তফসিল সংলাপের পথে কোনো বাধা নয়
১৬ নভেম্বর ২০২৩নির্বাচন কমিশন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করলেও সংলাপের পথে তা কোনো বাধা হতে পারে না বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা৷ সব দল আন্তরিকভাবে সমস্যার সমাধান চাইলে এখনও সংলাপ হতে পারে বলে মত তাদের৷
তফসিল কি সংলাপের পথে বাধা?
সাবেক নির্বাচন কমিশনার মো. রফিকুল ইসলাম মনে করেন, "নির্বাচনের তফসিল সংলাপের পথে কোনো বধা নয়৷ তফসিল স্থগিত হতে পারে, বাতিল হতে পারে, রিসিডিউল হতে পারে৷'' উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, ২০১৪ ও ২০১৮ সালে নির্বাচন পিছিয়েছে৷ ২০০৬ সালে ঘোষিত তফসিল বাতিল করে দিয়ে পরে ২০০৮ সালে নির্বাচন হয়েছে৷ বাতিল, স্থগিত ও পিছানো সব ধরনের উদাহরণই আছে৷
তিনি বলেন, "নির্বাচন মানেই গণতন্ত্র৷ পারস্পরিক সহাবস্থান, যথাযথ নির্বাচনী পরিবেশ-এগুলো না থাকলে তা গণতন্ত্র হয় না৷ তখন সেটা হয় ক্ষমতায় থাকা বা ক্ষমতায় যাওয়ার নির্বাচন৷”
অন্যদিকে সাবেক রাষ্ট্রদূত মো. হুমায়ুন কবিরের মতে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিদেশিদের সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের চাপ থাকবে৷ কোনো ভাবে নির্বাচন করে ফেললেই চাপ চলে যাবে তা নয়৷ বিতর্কিত নির্বাচন করলে তখন তাদের কাছে তার নথি থাকবে, যা চাপ বাড়াতে তারা কাজে লাগাবে৷
তিনি বলেন,"তফসিল ঘোষণা হলেও কোনো অসুবিধা নেই৷ সংলাপ করা যায় এবং সেটা করা উচিত৷ যদি সমঝোতা ছাড়া একতরফা নির্বাচন হয় তা দেশের এবং দেশের মানুষের জন্য ভালো হবে না৷”
প্রধান নির্বাচন কমিশনার তার ভাষণে বলেছেন, সংবিধান অনুযায়ী সংসদের মেয়াদপূর্তির পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচনের সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে৷ তবে এর ব্যতিক্রম হতে পারে বলে মনে করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার ওমর ফারুক৷ তিনি বলেন, "সুষ্ঠু ও অংশগ্রণমূলক নির্বাচনের জন্য যদি এর ব্যত্যয় ঘটাতে হয় তাহলে সেটা করা সম্ভব৷ অতীতে নজির আছে৷ সুপ্রিম কোর্টেরও রেফারেন্স নেয়া যায়৷ আসল কথা হলো দেশের ও দেশের মানুষের কল্যণে যেকোনো কিছুই করা যায়৷ তাতে সংবিধান বাধা হয় না৷''
প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল বুধবার জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে সংলাপের কথা বলেছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘নির্বাচন প্রশ্নে বিশেষত নির্বাচনের প্রাতিষ্ঠানিক পদ্ধতির প্রশ্নে দীর্ঘ সময় ধরে দেশের সার্বিক রাজনৈতিক নেতৃত্বে মতভেদ পরিলক্ষিত হচ্ছে৷ বহুদলীয় রাজনীতিতে মতাদর্শগত বিভাজন থাকতেই পারে৷ কিন্তু মতভেদ থেকে সংঘাত ও সহিংসতা হলে তা থেকে সৃষ্ট অস্থিতিশীলতা নির্বাচন প্রক্রিয়ায় বিরূপ প্রভাব বিস্তার করতে পারে৷ ৷''
কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইব্রাহিম প্রধান নির্বাচন কমিশনার সংলাপের আহ্বানের প্রসঙ্গ টেনে বলেন, সমঝোতা হলে বড় বড় রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশ নেবে৷ তাহলে নির্বাচন কমিশনেরও সাফল্য অনেক বৃদ্ধি পাবে৷
আওয়ামী লীগ ও বিএনপির অবস্থান
বুধ ও বৃহস্পতিবার দুই দিনে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের তিনবার সংলাপের সম্ভাবনা নাকচ করে দেন৷ ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস বুধবার সচিবালয়ে দেশটির দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লুর শর্তহীন সংলাপ বিষয়ক চিঠি হস্তান্তর করেন ওবায়দুল কাদেরর কাছে৷ বৈঠকের পর ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেন, ‘‘শুনেছি, এমন দুটি চিঠি আরও দুটি দলের কাছে দেয়া হয়েছে৷ তাদের একটি বিএনপি, আরেকটি জাতীয় পার্টি৷ এই চিঠিতে শর্তহীন রাজনৈতিক সংলাপের তাগিদ রয়েছে৷ তবে সংলাপের এখন আর সেই সুযোগ নেই৷''
একই দিন সন্ধ্যায় তফসিল ঘোষণার পর রাতে ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির কার্যালয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে আবারো সংলাপের বিষয় নাকচ করে দেন তিনি৷ বলেন, "তারা (বিএনপি) নির্বাচনী ট্রেনে না উঠলে কিছু করার নেই৷ নির্বাচনের ট্রেন তো কারো জন্য অপেক্ষা করবে না৷” বৃহস্পতিবার তিনি ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে বলেন, "সংলাপের সময় এখন আর অবশিষ্ট নেই৷ গতকালও (বুধবার) এটা আমি বলেছি৷ মিস্টার লু-এর চিঠি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আমি আলাপ করেছি৷ সেই চিঠির জবাব দুই একদিনের মধ্যে দেব৷ এটা একটা সৌজন্যবোধ ও শিষ্টাচারের বিষয়৷ তিনি একটা চিঠি দিয়েছেন, সেটার জবাব আমরা অবশ্যই দেবো৷ এটা গণতান্ত্রিক রীতিনীতির মধ্যেও পড়ে৷ চিঠি প্রসঙ্গে আমাদের কথা এটাই৷”
এর জবাবে বিএনপির প্রশিক্ষণ বিষয়ক সম্পাদক এ বি এম মোশররফ হোসেন বলেন," আমরা সব সময়ই সংলাপ চাই৷ সরকারই সংলাপ চায় না৷ সরকার যদি নীতিগতভাবে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয় তাহলেই সংলাপ হতে পারে৷ সরকার সংলাপের পথ বন্ধ করে রেখেছে৷ বিএনপির মহাসচিবসহ শীর্ষ নেতারা কারাগারে৷ কার সঙ্গে সংলাপ হবে? আজকে বিএনপি অফিসের সামনে তালা আর আওয়ামী লীগের অফিসের সামনে ভূরিভোজ৷”
অন্যদিতে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, "সংলাপে আওয়ামী লীগের কোনো বিশ্বাসযোগ্যতা ও গ্রহণযোগ্যতা নাই৷ ২০১৪ সালে তো খালেদা জিয়ার সঙ্গে টেলিফোনে সংলাপ হয়েছে৷ ২০১৮ সালে আনুষ্ঠানিক সংলাপ হয়েছে গণভবনে৷ উনি (শেখ হাসিনা) কথা দিয়েছিলেন নিরপেক্ষ নির্বাচনের৷ সেটা তো হয়নি৷”
তারপরও নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে আলোচনা হতে পারে বলে মত দেন তিনি৷ এজন্য প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে হবে এমন শর্ত তাদের৷
তিনি বলেন, ‘‘নির্বাচনের তফসিল হয়েছে তাই সংলাপ করা যাবে না এটা কোনো কথা নয়৷ এটা কোনো বাধা নয়৷ বাধা হলো অন্তরের নেতিবাচক ইচ্ছা৷ আমরা বলছি মুক্ত মন নিয়ে সংলাপের আয়োজন করতে হবে৷ সংলাপের পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে৷ এটা সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে৷ আটক নেতা-কর্মীদের জেলখানা থেকে মুক্তি দিতে হবে৷ তাহলে সংলাপের আংশিক পরিবেশ সৃষ্টি হবে৷”
এদিকে ৪৮ ঘন্টার অবরোধ কর্মসূচি চলার মধ্যেই তফসিল ঘোষণার প্রতিবাদে রোববার ভোর থেকে ও মঙ্গলবার ভোর পর্যন্ত ৪৮ ঘণ্টার হরতাল ডেকেছে বিএনপি৷ একই কর্মসূচি দিয়েছে বিএনপির সঙ্গে আন্দোলনে থাকা গণতন্ত্র মঞ্চ৷