কুমিল্লা থেকে ধীরে ধীরে সারা দেশেই উঠতে শুরু করেছে তনু হত্যার বিচারের দাবি৷ সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমও এই দাবিতে সরব৷ গত ২০ শে মার্চ কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে হত্যা করা হয় কলেজ ছাত্রী তনুকে৷
বিজ্ঞাপন
গত ২০ শে মার্চ কুমিল্লা সেনানিবাস এলাকায় পাওয়া যায় সোহাগী জাহান তনুর লাশ৷ পুলিশের ধারণা, ধর্ষনের চেষ্টা করে ব্যর্থ হওয়ায় কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্রী তনুকে হত্যা করা হয়েছে৷ তবে পুলিশের এই বক্তব্য এবং তদন্ত নিয়ে জনমনে ব্যাপক সন্দেহ রয়েছে৷ হত্যার বিচার দাবিতে সোচ্চার হয়েছে অনেক সংগঠন৷ তনুকে ধর্ষণের পর হত্যা করে একটি মহল এখন ঘটনা ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করছে – এমন অভিযোগ তুলে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাসহ অন্যান্য শহরে বিক্ষোভ করেছে তারা৷
জানা যায়, বাবা কুমিল্লা সেনানিবাসের বেসামরিক কর্মচারী বলে সেনানিবাসের কোয়ার্টারেই পরিবারের সঙ্গে থাকতেন ভিক্টোরিয়া কলেজে ইতিহাস বিভাগের ছাত্রী তনু৷ লেখাপড়ার পাশাপাশি কলেজে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডেও সক্রিয় ছিলেন৷ হাতখরচের টাকা যোগাড় করতে ছাত্র পড়াতেন৷ সেদিন বিকেলেও বাড়ির কাছেই গিয়েছিলেন ছাত্র পড়াতে৷ কিন্তু অন্যান্য দিনের মতো সন্ধ্যার আগে বাড়ি না ফেরায় চিন্তায় পড়ে যান মা৷ নিজেই খুঁজতে বেরিয়ে যান৷ সন্ধান না পেয়ে ফিরে আসেন৷ রাত দশটার দিকে তনুর বাবা বাসায় ফিরলে আবার শুরু হয় খোঁজা৷ অনেক খোঁজাখুঁজির পর সেনানিবাসের ভিতরেই এক কালভার্টের নীচে পাওয়া যায় সোহাগী জাহান তনুর মৃতদেহ৷
সেনানিবাসের ভেতরে এক শিক্ষার্থীর এমন মৃত্যুতে জনমনে উদ্বেগ ও অসন্তোষ দেখা দিয়েছে৷ তদন্ত প্রক্রিয়া নিয়েও উঠেছে প্রশ্ন৷ চলছে হত্যার প্রতিবাদ এবং দ্রুত ও সুষ্ঠু বিচারের দাবিতে বিক্ষোভ৷
তনু হত্যার বিষয়টি নিয়ে নানা রকমের প্রশ্ন উঠে আসছে৷ সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, সেনানিবাসের ভেতরে কিভাবে এমন নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে হত্যাকারীরা নির্বিঘ্নে গা ঢাকা দেয়? ধর্ষণ ও হত্যার সঙ্গে কে বা কারা জড়িত?
শান্তা মারিয়া তুলে ধরেছেন আরেকটি প্রশ্ন৷ তিনি লিখেছেন, ‘‘অনেক সময় ধর্ষণের দায় মেয়েটির উপর চাপিয়ে দিয়ে বলা হয় তার পোশাক নাকি ‘যথেষ্ট শালীন' ছিল না৷ মেয়েদের পোশাক ও চলাফেরার কারণেই নাকি ধর্ষণকারীরা উৎসাহিত হয়৷ নারীর পোশাক নিয়ে যারা মুখে ফেনা তোলে এবং কৌশলে ধর্ষণের দায় নারীর উপরেই চাপিয়ে দিতে তৎপর হয় তারা এবার নীরব কেন বুঝতে পারছি না৷ অবশ্য এ দেশে এক বছর বয়সি শিশুও ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হয়েছে৷ তনুর মতো হিজাব-পরা তরুণীও রেহাই পায়নি৷ রেহাই পায়নি মাদ্রাসা ছাত্রীরাও৷''
তনু হিজাব পরতেন৷ তারপরও তাঁকে ধর্ষণের করে হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ৷ এতে কি বোঝা গেল না যে, তথাকথিত শালীন পোশাক পরলেও নারীরা নিরাপদ নয়?
ছোট পোশাক পরাই কি ধর্ষণের কারণ?
ভারতে প্রতিদিন অন্তত ৯২ জন নারী ধর্ষণের শিকার হন৷ যখনই এ ধরনের কোন মামলা আদালতে উঠেছে তখন প্রথম যে প্রশ্নটি সামনে এসেছে তা হলো, ধর্ষণের শিকার ঐ নারী কি ধরনের পোশাক পরেছিলেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
যুগের সাথে পোশাক
যুগে যুগে পোশাকের ধরনে পরিবর্তন এসেছে৷ আদিমকালে ছিল পশুর চামড়া, গাছের ছাল আর এখন রয়েছে নানা ধরনের পোশাক৷ বর্তমানে দেশ, সংস্কৃতি, সমাজ ব্যবস্থা, কাজের ধরন, অনুষ্ঠান, পছন্দ ও ফ্যাশানের ভিত্তিতে বহু ধরনের পোশাক পরে থাকেন নারীরা৷
ছবি: AP
শরীর প্রদর্শন মানেই কি ধর্ষককে আমন্ত্রণ?
ভারতে বেশিরভাগ ধর্ষণ মামলায় দেখা গেছে, ধর্ষিতা সালোয়ার কামিজ বা শাড়ি পরেছিলেন৷ অর্থাৎ যাকে বলা হয় ভারতীয় নারীর আদর্শ পোশাক, সে ধরনের পোশাকই তাঁরা পরেছিলেন৷ অর্থাৎ এ জরিপ থেকেই প্রমাণিত হচ্ছে যে, শরীর প্রদর্শন না করে বা তথাকথিত ‘আধুনিক’ পোশাক না পরেও শ্লীলতাহানির শিকার হচ্ছেন নারীরা৷
ছবি: Reuters
আইনের ভয় নেই
২০১৩ সালে এক জরিপে দেখা গেছে যে, এশীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলোতে প্রতি চারজনের মধ্যে একজন পুরুষ জীবনে অন্তত একবার কোনো নারীকে ধর্ষণ করেছে৷ এর মধ্যে বেশিরভাগ পুরুষকেই কোনো আইনি ঝামেলা পোহাতে হয়নি৷
ছবি: Fotolia/DW
ধর্ষণ যখন বিনোদনের মাধ্যম
ভারতের উত্তর প্রদেশে ধর্ষণের ঘটনা বেড়েই চলেছে৷ এর কারণ হিসেবে পুলিশ নারীদের উপর পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রভাব, মেয়েদের মোবাইল ব্যবহার ও ছোট পোশাক পরিধানকে উল্লেখ করেছে৷ নারীদের নিরাপত্তা দিতে পুরোপুরি ব্যর্থ পুলিশ বলেছে, সেখানকার পুরুষরা তাদের বিনোদনের অভাব পূরণ করছে ধর্ষণের মাধ্যমে৷
ছবি: dapd
নারীদের দাবিয়ে রাখার হাতিয়ার
রাস্তা, অফিস বা যে কোনো পাবলিক প্লেসে পুরুষের যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন নারীরা৷ বিশেষ করে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ হওয়ায় নারীদের দাবিয়ে রাখতে পুরুষরা ধর্ষণকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে৷
ছবি: UNI
পরিচিতদের দ্বারাই বেশি ধর্ষণ
২০১৩ সালে ভারতের ন্যাশনাল ক্রাইম ব্যুরোর রিপোর্ট বলছে, সে বছর ১০০ জন ধর্ষণের শিকার নারীর মধ্যে ৯৮ জন এমন ব্যক্তিদের দ্বারা ধর্ষিত হয়েছেন, যারা তাঁদের পরিচিত৷ আদালতে যেসব মামলা ওঠে, বা গণমাধ্যমে যেসব ঘটনা প্রকাশ পায় সেগুলো বেশিরভাগই বাইরের লোকের হাতে৷ ফলে পরিচিত ব্যক্তি দ্বারা ধর্ষণের ব্যাপারটি ধামাচাপা পড়ে যায়৷
ছবি: Reuters/Ahmad Masood
যৌন নিগ্রহ সর্বত্র
ভারতে জন্মের আগে ভ্রুণের লিঙ্গ নির্ধারণ বেআইনি হলেও, খুব সাধারণ ঘটনা৷ ফলে পৃথিবীর আলো দেখতে পাওয়া মেয়েদের সংখ্যা এত কম যে, সমাজে নারী-পুরুষের অনুপাতে হেরফের হয়৷ এছাড়া বাল্যবিবাহ, কম বয়সে মা হওয়া, সন্তান জন্ম দিতে গিয়েও মৃত্যুবরণ করছেন নারীরা৷ পরিবারের ভেতরেও চলে যৌন নির্যাতন এবং ধর্ষণ৷ এরপরও কি আপনারা ধর্ষণের জন্য পোশাককে দায়ী করবেন?