জানতে পারছি না, চাপের মুখে আছি৷''
তনু হত্যার প্রতিবাদে এখন ফুঁসছে সারাদেশ৷ কুমিল্লায় শিক্ষার্থী এবং সাধারণ মানুষ টানা বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ অব্যাহত রেখেছেন৷ ঢাকাসহ সারাদেশে চলছে প্রতিবাদ৷ শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চও অবস্থান কর্মসূচি পালন করছে৷ আগামী ৩ এপ্রিল সারাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট ডেকেছে তারা৷
এই ঘটনার সংবাদ সংগ্রহ করতে কুমিল্লায় এখন জাতীয় দৈনিক ও টেলিভিশন চ্যানেলের সাংবাদিকরা অবস্থান করছেন৷ সেখান থেকে দৈনিক সমকালের বিশেষ প্রতিনিধি রাশেদ মেহেদী ডয়চে ভেলেকে টেলিফোনে জানান, ‘‘আমাদের অনুসন্ধান এবং সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে যে, একটি মহল শুরু থেকেই ঘটনাটি ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করেছে এবং সেই চেষ্টা অব্যাহত আছে৷ মামলার আলামত সংরক্ষণ, সুরতেহাল এবং ময়নাতদন্ত তাই প্রশ্নের মুখে পড়েছে৷ এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত দুর্বৃত্তরা খুব ঠান্ডা মাথায় কাজ করেছে৷ তারাও ঘটনাটি এখন ভিন্নখাতে নেয়ার জন্য চেষ্টা করেছে৷''
রাশেদ মেহেদী
রাশেদ মেহেদী উদাহরণ দিয়ে বলেন, ‘‘তনুর মরদেহের পাশে দু'টি মোবাইল ফোন পাওয়া যায়৷ অথচ তনু একটি মোবাইল ফোন ব্যবহার করতেন৷ তাহলে দু'টি মোবাইল ফোন এলো কিভাবে? তাছাড়া অপরাধীদের তো মেবাইল ফোন ফেলে রেখে যাওয়ার কথা না৷ তাহলে কারা, কোন উদ্দেশ্যে আরেকটি মোবাইল ফোন তনুর লাশের পাশে ফেলে রেখেছিল?''
তিনি বলেন, ‘‘এই মামলা দৃশ্যত এখন ডিবি তদন্ত করছে, কিন্তু বাস্তবে কী ঘটছে তা বলা মুশকিল৷ আমরা সাংবাদিকরা ক্যান্টনমেন্টর ভেতরে ঘটনাস্থল পরিদর্শনের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছি৷ আমরা কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট কর্তৃপক্ষসহ সবার সঙ্গেই কথা বলেছি৷ তবে ঘটনাস্থলে যাওয়ার অনুমতি পাইনি৷''
রাশেদ মেহেদী আরো বলেন, ‘‘অপরাধীদের চিহ্নিত করতে না পারলেও র্যাব পুলিশ যেভাবে ডেকে নিয়ে তনুর পরিবারের সদস্যদের জ্ঞিাসাবাদ করেছে, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে৷ প্রশ্ন উঠেছে উদ্দেশ্য নিয়ে৷''
এদিকে তনুর পরিবারের সদস্যরা এ মুহূর্তে মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে পারছেন না, পারছেন না কারু সাথে কথা বলথে৷ অনেকের নম্বরই বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে৷
তনু হত্যার পেছনে কার বা কাদের হাত থাকতে পারে বলে আপনার মনে হয়? জানান নীচের ঘরে৷
কেন এত ধর্ষণ? কী করলে কমবে এ জঘন্য অপরাধ?
নারী স্বাধীনতা, নারী আন্দোলন, নারী অধিকার নিয়ে সর্বত্র আলোচনা, সমালোচনা, বক্তৃতা, অন্যদিকে বেড়ে চলেছে ধর্ষণের সংখ্যা৷ কিন্তু কেন? এর জন্য কারা দায়ী, কী করে ধর্ষণ কমিয়ে আনা সম্ভব? বা ধর্ষিতা নারীদের কী-ই বা করা উচিত?
ছবি: Advocate Tanbir ul Islam Siddiqui
নারী নির্যাতন সম্পর্কে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট
নারী নির্যাতন সম্পর্কে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নতুন রিপোর্ট বলছে, বিশ্বের প্রায় এক তৃতীয়াংশ নারী যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন অহরহ৷ তার ওপর পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধের যেসব পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে, সেটাও যথার্থ নয়৷ এছাড়া বিশ্বের মোট নারীর ৭ শতাংশ নাকি জীবনের যে কোনো সময় ধর্ষণের শিকার হয়েছেন৷
ছবি: Fotolia/DW
উন্নত বিশ্বের নারীরাও রেহাই পান না
ধর্ষণ শব্দটি শুনলেই মনে হয় এ ধরণের অপরাধ হয়ে থাকে শুধু অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশগুলোতে৷ আসলে কিন্তু মোটেই তা নয়৷ সমীক্ষায় দেখা গেছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে ১৫ বছর বয়স হওয়ার আগেই শতকরা ৩৩ জন মেয়ে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়৷ এমনকি জার্মানির মতো উন্নত দেশের নারীরাও যৌন নিগ্রহ বা ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন প্রতিনিয়ত৷
ছবি: Fotolia/detailblick
ধর্ষিতা নারীরা জানাতে ভয় পান
জার্মানিতে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত বা ধর্ষিত নারীদের সঠিক পদ্ধতিতে ‘মেডিকেল টেস্ট’-এর ব্যবস্থা করে, এমন একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত স্ত্রী বিশেষজ্ঞ ডা. সোনিয়া পিলস বলেন, ‘‘ধর্ষণের শিকার নারী লজ্জায় এবং আতঙ্কে থাকেন৷ তিনি পুলিশের কাছে গিয়ে সে অভিজ্ঞতা বা ধর্ষক সম্পর্কে তথ্য জানাতে ভয় পান, কুণ্ঠা বোধ করেন৷ অনেকদিন লেগে যায় ধর্ষণের কথা কাউকে বলতে৷
ছবি: detailblick/Fotolia
ধর্ষককে ধরার জন্য দ্রুত ডাক্তারি পরীক্ষা
ধর্ষণের পর নারীদের কী করণীয় – এ বিষয়ে জার্মানির ধর্ষণ বিষয়ক নির্দেশিকায় কিছু পরামর্শ দেওয়া হয়েছে৷ যেমন ধর্ষণের পর একা না থেকে কারো সাথে কথা বলা৷ গোসল, খাওয়া, ধূমপান, বাথরুমে যাওয়ার আগে, অর্থাৎ ধর্ষণের চিহ্ন মুঝে না যাবার আগে ডাক্তারি পরীক্ষা করানো৷ এ পরীক্ষা করালে ধর্ষক কোনো অসুখ বা এইচআইভি-তে আক্রান্ত ছিল কিনা, তা জানা সম্ভব৷ নারীর শরীরে নখের আচড় বা খামচি থাকলে ধর্ষকের চিহ্ন সহজেই পাওয়া যায়৷
ছবি: DW/M. Ruettinger
যাঁরা ধর্ষণের শিকার, তাঁদের জন্য জরুরি বিভাগ
ধর্ষক যেসব জিনিসের সংস্পর্শে এসেছে, অর্থাৎ অন্তর্বাস, প্যাড এ সব তুলে রাখুন৷ ছবিও তুলে রাখতে পারেন৷ নিজেকে দোষী ভাববেন না, কারণ যে ধর্ষণের মতো জঘণ্যতম কাজটি করেছে – সেই অপরাধী, আপনি নন৷ জার্মানির বেশ কয়েকটি শহরের হাসপাতালে যৌন নির্যাতন বিষয়ক আলাদা জরুরি বিভাগ রয়েছে৷ তাছাড়া ধর্ষণ সংক্রান্ত নানা প্রশ্নের উত্তর জানতে রয়েছে ‘গেভাল্ট গেগেন ফ্রাউয়েন’, যেখানে ২৪ ঘণ্টাই টেলিফোন করা যায়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
গ্রুপ থেরাপি
যৌন নিগ্রহ বা ধর্ষণের শিকার নারীদের মানসিক ও শারীরিক সমস্যা সমাধানের জন্য জার্মানিতে রয়েছে গ্রুপ থেরাপি, যার সাহায্যে নারীরা আবার সমাজে সহজভাবে মিশতে পারেন এবং তাঁদের জীবনে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনাটি সহজে ভুলে যেতে পারেন৷
ছবি: dpa
সবচেয়ে বেশি যৌন অপরাধ হয় বাড়িতেই
ভারতের কোথাও না কোথাও প্রতি ২২ মিনিটে একটি মেয়ে ধর্ষণের শিকার হচ্ছে৷ তাই আদালতের নির্দেশে ভারতের পুলিশ বিভাগ এক সমীক্ষা চালিয়েছিল দিল্লির ৪৪টি এলাকায়৷ চলতি বছরের গত আট মাসে ২,২৭৮টি ধর্ষণ, যৌন নিপীড়ন এবং যৌন অপরাধের তদন্তের ফলাফলে দেখে গেছে: ১,৩৮০টি ক্ষেত্রে অভিযুক্তরা হলেন পরিবারের লোকজন এবং পরিচিতজনেরা৷ অর্থাৎ নিজের বাড়িতেও মেয়েরা নিরাপদ নয়!
ছবি: Fotolia/Miriam Dörr
সঠিক বিচার চাই
২০১৩ সালের ১৬ই ডিসেম্বর দিল্লিতে গণধর্ষণ ঘটনার পর, ভারতে ঘটা করে বিচার বিভাগীয় কমিশন বসিয়ে ধর্ষণ, যৌন নিগ্রহ দমনে আইন-কানুন ঢেলে সাজানো হয়৷ শাস্তির বিধান আরো কঠোর করা হয়৷ কিন্তু তাতে যৌন অপরাধের সংখ্যা না কমে বরং বেড়েছে৷
ছবি: picture alliance/abaca
বাংলাদেশে ধর্ষণের শিকার
বাংলাদেশে জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে ২০১১ সালে ৬২০ জন, ২০১২ সালে ৮৩৬ জন, ২০১৩ সালে ৭১৯ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন৷ চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত, অর্থাৎ মাত্র ছ’মাসে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৪৩১টি এবং এর মধ্যে গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৮২ জন৷ তাছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে অপহরণ করে ধর্ষণ এবং পরে হত্যার ঘটনাও অনেক বেড়েছে৷
ছবি: DW
নারীর পোশাকই কি ধর্ষণের জন্য দায়ী?
বাংলাদেশের একজন পুলিশ কর্মকর্তা একটি মার্কিন সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ‘‘বাংলাদেশের নারীরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বেপরোয়াভাবে, বেপর্দায় চলাফেলার কারণে ধর্ষণের শিকার হন৷’’ পুলিশের কর্মকর্তার দাবি, ধর্ষণের দায় প্রধানত নারীদের৷ তাঁর ভাষায়, ‘‘বখাটে ছেলেরা তো ঘোরাফেরা করবেই৷’’ এ কথা শুধু পুলিশ কর্মকর্তার নয়, ভারত-বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থাই এরকম৷ ধর্ষণ বন্ধ করতে এই মধ্যযুগীয় চিন্তা, চেতনার পরিবর্তন প্রয়োজন৷
ছবি: AFP/Getty Images/M. Uz Zaman
ছোট বেলা থেকে সচেতন করতে হবে
ধর্ষণ সম্পর্কে ছোটবেলা থেকে সঠিক ধারণা দিলে স্বাভাবিকভাবে ধর্ষণের সংখ্যা কমবে৷ তাছাড়া পাঠ্যপুস্তকেও বিষয়টি গুরুত্ব দেওয়া উচিত৷ ধর্ষিতা নারীকে শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণার শিকার হতে হয়, সে সম্পর্কেও সচেতনতা দরকার৷ অনেকে যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন৷ গোটা সমাজও নারীকেই দোষ দিয়ে থাকে৷ ডাক্তারি বা মনস্তাত্ত্বিক সাহায্য ছাড়াও প্রয়োজন পরিবার, বন্ধুবান্ধব ও সমাজের বন্ধুবৎসল আচরণ৷