দুই বছরেও সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যাকাণ্ডের তদন্তে কোনো অগ্রগতি হয়নি৷ চিহ্নিত বা গ্রেপ্তার হয়নি অপরাধীরা৷ তারপরও আশা ছাড়েননি তাঁদের পরিবারের সদস্যরা৷
বিজ্ঞাপন
সাগরের মা সাংবাদিকদের আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার অনুরোধ করেছেন৷ তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু সাগর-রুনির হত্যাকারীদের চিহ্নিত করতে প্রশাসনিক ব্যর্থতায় লজ্জিত হওয়ার কথা জনিয়েছেন৷ এদিকে সাংবাদিকরা নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন৷
দুই বছর আগে ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ভোররাতে ঢাকার রাজাবাজারের বাসায় নির্মমভাবে হত্যা করা হয় সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনিকে৷ বেঁচে আছে তাঁদের একমাত্র শিশু সন্তান মেঘ৷ এই দুই বছরেও তাঁদের হত্যাকারীদের চিহ্নিত করতে পারেননি তদন্তকারীরা৷ অপরাধীদের গ্রেপ্তারের দাবিতে দুই বছরে সাংবাদিকসহ দেশের সাধারণ মানুষ অনেক আন্দোলন-অনশন করেছেন৷ সাগর-রুনির পরিবারের সদস্যরা চোখের জল ফেলেছেন৷ মেঘের বয়স দুই বছর বেড়েছে৷ কিন্তু অপরাধীরা আটক হয়নি৷ হয়েছে তদন্তের নামে নানা নাটক আর গল্প৷
কেন খুন হয়েছেন সাগর, রুনি?
সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার এবং মেহেরুন রুনি হত্যাকাণ্ডের তিন বছর পূর্ণ হয়েছে৷ কিন্তু আজও নিহতের পরিবার, শুভানুধ্যায়ী আর সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের মানুষ জানতে পারলো না, কেন এই হত্যাকাণ্ড? এই বিষয়ে ছবিঘর দেখুন এখানে:
ছবি: DW
সেই কালোরাত
২০১২ সালের এগারোই ফেব্রুয়ারি৷ সেদিন খুব ভোরবেলা জানা গিয়েছিল, ঢাকায় নিজের ভাড়া বাসায় খুন হয়েছেন সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার এবং মেহেরুন রুনি৷ একই ফ্ল্যাটে থাকলেও প্রাণে বেঁচে যান তাদের একমাত্র শিশুপুত্র মেঘ৷
ছবি: dapd
সাগর সরওয়ার
দেশি-বিদেশি একাধিক গণমাধ্যমে কাজ করার পর ২০১১ সালে মাছরাঙ্গা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক হিসেবে কাজ শুরু করেন সাগর সরওয়ার (ডানে)৷ সর্বশেষ সেই টেলিভিশন চ্যানেলেই কাজ করেছেন তিনি৷ ২০১২ সালের দশই ফেব্রুয়ারি গভীর রাতে কাজ থেকে বাসায় ফেরার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই খুন হন সাগর৷
ছবি: DW
মেহেরুন রুনি
একাধিক দৈনিকে কাজ করার পর কয়েক বছর আগে টেলিভিশন চ্যানেল এটিএন বাংলায় কাজ শুরু করেন মেহেরুন রুনি (বামে)৷ মাঝে স্বামীর সঙ্গে বছর দেড়েক জার্মানিতে কাটিয়েছেন তিনি৷ এরপর ২০১১ সালে আবারো ফিরে যান নিজের কর্মস্থলে৷
ছবি: DW
৪৮ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তার!
১১ ফেব্রুয়ারি ভোররাতে এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে খুনিদের গ্রেপ্তারের প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন৷ বলাবাহুল্য, সেই প্রতিশ্রুতি পূরণ হয়নি৷
ছবি: DW
সাংবাদিকদের আন্দোলন
বাংলাদেশের বিভিন্ন সাংবাদিক সংগঠনের মধ্যে মতের অমিল থাকলেও সাগর-রুনি ইস্যুতে ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলনের ঘোষণা প্রদান করে সব সংগঠন৷ খুনিদের গ্রেপ্তারের দাবিতে গত এক বছরে বেশ কয়েকটি প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করেছে বিভিন্ন সংগঠন৷
ছবি: DW/Harun Ur Rashid Swapan
আন্তর্জাতিক প্রতিবাদ
সাংবাদিক দম্পতি হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে এবং খুনিদের দ্রুত গ্রেপ্তারের দাবিতে গর্জে ওঠে বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত বাঙালিরা৷ জার্মানিসহ কয়েকটি দেশে খুনিদের গ্রেপ্তারের দাবিতে মানববন্ধনের আয়োজন করা হয়৷ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সাংবাদিক সংগঠনও খুনিদের গ্রেপ্তারের দাবিতে বিবৃতি প্রকাশ করেছে৷
ছবি: DW
ব্লগারদের প্রতিরোধ
সাংবাদিক সংগঠনগুলোর আন্দোলনের পাশাপাশি ব্লগাররা এই দম্পতি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তারের দাবিতে রাজপথে নামে৷ গত বছর এই ইস্যুতে ব্লগ ‘ব্ল্যাক আউট’ পালন করে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম ব্লগ৷ সামহয়্যার ইন ব্লগে এখনো রয়েছে হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ব্যানার৷
ছবি: DW
রিপোটার্স উইদাআউট বর্ডার্স
সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে রাজপথে ব্লগারদের সক্রিয় আন্দোলনে সম্পৃক্ত থাকাসহ বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম ইত্যাদি ইস্যুতে ব্লগ লিখে ডয়চে ভেলের দ্য বব্স প্রতিযোগিতার রিপোটার্স উইদাআউট বর্ডার্স অ্যাওয়ার্ড জয় করে আবু সুফিয়ানের বাংলা ব্লগ৷ ছবিতে আন্দোলনরত আবু সুফিয়ান৷
ছবি: DW
নতুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নাটকীয় ঘোষণা
গত অক্টোবর মাসে নতুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডে ‘জড়িত’ আটজনকে চিহ্নিত করে সাতজনকে গ্রেপ্তারের কথা জানান৷ বাকি একজনকে গ্রেপ্তার করা হয় গত সপ্তাহে৷ ব়্যাব গ্রেপ্তারকৃতদের বলছে ‘সন্দেহভাজন’৷ আর পরিবার মনে করছে, এদেরকে গ্রেপ্তারের মাধ্যমে কার্যত ‘জজ মিয়া’ নাটক সাজানো হচ্ছে৷
আন্তর্জাতিক তদন্ত চান পরিবার
সাগর-রুনির হত্যাকাণ্ডের এক বছর হলেও তদন্তে কোনো অগ্রগতি নেই৷ ধরা পড়েনি মূল অপরাধীরা৷ তাই তাদের পরিবার এখন আন্তর্জাতিক তদন্তের দাবি করেছেন৷ রুনির ভাই নওশের রোমান জানিয়েছেন, তারা (ব়্যাব) তদন্তের চেয়ে হয়রানি করতে বেশি উৎসাহী৷ সাগর রুনির একমাত্র সন্তান মেঘের নিরাপত্তাও প্রত্যাহার করা হয়েছে৷
ছবি: DW/Harun Ur Rashid Swapan
জজ মিয়া নাটক চান না সাগরের মা
সাগরের মা সালেহা মনির এখনও কাঁদেন৷ তাঁর দাবি হচ্ছে, প্রকৃত অপরাধীদের ধরতে হবে৷ এক বছর পর দারোয়ান এনামুলকে গ্রেফতার তাঁর কাছে জজ মিয়া নাটক ছাড়া কিছুই নয়৷ তাঁর মতে, এক বছরে নানা টালবাহানা করে প্রকৃত অপরাধীদের আড়াল করার চেষ্টা চলছে৷
ছবি: DW/Harun Ur Rashid Swapan
11 ছবি1 | 11
সাগর-রুনির মৃত্যুর দু'বছরে তাই মঙ্গলবার ঢাকা ও ঢাকার বাইরে নানা কর্মসূচিতে হতাশার কথাই প্রকাশ পেয়েছে৷ কিন্তু সাগরের মা সালেহা মুনীর আশা ছাড়েননি৷ তিনি সকালে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির স্মরণ সভায় কান্না জড়িত কণ্ঠে সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, ‘‘আন্দোলন থামিও না, যত সাংবাদিক মারা গেছে সবার বিচারের দাবিতে তোমরা আন্দোলন চালিয়ে যাও৷ আমার মেঘের জন্য আমি বিচার চাই৷'' তিনি বলেন, ‘‘আমি খুব আশাবাদী, সাংবাদিকরা আবার এক হয়েছে শুনে আমি খুশি হয়েছি৷'' তিনি বলেন, ‘‘সাগর-রুনির হত্যাকারীদের শাস্তি না হওয়া পর্যন্ত আমি তাঁদের কবর জিয়ারত করব না৷''
জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে প্রতিবাদ সমাবেশে সাংবাদিক নেতা মনজুরুল আহসান বুলবুল বলেছেন, ‘‘দুই বছরেও এই হত্যার রহস্য উন্মোচিত হলো না, এটি আমাদের লজ্জা৷ আর সাগর-রুনির নিরাপত্তা দিতে না পারা এবং খুনের বিচার না করা এই রাষ্ট্রের লজ্জা৷'' তিনি বলেন, ‘‘সাগর-রুনি আমাদের চেতনার মধ্যেই আছে৷ আমরা এই হত্যার বিচারের দাবিতে ঐক্যবব্ধ ছিলাম এবং থাকব৷'' এই সমাবেশে দুই সাংবাদিক ইউনিয়নের নেতারাই উপস্থিত ছিলেন৷
সাগর মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক ছিলেন৷ রুনি ছিলেন এটিএন বাংলার সিনিয়র রিপোর্টার৷ মাছরাঙা টেলিভিশনের সামনে সাগরের সহকর্মীরা মানববন্ধন করেন৷ আর এটিএন বাংলার কার্যালয় কারওয়ান বাজার এলাকায় মানবন্ধন করেন সাগর-রুনির সহকর্মীরা৷ তাঁরা আর টালবাহানা না করে সাগর-রুনির হত্যাকারীদের গ্রেপ্তারের দাবি জানান৷ তাঁদের প্রশ্ন, হত্যাকারীরা কি এতই ক্ষমতাধর যে সরকারও তাদের আইনের আওতায় আনতে পারে না?
এদিকে সকালে সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনের শুরুতেই তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেন, ‘‘সাগর-রুনির হত্যা রহস্য উদঘাটিত না হওয়ায় দুঃখ প্রকাশ করছি৷ প্রশাসনিক ব্যর্থতার জন্য লজ্জাবোধ করছি৷ মন্ত্রণালয়ের তরফ থেকে যথাযথ কর্তৃপক্ষকে তাগিদ দেব, তদবির করব যেন প্রকৃত ঘটনা দেশবাসী জানতে পারেন৷'' হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে কোনো রাজনৈতিক সম্পর্ক নেই মন্তব্য করে ইনু বলেন, ‘‘রহস্য উদঘাটনে সরকার আন্তরিক৷''
এদিকে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি আগামী ৩১ মার্চ সাগর-রুনির হত্যাকারীদের গ্রেপ্তারের দাবিতে অনশন কর্মসূচি ঘোষণা করেছে৷